সাতক্ষীরা শান্ত, সমগ্র দেশ হবে কবে? by আলমগীর স্বপন
মধ্য
দুপুরের সূর্যের আলোয় যেন রুপার ঝিলিক মধুমতি নদীর টলটলে নীল জল। প্রকৃতির
এমন পাগলপারা সৌন্দর্যেও অনেকটা নিরুত্তাপ ওহাব সর্দার। ঝকঝকে রোদ যেন
পুড়িয়ে দিচ্ছে তার চিমসে যাওয়া সত্তর বছরের গতর। ভবিষ্যতের চিন্তায় কপালের
বলিরেখা যেন আরও বাড়ছে। কারণ অবরোধ-হরতালের দেড় মাসে তার ছোট চায়ের দোকানে
গ্রাহকের দেখা আগের মতো নেই। নদীতে গোসল সেরে ঘাটে বসে হয় তো আনমনে
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবছিলেন কিংবা হয়তো ডুব দিয়েছিলেন রঙ্গিন অতীতে।
আমাদের ডাকে চমকে ওঠেন। থিতু হয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, চা খাবেন নাকি?
গত প্রায় দশ-এগার বছর চা বেচেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শঙ্করপাশা ঘাটে। এর আগে যাত্রাদলের ম্যানেজারি করতেন ওহাব সর্দার। রঙ্গিন সেই জীবন থেকে এক সময় বের হয়ে আসেন। জীবিকার তাগিদে আবার নেমে পড়েন কম পুঁজির চা বেচার কাজে। ঘাটে তার চায়ের সুনামও বেশ। কিন্তু গত প্রায় দেড় মাসের হরতাল-অবরোধে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। আর পারি না বাবা। আগে প্রতিদিন সাত-আটশ টাকার চা বেচতাম। এখন দেড়-দুশও ওঠে না। মরণদশা আমাগের।
নদীর ওপারে নড়াইল জেলা। এই রুট দিয়ে যশোরের বেনাপোল থেকে কিছু পণ্যবাহী ট্রাক দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যায়। ঘাটের ইজারাদার মঞ্জুর হাসান চা খেতে খেতে বলছিলেন, গাড়ি নাই ঘাটে। আগে প্রতিদিন গড়ে দেড়-দুশ গাড়ি পারাপার হতো। এখন এর অর্ধেকও যায় না। প্রতিদিনই লস হচ্ছে।
হরতাল-অবরোধে এ ধরনের চিত্র খোদ প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জেই। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা এগোতে থাকি আরও দক্ষিণে। খুলনা পেরিয়ে সাতক্ষীরার পথে যেতে যেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। অনেকটা ভয়ে ভয়ে এই পথে আমাদের যাত্রা। কারণ সবারই জানা। দুবছর আগে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত সাতক্ষীরা জেলায় যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল তা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়কে ঘিরে এই জেলায় সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল। রায়ের পরপরই জামায়াতের নেতা-কর্মীরা হামলা করে সদর সিটি কলেজের প্রভাষক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মামুনের বাড়িতে। কুপিয়ে-পিটিয়ে স্ত্রীর সামনে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় তার দোতলা বসতবাড়ি। এভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের এক বছরে জামায়াত-শিবিরের হামলায় এই জেলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৭ জন নিহত হয়েছিলেন। অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেকের বসতবাড়ি, গুদাম, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সময় হামলা থেকে রক্ষা পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। তাই শংকা, ভয় নিয়েই আমাদের গাড়ি এগোচ্ছিল সাতক্ষীরার পথে। তবে যেতে যেতে আমরা কিছুটা অবাকও হই। হরতাল-অবরোধ সত্ত্বেও রাস্তার ধারের দোকানপাট খোলা। ভ্যানে করে বাড়ির পথে একসঙ্গে ফিরছেন নারী-পুরুষ। সদাই কিনে বাপ-ছেলে ফিরছেন গল্প করতে করতে। আবার কেউ কেউ চায়ের দোকানে ঠিকই আড্ডা জমিয়েছেন। সড়ক, মহাসড়ক ধরে ছুটছে পণ্যবাহী ট্রাক, বাস। পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন জাগে, এই জেলা অবরোধ-হরতালমুক্ত নাকি? দুই বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির আন্দোলনে পুরো সাতক্ষীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। শহরে কিছু অংশ ছাড়া পুরো জেলা জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না। জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব সে সময় এতটাই ছিল যে, কেউ শহর থেকে বের হতে কিংবা বাহির থেকে কেউ সদরে ঢুকতে ভয় পেতেন। সাতক্ষীরা-কলারোয়া হয়ে যে পথ যশোর হয়ে ঢাকায় মিশেছে, সেই রাস্তার ছয়ঘরিয়া এলাকায় গিয়ে এর প্রমাণও আমরা পাই। এখনও এই সড়কে আছে সেই সময়ের ক্ষতচিহ্ন। কিছু দূর পরপরই কাটা গাছের গোড়া। সে সময় এই সড়কের প্রায় হাজারখানেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে কিংবা কোথাও কোথাও রাস্তা কেটে ব্যারিকেড দেয়া হয় তখন। যাতে কোনো যানবাহন চলাচল করতে না পারে। কিন্তু এবারের হরতাল-অবরোধে পেট্রলবোমা হামলা, নাশকতা, গাছকাটা দূরের কথা আন্দোলনের সমর্থনে কেউ রাস্তায়ও নামেননি। তাই স্বাভাবিক সময়ের মতোই পণ্যবাহী ট্রাক, বাস কিংবা ভটভটি, নসিমন, করিমন ছুটে যাচ্ছিল এই পথ ধরে। পাশে পোনা মাছের ঘেরে কাজ করছিলেন কয়েকজন। তারা জানালেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী যে অ্যাকশন গেছে তাতে এখন কারও সাধ্যি আছে, মাঠে নামবে। অনেকেরে ক্রসফায়ারে দেছে।
রাস্তার পশ্চিম দিকে দেখিয়ে তারা বলেন, ওই যে দূরে দেখছেন, ওইটা আগরদাড়ি ইউনিয়ন। সেখানকার মাদরাসা থেকে এসে জামায়াত-শিবিরের লোকজন অ্যাকশন করত। এখন কী অবস্থা তাদের খোঁজ নেন গিয়ে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেই, আগরদাড়ি যাব। ভারতের বৈকারী-তলইগাছা সীমান্ত ঘেঁষা এই ইউনিয়নকে সাতক্ষীরাতেই বলা হয় মিনি পাকিস্তান। জনসংখ্যার বেশিরভাগই জামায়াত-শিবির সমর্থক। সহিংসতার সময় স্থানীয় আগরদাড়ি মাদরাসা ও জামায়াত অফিসকে তারা মিনি ক্যান্টনমেন্ট বানিয়েছিল। এখান থেকে হামলার কর্মকৌশল ঠিক করার পাশাপাশি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ আছে। সে সময় এখানে অভিযান চালাতে এসে ঘেরাওয়ের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল যৌথ বাহিনী। স্থানীয়দের কাছে এ ধরনের নানা তথ্য শুনতে শুনতেই শহরের কদমতলা মোড় ঘুরে আমাদের গাড়ি পৌঁছে যায় আগরদাড়ি মাদরাসার গেটে। আমাদের দেখে মাথায় টুপি, জুব্বাপরা মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষক এগিয়ে আসেন। আমাদের প্রশ্নের আগেই, জামায়াত সমর্থক একজন শিক্ষক বলেন, এইবারের হরতাল-অবরোধে অন্য জেলায় যাই ঘটুক। এইখানে কোনো সমস্যা নাই। তবে তিনি স্বীকার করেন সহিংসতার কারণে এই মাদরাসার এমপিও বাতিলের কথা। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। আমরা এগিয়ে যাই মাদরাসা চত্বরে থাকা জামায়াতের অফিসের দিকে। গেটে বড় তালা ঝুলছে। এর মাঝে আমাদের অনুসরণ করছিলেন শিবিরের কয়েকজন কর্মী। শেষে এগিয়ে আসেন আমাদের দিকে। বলেন, এখানে আসছেন, লিখতে হবে- ক্রসফায়ারে আমাদের ৩২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১৫০ জনের ওপরে। একজনের পা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা ঘরে থাকতে পারে না। কঠোর নজরদারিতে আছে তারা। জিজ্ঞেস করি, আপনাদের অনেক নেতা নাকি ভারত পালিয়ে গেছেন? কিছুটা নিশ্চুপ তারা। এর মাঝেই মোটরসাইকেল নিয়ে একজন জামায়াতকর্মী হাজির। তার কণ্ঠ কিছুটা চড়া। এখানে কেন আসছেন? কী চান? আমরা কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে যাই সেখান থেকে। কারণ এই এলাকায় সহিংসতার সেই ভয়াবহ সময়ে তাদের সমর্থক মিডিয়ার কর্মীরাও হামলার শিকার হয়েছিলেন। ধুলো উড়িয়ে এবড়োখেবড়ো পথে আমরা এগোতে থাকি শহরের দিকে। পথে চোখে পড়ে একটি ভাঙা দোতলা বাড়ি। ক্রসফায়ারে নিহত আগরদাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আনারুল ইসলামের বাড়ি এটি। জামায়াতের সহিংসতায় সরাসরি ইন্ধনের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর তালিকায় সীমান্তে চোরাচালানের অন্যতম হোতাও ছিলেন তিনি। তার বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া হয়েছে যে, সেখানে কারও বসবাসের উপায় নেই। আমাদের উপস্থিতির খবর জেনে নিহত আনারুলের ভাবী ছুটে আসেন। পাশেই থাকেন। তিনি জানান, ওই সময় যারা গণ্ডগোল করেছে তারা মাঝে মাঝে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসত। এটাই তার দোষ। এ জন্য বাড়ি ভাঙা হয়েছে। ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। এর বেশি আর তিনি বলতে রাজি হন না।
তবে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে এক কিলোমিটার যেতেই পৌর এলাকা। সেখানে আবার ভিন্নমত। আনারুলের বিরুদ্ধে অনেকেই সহিংসতায় ইন্ধনের অভিযোগ আনে। বলে, এদের কারণে সাতক্ষীরায় অশান্তি ছিল। স্থানীয় সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন, যিনি জামায়াতের হামলার শিকার হয়েছিলেন, তার এখনকার স্বস্তি যেভাবেই হোক এখন শান্তিতে আছি। এই বক্তব্য সমর্থন করেন সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির সে সময় যে মাত্রার সহিংসতা চালিয়েছে তাতে মানুষ আতংকে ঘুমাতে পারত না, তার মানে কি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেন? তিনি এর উত্তর দিতে একটু ইতস্তত করলেও জেলা পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির কিন্তু অকপটেই বললেন, জানমাল রক্ষায় পুলিশের কোনো পিছুটান ছিল না। আইন-শৃংখলা বাহিনী যা কিছু করেছে আইনের মধ্য থেকেই করেছে। সাতক্ষীরা কেন বদলেছে এর কিছু তথ্যও দেন। জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেউ নাশকতা-ষড়যন্ত্রে তৎপর হলে তথ্য চলে আসে। এভাবে কয়েকদিন আগে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক এমপি ও জেলা জামায়াতের আমীর আবদুল খালেক মণ্ডল। এ ছাড়া জামায়াত অধ্যুষিত এ এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন নানা সাংস্কৃতিক কর্মসূচিও চালাচ্ছে, যাতে মানুষের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা যায়।
সাতক্ষীরা মডেলেই সহিংসতাপ্রবণ যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে স্থানীয় প্রশাসন। একইভাবে এবারের হরতাল অবরোধে বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীসহ সহিংসতাপ্রবণ এলাকায় চলছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযান। এসব এলাকায় ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ২০ জনেরও বেশি। তাদের বিরুদ্ধে পেট্রলবোমার আগুনে পঞ্চাশেরও বেশি মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগ। সহিংসতা ও নাশকতা দমনে আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলেই দিয়েছেন, পেট্রলবোমা হামলা করে সাধারণ মানুষ হত্যাকারীদের কোনো ছাড় নেই। এ ক্ষেত্রে তারা জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কোনো কোনো স্থানে পেট্রলবোমা হামলা সাময়িকভাবে থামানো গেলেও বন্ধ হবে কি হরতাল-অবরোধ? অর্থনীতি কি দ্রুতই ফিরবে আগের চেহারায়? সাতক্ষীরার মতো স্বাভাবিক হবে কি সারা বাংলাদেশ?
আবারও ফিরে আসি গোপালগঞ্জের শঙ্করপাশা ঘাটের চা বিক্রেতা ওহাব সর্দারের কাছে। বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা- সারা জীবন তার ভোট পড়েছে নৌকার ব্যালটেই। শুধু তাই নয়, সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার মুক্তি চেয়ে নফল নামাজও পড়েছেন। ঘাটে বসে এ কথা বলতে না ভুললেও, হরতাল-অবরোধে খোদ গোপালগঞ্জবাসীও যে ক্ষতিগ্রস্ত তা স্বীকার করতে কার্পণ্য করেননি তিনি। কারণ তিনি মনে করেন, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন কোনো স্থান না। গোপালগঞ্জ শান্ত আছে, বলপ্রয়োগে সাতক্ষীরা স্বাভাবিক হলেও সারা দেশে ২০ দলীয় জোটের সহিংসতার আগুনের আঁচ তাদের কপালও পোড়াচ্ছে।
তাই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সবকিছু স্বাভাবিক দাবি করলেও এসব এলাকার মানুষ মনে করেন দমন-পীড়ন কিংবা বলপ্রয়োগে সংকট নিরসন হবে না। তৃণমূলের খেটে খাওয়া এই মানুষেরা মনে করেন, সহিংসতাও কোনো দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে না। তাই তারা রাজায় রাজায় যুদ্ধের অবসান চান। প্রাণভিক্ষা চান উলুখাগড়ার?
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
alm-swapn@yahoo.com
আমাদের ডাকে চমকে ওঠেন। থিতু হয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, চা খাবেন নাকি?
গত প্রায় দশ-এগার বছর চা বেচেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শঙ্করপাশা ঘাটে। এর আগে যাত্রাদলের ম্যানেজারি করতেন ওহাব সর্দার। রঙ্গিন সেই জীবন থেকে এক সময় বের হয়ে আসেন। জীবিকার তাগিদে আবার নেমে পড়েন কম পুঁজির চা বেচার কাজে। ঘাটে তার চায়ের সুনামও বেশ। কিন্তু গত প্রায় দেড় মাসের হরতাল-অবরোধে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। আর পারি না বাবা। আগে প্রতিদিন সাত-আটশ টাকার চা বেচতাম। এখন দেড়-দুশও ওঠে না। মরণদশা আমাগের।
নদীর ওপারে নড়াইল জেলা। এই রুট দিয়ে যশোরের বেনাপোল থেকে কিছু পণ্যবাহী ট্রাক দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যায়। ঘাটের ইজারাদার মঞ্জুর হাসান চা খেতে খেতে বলছিলেন, গাড়ি নাই ঘাটে। আগে প্রতিদিন গড়ে দেড়-দুশ গাড়ি পারাপার হতো। এখন এর অর্ধেকও যায় না। প্রতিদিনই লস হচ্ছে।
হরতাল-অবরোধে এ ধরনের চিত্র খোদ প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জেই। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা এগোতে থাকি আরও দক্ষিণে। খুলনা পেরিয়ে সাতক্ষীরার পথে যেতে যেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। অনেকটা ভয়ে ভয়ে এই পথে আমাদের যাত্রা। কারণ সবারই জানা। দুবছর আগে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত সাতক্ষীরা জেলায় যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল তা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়কে ঘিরে এই জেলায় সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল। রায়ের পরপরই জামায়াতের নেতা-কর্মীরা হামলা করে সদর সিটি কলেজের প্রভাষক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মামুনের বাড়িতে। কুপিয়ে-পিটিয়ে স্ত্রীর সামনে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় তার দোতলা বসতবাড়ি। এভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের এক বছরে জামায়াত-শিবিরের হামলায় এই জেলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৭ জন নিহত হয়েছিলেন। অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেকের বসতবাড়ি, গুদাম, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সময় হামলা থেকে রক্ষা পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। তাই শংকা, ভয় নিয়েই আমাদের গাড়ি এগোচ্ছিল সাতক্ষীরার পথে। তবে যেতে যেতে আমরা কিছুটা অবাকও হই। হরতাল-অবরোধ সত্ত্বেও রাস্তার ধারের দোকানপাট খোলা। ভ্যানে করে বাড়ির পথে একসঙ্গে ফিরছেন নারী-পুরুষ। সদাই কিনে বাপ-ছেলে ফিরছেন গল্প করতে করতে। আবার কেউ কেউ চায়ের দোকানে ঠিকই আড্ডা জমিয়েছেন। সড়ক, মহাসড়ক ধরে ছুটছে পণ্যবাহী ট্রাক, বাস। পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন জাগে, এই জেলা অবরোধ-হরতালমুক্ত নাকি? দুই বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির আন্দোলনে পুরো সাতক্ষীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। শহরে কিছু অংশ ছাড়া পুরো জেলা জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না। জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব সে সময় এতটাই ছিল যে, কেউ শহর থেকে বের হতে কিংবা বাহির থেকে কেউ সদরে ঢুকতে ভয় পেতেন। সাতক্ষীরা-কলারোয়া হয়ে যে পথ যশোর হয়ে ঢাকায় মিশেছে, সেই রাস্তার ছয়ঘরিয়া এলাকায় গিয়ে এর প্রমাণও আমরা পাই। এখনও এই সড়কে আছে সেই সময়ের ক্ষতচিহ্ন। কিছু দূর পরপরই কাটা গাছের গোড়া। সে সময় এই সড়কের প্রায় হাজারখানেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে কিংবা কোথাও কোথাও রাস্তা কেটে ব্যারিকেড দেয়া হয় তখন। যাতে কোনো যানবাহন চলাচল করতে না পারে। কিন্তু এবারের হরতাল-অবরোধে পেট্রলবোমা হামলা, নাশকতা, গাছকাটা দূরের কথা আন্দোলনের সমর্থনে কেউ রাস্তায়ও নামেননি। তাই স্বাভাবিক সময়ের মতোই পণ্যবাহী ট্রাক, বাস কিংবা ভটভটি, নসিমন, করিমন ছুটে যাচ্ছিল এই পথ ধরে। পাশে পোনা মাছের ঘেরে কাজ করছিলেন কয়েকজন। তারা জানালেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী যে অ্যাকশন গেছে তাতে এখন কারও সাধ্যি আছে, মাঠে নামবে। অনেকেরে ক্রসফায়ারে দেছে।
রাস্তার পশ্চিম দিকে দেখিয়ে তারা বলেন, ওই যে দূরে দেখছেন, ওইটা আগরদাড়ি ইউনিয়ন। সেখানকার মাদরাসা থেকে এসে জামায়াত-শিবিরের লোকজন অ্যাকশন করত। এখন কী অবস্থা তাদের খোঁজ নেন গিয়ে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেই, আগরদাড়ি যাব। ভারতের বৈকারী-তলইগাছা সীমান্ত ঘেঁষা এই ইউনিয়নকে সাতক্ষীরাতেই বলা হয় মিনি পাকিস্তান। জনসংখ্যার বেশিরভাগই জামায়াত-শিবির সমর্থক। সহিংসতার সময় স্থানীয় আগরদাড়ি মাদরাসা ও জামায়াত অফিসকে তারা মিনি ক্যান্টনমেন্ট বানিয়েছিল। এখান থেকে হামলার কর্মকৌশল ঠিক করার পাশাপাশি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ আছে। সে সময় এখানে অভিযান চালাতে এসে ঘেরাওয়ের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল যৌথ বাহিনী। স্থানীয়দের কাছে এ ধরনের নানা তথ্য শুনতে শুনতেই শহরের কদমতলা মোড় ঘুরে আমাদের গাড়ি পৌঁছে যায় আগরদাড়ি মাদরাসার গেটে। আমাদের দেখে মাথায় টুপি, জুব্বাপরা মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষক এগিয়ে আসেন। আমাদের প্রশ্নের আগেই, জামায়াত সমর্থক একজন শিক্ষক বলেন, এইবারের হরতাল-অবরোধে অন্য জেলায় যাই ঘটুক। এইখানে কোনো সমস্যা নাই। তবে তিনি স্বীকার করেন সহিংসতার কারণে এই মাদরাসার এমপিও বাতিলের কথা। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। আমরা এগিয়ে যাই মাদরাসা চত্বরে থাকা জামায়াতের অফিসের দিকে। গেটে বড় তালা ঝুলছে। এর মাঝে আমাদের অনুসরণ করছিলেন শিবিরের কয়েকজন কর্মী। শেষে এগিয়ে আসেন আমাদের দিকে। বলেন, এখানে আসছেন, লিখতে হবে- ক্রসফায়ারে আমাদের ৩২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১৫০ জনের ওপরে। একজনের পা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা ঘরে থাকতে পারে না। কঠোর নজরদারিতে আছে তারা। জিজ্ঞেস করি, আপনাদের অনেক নেতা নাকি ভারত পালিয়ে গেছেন? কিছুটা নিশ্চুপ তারা। এর মাঝেই মোটরসাইকেল নিয়ে একজন জামায়াতকর্মী হাজির। তার কণ্ঠ কিছুটা চড়া। এখানে কেন আসছেন? কী চান? আমরা কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে যাই সেখান থেকে। কারণ এই এলাকায় সহিংসতার সেই ভয়াবহ সময়ে তাদের সমর্থক মিডিয়ার কর্মীরাও হামলার শিকার হয়েছিলেন। ধুলো উড়িয়ে এবড়োখেবড়ো পথে আমরা এগোতে থাকি শহরের দিকে। পথে চোখে পড়ে একটি ভাঙা দোতলা বাড়ি। ক্রসফায়ারে নিহত আগরদাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আনারুল ইসলামের বাড়ি এটি। জামায়াতের সহিংসতায় সরাসরি ইন্ধনের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর তালিকায় সীমান্তে চোরাচালানের অন্যতম হোতাও ছিলেন তিনি। তার বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া হয়েছে যে, সেখানে কারও বসবাসের উপায় নেই। আমাদের উপস্থিতির খবর জেনে নিহত আনারুলের ভাবী ছুটে আসেন। পাশেই থাকেন। তিনি জানান, ওই সময় যারা গণ্ডগোল করেছে তারা মাঝে মাঝে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসত। এটাই তার দোষ। এ জন্য বাড়ি ভাঙা হয়েছে। ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। এর বেশি আর তিনি বলতে রাজি হন না।
তবে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে এক কিলোমিটার যেতেই পৌর এলাকা। সেখানে আবার ভিন্নমত। আনারুলের বিরুদ্ধে অনেকেই সহিংসতায় ইন্ধনের অভিযোগ আনে। বলে, এদের কারণে সাতক্ষীরায় অশান্তি ছিল। স্থানীয় সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন, যিনি জামায়াতের হামলার শিকার হয়েছিলেন, তার এখনকার স্বস্তি যেভাবেই হোক এখন শান্তিতে আছি। এই বক্তব্য সমর্থন করেন সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির সে সময় যে মাত্রার সহিংসতা চালিয়েছে তাতে মানুষ আতংকে ঘুমাতে পারত না, তার মানে কি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেন? তিনি এর উত্তর দিতে একটু ইতস্তত করলেও জেলা পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির কিন্তু অকপটেই বললেন, জানমাল রক্ষায় পুলিশের কোনো পিছুটান ছিল না। আইন-শৃংখলা বাহিনী যা কিছু করেছে আইনের মধ্য থেকেই করেছে। সাতক্ষীরা কেন বদলেছে এর কিছু তথ্যও দেন। জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেউ নাশকতা-ষড়যন্ত্রে তৎপর হলে তথ্য চলে আসে। এভাবে কয়েকদিন আগে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক এমপি ও জেলা জামায়াতের আমীর আবদুল খালেক মণ্ডল। এ ছাড়া জামায়াত অধ্যুষিত এ এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন নানা সাংস্কৃতিক কর্মসূচিও চালাচ্ছে, যাতে মানুষের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা যায়।
সাতক্ষীরা মডেলেই সহিংসতাপ্রবণ যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে স্থানীয় প্রশাসন। একইভাবে এবারের হরতাল অবরোধে বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীসহ সহিংসতাপ্রবণ এলাকায় চলছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযান। এসব এলাকায় ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ২০ জনেরও বেশি। তাদের বিরুদ্ধে পেট্রলবোমার আগুনে পঞ্চাশেরও বেশি মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগ। সহিংসতা ও নাশকতা দমনে আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলেই দিয়েছেন, পেট্রলবোমা হামলা করে সাধারণ মানুষ হত্যাকারীদের কোনো ছাড় নেই। এ ক্ষেত্রে তারা জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কোনো কোনো স্থানে পেট্রলবোমা হামলা সাময়িকভাবে থামানো গেলেও বন্ধ হবে কি হরতাল-অবরোধ? অর্থনীতি কি দ্রুতই ফিরবে আগের চেহারায়? সাতক্ষীরার মতো স্বাভাবিক হবে কি সারা বাংলাদেশ?
আবারও ফিরে আসি গোপালগঞ্জের শঙ্করপাশা ঘাটের চা বিক্রেতা ওহাব সর্দারের কাছে। বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা- সারা জীবন তার ভোট পড়েছে নৌকার ব্যালটেই। শুধু তাই নয়, সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার মুক্তি চেয়ে নফল নামাজও পড়েছেন। ঘাটে বসে এ কথা বলতে না ভুললেও, হরতাল-অবরোধে খোদ গোপালগঞ্জবাসীও যে ক্ষতিগ্রস্ত তা স্বীকার করতে কার্পণ্য করেননি তিনি। কারণ তিনি মনে করেন, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন কোনো স্থান না। গোপালগঞ্জ শান্ত আছে, বলপ্রয়োগে সাতক্ষীরা স্বাভাবিক হলেও সারা দেশে ২০ দলীয় জোটের সহিংসতার আগুনের আঁচ তাদের কপালও পোড়াচ্ছে।
তাই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সবকিছু স্বাভাবিক দাবি করলেও এসব এলাকার মানুষ মনে করেন দমন-পীড়ন কিংবা বলপ্রয়োগে সংকট নিরসন হবে না। তৃণমূলের খেটে খাওয়া এই মানুষেরা মনে করেন, সহিংসতাও কোনো দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে না। তাই তারা রাজায় রাজায় যুদ্ধের অবসান চান। প্রাণভিক্ষা চান উলুখাগড়ার?
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
alm-swapn@yahoo.com
No comments