শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা শুরু হোক by আলী যাকের
আমাদের
আপন আঙিনায় নভেম্বর মাস। তখনও শীত তেমন জাঁকিয়ে পড়েনি। রাত যখন মধ্যযামে,
আমি একটা চাদর জড়িয়ে আমার পড়ার ঘরের জানালার ধারে বসে ছিলাম। একটি বহুতল
আবাসিক ভবনের দশ তলায় আমি থাকি। আমার সামনে উত্তরের জানালাটি খোলা ছিল।
মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছিল ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুর মূর্ছনা। এই
সঙ্গীত শুনছিলাম বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কল্যাণে। তাদের বার্ষিক শুদ্ধ সঙ্গীতের
অনুষ্ঠান থেকে। আমরা সবাই জানি, আজকাল প্রতি বছর এ আসরটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত
হয় সেনাবাহিনীর স্টেডিয়ামে। সেই শুরু থেকেই এই সম্মিলনে প্রচুর মানুষ ভিড়
করে আসে। তবে এ বছর প্রায় ষাট হাজার সঙ্গীতপ্রেমীর সমাগম হয়েছিল এই
অনুষ্ঠানে। আমি গত দুই বছর ধরে স্বশরীরে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারি
না স্বাস্থ্যগত কারণে। অতএব, আমার পড়ার ঘরের টেবিলের ধারে বসে সঙ্গীতের
সুধা পান করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। ওইখানে বসেই আমি এই উপমহাদেশের তাবৎ
প্রধান সঙ্গীতজ্ঞের নিবেদন উপভোগ করেছি। শুনেছি অজয় চক্রবর্তী, কৌশিকী
চক্রবর্তী, ভীমসেন জোশী, আমজাদ খান, শিবকুমার শর্মা, ডাগর ভ্রাতৃদ্বয়,
কিশোরী আমোলকার প্রমুখের অনবদ্য সঙ্গীত। শুনতে শুনতে কখন যে অন্ধকার রাত
ফর্সা হয়ে এসেছে তা লক্ষ্যও করিনি। ডুবে রয়েছি সুরের মূর্ছনায়। মনে মনে
সাধুবাদ জানিয়েছি বেঙ্গলকে, আমাদের এই শহরে এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিবেদন
জনসমক্ষে আনার জন্য।
ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি আমার অনুরাগ যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেই তখন থেকে। সেই বাল্যকাল থেকে আকৃষ্ট ছিলাম বাংলা আধুনিক সঙ্গীতে এবং মা আর দিদির কল্যাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুলগীতির প্রতি। মনে পড়ে, আমরা প্রায়ই কলকাতার আকাশবাণীতে চিঠি লিখে অনুরোধ করতাম বিভিন্ন গান শোনানোর জন্য। আকাশবাণীর অনুরোধের আসর থেকে আমাদের নাম যখন উচ্চারিত হতো, তখন কী আনন্দ যে হতো মনে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ওই সঙ্গীতবোধ নিয়ে আস্তে আস্তে বয়োবৃদ্ধি হচ্ছিল আমাদের। তখন আমাদের অজান্তে কখন যে সংস্কৃতি আর রাজনীতি এই বাংলাদেশে এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতেও পারিনি। হঠাৎ একদিন ছায়ানটের কল্যাণে ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেল। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এসব কথা ভাবছিলাম ওই রাতে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনতে শুনতে। ভাবছিলাম আজকের এই বাংলাদেশে শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রতি যে কোনো অনুরাগ অথবা শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসারে যে কোনো প্রচেষ্টাকেই আমাদের মাথায় তুলে নেওয়া দরকার। ঠিক এই কাজটিই করছে বেঙ্গল। বেঙ্গলের ওই আসর ঘিরে জমে উঠছে রসাস্বাদনে উদগ্রীব সঙ্গীতপ্রেমীদের সম্মিলন। তারা সন্ধ্যা হতে না হতেই জড়ো হচ্ছেন সুর সাগরে অবগাহন করতে। সম্মিলিত সব মানুষের মধ্যে সুর বেঁধে দিচ্ছে এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। কাকডাকা প্রত্যুষে তারা যখন যার যার গৃহে ফিরে যাচ্ছেন, তখন যেন তারা একদল সঙ্গীত অধিকৃত মানুষ। ফরাসি লেখক আলবেয়ার ক্যামুর ভাষায় 'চড়ংংবংংবফ'.
অথচ বেশিদিনের কথা নয়, বিষয়টা ছিল ভিন্ন রকম। সেই চলি্লশের দশকের শেষে দেশটি যখন পাকিস্তান হলো তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আপাত সেক্যুলার শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সত্ত্বেও শিল্পকলা এ দেশে হয়ে গেল ব্রাত্য এবং শিল্পকলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মানুষও হয়ে পড়ল অচ্ছুত। এই ঢাকা শহরেই তো আমরা দেখেছি, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান জনসমক্ষে অপমানিত হয়েছেন! সবে তানপুরার তার সুরে বেঁধে তিনি পাহাড়ি রাগে একটি ঠুমরির আলাপ শুরু করতেই এক উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি আমলা প্রথম সারি থেকে বলে উঠলেন, 'অনেক হয়েছে! এবারে একটা গজল শোনান ওস্তাদজি!' কথিত আছে, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে নীরবে ওই আসর থেকে উঠে আসেন এবং অচিরেই চলে যান ভারতে। আবাস গড়েন কলকাতাতেই। সেখানে তিনি সুরের সাগর মন্থন করে দুর্লভ সব রত্ন তুলে এনে পরিবেশন করেন বিশ্বের সব সঙ্গীতপ্রেমী মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে। পরবর্তীকালে আমাদের অতি পরিচিত শিল্পী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী প্রমুখ বড়ে গোলাম আলীর ধ্বজা বয়ে চলেছেন এবং চলছেন।
আমরা প্রথম থেকেই প্রত্যক্ষ করেছি সামগ্রিকভাবে শুদ্ধ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং বিশেষভাবে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিপরীতে পাকিস্তানিদের আগ্রাসন। রবীন্দ্রনাথকে আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি পাকিস্তানিরা। রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দ্বিখণ্ডিতভাবে দাঁড় করিয়েছে আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। এখন কয়জন খোঁজ রাখেন যে, পাকিস্তানি আমলে নজরুলের কিছু তথাকথিত ইসলামী গজল ছাড়া তার সঙ্গীতের যে ঋদ্ধ ভাণ্ডার ছিল, সেটি অনাস্বাদিত রয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ বাঙালির কাছে? তার শ্যামাসঙ্গীত আমরা শুনতে পাইনি। তার ভক্তিসঙ্গীত আমাদের জন্য ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছিল।
সেই প্রতিকূল অবস্থায় বাংলাদেশের কিছু সাহসী তরুণ স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েছিল বাঙালিকে নিজ বাসভূমে পুনর্বাসিত করার চেষ্টায়। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তারা লড়ে গেছেন আমাদেরই সংস্কৃতির স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথ ফিরে পেয়েছেন তার স্থান। উদযাপিত হয়েছে তার জন্মশতবার্ষিকী। নজরুলের অধিকাংশ গান শেখানো হয়েছে শিশু, কিশোর, যুবাদের। নতুন কবিতা লেখা হয়েছে আধুনিক বাঙালি কবিদের দ্বারা। লেখা হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতন্ত্রকামী যত কাব্য। এভাবে আমরা এগিয়ে গেছি সংস্কৃতি-ভাস্বর স্বাধীনচেতা এক জাতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এসবই মনে আসছিল সেই রাতে, রাতের শেষে। চৌরাসিয়ার বাঁশিতে স্বপ্নমগ্ন হয়ে। তবে সে সঙ্গে আরও কিছু কথা মনে এসেছিল। আমরা যারা বছরের পর বছর ভিড় করে যাচ্ছি সঙ্গীতের ওই মিলনমেলায়, তারা যেন কেবল আপাতরম্যে গা ভাসিয়ে না দিয়ে কিছু সঙ্গীত বক্ষে ধারণ করে নিয়ে যাই যার যার আবাসে। প্রতিনিয়ত ওইসব অমৃত সুধা পান করি। যেন সঙ্গীত মিলনমেলা থেকে উঠে আসে আমাদের ঘরে ঘরে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি আমার অনুরাগ যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেই তখন থেকে। সেই বাল্যকাল থেকে আকৃষ্ট ছিলাম বাংলা আধুনিক সঙ্গীতে এবং মা আর দিদির কল্যাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুলগীতির প্রতি। মনে পড়ে, আমরা প্রায়ই কলকাতার আকাশবাণীতে চিঠি লিখে অনুরোধ করতাম বিভিন্ন গান শোনানোর জন্য। আকাশবাণীর অনুরোধের আসর থেকে আমাদের নাম যখন উচ্চারিত হতো, তখন কী আনন্দ যে হতো মনে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ওই সঙ্গীতবোধ নিয়ে আস্তে আস্তে বয়োবৃদ্ধি হচ্ছিল আমাদের। তখন আমাদের অজান্তে কখন যে সংস্কৃতি আর রাজনীতি এই বাংলাদেশে এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতেও পারিনি। হঠাৎ একদিন ছায়ানটের কল্যাণে ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেল। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এসব কথা ভাবছিলাম ওই রাতে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনতে শুনতে। ভাবছিলাম আজকের এই বাংলাদেশে শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রতি যে কোনো অনুরাগ অথবা শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসারে যে কোনো প্রচেষ্টাকেই আমাদের মাথায় তুলে নেওয়া দরকার। ঠিক এই কাজটিই করছে বেঙ্গল। বেঙ্গলের ওই আসর ঘিরে জমে উঠছে রসাস্বাদনে উদগ্রীব সঙ্গীতপ্রেমীদের সম্মিলন। তারা সন্ধ্যা হতে না হতেই জড়ো হচ্ছেন সুর সাগরে অবগাহন করতে। সম্মিলিত সব মানুষের মধ্যে সুর বেঁধে দিচ্ছে এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। কাকডাকা প্রত্যুষে তারা যখন যার যার গৃহে ফিরে যাচ্ছেন, তখন যেন তারা একদল সঙ্গীত অধিকৃত মানুষ। ফরাসি লেখক আলবেয়ার ক্যামুর ভাষায় 'চড়ংংবংংবফ'.
অথচ বেশিদিনের কথা নয়, বিষয়টা ছিল ভিন্ন রকম। সেই চলি্লশের দশকের শেষে দেশটি যখন পাকিস্তান হলো তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আপাত সেক্যুলার শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সত্ত্বেও শিল্পকলা এ দেশে হয়ে গেল ব্রাত্য এবং শিল্পকলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মানুষও হয়ে পড়ল অচ্ছুত। এই ঢাকা শহরেই তো আমরা দেখেছি, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান জনসমক্ষে অপমানিত হয়েছেন! সবে তানপুরার তার সুরে বেঁধে তিনি পাহাড়ি রাগে একটি ঠুমরির আলাপ শুরু করতেই এক উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি আমলা প্রথম সারি থেকে বলে উঠলেন, 'অনেক হয়েছে! এবারে একটা গজল শোনান ওস্তাদজি!' কথিত আছে, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে নীরবে ওই আসর থেকে উঠে আসেন এবং অচিরেই চলে যান ভারতে। আবাস গড়েন কলকাতাতেই। সেখানে তিনি সুরের সাগর মন্থন করে দুর্লভ সব রত্ন তুলে এনে পরিবেশন করেন বিশ্বের সব সঙ্গীতপ্রেমী মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে। পরবর্তীকালে আমাদের অতি পরিচিত শিল্পী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী প্রমুখ বড়ে গোলাম আলীর ধ্বজা বয়ে চলেছেন এবং চলছেন।
আমরা প্রথম থেকেই প্রত্যক্ষ করেছি সামগ্রিকভাবে শুদ্ধ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং বিশেষভাবে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিপরীতে পাকিস্তানিদের আগ্রাসন। রবীন্দ্রনাথকে আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি পাকিস্তানিরা। রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দ্বিখণ্ডিতভাবে দাঁড় করিয়েছে আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। এখন কয়জন খোঁজ রাখেন যে, পাকিস্তানি আমলে নজরুলের কিছু তথাকথিত ইসলামী গজল ছাড়া তার সঙ্গীতের যে ঋদ্ধ ভাণ্ডার ছিল, সেটি অনাস্বাদিত রয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ বাঙালির কাছে? তার শ্যামাসঙ্গীত আমরা শুনতে পাইনি। তার ভক্তিসঙ্গীত আমাদের জন্য ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছিল।
সেই প্রতিকূল অবস্থায় বাংলাদেশের কিছু সাহসী তরুণ স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েছিল বাঙালিকে নিজ বাসভূমে পুনর্বাসিত করার চেষ্টায়। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তারা লড়ে গেছেন আমাদেরই সংস্কৃতির স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথ ফিরে পেয়েছেন তার স্থান। উদযাপিত হয়েছে তার জন্মশতবার্ষিকী। নজরুলের অধিকাংশ গান শেখানো হয়েছে শিশু, কিশোর, যুবাদের। নতুন কবিতা লেখা হয়েছে আধুনিক বাঙালি কবিদের দ্বারা। লেখা হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতন্ত্রকামী যত কাব্য। এভাবে আমরা এগিয়ে গেছি সংস্কৃতি-ভাস্বর স্বাধীনচেতা এক জাতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এসবই মনে আসছিল সেই রাতে, রাতের শেষে। চৌরাসিয়ার বাঁশিতে স্বপ্নমগ্ন হয়ে। তবে সে সঙ্গে আরও কিছু কথা মনে এসেছিল। আমরা যারা বছরের পর বছর ভিড় করে যাচ্ছি সঙ্গীতের ওই মিলনমেলায়, তারা যেন কেবল আপাতরম্যে গা ভাসিয়ে না দিয়ে কিছু সঙ্গীত বক্ষে ধারণ করে নিয়ে যাই যার যার আবাসে। প্রতিনিয়ত ওইসব অমৃত সুধা পান করি। যেন সঙ্গীত মিলনমেলা থেকে উঠে আসে আমাদের ঘরে ঘরে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments