পোড়া শরীরে কিস্তির বোঝা by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

ঋণ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন ট্রাকচালক সাইদুল ইসলাম (৪০)। টানা অবরোধের কারণে রাস্তায় নামেননি। কিস্তির টাকাও জোগাড় হয়নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে স্টিয়ারিং ধরলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। গত সোমবার রাতে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হলেন সাইদুল। এতটাই পুড়েছেন যে তাঁকে চেনারই উপায় নেই। একই অবস্থা আরও দুই হেলপারের (ট্রাকচালকের সহকারী)। পোড়া শরীর নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন এই তিন পরিবহনশ্রমিক। মঙ্গলবার দুপুরে বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, সাইদুলের চোখমুখ বলে কিছু নেই। আগুনে পুড়ে গোটা মুখ একটা মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। পাশে বসে পাখা নাড়ছেন তাঁর স্ত্রী লালবানু। সাইদুলের বাড়ি রাজশাহী নগরের আলীগঞ্জ এলাকায়। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে কলেজে পড়ে। আরেক মেয়ের সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। এ জন্য তিন দফায় তিনটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৩০ হাজার, ২০ হাজার ও ২৪ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে। প্রথম দুটি ঋণের জন্য মাসে পাঁচ হাজার টাকা এবং শেষের ঋণের জন্য সপ্তাহে ৬০০ টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। লালবানু বলেন, টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে তাঁর স্বামী ট্রাক বের করতে পারেননি। জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে। কিস্তির টাকার জন্য এনজিওর লোকেরাও তাগাদা দিচ্ছেন। কোনো উপায় না দেখে সাইদুল সোমবার ট্রাক নিয়ে বের হয়েছিলেন। বালু টানার কাজ পেয়েছিলেন। বালু টেনে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে রাত আটটার দিকে নগরের মোল্লাপাড়া এলাকায় দুষ্কৃতকারীরা ট্রাকে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লালবানু বলেন, এখন ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার কী হবে? কী খেয়ে বাঁচবেন? কী করেই বা ঋণের টাকা শোধ করবেন? কীভাবে সুস্থ করে তুলবেন স্বামীকে? সাইদুলের ট্রাকেই ছিলেন হেলপার শহিদুল ইসলাম (৩৮)। বাড়ি পবা উপজেলার মুন্না ডাইং এলাকায়। মুখসহ তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি জীবিত, না মৃত। তাঁর স্ত্রী মাঞ্জুরা বেগম জানান, সম্প্রতি ঋণ করে তাঁরা ঘর তুলেছেন। সপ্তাহে ৭০০ টাকা কিস্তি টানতে হয়। অবরোধ শুরুর পর কোনো কিস্তি দিতে পারেননি। সংসার চালানোও কষ্টকর হয়ে পড়ে। কোনো উপায় না দেখে তাঁর স্বামী ট্রাকে উঠেছিলেন। এখন সুস্থ মানুষটা পঙ্গু হয়ে গেলে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি কোথায় দাঁড়াবেন?
সোমবার প্রায় একই সময়ে নগরের ছোট বনগ্রাম বারোরাস্তার মোড়ে অপর একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হন মুশরইল এলাকার হেলপার ফারুক হোসেন (৪২)। তাঁর মুখ এতটাই পুড়ে গেছে যে, কোনো সাড়া পর্যন্ত দিতে পারেন না।
ফারুকের স্ত্রী রানি বেগম জানান, তাঁদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। অল্প কিছু জমি আছে তাঁদের। সেখানে সম্প্রতি একটা ঘর তুলেছেন। এ জন্য দুটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সপ্তাহে ১ হাজার ২০০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। এখন কিস্তি পরিশোধ তো দূরের কথা, সন্তানদের মুখে ঠিকমতো খাবারই তুলে দিতে পারছেন না। উপায় না দেখে তাঁর স্বামী ট্রাকে ওঠেন। সারা দিন গাড়ি ঠিক করে রাতে গ্যারেজে ফেরার পথে তিনি হামলার শিকার হন। রানি বেগম বলেন, বড় মেয়ে শুধু কাঁদছে। তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। ছোটটা বাবাকে চিনতে পারছে না। ভয় পাচ্ছে। দূরে দূরে গিয়ে থাকছে। একদিকে পেটের জ্বালা, তার ওপর এই অবস্থা! এখন কোথায় যাবেন, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন বলেন, তিনজনেরই চিকিৎসা খরচ সরকার থেকে বহন করা হচ্ছে। তাঁদের ২০ থেকে ২৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। এখানেই তাঁদের সুস্থ করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.