হনুয দিল্লি দূরঅস্ত by মাসুদ মজুমদার
১. বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ঠিক কোন স্তরে রয়েছে সেটা হুট করে বলা সম্ভব নয়। ‘দি ইকনোমিস্ট’ ব্যাখ্যা করেছে, কেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেই সাথে ইঙ্গিত দিয়েছে তৃতীয় শক্তির উত্থান অনিবার্য হওয়ার ব্যাপারে। শাসকশ্রেণীর চিন্তাভাবনা চরমভাবে ফ্যাসিবাদধর্মী। তারা কোনো রাজনৈতিক সমাধান চায় নাÑ হররোজ এমন ধারণাই দিয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া চলমান সঙ্কটকে তারা নাশকতা ও আইনশৃঙ্খলাজনিত সঙ্কট দেখিয়ে দমনপীড়ন চূড়ান্ত করতে চান। আবার সর্বোচ্চ সাংবিধানিক ক্ষমতাটাও দেখানোর হুমকি দিচ্ছেন। এর সরল অর্থ জরুরি অবস্থা জারি করবেন। স্মরণ করিয়ে দেবো, কুইনিন জ্বর সারাবে কিন্তু কুইনিন সারাবে কে? অর্থাৎ জরুরি অবস্থা না হয় শুরু হলোÑ শেষ হবে কিভাবে? প্রসঙ্গে তুঘলক ও নিজাম উদ্দিন আওলিয়াকে নিয়ে হামিদ মীরের একটি লেখার কথা মনে পড়ল।
হামিদ মীর দৈনিক জং-এর কলামিস্ট। জিও টিভির প্রধান নির্বাহী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার সংবেদনশীল মন ও পাকিস্তানি শাসকদের দিকে দায়দায়িত্বের অঙ্গুলি তোলেন বলেই বাংলাদেশের মানুষের মমত্ববোধ তার প্রতি রয়েছে। তার প্রায় লেখা বাংলাদেশের অন্তত দু’টি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়। তবে যেসব লেখায় তিনি নিজের বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও তার জাতিসত্তা নিয়ে লিখে থাকেন, যারা সচরাচর তার লেখা ছাপেন, তারা এ ধরনের লেখা এড়িয়ে যায়। নয়া দিগন্ত এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সৎ এবং বস্তুনিষ্ঠও। তার নিজস্ব মতপ্রধান লেখাও এখানে ছাপা হয়। কারণ এটাই সাংবাদিকতা পেশার পেশাদারিত্ব ও সতীত্ব। সম্প্রতি ‘ওবামা ও হনুমান’ নিয়ে তার একটি লেখা অনূদিত হয়ে ছাপা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, খালেদা জিয়ার কপালে দুঃখ আছে। তাৎক্ষণিক হামিদ মীরের লেখায় তুলে ধরা ইতিহাসভিত্তিক ঘটনাটি মনে পড়ল। তখন আরো অনেকের কপালের দিকে তাকালাম। নিজের কপালেও হাত দিয়ে দেখলামÑ মনে হলো প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা বোধ করি কেউ দুঃখ মুক্ত নই। বিশেষত শাসকেরা যখন নিজেদের সব সীমাবদ্ধতা ভুলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেন, যখন মনে করেন অতীতে কোনো দেশে কোনো শাসক ছিল না, ভবিষ্যতেও আর কোনো শাসক থাকবে না, তারাই শুরু ও শেষ। তারা ভুলে যান পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে সৃষ্টি করলেও অপরিহার্য করে অমরত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেননি। এ জন্যই শাসকদের বাড়াবাড়ির খেসারত সব সময় দুনিয়াতেও কিছুটা শেষ করে দিয়ে যেতে হয়। অবশিষ্টটা আদালতে আখেরাতের জন্য তোলা থাকে। দুনিয়াতে তারা নিজেরা যেমন সেই মাশুল গোনেন, তেমনি জনগণকেও গুনতে হয়। এ প্রসঙ্গে নজির টানার জন্যই হামিদ মীরের লেখার উদ্ধৃতি দেয়ার দায়বোধ করলাম।
হামিদ মীর লিখেছেন, “হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর ওপর দিল্লির শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাখোশ ছিলেন। কেননা শাসকের দরবারে এই বুজুর্গ সুফি যাওয়া-আসা করতেন না। সর্বসাধারণের মাঝে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর গ্রহণযোগ্যতা তুঘলকের ভালো লাগত না। একবার তুঘলক বঙ্গ অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ শেষে দিল্লি ফিরে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি দ্রুতগতির দূতের মাধ্যমে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর কাছে পয়গাম পাঠালেন, আমার পৌঁছার আগেই আপনি অন্য কোথাও চলে যাবেন। দিল্লিতে হয় আপনি থাকবেন, নয়তো আমি থাকব। যদি আপনি শহর ত্যাগ না করেন, তাহলে পরিণাম ভালো হবে না। হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:কে ওই ধমকমিশ্রিত পয়গাম শোনানো হলে তার পবিত্র মুখ দিয়ে আপনাআপনি এই বাক্য বেরিয়ে এলো, ‘হনুয দিল্লি দূরঅস্ত’ (দিল্লি এখনো দূরে)।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বঙ্গবিজয় করে ফিরে আসছেন। এ উপলে তার অভ্যর্থনার জন্য পুরো শহরকে সাজানো হলো। শহর থেকে কিছু দূরে তুঘলকাবাদে একটি অস্থায়ী মহল নির্মাণ করা হলো, যাতে বিজয়ী সুলতান এখানে এসে কিছু সময় বিশ্রাম নেবেন। অতঃপর ফুরফুরে তরতাজা হয়ে শান-শওকত নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করবেন। তুঘলক ওই অস্থায়ী মহলে খাবার খাচ্ছেন। এ দিকে দিল্লিতে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর মুরিদরা চিন্তা করছেন, সুলতান শহর থেকে সামান্য কয়েক মাইল দূরে রয়েছেন। যখন তিনি শহরে প্রবেশ করবেন, না জানি কী ঘটবে! ওদিকে সুলতান খাবার শেষ করে হাত ধুচ্ছিলেন। ওই সময় আকাশ থেকে বজ্রপাত হলো। সেই সাথে অস্থায়ী মহলের ছাদ দড়াম করে মাথার ওপর ভেঙে পড়ল।
সুলতান তার পাঁচজন সঙ্গীসহ মারা গেলেন। দিল্লিতে তার লাশ পৌঁছল। এরপর ‘হনুয দিল্লি দূরঅস্ত’ ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়ে গেল।”...
একই লেখায় হামিদ মীর আরো লিখলেন, “যে শহরে ওবামা ভারতকে লবডঙ্কা দেখালেন, ওই শহরে গালিব নামের এক কবিও শায়িত আছেন। তিনি বলেছিলেনÑ আমাদের জানা আছে জান্নাতের বাস্তবতা, কিন্তু গালিব মনে করেন, মনকে খুশি রাখতে এ কল্পনাও যে ভালো। ভারতীয়দের খুশি রাখতে ওবামা বারবার এমন এক কল্পনা পেশ করছেন, যার বাস্তবরূপ দেয়া বেশ কঠিন। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মধ্যে আমেরিকা ছাড়া ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন রয়েছে। আমেরিকা শুধু ভারতকে নয়, বরং জাপানকেও এ টোপ দিয়ে রেখেছে যে, সে তাকে নিরাপত্তা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ সদস্য বানাবে। জাপান ও ভারতের মাঝে একটি মিল রয়েছে। তা হচ্ছে উভয়েরই চীনের সাথে সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকা জাপান ও ভারতের সাথে যৌথভাবে চীনের নিকটবর্তী সমুদ্রে নৌমহড়াও করেছে। ওবামা ভুলে গেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যেরই ভেটো শক্তি রয়েছে।
২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আমরা ওবামার সফরের ওপর জিও নিউজ এবং ভারতের হিন্দি চ্যানেল আজতক টিভির এক যৌথ প্রোগ্রাম সূচনার আগে ইসলামাবাদের স্টুডিওতে বসে দিল্লি থেকে আজতক টিভির হেডলাইন শেষ হওয়ার অপো করছি। হঠাৎ ভারতীয় টিভির সংবাদপাঠিকার এ শব্দগুলো আমার কানে এলো, ‘ওবামাও হনুমানভক্ত। তিনি হনুমান মূর্তি সর্বদা সঙ্গেই রাখেন।’ অতঃপর আমাদের প্রোগ্রাম শুরু হলো। প্রোগ্রাম শেষ হলে আমি দিল্লিতে ফোন করে ওবামা ও হনুমান সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করি। জানা গেল, ওবামা এল কে আদভানির কন্যা প্রতিভা আদভানির সাথে সাাৎকালে বলেছেন, তিনি হনুমানকে ভক্তি করেন। তার মূর্তিও সঙ্গে রাখেন। অতঃপর ওবামা তার পকেট খোলেন এবং হনুমানের ছোট্ট একটি মূর্তি বের করে প্রতিভাকে দেখান। হনুমান হিন্দুদের রামায়ণ ও মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। হিন্দু বর্ণনা মতে, হনুমানের আকৃতি বানরের সাথে মিলে যায়। হনুমান রাম-রাবণের লড়াইয়ে রামের প নেন এবং সীতাকে লঙ্কা থেকে খুঁজে নিয়ে আসেন। ওবামা প্রতিভাকে জানান, তিনি হনুমানকে নিজের জন্য বেশ সৌভাগ্য মনে করেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি হনুমানের মূর্তি নিজের সাথে রাখছেন। ওবামার ভারত সফরের সবচেয়ে বড় খবর এটাই যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক হিন্দু ভগবানকে ভক্তি করেন। এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি যাকে ইচ্ছা ভক্তি করবেন, যাকে ইচ্ছা ভক্তি করবেন না। কিন্তু মনে রাখবেন, তার বক্তব্য ও পলিসি দ্বারা দণি এশিয়ায় যেন উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায়। তিনি তো বেশ ভালো সবক দিয়েছেন, আমেরিকা কারো বন্ধু নয়, শুধু নিজের বন্ধু।” এ লেখায় আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় ধরনের সবক রয়েছে কি না ভেবে দেখতে পারেন।
২. কয়েক দিন আগের ঘটনা। সন্ধ্যায় টিভিসেটের সামনে বসা ছিলাম। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের বিষয় নিয়ে একটি ধারাভাষ্য শুনছিলাম। হঠাৎ একটি শব্দ কানে বাজল এবং বাঁধল। ধারাভাষ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা ধরনের ইতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছিল। হঠাৎ শেষ করা হলো ‘বঙ্গবন্ধু তোমাকে প্রণাম’ বলে। আমি জানি না বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে এ ধরনের শব্দ চয়নে তিনি ব্যথিত হতেন কি না। প্রণাম একটি বিশেষ ধর্মের লোকজন শ্রদ্ধাবনত হয়ে গুরুজনদের জন্য ব্যবহার করেন। তারা সালাম বলেন না। বাঙালি মুসলমানও প্রণাম জানায় না। একটি শব্দ নিয়ে ধর্মান্ধতা বা রক্ষণশীলতা প্রকাশ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধানে সালামের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রণাম শব্দ গ্রহণ করেনি। তাই আমাদের মন ও মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে ভাষাশহীদদের সম্মানে বইমেলা। উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এক দিকে আমাদের ভাষার লড়াই, স্বাতন্ত্র্য রক্ষার আন্দোলনÑ অন্য দিকে কলকাতাইয়া শব্দের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, তাও আবার বঙ্গবন্ধুর জন্য বরাদ্দ করা কোনো সুখকর আলামত স্পষ্ট করে না।
কোকোর মৃত্যুর পরও কোনো কোনো চ্যানেলে ও পত্রিকায় মরদেহ, শেষকৃত্যসহ এমন সব শব্দ চয়ন করেছে, যা আবহমান বাংলার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শুনতে ও বলতে অভ্যস্ত নয়। লাশ বলতে আমরা অভ্যস্ত। মৃত্যুকে আমরা ইন্তেকালও বলি। জানাজাকে আমরা শেষকৃত্য বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও বলি না। মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর পরই আমরা পড়িÑ আল্লাহর কাছ থেকে আসে আল্লাহর কাছে যায়। তাও আরবিতে বলতেই আমরা অভ্যস্তÑ ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজকাল আমরা অনেক শব্দ আমদানি করছি। কলকাতা থেকে আমদানি করা কিংবা অনুসরণ করে আমাদের শব্দভাণ্ডার বাড়াচ্ছি বৈ কমাচ্ছি না, তবে শব্দের অপপ্রয়োগ বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হচ্ছে না বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের গ্রাস করছে কি না, সবাইকে ভেবে দেখতে বলি। আমরা কখনো কূপমন্ডূক হতে যাবো না কিন্তু অতি আধুনিক হতে গিয়ে অস্তিত্ব বিপন্ন হতেও দিতে পারি না।
আমরা জল-পানির যুদ্ধ করতে চাই না। পুরো ভারতে বলে পানি পিহতা হ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে জল পান করে। আমরা জলও পান করি, পানিও পান করি। বরং পান করার পরিবর্তে ‘খাই’ অশুদ্ধ শব্দ বলতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এতে আমাদের কোনো গোঁড়ামি নেই। কবরস্থানকে শ্মশান, জানাজাকে অন্য কিছু, দাফন কাফনকে অপভ্রংশ শব্দের ভাষায় বলাতে আমরা একেকারেই অনভ্যস্ত। কুলখানি, চল্লিশা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, সব দোয়া সব সময় করা যায়। দিন মেপে দোয়ার নিয়ম যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাও এসব দোয়ার অনুষ্ঠানকে প্রার্থনা সভা বলা আমাদের সাথে যায় না। তাই দয়া করে কিংবা মতলববাজি করে আমাদের ওপর কিছু আরোপ করা সমীচীন হচ্ছে না। তাতে সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাত অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে; যা আমাদের আবার একটি ভাষা আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেবে, যার রাজনৈতিক রূপটাও হবে অনাকাক্সিত।
হামিদ মীর দৈনিক জং-এর কলামিস্ট। জিও টিভির প্রধান নির্বাহী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার সংবেদনশীল মন ও পাকিস্তানি শাসকদের দিকে দায়দায়িত্বের অঙ্গুলি তোলেন বলেই বাংলাদেশের মানুষের মমত্ববোধ তার প্রতি রয়েছে। তার প্রায় লেখা বাংলাদেশের অন্তত দু’টি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়। তবে যেসব লেখায় তিনি নিজের বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও তার জাতিসত্তা নিয়ে লিখে থাকেন, যারা সচরাচর তার লেখা ছাপেন, তারা এ ধরনের লেখা এড়িয়ে যায়। নয়া দিগন্ত এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সৎ এবং বস্তুনিষ্ঠও। তার নিজস্ব মতপ্রধান লেখাও এখানে ছাপা হয়। কারণ এটাই সাংবাদিকতা পেশার পেশাদারিত্ব ও সতীত্ব। সম্প্রতি ‘ওবামা ও হনুমান’ নিয়ে তার একটি লেখা অনূদিত হয়ে ছাপা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, খালেদা জিয়ার কপালে দুঃখ আছে। তাৎক্ষণিক হামিদ মীরের লেখায় তুলে ধরা ইতিহাসভিত্তিক ঘটনাটি মনে পড়ল। তখন আরো অনেকের কপালের দিকে তাকালাম। নিজের কপালেও হাত দিয়ে দেখলামÑ মনে হলো প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা বোধ করি কেউ দুঃখ মুক্ত নই। বিশেষত শাসকেরা যখন নিজেদের সব সীমাবদ্ধতা ভুলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেন, যখন মনে করেন অতীতে কোনো দেশে কোনো শাসক ছিল না, ভবিষ্যতেও আর কোনো শাসক থাকবে না, তারাই শুরু ও শেষ। তারা ভুলে যান পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে সৃষ্টি করলেও অপরিহার্য করে অমরত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেননি। এ জন্যই শাসকদের বাড়াবাড়ির খেসারত সব সময় দুনিয়াতেও কিছুটা শেষ করে দিয়ে যেতে হয়। অবশিষ্টটা আদালতে আখেরাতের জন্য তোলা থাকে। দুনিয়াতে তারা নিজেরা যেমন সেই মাশুল গোনেন, তেমনি জনগণকেও গুনতে হয়। এ প্রসঙ্গে নজির টানার জন্যই হামিদ মীরের লেখার উদ্ধৃতি দেয়ার দায়বোধ করলাম।
হামিদ মীর লিখেছেন, “হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর ওপর দিল্লির শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাখোশ ছিলেন। কেননা শাসকের দরবারে এই বুজুর্গ সুফি যাওয়া-আসা করতেন না। সর্বসাধারণের মাঝে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর গ্রহণযোগ্যতা তুঘলকের ভালো লাগত না। একবার তুঘলক বঙ্গ অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ শেষে দিল্লি ফিরে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি দ্রুতগতির দূতের মাধ্যমে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর কাছে পয়গাম পাঠালেন, আমার পৌঁছার আগেই আপনি অন্য কোথাও চলে যাবেন। দিল্লিতে হয় আপনি থাকবেন, নয়তো আমি থাকব। যদি আপনি শহর ত্যাগ না করেন, তাহলে পরিণাম ভালো হবে না। হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:কে ওই ধমকমিশ্রিত পয়গাম শোনানো হলে তার পবিত্র মুখ দিয়ে আপনাআপনি এই বাক্য বেরিয়ে এলো, ‘হনুয দিল্লি দূরঅস্ত’ (দিল্লি এখনো দূরে)।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বঙ্গবিজয় করে ফিরে আসছেন। এ উপলে তার অভ্যর্থনার জন্য পুরো শহরকে সাজানো হলো। শহর থেকে কিছু দূরে তুঘলকাবাদে একটি অস্থায়ী মহল নির্মাণ করা হলো, যাতে বিজয়ী সুলতান এখানে এসে কিছু সময় বিশ্রাম নেবেন। অতঃপর ফুরফুরে তরতাজা হয়ে শান-শওকত নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করবেন। তুঘলক ওই অস্থায়ী মহলে খাবার খাচ্ছেন। এ দিকে দিল্লিতে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহ:-এর মুরিদরা চিন্তা করছেন, সুলতান শহর থেকে সামান্য কয়েক মাইল দূরে রয়েছেন। যখন তিনি শহরে প্রবেশ করবেন, না জানি কী ঘটবে! ওদিকে সুলতান খাবার শেষ করে হাত ধুচ্ছিলেন। ওই সময় আকাশ থেকে বজ্রপাত হলো। সেই সাথে অস্থায়ী মহলের ছাদ দড়াম করে মাথার ওপর ভেঙে পড়ল।
সুলতান তার পাঁচজন সঙ্গীসহ মারা গেলেন। দিল্লিতে তার লাশ পৌঁছল। এরপর ‘হনুয দিল্লি দূরঅস্ত’ ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়ে গেল।”...
একই লেখায় হামিদ মীর আরো লিখলেন, “যে শহরে ওবামা ভারতকে লবডঙ্কা দেখালেন, ওই শহরে গালিব নামের এক কবিও শায়িত আছেন। তিনি বলেছিলেনÑ আমাদের জানা আছে জান্নাতের বাস্তবতা, কিন্তু গালিব মনে করেন, মনকে খুশি রাখতে এ কল্পনাও যে ভালো। ভারতীয়দের খুশি রাখতে ওবামা বারবার এমন এক কল্পনা পেশ করছেন, যার বাস্তবরূপ দেয়া বেশ কঠিন। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মধ্যে আমেরিকা ছাড়া ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন রয়েছে। আমেরিকা শুধু ভারতকে নয়, বরং জাপানকেও এ টোপ দিয়ে রেখেছে যে, সে তাকে নিরাপত্তা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ সদস্য বানাবে। জাপান ও ভারতের মাঝে একটি মিল রয়েছে। তা হচ্ছে উভয়েরই চীনের সাথে সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকা জাপান ও ভারতের সাথে যৌথভাবে চীনের নিকটবর্তী সমুদ্রে নৌমহড়াও করেছে। ওবামা ভুলে গেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যেরই ভেটো শক্তি রয়েছে।
২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আমরা ওবামার সফরের ওপর জিও নিউজ এবং ভারতের হিন্দি চ্যানেল আজতক টিভির এক যৌথ প্রোগ্রাম সূচনার আগে ইসলামাবাদের স্টুডিওতে বসে দিল্লি থেকে আজতক টিভির হেডলাইন শেষ হওয়ার অপো করছি। হঠাৎ ভারতীয় টিভির সংবাদপাঠিকার এ শব্দগুলো আমার কানে এলো, ‘ওবামাও হনুমানভক্ত। তিনি হনুমান মূর্তি সর্বদা সঙ্গেই রাখেন।’ অতঃপর আমাদের প্রোগ্রাম শুরু হলো। প্রোগ্রাম শেষ হলে আমি দিল্লিতে ফোন করে ওবামা ও হনুমান সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করি। জানা গেল, ওবামা এল কে আদভানির কন্যা প্রতিভা আদভানির সাথে সাাৎকালে বলেছেন, তিনি হনুমানকে ভক্তি করেন। তার মূর্তিও সঙ্গে রাখেন। অতঃপর ওবামা তার পকেট খোলেন এবং হনুমানের ছোট্ট একটি মূর্তি বের করে প্রতিভাকে দেখান। হনুমান হিন্দুদের রামায়ণ ও মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। হিন্দু বর্ণনা মতে, হনুমানের আকৃতি বানরের সাথে মিলে যায়। হনুমান রাম-রাবণের লড়াইয়ে রামের প নেন এবং সীতাকে লঙ্কা থেকে খুঁজে নিয়ে আসেন। ওবামা প্রতিভাকে জানান, তিনি হনুমানকে নিজের জন্য বেশ সৌভাগ্য মনে করেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি হনুমানের মূর্তি নিজের সাথে রাখছেন। ওবামার ভারত সফরের সবচেয়ে বড় খবর এটাই যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক হিন্দু ভগবানকে ভক্তি করেন। এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি যাকে ইচ্ছা ভক্তি করবেন, যাকে ইচ্ছা ভক্তি করবেন না। কিন্তু মনে রাখবেন, তার বক্তব্য ও পলিসি দ্বারা দণি এশিয়ায় যেন উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায়। তিনি তো বেশ ভালো সবক দিয়েছেন, আমেরিকা কারো বন্ধু নয়, শুধু নিজের বন্ধু।” এ লেখায় আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় ধরনের সবক রয়েছে কি না ভেবে দেখতে পারেন।
২. কয়েক দিন আগের ঘটনা। সন্ধ্যায় টিভিসেটের সামনে বসা ছিলাম। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের বিষয় নিয়ে একটি ধারাভাষ্য শুনছিলাম। হঠাৎ একটি শব্দ কানে বাজল এবং বাঁধল। ধারাভাষ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা ধরনের ইতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছিল। হঠাৎ শেষ করা হলো ‘বঙ্গবন্ধু তোমাকে প্রণাম’ বলে। আমি জানি না বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে এ ধরনের শব্দ চয়নে তিনি ব্যথিত হতেন কি না। প্রণাম একটি বিশেষ ধর্মের লোকজন শ্রদ্ধাবনত হয়ে গুরুজনদের জন্য ব্যবহার করেন। তারা সালাম বলেন না। বাঙালি মুসলমানও প্রণাম জানায় না। একটি শব্দ নিয়ে ধর্মান্ধতা বা রক্ষণশীলতা প্রকাশ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধানে সালামের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রণাম শব্দ গ্রহণ করেনি। তাই আমাদের মন ও মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে ভাষাশহীদদের সম্মানে বইমেলা। উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এক দিকে আমাদের ভাষার লড়াই, স্বাতন্ত্র্য রক্ষার আন্দোলনÑ অন্য দিকে কলকাতাইয়া শব্দের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, তাও আবার বঙ্গবন্ধুর জন্য বরাদ্দ করা কোনো সুখকর আলামত স্পষ্ট করে না।
কোকোর মৃত্যুর পরও কোনো কোনো চ্যানেলে ও পত্রিকায় মরদেহ, শেষকৃত্যসহ এমন সব শব্দ চয়ন করেছে, যা আবহমান বাংলার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শুনতে ও বলতে অভ্যস্ত নয়। লাশ বলতে আমরা অভ্যস্ত। মৃত্যুকে আমরা ইন্তেকালও বলি। জানাজাকে আমরা শেষকৃত্য বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও বলি না। মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর পরই আমরা পড়িÑ আল্লাহর কাছ থেকে আসে আল্লাহর কাছে যায়। তাও আরবিতে বলতেই আমরা অভ্যস্তÑ ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজকাল আমরা অনেক শব্দ আমদানি করছি। কলকাতা থেকে আমদানি করা কিংবা অনুসরণ করে আমাদের শব্দভাণ্ডার বাড়াচ্ছি বৈ কমাচ্ছি না, তবে শব্দের অপপ্রয়োগ বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হচ্ছে না বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের গ্রাস করছে কি না, সবাইকে ভেবে দেখতে বলি। আমরা কখনো কূপমন্ডূক হতে যাবো না কিন্তু অতি আধুনিক হতে গিয়ে অস্তিত্ব বিপন্ন হতেও দিতে পারি না।
আমরা জল-পানির যুদ্ধ করতে চাই না। পুরো ভারতে বলে পানি পিহতা হ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে জল পান করে। আমরা জলও পান করি, পানিও পান করি। বরং পান করার পরিবর্তে ‘খাই’ অশুদ্ধ শব্দ বলতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এতে আমাদের কোনো গোঁড়ামি নেই। কবরস্থানকে শ্মশান, জানাজাকে অন্য কিছু, দাফন কাফনকে অপভ্রংশ শব্দের ভাষায় বলাতে আমরা একেকারেই অনভ্যস্ত। কুলখানি, চল্লিশা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, সব দোয়া সব সময় করা যায়। দিন মেপে দোয়ার নিয়ম যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাও এসব দোয়ার অনুষ্ঠানকে প্রার্থনা সভা বলা আমাদের সাথে যায় না। তাই দয়া করে কিংবা মতলববাজি করে আমাদের ওপর কিছু আরোপ করা সমীচীন হচ্ছে না। তাতে সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাত অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে; যা আমাদের আবার একটি ভাষা আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেবে, যার রাজনৈতিক রূপটাও হবে অনাকাক্সিত।
No comments