বিশ্বের মাতৃভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট by ড. আবুল কালাম মো. রফিকুল্লাহ

বিশ্বের বিকাশমান, বিপন্ন, প্রায়-বিপন্ন সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং এসব ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট ভাষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি মাইলফলক। ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ফলে বিশ্বময় একুশের চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভাষাগত প্রাধান্য বিস্তারকারী মানসিকতার অবসান ঘটেছে। এ ঘোষণার এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৭ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, পৃথিবীর বিকাশমান ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় গবেষণা করার জন্য ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হবে। সে অনুযায়ী ১৫ মার্চ ২০০১ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান। ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট আইন পাস হলে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এ আইন অনুসারে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্সটিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং এটি পরিচালিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত পরিচালনা বোর্ড দ্বারা। শিক্ষামন্ত্রী এ বোর্ডের সভাপতি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট আইন-২০১০-এ প্রতিষ্ঠানের মোট ২৩টি দায়িত্বের উল্লেখ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ১. দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ; ২. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এতদসংক্রান্ত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা; ৩. বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা-আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কো সদস্য দেশসমূহের মধ্যে এ সংক্রান্ত ইতিহাস প্রচার; ৪. বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ; ৫. বাংলা ভাষার উন্নয়নে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা; ৬. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন; ৭. ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণ; ৮. বিভিন্ন ভাষার অভিধান বা কোষ গ্রন্থ প্রকাশ এবং হালনাগাদকরণ; ৯. ভাষা বিষয়ে গবেষণা জার্নাল প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন; ১০. ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশী ও বিদেশীদের ফেলোশিপ প্রদান; ১১. ভাষা বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান; ১২. ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও রক্ষা; ১৩. বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা এবং হালনাগাদকরণ; ১৪. ভাষা জাদুঘর তথ্য সমৃদ্ধকরণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রতিবছর অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয়। তিন-চার দিনব্যাপী উদযাপন অনুষ্ঠানমালায় থাকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, আলোচনা, সেমিনার, ভাষামেলা, বিভিন্ন ভাষার ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী, স্মরণিকা প্রকাশ, মাতৃভাষায় কবিতা পাঠের আসর, প্রাচীন লিখন-বিধি প্রদর্শনী ইত্যাদি। এ উদযাপন অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন প্রধানমন্ত্রী এবং সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী। আরও উপস্থিত থাকেন প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টাবৃন্দ, জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিববৃন্দ, উপাচার্যবৃন্দ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি এবং সংস্কৃতিকর্মীবৃন্দ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইন্সটিটিউটটি বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা আশ্রয়ী বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনা সভার আয়োজন করে আসছে। ইন্সটিটিউট মাতৃভাষা বার্তা নামে একটি নিউজ লেটার নিয়মিত প্রকাশ করছে। তাছাড়া মাতৃভাষা ও 'Mother Language' নামে দুটি জার্নাল অচিরেই প্রকাশিত হবে। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১০ ও ২০১২ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলো নিয়ে ইন্সটিটিউট থেকে ভাষা ও ভাষা প্রসঙ্গ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা পরিচিতি : মৌলভীবাজার জেলা শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
ইন্সটিটিউটের ভাষা জাদুঘরে এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১১৮টি দেশের মাতৃভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং মহান ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র, বিভিন্ন ভাষার লিপি ও লিখনব্যবস্থার পরিচয়সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন। ২০১২ সালে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা, উপ-মহাপরিচালক বেতাচিউ এনগিদা এবং আইসেস্কো মহাপরিচালক ড. আবদুল-আজিজ ওতমান আল তোয়াইজিরি ভাষা জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
বাংলাদেশে বাংলাভাষিক ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও তাদের ভাষাসমূহের প্রকৃত সংখ্যা ও বাস্তব অবস্থা এখনও নির্ণয় করা যায়নি। এ উপমহাদেশে স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের Linguistic Survey of India (1903-1928)-এর পর বাংলাদেশে ভাষাবিষয়ক গ্রহণযোগ্য ব্যাপক গবেষণা আর হয়নি। ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে গ্রিয়ার্সনের গবেষণা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ; তবে সময়ের ব্যবধানে এ গবেষণা ফলাফলের ব্যবহারিক উপযোগিতা কমে আসছে। পক্ষান্তরে, ভারত ইতিমধ্যে একবার ভাষা বিষয়ে সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে (১৯৮৪-১৯৯১) এবং প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ভাষাসমীক্ষার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রসঙ্গক্রমে নেপালের উদাহরণও উল্লেখ্য। নেপাল একবার ভাষাসমীক্ষা সম্পন্ন করে (১৯৫২-১৯৫৪) পুনরায় জাতীয় পর্যায়ে ভাষাসমীক্ষার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। নেপালের জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের তত্ত্বাবধানে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের Central Department of Linguistics সাত বছর মেয়াদি (২০০৮-২০১৫) এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে অনুরূপ সমীক্ষা পরিচালনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় ২০১২ সালের শেষদিকে। এ মহতী উদ্যোগটি হচ্ছে বাংলাদেশের নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা। আর এটি তৎকালীন শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর চিন্তার ফসল। তিনি প্রথম ১২ নভেম্বর ২০১২ তারিখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের সভাকক্ষে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, বাংলা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এ সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, উপভাষা/ বর্ণমালা/লিপি ও লিখন পদ্ধতি, তাদের জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় সংক্রান্ত তথ্যসংবলিত একটি নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা পরিচালনা এবং এ সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যাটালগ বা বৃত্তান্ত তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকনির্দেশনা দেন। কর্মসূচিটি ২১ এপ্রিল ২০১৪ প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে জুন ২০১৪ থেকে এর বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়।
গবেষণার প্রতিবেদন বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় ১০টি ভলিয়্যুমে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। কর্মসূচির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯৮.৪৩ লাখ টাকা। বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিনাত ইমতিয়াজ আলী, মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট, কর্মসূচি মনিটর করছেন এবং এ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. অরুণা বিশ্বাস (যুগ্ম সচিব) পরিচালক-কর্মসূচি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ইন্সটিটিউটের আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষাবিষয়ে প্রশিক্ষণ ও ডকুমেন্টশন কার্যক্রম গ্রহণ করা। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে বর্তমান শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খানের নির্দেশনায় ইন্সটিটিউট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদেশী ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের সহায়তায় 'Top Living Ten and Dying Ten Languages Teaching Project' গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় পৃথিবীর জীবন্ত প্রধান দশটি ভাষা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বের প্রভাবশালী সংশ্লিষ্ট ভাষা ও ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে প্রশিক্ষণার্থীদের পরিচিত করে দেয়া এবং ভাষাগত যোগাযোগ দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা, যাতে করে তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণসহ অন্যান্য পেশাগত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়।
বহির্বিশ্বের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা উন্নয়ন ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা এ ইন্সটিটিউটের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে ইন্সটিটিউটের দুটি প্রতিনিধি দল ইতিমধ্যে ভারত ও শ্রীলংকা সফর করে এসেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটকে ইউনেস্কো ক্যাটাগরি-২ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ইউনেস্কো সদর দফতর থেকে Feasibility Study Team ইন্সটিটিউটটি পরিদর্শন করে গেছে। আশা করা যায়, পরবর্তী ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ক্যাটাগরি-২ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপিত হবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইন্সটিটিউটের অবস্থান ও মর্যাদা আরও বাড়বে।
ইন্সটিটিউটের শৈশব এখনও কাটেনি। তবু ২০১০ সালে কার্যক্রম শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির সফলতার ঝুড়ি একেবারে হালকা নয়। তাছাড়া শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মাতৃভাষা বিষয়ক গবেষণা ও অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণের ব্যাপক চিন্তাভাবনা চলছে। বিশ্বের সব জীবন্ত মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং বিপন্ন ও প্রায়-বিপন্ন মাতৃভাষার পুনর্জীবন, সংরক্ষণ ও ডকুমেন্টশনই এ ইন্সটিটিউটের লক্ষ্য। তাই নিঃসন্দেহে এটি হবে একটি আন্তর্জাতিক মানের ভাষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। আর এজন্য প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে জনবল কাঠামোর আওতায় একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠার।
ড. আবুল কালাম মো. রফিকুল্লাহ : লেখক
rafique51057@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.