‘র্যাট ট্রাইবস’দের বিচিত্র জীবন
এক
স্বপ্ন নিয়ে বেইজিং নামক শহরটিতে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু গ্রামের
অধিবাসীদের জন্য বেইজিং-এ জীবনযাত্রা অত সস্তা ছিল না। সুতরাং উপায় কী?
মাটির নিচে চলে যাও! বলছি চীনের কথিত ‘র্যাট ট্রাইবস’দের কথা। র্যাট
ট্রাইবস কোন উপজাতিদের নাম নয় বা কোন জাতিও নয়। তারা এসেছেন চীনের বিভিন্ন
প্রান্ত থেকে। অনেকে আবার প্রতিবেশী দেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে এসেছেন
বেইজিং-এ। মাটির নিচে বাংকারে নিজেদের বসত বানিয়ে নিয়েছেন প্রায় এরকম ১০
লাখ মানুষ। এ মানুষগুলোর থাকার জন্য সবচেয়ে সেরা বিকল্প যেন এটিই। প্রতি
মাসে ৩০০ ইউয়ান (৪৮ ডলার) খরচ হয় তাদের। মাটির উপরে যে দালানকোঠা, তার
ভাড়ার তুলনায় মাটির নিচের ঘরগুলোর ভাড়া নিতান্তই কম। মাটির নিচে তাদের বসতি
বলে কৌতুক করে তাদেরকে অনেকে ডাকে ‘র্যাট ট্রাইবস’। কথিত এ র্যাট
ট্রাইবসদের গল্প ছাপা হয়েছে বৃটেনের ডেইলি মেইল পত্রিকায়। ১৯৬৯ সালে চীনের
চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর আমলে শীতল যুদ্ধের সময় বানানো হয়েছিল বাংকারগুলো।
সোভিয়েত হামলা হতে পারে আশঙ্কায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে রাখার জন্য শহরের
বাসিন্দাদের প্রতি আদেশ জারি করা হয়েছিল। সে সময় প্রায় ২০ হাজার বাংকার খনন
করা হয়েছিল মাটির নিচে। মাও মারা যাবার পর দেং শিয়াওপিং ক্ষমতায় এলেন।
মাওয়ের আমলে নেয়া রক্ষণাত্মক কৌশল পরিহার শুরু হলো। এরপর বাড়ির মালিকরা
হোটেল রুম হিসেবে বাংকারগুলো ভাড়া দিতে লাগলেন। ৯০-এর দশকের দিকে সরকার এসব
অধিগ্রহণ শুরু করে। ওই রুমগুলোর বেশির ভাগ এখন লাভজনক আবাসন ব্যবস্থার
অন্তর্ভুক্ত। এর মানে, মঙ্গোলিয়া থেকে চীনে যাওয়া অভিনেতা ঝাং শি’র মতো
অনেকে এখন আরও ভালোভাবে বাঁচতে পারবেন, স্বপ্নগুলো বুনতে পারবেন। তার
পিতা-মাতা চেয়েছিলেন, তিনি পুলিশের চাকরি করবেন। কিন্তু তিনি সেটা চাননি।
অভিনেতা হিসেবেই নিজেকে কল্পনা করে আসছেন সবসময়। কিন্তু এ পেশায় প্রতিষ্ঠিত
হওয়াটা খুব কষ্টের। ভাড়া কম হওয়ায় তিনি থাকেন যুদ্ধের সময় খনন করা ওই
ভূগর্ভস্থ রুমগুলোতে। শিল্পী সিম চি ইনের একটি শর্ট ফিল্মে দেখানো হয়
ভূগর্ভস্থ ওই বাংকারগুলো। ঝাং জানান, যখন আমার বাবা আমাকে দেখতে এলেন, তখন
আমার অবস্থা দেখে তিনি কেঁদেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাবা, আমি এমনটা
প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম, যখন আমি বের হয়ে মানুষের সঙ্গে
মিশি, তখন আমাকে বেশ মার্জিত দেখায়। তখন কে বলতে পারবে যে, আমি মাটির নিচে
এমন একটি ঘরে থাকি? এরকম একটি রুমে থাকেন চেন লেক্সিউ নামের আরেকজন। ৫০
বছর বয়সী এ নারী সেখানে গিয়েছেন কয়লা খনির জন্য বিখ্যাত শহর লিউপানশুই
থেকে। কৃষিকাজ আর লাভজনক মনে না হওয়ায়, নিজের ছেলের কাছে থাকতে বেইজিং-এ
পাড়ি জমান তিনি। ঝাং জিনওয়েন নামের আরেকজন হাইস্কুল পার হওয়ার পরই হুবেই
প্রদেশ থেকে চলে গিয়েছেন বেইজিং-এ। শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছে
তার, তিনিও থাকছেন ওই মাটির নিচের ঘরগুলোয়। লি ইয়াং গিয়েছেন টংঝৌ থেকে।
তিনি এখন কাজ করছেন কার মেকানিক হিসেবে। টাকা বাঁচানোর জন্য তিনিও থাকছেন
বাংকারে। একই অবস্থা শু জুনিপিং-এর। তার পুরো পরিবার থাকছে সেখানে। পরিবার
বলতে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ঝোউ ঝেংদি ও তার স্বামী ঝোউ হাইলিন। এটি অবস্থিত
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মরুভূমির পাশে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সব ঋতুতেই
সুবিধাজনক আবহাওয়া বিরাজ করে এখানে। শীতকালে গরম লাগে, গরমকালে শীত অনুভূত
হয়। তবে বেশির ভাগ বাসিন্দাই স্বপ্ন দেখেন, একদিন তারা মাটির উপরের দালানে
থাকবেন। তবে তাদের স্বপ্ন বড়সড়ো প্রশ্নবোধক চিহ্নের সম্মুখীন। কেননা, ২০১০
সালেই কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও
সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে শহরজুড়ে অভিযান চালানো হবে। এছাড়া, আদি
বাসিন্দারা এই ‘র্যাট ট্রাইবস’দের বাইরের লোক বলে মনে করেন। সরকার ২০১২
সালের মধ্যে এসব বাংকার বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কম ভাড়ার
প্রশ্নে বেইজিং-এ এ বাংকারগুলোই যেন সমাধান। তাই হয়তো এসব সরকার এখনও
বিলুপ্ত করেনি। কিন্তু কখন শুরু হয়ে যায় সরকারি অভিযান, এ আশঙ্কায় অনিশ্চিত
ভবিষ্যৎকে সঙ্গী করে পথ চলছে ১০ লাখ মানুষ।
No comments