‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ বিতর্ক প্রসঙ্গে by খন্দকার মাহবুব হোসেন
জনাব
ফরহাদ মজহারের ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ বিতর্ক শিরোনামে ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক
নয়া দিগন্তে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ওই লেখায় দেশের চলমান
রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ২৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন
মিলনায়তনে বাংলাদেশ সুশীলসমাজ কর্তৃক একটি সংগঠনের আলোচনা সভায় বিশিষ্ট
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন এবং
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। আমার ওই আলোচনা সভায়
সভাপতিত্ব করার সুযোগ হয়েছিল।
আমি জানি না, ফরহাদ মজহারের মতো একজন চিন্তাবিদ ওই প্রস্তাবের মধ্যে ‘আওয়ামী লীগের পুরনো রাজনীতির অনুরণন’ এমনকি ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ মার্কা’ জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের ইঙ্গিত কোথায় পেলেন?
দেশে বর্তমানে একটি চরম রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা এবং শঙ্কা আজ গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে। এই অবস্থায় দেশের বিবেকবান এবং চিন্তাশীল সুশীলসমাজের এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের অনেকের সাথে আলোচনা করে ড. এমাজউদ্দীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবে মূল লক্ষ্য ছিল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো ক্ষমতাসীন দলের দলীয় প্রাধান্যের বাহিরে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এবং যার ফলে আজ দেশে চরম রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তার উত্তরণে পথ বের করা। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ
‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য হবে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অর্থবহ সংস্কারের মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা।’
তাই জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের কাঠামোর মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্ভুক্তি করার ঘ্রাণ তিনি কোথা থেকে পেলেন এটা আমাদের বোধগম্য নয়।
গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারকে যখন বিদায় নিতে হয়েছিল, তখনো এ ধরনের একটি ঐকমত্যের সরকার করা হয়েছিল। যে সরকার তৎকালীন সংবিধানের কাঠামোর বাইরের সরকার ছিল। ওই ঐকমত্যের সরকারে ক্ষমতাসীন এরশাদের জাতীয় পার্টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে ওই সরকারকে সাংবিধানিকভাবে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। ওই সরকারের কার্যক্রমে দেশে শান্তি ফিরে এসেছিল এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফরহাদ মজহার জাতীয় সঙ্কট উত্তরণের ক্ষেত্রে ওই পদক্ষেপ কী করে ভুলে গেলেন।
তিনি লিখছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনো কনস্টিউটিউশনাল বৈধতার তোয়াক্কা করেননি।’ এটাই স্বাভাবিক, কেননা জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাই জনগণের ইচ্ছা এবং আকাক্সা পূরণে যেকোনো পদক্ষেপ সাংবিধানিকভাবে একসময় স্বীকৃতি লাভ করে।
তাই আজকের এই জাতীয় সঙ্কট মুহূর্তে গণ-আন্দোলনের মুখে সঙ্কট উত্তরণে যেকোনো পন্থার বৈধতা লাভের ব্যাপারে তিনি যে ‘চিন্তা’ প্রকাশ করেছেন, তার কোনো অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না।
ফরহাদ মযহার তার ওই লেখায় লিখেছেন, ‘উকিলদের উকালিতি নয়... উকিল মোক্তারের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশের প্রায় প্রকট রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এর কোনো নজির তিনি উল্লেখ করেননি। তবে হঠাৎ করে তিনি আইনজীবীদের প্রতি এমন আক্রমণাত্মক মনোভাব কেন প্রকাশ করলেন, এটা আমার বোধগম্য নয়। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে তার এই আইনজীবীরাই অনেক দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রেখেছেন।
শেষ কথা বলতে হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সঙ্কট উত্তরণের পথে জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে একসময় রাশিয়া ও চীনের চিন্তাধারা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ইতোমধ্যে নির্বাসিত হয়েছে। আমরা ওই ধরনের অতি বিপ্লবের ফাঁদে পা রাখতে নারাজ।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি
আমি জানি না, ফরহাদ মজহারের মতো একজন চিন্তাবিদ ওই প্রস্তাবের মধ্যে ‘আওয়ামী লীগের পুরনো রাজনীতির অনুরণন’ এমনকি ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ মার্কা’ জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের ইঙ্গিত কোথায় পেলেন?
দেশে বর্তমানে একটি চরম রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা এবং শঙ্কা আজ গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে। এই অবস্থায় দেশের বিবেকবান এবং চিন্তাশীল সুশীলসমাজের এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের অনেকের সাথে আলোচনা করে ড. এমাজউদ্দীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবে মূল লক্ষ্য ছিল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো ক্ষমতাসীন দলের দলীয় প্রাধান্যের বাহিরে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এবং যার ফলে আজ দেশে চরম রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তার উত্তরণে পথ বের করা। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ
‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য হবে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অর্থবহ সংস্কারের মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা।’
তাই জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের কাঠামোর মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্ভুক্তি করার ঘ্রাণ তিনি কোথা থেকে পেলেন এটা আমাদের বোধগম্য নয়।
গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারকে যখন বিদায় নিতে হয়েছিল, তখনো এ ধরনের একটি ঐকমত্যের সরকার করা হয়েছিল। যে সরকার তৎকালীন সংবিধানের কাঠামোর বাইরের সরকার ছিল। ওই ঐকমত্যের সরকারে ক্ষমতাসীন এরশাদের জাতীয় পার্টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে ওই সরকারকে সাংবিধানিকভাবে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। ওই সরকারের কার্যক্রমে দেশে শান্তি ফিরে এসেছিল এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফরহাদ মজহার জাতীয় সঙ্কট উত্তরণের ক্ষেত্রে ওই পদক্ষেপ কী করে ভুলে গেলেন।
তিনি লিখছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনো কনস্টিউটিউশনাল বৈধতার তোয়াক্কা করেননি।’ এটাই স্বাভাবিক, কেননা জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাই জনগণের ইচ্ছা এবং আকাক্সা পূরণে যেকোনো পদক্ষেপ সাংবিধানিকভাবে একসময় স্বীকৃতি লাভ করে।
তাই আজকের এই জাতীয় সঙ্কট মুহূর্তে গণ-আন্দোলনের মুখে সঙ্কট উত্তরণে যেকোনো পন্থার বৈধতা লাভের ব্যাপারে তিনি যে ‘চিন্তা’ প্রকাশ করেছেন, তার কোনো অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না।
ফরহাদ মযহার তার ওই লেখায় লিখেছেন, ‘উকিলদের উকালিতি নয়... উকিল মোক্তারের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশের প্রায় প্রকট রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এর কোনো নজির তিনি উল্লেখ করেননি। তবে হঠাৎ করে তিনি আইনজীবীদের প্রতি এমন আক্রমণাত্মক মনোভাব কেন প্রকাশ করলেন, এটা আমার বোধগম্য নয়। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে তার এই আইনজীবীরাই অনেক দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রেখেছেন।
শেষ কথা বলতে হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সঙ্কট উত্তরণের পথে জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে একসময় রাশিয়া ও চীনের চিন্তাধারা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ইতোমধ্যে নির্বাসিত হয়েছে। আমরা ওই ধরনের অতি বিপ্লবের ফাঁদে পা রাখতে নারাজ।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি
No comments