রাজনীতি- গণতন্ত্রের বারোটা বাজতে কত বাকি? by এ কে এম জাকারিয়া

২০১০ সালে মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর ‘ইজিপ্টস রিয়েল স্টেট অব ইমার্জেন্সি ইজ ইটস রিপ্রেসড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে এক লেখা লিখেছিলেন দেশটির নোবেল (শান্তি) পুরস্কার বিজয়ী মোহাম্মেদ এল বারাদি। মিসরে আরব বসন্তের ছোঁয়া লাগার ঠিক আগে আগে। লেখাটির শুরুর লাইনটি হচ্ছে ‘মিসরে আরও একটি প্রতারণামূলক ও প্রহসনের নির্বাচন হয়ে গেল।’ আর মূল বিষয় হচ্ছে, তাত্ত্বিকভাবে মিসরের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কী আছে আর বাস্তবে কী হয় বা হচ্ছে। হোসনি মোবারক তখনো ক্ষমতায়। এল বারাদি যা লিখেছেন তা অনেকটা এ রকম, তাত্ত্বিকভাবে মিসরে একটি সংবিধান ও আইন কার্যকর রয়েছে এবং সেখানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছাই সব। হোসনি মোবারক একজন সম্রাটের মতো ক্ষমতা ভোগ করেন। তাত্ত্বিকভাবে মিসরে বহুদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো দল গঠন করতে হলে এমন একটি কমিটির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়, যে কমিটির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।
এল বারাদি আরও লিখেছেন, মিসরে তাত্ত্বিকভাবে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রয়েছেন, কিন্তু গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে দেশটি পেয়েছে মাত্র তিনজন শাসককে। তিনজনের শাসন পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়তো পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু তাঁরা সবাই কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থারই নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ২৯ বছর ধরে মিসর দেশটি একটি ‘জরুরি অবস্থার’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জরুরি অবস্থার এই অস্ত্র ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট সংবিধানে দেওয়া জনগণের মৌলিক অধিকারকে সহজেই স্থগিত করতে পারেন। এবং এই অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। কেউ ভিন্নমত প্রকাশের সাহস দেখালে তা ব্যবহার করে তাকে আটক, নির্যাতন বা কখনো হত্যাও করা হয়েছে। এ ধরনের আরও অনেক প্রসঙ্গই এল বারাদি তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, যেগুলো দেশটিতে তাত্ত্বিকভাবে কার্যকর আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই।
পাঠকদের অনেকেরই এটা জানা যে মিসরে ২০১০ সালের এই ‘প্রতারণাপূর্ণ ও প্রহসনের’ নির্বাচনের মাস খানেক পর ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসেই শুরু হয়েছিল তাহরির স্কয়ারের জাগরণ। দীর্ঘদিনের ‘কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়নমূলক’ শাসন যে ধরনের রাজনৈতিক শক্তি বিকাশের সুযোগ ও পরিস্থিতি তৈরি করে, মিসরের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এখানে তলে তলে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মুসলিম ব্রাদারহুড। মিসরের জনগণ ও তরুণদের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ও গণজাগরণের প্রথম ফসলটি মুসলিম ব্রাদারহুড নিজেদের ঘরে তুলতে পেরেছিল।
৮০০-রও বেশি গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীর মৃত্যু এবং দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা এই গণ-আন্দোলন স্বৈরশাসক মোবারকের পতন ঘটায়। এরপর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে যে নির্বাচন হলো, সেখানে বিজয়ী হয়ে নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলতে খুব সময় নেয়নি মুসলিম ব্রাদারহুড। ক্ষমতার এক বছর পূর্তি না হতেই শুরু হয় মুরসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন। বিপ্লবের ফসল এককভাবে নিজেদের ঘরে তোলা, পুরোনো কায়দায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং ইসলামি আইন চালুর চেষ্টার প্রতিবাদে মিসরে উদারনৈতিক, সেক্যুলার ও বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন শুরু করে। এর সুযোগে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতার পালাবদলে মিসরের শাসনক্ষমতা এখন সাবেক সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির হাতে। অনেকটা মোবারক স্টাইলের সেই পুরোনো কাঠামোতেই আবার ফিরে গেছে মিসর।
মিসরের গণতন্ত্রের বারোটা বেজে আছে শুরু থেকেই। গণতন্ত্রের ঘড়ি সেখানে সেই বারোটা বাজা অবস্থাতেই অচল হয়ে আছে। তাহরির স্কয়ারের গণজাগরণ, আন্দোলন বা বিপ্লব যা-ই বলা হোক না কেন, কিছুই তাকে সচল করতে পারল না! মুরসির ব্রাদারহুড মিসরকে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে চরিত্র বদলে দেওয়ার’ যে চেষ্টা শুরু করেছিল, তা রুখতে সিসি দিনে দিনে আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভের পথই ধরেছে মুসলিম ব্রাদারহুড। গত ২৫ জানুয়ারি তাহরির স্কয়ার গণজাগরণের চার বছর পূর্তির দিনে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সহিংস বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে মারা গেছে ২৫ জনেরও বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে এখন বিভ্রান্তি আর চরম হতাশার মধ্যে পড়েছেন মিসরের সেই তরুণেরা, যাঁরা মুসলিম ব্রাদারহুডের ‘ইসলামি’ বা পুরোনো কায়দায় গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়নমূলক শাসন—কোনোটাই দেখতে চান না। তাহরির স্কয়ার জাগরণের চার বছর পূর্তির ঠিক আগেই যখন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ও তাঁর দুই ছেলে আদালতের সিদ্ধান্তে ছাড়া পান, তখন এই তরুণদের বা দেশটির গণতন্ত্রকামী জনগণের হতাশা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, তা আমরা অনুমান করতে পারি।
বাংলাদেশ মিসর নয়। এখানে গণতন্ত্রের ঘড়ি হয়তো থেমে যায়নি, তবে গণতন্ত্রের বারোটা বাজানোর সব উদ্যোগ-আয়োজনই চলছে। এর লক্ষণগুলোও দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এক বছর হলো আমাদের দেশে তাত্ত্বিকভাবে একটি ‘নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, তার ধারেকাছ দিয়েও যায়নি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। তাত্ত্বিকভাবে দেশে সংসদ আছে এবং বিরোধী দলও আছে। কিন্তু বাস্তবে এটা সরকারি দল ও তাদের সহযোগীদের মিলমিশের এক সংসদ।
এখানে সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম রয়েছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে যারা বিবেচিত, তাদের সভা-সমাবেশ করার কোনো অধিকার নেই। তাত্ত্বিকভাবে যে সরকারটি ‘নির্বাচিত’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ হিসেবে বিবেচিত, সেটি বাস্তবে কতটা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে তা এখন সবার কাছেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে তারা তা লুকাতেও চাইছে না। আলোচনা, সংলাপ বা সমঝোতা—এসব কোনো কিছুতেই সরকারের সায় নেই।
আর যাদের আমরা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছি, সেই বিএনপি বা তাদের জোট এসব কী
করছে! সরকারের সঙ্গে না পেরে জনগণকে মাঠে নামিয়ে গণ-আন্দোলন করার শক্তি হারিয়ে বা কৌশল না নিয়ে সাধারণ মানুষকে তারা তাদের শিকারে পরিণত করছে। তারা এখন মানুষ পুড়িয়ে মারছে এবং এভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। এটা সাধারণ গণ-আন্দোলন বা সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনও নয়, এটা স্রেফ সন্ত্রাস। দুনিয়াজুড়ে সন্ত্রাসী দলগুলো এ ধরনের কাজ করে।
বিএনপি যদি সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণাও করে, তার পরও তো তারা মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো কাজ করতে পারে না। যুদ্ধেরও একটা নিয়ম আছে, কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। বেসামরিক ও সাধারণ নাগরিকেরা যুদ্ধের সময়ও ছাড় পায়। আর এখানে তারাই প্রধান শিকার। এটা এখন পরিষ্কার যে ‘গণতন্ত্র উদ্ধার’ বিএনপির লক্ষ্য নয়, তারা আসলে অন্য কিছু চায়। এ ধরনের সন্ত্রাস আর মানুষ পোড়ানোর কৌশল ধরে রাখার মানে হচ্ছে সরকারকে আরও কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে এবং এর পক্ষে যুক্তি তৈরির সুযোগ করে দেওয়া। বিএনপি কি সেটাই চাইছে?
মিসরের জনগণের মতো বাংলাদেশের জনগণও এখন এক চরম হতাশা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছে। জনগণ গণতন্ত্র চায়, চায় সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচন। তারা সরকারের কাছ থেকে যেমন গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করে, তেমনি দেশে শাস্তি–শৃঙ্খলা বাজায় থাকুক, সেটাও চায়। তারা চায় যেকোনো রাজনৈতিক সমস্যা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে মিটমাট হোক। সরকার এসব বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছে না। অন্যদিকে বিরোধীরা রাজনীতি বাদ দিয়ে সন্ত্রাস ও মানুষ পোড়ানোর যে বর্বরতা শুরু করেছে, তাতে দুটি পক্ষের কোনোটির প্রতিই নিঃশর্ত সমর্থন বা পক্ষপাত দেখানোর সুযোগ আছে কি?
গত এক মাসের অবরোধ কর্মসূচি ৬০ জনের জীবন নিয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জন মরেছেন পেট্রলবোমা, ককটেল ও আগুনে পুড়ে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গত সোমবার রাতের বাসে পেট্রলবোমার ঘটনা প্রমাণ করেছে যে এসব বর্বরতা নিয়ে দেশবাসীর বিলাপ ও হাহাকার বিএনপি ও তাদের সহযোগীদের নরম করতে পারেনি। অবরোধ অব্যাহত থাকা মানে এসব বর্বরতা চলতেই থাকা। সরকার যে আরও কঠোর হওয়ার পথ ধরবে সেটা পরিষ্কার, শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপই হয়তো নেবে। এতে কোন পক্ষ কীভাবে লাভবান হবে, সেই হিসাব–নিকাশ হয়তো তাদের কাছে আছে, তবে গণতন্ত্রের যে বারোটা বাজবে, সেটা নিশ্চিত। দুই পক্ষই যেন সেই সময়টির জন্যই অপেক্ষা করছে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.