আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি by শাহদীন মালিক
৩
ফেব্রুয়ারি বেলা সোয়া ১১টা, বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের সংবাদ সম্মেলন। চিকিৎসাধীন দগ্ধ
রোগীদের অবস্থার বিবরণী। বার্ন কারও ২০ শতাংশ, কারও ৪০ শতাংশ। নাম, বয়স,
কোথা থেকে এসেছেন—এসব তথ্য। মোট চিকিৎসা নিতে এসেছেন ১১১ জন। হাসপাতালে
এখন আছেন ৬১ জন। ৩ তারিখ ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে বাসে পেট্রলবোমা
হামলায় ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন সাতজন। সেখান থেকে আরও ছয়জন আগুনে পোড়া
রোগী সকালে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন। চিকিৎসক বিভিন্ন হিসাব দিচ্ছেন। আমাদের
বীভৎসতার হিসাব। আমাদের নির্মমতার হিসাব। আর সরাসরি টিভিতে সম্প্রচার করা
হচ্ছিল এসব খতিয়ান। অধমের মতো নিশ্চিত হাজার হাজার টিভি দর্শক এ হিসাব
দেখছিলেন, শুনছিলেন।
আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। নির্মম, নির্দয়, অসুস্থ জাতি। কয়েক দিন আগে নরসিংদীর এক গ্রামের বাসিন্দারা সাতজন ডাকাতকে পিটিয়ে মেরেছে। একজন বেঁচে গেছে। পুলিশ, র্যাব, ডিবি প্রায় প্রতিদিন গুলি করে মানুষ মারছে। বিজিবিপ্রধানের আস্ফালনের পর সহসা বিজিবি যদি গুলি করে মানুষ না মারে, তাহলে তো তাদের বীরত্ব নিয়ে গুঞ্জন শুরু হবে। সবাই মানুষ মারে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমরা ক্ষমতায় থাকব, থাকবই। আমরা ওদের হটিয়ে ক্ষমতায় যাবই! এটাই এখন আমাদের ‘রাজনীতি’।
এমন যদি হতো, এক পক্ষ হঠাৎ বলে বসল, ‘আসুন, কথা বলি’। অন্য পক্ষ নির্ঘাত আঁতকে উঠত, ‘শর্ত কী?’ ‘না, কোনো শর্ত নেই। আসুন, কথা বলি।’ আমাদের রাজনীতিতে এটা হওয়ার নয়। সভ্য লোকেরা কথা বলে, আলাপ-আলোচনা করে, কথা রাখে, ছাড় দেয়। কিন্তু আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অসুস্থ মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, থাকার কথাও না। বরং প্রতিযোগিতা হচ্ছে কে কত হিংস্র কথা বলতে পারে, তা নিয়ে।
‘গুগল’-এর এক সুবিধা—সহজেই অনেক কিছু জানা যায় সেখান থেকে। সবকিছুই যেন আঙুলের ডগায়। খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধারণা, ‘রোম যখন পুড়ছিল তখন সম্রাট নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ খারাপ অর্থে নিরো এক দয়া-মায়াহীন হিংস্র শাসকের প্রতীক। গল্পে আছে, সম্রাট নিরো নিজেই আগুন লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন ব্যালকনি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। ঘটনা ঘটেছিল ৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮-১৯ জুলাই তারিখে। অবশ্য অনেকে বলেন, আগুন জ্বলেছিল চার-পাঁচ দিন ধরে। উল্টো কেচ্ছাও আছে। বলা হয়, যখন আগুন লেগেছিল তখন বা সেই দিন সম্রাট নিরো রোমেই ছিলেন না। দুদিন পর রোমে ফিরে এসে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা তদারকি করেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে সাহায্য বিতরণ করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ ইতিহাসের একটা আওয়ামী লীগ ভাষ্য, আরেকটা বিএনপি ভাষ্য। অধমের ভাষ্য আরেকটা, বাংলায় নিরোর বাঁশি বাজানোর কথা কোথা থেকে কেমনে চালু হলো? অধম ল্যাটিন ভাষা জানে না। সভ্যতার উৎপত্তি ল্যাটিন ভাষায়। তাই এখন বুঝি ছাত্রাবস্থায় এই ভাষাটি রপ্ত করা দরকার ছিল। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে—ভাষা শেখার বয়স পেরিয়ে গেছে।
ইংরেজিতে বলা হয়, নিরো ফিডল বাজাচ্ছিলেন। পরে দেখা গেল ‘ফিডল’ অর্থাৎ বেহালা গোছের সরু তারের বাদ্যযন্ত্র, যেটা মোটামুটিভাবে দশম বা একাদশ শতাব্দীর আগে আবিষ্কৃত হয়নি। তাই নিরো আর যা বাজান না কেন, ‘ফিডল’ বাজাচ্ছিলেন না। ধারণা করছি, একটা যন্ত্রতে একদিকে ফুঁ দেবেন আর অন্য দিকে সুরেলা আওয়াজ বের হবে এমন যন্ত্র। অর্থাৎ বাঁশি। দুই হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত, যা ব্যবহৃত হতো না। আগুনে সম্রাট নিরোর একটা প্রধান প্রাসাদ পুড়ে গিয়েছিল। যাহোক, যতটা রটে, তত না, নিশ্চয় না; আবার একদমও যা, তা–ও না।
লেখার মাঝখানে এক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা কিছু কাগজ নিয়ে এল। দেখে, সই করার জন্য। ‘স্যার, প্রতিদিন সকালে বাসে অথবা ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসি। জানি না আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে পারব, নাকি আত্মীয়স্বজনদের আমার পোড়া শরীর দেখতে ঢাকা মেডিকেলে আসতে হবে। চাকরি তো করতে হবে, সকাল-বিকেল তাই ঝুঁকি নিতে হবে?’
তরুণ কর্মকর্তাটি দুই নেত্রী সম্পর্কে তারপর যা মন্তব্য করল, সেটা লিখে সবাই মিলে জেলে যাওয়ার খায়েশ নেই। সে কথাগুলো বলে ফেলেছিল বেফাঁস। নিজেই মাফ চাইল তার অতি কড়া মন্তব্যের জন্য। বুঝলাম, যুক্তিতাড়িত নয়, অনুভূতিতাড়িত মন্তব্য। এটাও অসুস্থতার লক্ষণ। সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
মানুষ যখন ভেঙে পড়ছে, তখন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে বাধ্য। হচ্ছেও তা-ই। অধমের ধারণা, পুলিশের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের দেশের চল্লিশোর্ধ্ব বছরের মধ্যে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা যত কমে, তার কর্তাব্যক্তিদের হাঁকডাক, লম্ফঝম্ফ তত বাড়ে। তা-ই হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে, পুলিশের প্রধান কাজ হচ্ছে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া, গড়ে ৫০টির কম মামলা নিশ্চয় কোনো বড় মাপের বিএনপির নেতার বিরুদ্ধে নেই। কম থাকলেও অচিরেই পুলিশ সেটা নিশ্চয় পূরণ করবে। অর্থাৎ মামলার সংখ্যা জনপ্রতি ৫০ পার করে দেবে।
আর আদালত নির্বিচারে সব মামলা গ্রহণ করছেন, রিমান্ড দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশে এ গোছের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরাট বিরাট অংশকে বিলুপ্ত করতে হয়েছে। এই গত সপ্তাহেই আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিনা কির্চনার তাঁর দেশের এসআইউই নামে পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থার বিলুপ্তি ও নতুন আইন করে নতুন গোয়েন্দা সংস্থা তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন।
অসুখ অল্প-বিস্তর হলে চিকিৎসা দিয়ে সেরে ওঠা যায়। অনেক দিন চিকিৎসা না করলে বা অবহেলা করলে সাধারণ রোগবালাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে বা হয়েই যায়। অবস্থা এভাবে চললে আমরা সবাই ভীষণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ব।
সরকারকে বুঝতে হবে যে ২০১৪-এর নির্বাচনের ওপর ভর করে পাঁচ বছর সরকার চালানো যাবে না। চালাতে গেলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। ২০ দলকেও বুঝতে হবে যে পেট্রলবোমা, তা আপনারা মারেন বা না মারেন, (নিরোর মতো) তা দিয়ে আপনাদের জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে না, আর এর মাধ্যমে সরকার উৎখাত করা অসম্ভব। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থেকেই তাঁর সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনই এখন একমাত্র পথ। অন্য পথও হয়তো আছে। অধম এই মুহূর্তে তার হদিস পাচ্ছে না।
মধ্যবর্তী নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকারের কলেবর অবশ্যই ছোট হতে হবে, তাতে দু-চারজন মন্ত্রী থাকবেন বিএনপির পছন্দ অনুযায়ী। বিএনপি হয়তো চাইবে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন। দেনদরবার হতে পারে। দেনদরবার হতে হবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে। নির্বাচন কমিশনকে ভালো গ্রহণযোগ্য অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য কী কী করতে হবে, কাকে দিয়ে করতে হবে, সে অভিজ্ঞতা জাতির আছে। তাই কাজটা কঠিন হবে না।
উভয় পক্ষের রাজনীতিবিদেরা ভাবছেন, তাঁরা ঠিক করছেন। তাঁরা ভুল ভাবছেন। তবে যিনি সরকার চালান, দায়িত্বটা তাঁর বেশি। দেশ এমনভাবে চালাবেন না, যাতে পুরো জাতি দীর্ঘস্থায়ী রোগবালাইেয় আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত আমরা সবাই হয়ে গেছি। তবে ওষুধ পেলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারব।
অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করতে পারবেন না। শক্তি প্রয়োগ না করে বিকল্প ব্যবস্থায় দেশের সমস্যা সমাধান করতে পারেন কেবল সত্যিকারের নেতারা। আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশে এখন সত্যিকার নেতার বড়ই অভাব। আছে বিস্তর ক্ষমতাধর এবং ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ। তাঁদের খপ্পরে পড়ে আমরা ক্রমান্বয়ে একটা অসুস্থ জাতিতে পরিণতি হচ্ছি, অচিরে যাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিরাপত্তা থাকবে না।
সুস্থতার আশা তো আর ছাড়া যায় না। মধ্যবর্তী নির্বাচনই এখন একমাত্র ট্রিটমেন্ট। হয়তোবা।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।
আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। নির্মম, নির্দয়, অসুস্থ জাতি। কয়েক দিন আগে নরসিংদীর এক গ্রামের বাসিন্দারা সাতজন ডাকাতকে পিটিয়ে মেরেছে। একজন বেঁচে গেছে। পুলিশ, র্যাব, ডিবি প্রায় প্রতিদিন গুলি করে মানুষ মারছে। বিজিবিপ্রধানের আস্ফালনের পর সহসা বিজিবি যদি গুলি করে মানুষ না মারে, তাহলে তো তাদের বীরত্ব নিয়ে গুঞ্জন শুরু হবে। সবাই মানুষ মারে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমরা ক্ষমতায় থাকব, থাকবই। আমরা ওদের হটিয়ে ক্ষমতায় যাবই! এটাই এখন আমাদের ‘রাজনীতি’।
এমন যদি হতো, এক পক্ষ হঠাৎ বলে বসল, ‘আসুন, কথা বলি’। অন্য পক্ষ নির্ঘাত আঁতকে উঠত, ‘শর্ত কী?’ ‘না, কোনো শর্ত নেই। আসুন, কথা বলি।’ আমাদের রাজনীতিতে এটা হওয়ার নয়। সভ্য লোকেরা কথা বলে, আলাপ-আলোচনা করে, কথা রাখে, ছাড় দেয়। কিন্তু আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অসুস্থ মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, থাকার কথাও না। বরং প্রতিযোগিতা হচ্ছে কে কত হিংস্র কথা বলতে পারে, তা নিয়ে।
‘গুগল’-এর এক সুবিধা—সহজেই অনেক কিছু জানা যায় সেখান থেকে। সবকিছুই যেন আঙুলের ডগায়। খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধারণা, ‘রোম যখন পুড়ছিল তখন সম্রাট নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ খারাপ অর্থে নিরো এক দয়া-মায়াহীন হিংস্র শাসকের প্রতীক। গল্পে আছে, সম্রাট নিরো নিজেই আগুন লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন ব্যালকনি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। ঘটনা ঘটেছিল ৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮-১৯ জুলাই তারিখে। অবশ্য অনেকে বলেন, আগুন জ্বলেছিল চার-পাঁচ দিন ধরে। উল্টো কেচ্ছাও আছে। বলা হয়, যখন আগুন লেগেছিল তখন বা সেই দিন সম্রাট নিরো রোমেই ছিলেন না। দুদিন পর রোমে ফিরে এসে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা তদারকি করেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে সাহায্য বিতরণ করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ ইতিহাসের একটা আওয়ামী লীগ ভাষ্য, আরেকটা বিএনপি ভাষ্য। অধমের ভাষ্য আরেকটা, বাংলায় নিরোর বাঁশি বাজানোর কথা কোথা থেকে কেমনে চালু হলো? অধম ল্যাটিন ভাষা জানে না। সভ্যতার উৎপত্তি ল্যাটিন ভাষায়। তাই এখন বুঝি ছাত্রাবস্থায় এই ভাষাটি রপ্ত করা দরকার ছিল। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে—ভাষা শেখার বয়স পেরিয়ে গেছে।
ইংরেজিতে বলা হয়, নিরো ফিডল বাজাচ্ছিলেন। পরে দেখা গেল ‘ফিডল’ অর্থাৎ বেহালা গোছের সরু তারের বাদ্যযন্ত্র, যেটা মোটামুটিভাবে দশম বা একাদশ শতাব্দীর আগে আবিষ্কৃত হয়নি। তাই নিরো আর যা বাজান না কেন, ‘ফিডল’ বাজাচ্ছিলেন না। ধারণা করছি, একটা যন্ত্রতে একদিকে ফুঁ দেবেন আর অন্য দিকে সুরেলা আওয়াজ বের হবে এমন যন্ত্র। অর্থাৎ বাঁশি। দুই হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত, যা ব্যবহৃত হতো না। আগুনে সম্রাট নিরোর একটা প্রধান প্রাসাদ পুড়ে গিয়েছিল। যাহোক, যতটা রটে, তত না, নিশ্চয় না; আবার একদমও যা, তা–ও না।
লেখার মাঝখানে এক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা কিছু কাগজ নিয়ে এল। দেখে, সই করার জন্য। ‘স্যার, প্রতিদিন সকালে বাসে অথবা ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসি। জানি না আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে পারব, নাকি আত্মীয়স্বজনদের আমার পোড়া শরীর দেখতে ঢাকা মেডিকেলে আসতে হবে। চাকরি তো করতে হবে, সকাল-বিকেল তাই ঝুঁকি নিতে হবে?’
তরুণ কর্মকর্তাটি দুই নেত্রী সম্পর্কে তারপর যা মন্তব্য করল, সেটা লিখে সবাই মিলে জেলে যাওয়ার খায়েশ নেই। সে কথাগুলো বলে ফেলেছিল বেফাঁস। নিজেই মাফ চাইল তার অতি কড়া মন্তব্যের জন্য। বুঝলাম, যুক্তিতাড়িত নয়, অনুভূতিতাড়িত মন্তব্য। এটাও অসুস্থতার লক্ষণ। সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
মানুষ যখন ভেঙে পড়ছে, তখন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে বাধ্য। হচ্ছেও তা-ই। অধমের ধারণা, পুলিশের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের দেশের চল্লিশোর্ধ্ব বছরের মধ্যে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা যত কমে, তার কর্তাব্যক্তিদের হাঁকডাক, লম্ফঝম্ফ তত বাড়ে। তা-ই হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে, পুলিশের প্রধান কাজ হচ্ছে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া, গড়ে ৫০টির কম মামলা নিশ্চয় কোনো বড় মাপের বিএনপির নেতার বিরুদ্ধে নেই। কম থাকলেও অচিরেই পুলিশ সেটা নিশ্চয় পূরণ করবে। অর্থাৎ মামলার সংখ্যা জনপ্রতি ৫০ পার করে দেবে।
আর আদালত নির্বিচারে সব মামলা গ্রহণ করছেন, রিমান্ড দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশে এ গোছের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরাট বিরাট অংশকে বিলুপ্ত করতে হয়েছে। এই গত সপ্তাহেই আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিনা কির্চনার তাঁর দেশের এসআইউই নামে পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থার বিলুপ্তি ও নতুন আইন করে নতুন গোয়েন্দা সংস্থা তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন।
অসুখ অল্প-বিস্তর হলে চিকিৎসা দিয়ে সেরে ওঠা যায়। অনেক দিন চিকিৎসা না করলে বা অবহেলা করলে সাধারণ রোগবালাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে বা হয়েই যায়। অবস্থা এভাবে চললে আমরা সবাই ভীষণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ব।
সরকারকে বুঝতে হবে যে ২০১৪-এর নির্বাচনের ওপর ভর করে পাঁচ বছর সরকার চালানো যাবে না। চালাতে গেলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। ২০ দলকেও বুঝতে হবে যে পেট্রলবোমা, তা আপনারা মারেন বা না মারেন, (নিরোর মতো) তা দিয়ে আপনাদের জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে না, আর এর মাধ্যমে সরকার উৎখাত করা অসম্ভব। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থেকেই তাঁর সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনই এখন একমাত্র পথ। অন্য পথও হয়তো আছে। অধম এই মুহূর্তে তার হদিস পাচ্ছে না।
মধ্যবর্তী নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকারের কলেবর অবশ্যই ছোট হতে হবে, তাতে দু-চারজন মন্ত্রী থাকবেন বিএনপির পছন্দ অনুযায়ী। বিএনপি হয়তো চাইবে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন। দেনদরবার হতে পারে। দেনদরবার হতে হবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে। নির্বাচন কমিশনকে ভালো গ্রহণযোগ্য অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য কী কী করতে হবে, কাকে দিয়ে করতে হবে, সে অভিজ্ঞতা জাতির আছে। তাই কাজটা কঠিন হবে না।
উভয় পক্ষের রাজনীতিবিদেরা ভাবছেন, তাঁরা ঠিক করছেন। তাঁরা ভুল ভাবছেন। তবে যিনি সরকার চালান, দায়িত্বটা তাঁর বেশি। দেশ এমনভাবে চালাবেন না, যাতে পুরো জাতি দীর্ঘস্থায়ী রোগবালাইেয় আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত আমরা সবাই হয়ে গেছি। তবে ওষুধ পেলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারব।
অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করতে পারবেন না। শক্তি প্রয়োগ না করে বিকল্প ব্যবস্থায় দেশের সমস্যা সমাধান করতে পারেন কেবল সত্যিকারের নেতারা। আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশে এখন সত্যিকার নেতার বড়ই অভাব। আছে বিস্তর ক্ষমতাধর এবং ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ। তাঁদের খপ্পরে পড়ে আমরা ক্রমান্বয়ে একটা অসুস্থ জাতিতে পরিণতি হচ্ছি, অচিরে যাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিরাপত্তা থাকবে না।
সুস্থতার আশা তো আর ছাড়া যায় না। মধ্যবর্তী নির্বাচনই এখন একমাত্র ট্রিটমেন্ট। হয়তোবা।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments