রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি অভিন্ন? by মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ খন্দকার
অর্থনীতির জন্য স্থিতিশীল ও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থাকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘ফ্রড’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জাতীয় সংসদে এক সংসদ সদস্যের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ইসলামি ব্যাংকিং প্রথম থেকেই আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা একান্তই একটা ফ্রড এবং সেভাবেই এটাকে সব সময় বিবেচনা করেছি।... ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। রিবা এবং বর্তমান সুদ এক জিনিস নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি সুদ। রিবার মধ্যে কোনো ধরনের মানবিক চিন্তাধারা নেই। কিন্তু সুদ মানবিক চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুদ হলো কস্ট অব ফান্ড এবং কস্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কিন্তু রিবাতে সেটা ছিল না। যারা ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলেন তারা সুদ ও রিবাকে এক করে ফেলেন। এটা একান্তই ভুল এবং এই ভুলের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামি ব্যাংকিং হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে তিনটি প্রশ্ন উঠে আসে। এগুলো হলো- ক. ইসলামি ব্যাংকিং কি ফ্রড বা প্রতারণা? খ. আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস? গ. সুদ কি মানবিক চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
ক. ইসলামি ব্যাংকিং কি ফ্রড?
অর্থমন্ত্রীর এই অভিমত বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। ইসলামি ব্যাংক কী কারণে ফ্রড তা তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট নয়। যদি ধরে নেয়া হয় তার এ মন্তব্যের অর্থ হলো, ইসলামি ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ স্বচ্ছ নয়। তাহলে আমরা বাস্তবে দেখি তার উল্টো অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রুলস-রেগুলেশন্স, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং স্ট্যান্ডার্ডÑ ব্যাসেল-২ ও মানি লন্ডারিং আইনসহ দেশী ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন পরিপালনে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকগুলো অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক থেকে এগিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বহু সুদভিত্তিক বিভিন্ন ব্যাংক যখন ঋণদানে অনিয়ম ও দুর্র্নীতিতে জড়িয়ে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, তখন ইসলামি ব্যাংকগুলো এ েেত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামি ব্যাংকগুলোর অবদান খ্যাতিমান সবার কাছেই স্বীকৃত। অন্য দিকে ইসলামি ব্যাংকগুলো সুদের বিকল্প হিসেবে লাভ-লোকসানে অংশীদারি পদ্ধতি, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা বা ভাড়া ইত্যাদি শরিয়াহ-সম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসায় পরিচালনা করে। তারা কোনোভাবেই ইসলামের নামে সুদের ব্যবসায় করে না। তাই এ েেত্রও ইসলামি ব্যাংকিংকে ‘ফ্রড’ বলা সমীচীন নয় বলেই মনে হয়।
খ. আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস?
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আরো একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। তা হলো, আল কুরআনের রিবা আর প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ এক নয়। সম্ভবত তিনি আল কুরআনে উল্লেখিত রিবাকে নিষিদ্ধ বললেও ব্যাংকিং সুদকে বৈধ মনে করেন এবং ব্যাংকিং সুদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলেই তার ধারণা। প্রকৃতপে আল কুরআনের রিবা এবং ব্যাংকিং সুদ একই জিনিস এবং উভয়ই অর্থনীতির জন্য তিকর।
‘সুদ’ শব্দটি এসেছে ফার্সি থেকে, যেটি উর্দুতেও ব্যবহার হয়। পবিত্র কুরআনে ‘রিবা’ শব্দ দিয়ে এটি ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রিবার অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দ না থাকায় এর অনুবাদ করা হয় ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে। প্রকৃতপে রিবা শব্দটি আরো ব্যাপক অর্থবোধক। আর প্রচলিত সুদ সেই ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (usury) বা ইন্টারেস্ট (interest)।
আল কুরআনে ব্যবহৃত ‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদ্ভূত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্বনির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয় তাই রিবা বা সুদ। আবার একই শ্রেণিভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয় তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়। সুদ প্রধানত দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো রিবা আন নাসিয়াহ বা মেয়াদি সুদ। আরবি ‘নাসিয়াহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীা। রিবা নাসিয়াহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ। যেমনÑ কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবা বলা হবে। আল কুরআনে উল্লেখিত এ রিবাকেই রিবা আন নাসিয়াহ বা রিবা আল কুরআন বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার রিবা হলো রিবা আল ফদল। আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবা আল ফদল। অর্থাৎ, একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে একপ আরেক পরে কাছ থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়াহসম্মত বিনিময় ছাড়া যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবা আল ফদল বলে। যেমনÑ এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দেড় কেজি নিন্মমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবা আল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়।
আল কুরআনে রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর হাদিসে সুদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রাথমিক যুগের মুফাসসিরগণ রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন। প্রখ্যাত মুফাসসির জারির ইবনে আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নি¤েœ বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘জাহেলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এত এত পরিমাণ বেশি দেবো, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।’ এ ছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছে, ‘যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তাই রিবা বা সুদ।’ হাদিসে আরো বলা হয়েছে, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। বেশকম করলে বা বাকিতে করলে তা সুদি কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী হবে।’ ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার বিখ্যাত তাফসির আহকামুল কুরআনে রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন : ‘জাহেলিয়াতের সময় সুদ ছিল, কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের ওপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।’ ইমাম ফখরউদ্দিন আল রাজি জাহেলি যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জাহেলিয়াতের যুগে রিবা আন-নাসিয়া ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থ ঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু আসল ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।’
ওপরে রিবার যে সংজ্ঞা পেশ করা হয়েছে তার সাথে বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক সুদের কোনো পার্থক্য নেই। কেউ কেউ বলেন, পবিত্র কুরআনে কেবল ভোগ্যঋণের সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু বাণিজ্যিক ঋণের সুদ নিষিদ্ধ নয়। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, বাণিজ্যিক ঋণ নেয় ধনীরা এবং এ ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। তাই ভোগ্যঋণ দিয়ে সুদ আদায়ের েেত্র যে বেইনসাফি ও অমানবিকতা রয়েছে তা উৎপাদনশীল বাণিজ্যিক ঋণের েেত্র নেই। সুতরাং বাণিজ্যিক সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তাদের এ বক্তব্য মোটেও সঠিক নয়। কেননা, পবিত্র কুরআনে সুদ সম্পর্কে যেসব আয়াত এসেছে, সেখানে সুদের কোনো শ্রেণিবিভাগ করা হয়নি। ফলে সব ধরনের সুদই হারাম। ব্যাংকিং সুদ, ভোগ্যঋণের সুদ ও বিনিয়োগ সুদ বা ব্যবসার জন্য গৃহীত ঋণের সুদের মধ্যে পার্থক্য করার বিষয়টি একটি নতুন ধারণা। এ ধারণার প্রবর্তকদের মতে, শুধু ভোগ্যঋণের সুদ হারাম আর ব্যাংকিং সুদ বা বিনিয়োগ সুদ হালাল। তাদের এ ধারণা উম্মাহর সব আলেম ও ফকিহদের মতামত থেকে ভিন্ন। তাদের মতের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর সমর্থন নেই। কেননা, মহান আল্লাহ সব ধরনের সুদ হারাম করেছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের চূড়ান্ত ঘোষণা, ‘আল্লাহ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’
ব্যাংকিং সুদ বৈধ করার প্রবক্তারা বলেন, রাসূল সা:-এর যুগে ব্যাংক ছিল না, এটি খ্রিষ্টীয় ১৭ শতকের উদ্ভাবনÑ তাদের এ ধারণা ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের ২০০০ বছর আগেও ব্যাংকিং লেনদেন চালু ছিল। এনসাইকোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে ব্যাংক-ব্যবস্থার গোড়ার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, “ব্যাবিলনবাসীরা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দেই ব্যাংক-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তবে এর পেছনে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিপুল সম্পদের অধিকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আনুষঙ্গিক কাজ হিসেবেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। ...খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭৫ অব্দ পর্যন্ত ব্যাবিলনে ‘দি ইজিবি ব্যাংক অব ব্যাবিলন’ নামে একটি ব্যাংক ছিল।’’ এই ব্যাংকের রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায়, ব্যাংকটি গ্রাহকদের ক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করত, ফসলের ওপর ঋণ দিত এবং ঋণের নিশ্চয়তাস্বরূপ েেতর ফসল জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। এ ছাড়াও ব্যাংকটি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস জামানত হিসেবে জমা রেখে ঋণ দিত এবং সুদের বিনিময়ে আমানত গ্রহণ করত।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর আগমনের অতি নিকটবর্তী সময়েও বাইজেন্টাইন সম্রাট শাসিত সিরিয়ায় সব ধরনের শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষি খাতে সুদভিত্তিক ঋণের প্রচলন ছিল। সে সময় সুদভিত্তিক ঋণের এতই ব্যাপকতা ছিল যে, সম্রাটকে সুদের হার নির্ধারণপূর্বক আইন জারি করতে হতো। সে সময় সিরিয়ার সাথে আরববাসী, বিশেষ করে মক্কার অধিবাসীদের সুদীর্ঘ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এ বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে আরববাসীরাও বাণিজ্যিক সুদ সম্পর্কে ছিল পূর্ণ সচেতন। এ ছাড়া তৎকালীন আরববাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, সে সময় যেমন ভোগ্যঋণের প্রচলন ছিল, তেমনি বাণিজ্যিক ঋণেরও প্রচলন ছিল। ড. জাওয়াদ আলী জাহেলি যুগের আরবদের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ‘সে সময় সবাই মিলে মুনাফার আশায় বাণিজ্য কাফেলাকে ঋণ দিত।’ ইবনে জারির আত-তাবারি লিখেছেন, বনু আমর গোত্র বনু আল-মুগিরা গোত্রের কাছ থেকে সুদ আদায় করত। ইমাম বুখারি একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। সেখানে দেখা যায়, এক ইসরাইলি অন্য এক ব্যক্তির কাছ থেকে এক হাজার দিরহাম ঋণ নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ঋণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময় যেমন প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক ঋণের প্রচলন ছিল, তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও বাণিজ্যিক ঋণের প্রচলন ছিল। এ বিষয়ে কুরআন-হাদিস ও ইতিহাসে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। ফলে কুরআন নাজিলের সমসাময়িককালে আরববাসীদের কাছে বাণিজ্যিক সুদের ধারণা সুস্পষ্ট ছিল। তাই এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, কুরআন যে সুদ নিষিদ্ধ করেছে তা কেবল ভোগ্যঋণের সুদ, বাণিজ্যিক বা ব্যাংকিং সুদ নয়। প্রকৃতপে সর্বপ্রকার সুদই ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধু ইসলাম নয়; বরং হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধসহ বহু ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ। এমনকি বহু দার্শনিক যেমন প্লেটো, অ্যারিস্টটল, থমাস একুইনো ও মিসাব্যুর মতো দার্শনিকেরা সুদকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গ. সুদ কি মানবিক চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
সুদ মানবিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং এটির জন্মই হয়েছে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। এটির অপকারিতা শুধ ধর্মেই বর্ণিত নয়, বরং আধুনিক অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতেও সুদের কোনো শুভ ফল নেই। অর্থনৈতিক মন্দা, আয়বৈষম্য ও বেকারত্ব সৃষ্টির েেত্র সুদের প্রভাব স্পষ্ট। এ েেত্র লর্ড কিনসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যায় এবং সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বেড়ে যায়। তিনি দেখিয়েছেন, সুদের হার শূন্য হলেই কেবল পূর্ণ বিনিয়োগ সম্ভব হয় এবং দেশের বস্তুগত ও মানবীয় সম্পদের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়াও সুদের আর্থসামাজিক নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। এ ুদ্র পরিসরে তা আলোচনা করার অবকাশ নেই।
পরিশেষে বলা যায়, আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত সুদ কোনোটির মধ্যেই মানবতার জন্য কোনো কল্যাণ নেই এবং উভয়ের অনিবার্য পরিণতি হলো অর্থনৈতিক মন্দা ও আর্থিক অস্থিতিশীলতা। এ থেকে বাঁচার জন্যই কল্যাণধর্মী ইসলামি ব্যাংক-ব্যবস্থার প্রসার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এটি কোনো নতুন ব্যাংকিং দর্শনও নয়; বরং ইসলামি ব্যাংকিংয়ে জমাগ্রহণ নীতির েেত্র বিশিষ্ট সাহাবি হজরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম রা:-এর দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বহু লোক তার কাছে অর্থকড়ি জমা রাখত এবং প্রয়োজনের সময় আংশিক বা সম্পূর্ণই ফেরত নিয়ে যেত। তিনি জনসাধারণের অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ না করে করদ হিসেবে নিতেন। এ সম্পর্কে সহি আল বুখারিতে উল্লেখ রয়েছে, কেউ হজরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম রা:-এর কাছে অর্থকড়ি আমানত হিসেবে রাখার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেন, ‘না, এভাবে নয়; বরং তুমি তা আমার কাছে ঋণ হিসেবে রেখে যাও।’ আব্বাসীয় খলিফা আল মুক্তাদিরের (৯০৮-৯৩২ খ্রি:) আমলে মুসলমানেরা আধুনিক ব্যাংক-ব্যবস্থার বেশির ভাগ মৌলিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এ সময় তারা মুসলিম বিশ্বের সমস্ত সঞ্চিত অর্থকে একত্র করে মূলধন গঠনে সম হয়। দেশ-বিদেশে ব্যবসায় পরিচালনায় সুদমুক্তভাবে অর্থ জোগান দিতেও সম হয়। এ প্রক্রিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে নানাবিধ রাজনৈতিক কারণে মুসলমানেরা তাদের অর্থনৈতিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। এ সময় পশ্চিমা শক্তি মুসলিম বিশ্বের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে ইসলামি ব্যাংক-ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানেরা তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের েেত্র কিছুটা হলেও সফলতা লাভ করেছে। এই মানবদরদি, কল্যাণধর্মী ও সুদমুক্ত ইসলামি ব্যাংক-ব্যবস্থার উন্নয়নে দরদি মনোভাব নিয়ে সবার এগিয়ে আসা কর্তব্য।
লেখক : ইসলামি শরিয়াহ গবেষক
rahmatullah1066@gmail.com
অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে তিনটি প্রশ্ন উঠে আসে। এগুলো হলো- ক. ইসলামি ব্যাংকিং কি ফ্রড বা প্রতারণা? খ. আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস? গ. সুদ কি মানবিক চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
ক. ইসলামি ব্যাংকিং কি ফ্রড?
অর্থমন্ত্রীর এই অভিমত বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। ইসলামি ব্যাংক কী কারণে ফ্রড তা তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট নয়। যদি ধরে নেয়া হয় তার এ মন্তব্যের অর্থ হলো, ইসলামি ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ স্বচ্ছ নয়। তাহলে আমরা বাস্তবে দেখি তার উল্টো অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রুলস-রেগুলেশন্স, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং স্ট্যান্ডার্ডÑ ব্যাসেল-২ ও মানি লন্ডারিং আইনসহ দেশী ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন পরিপালনে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকগুলো অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক থেকে এগিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বহু সুদভিত্তিক বিভিন্ন ব্যাংক যখন ঋণদানে অনিয়ম ও দুর্র্নীতিতে জড়িয়ে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, তখন ইসলামি ব্যাংকগুলো এ েেত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামি ব্যাংকগুলোর অবদান খ্যাতিমান সবার কাছেই স্বীকৃত। অন্য দিকে ইসলামি ব্যাংকগুলো সুদের বিকল্প হিসেবে লাভ-লোকসানে অংশীদারি পদ্ধতি, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা বা ভাড়া ইত্যাদি শরিয়াহ-সম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসায় পরিচালনা করে। তারা কোনোভাবেই ইসলামের নামে সুদের ব্যবসায় করে না। তাই এ েেত্রও ইসলামি ব্যাংকিংকে ‘ফ্রড’ বলা সমীচীন নয় বলেই মনে হয়।
খ. আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস?
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আরো একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। তা হলো, আল কুরআনের রিবা আর প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ এক নয়। সম্ভবত তিনি আল কুরআনে উল্লেখিত রিবাকে নিষিদ্ধ বললেও ব্যাংকিং সুদকে বৈধ মনে করেন এবং ব্যাংকিং সুদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলেই তার ধারণা। প্রকৃতপে আল কুরআনের রিবা এবং ব্যাংকিং সুদ একই জিনিস এবং উভয়ই অর্থনীতির জন্য তিকর।
‘সুদ’ শব্দটি এসেছে ফার্সি থেকে, যেটি উর্দুতেও ব্যবহার হয়। পবিত্র কুরআনে ‘রিবা’ শব্দ দিয়ে এটি ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রিবার অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দ না থাকায় এর অনুবাদ করা হয় ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে। প্রকৃতপে রিবা শব্দটি আরো ব্যাপক অর্থবোধক। আর প্রচলিত সুদ সেই ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (usury) বা ইন্টারেস্ট (interest)।
আল কুরআনে ব্যবহৃত ‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদ্ভূত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্বনির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয় তাই রিবা বা সুদ। আবার একই শ্রেণিভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয় তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়। সুদ প্রধানত দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো রিবা আন নাসিয়াহ বা মেয়াদি সুদ। আরবি ‘নাসিয়াহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীা। রিবা নাসিয়াহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ। যেমনÑ কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবা বলা হবে। আল কুরআনে উল্লেখিত এ রিবাকেই রিবা আন নাসিয়াহ বা রিবা আল কুরআন বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার রিবা হলো রিবা আল ফদল। আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবা আল ফদল। অর্থাৎ, একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে একপ আরেক পরে কাছ থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়াহসম্মত বিনিময় ছাড়া যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবা আল ফদল বলে। যেমনÑ এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দেড় কেজি নিন্মমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবা আল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়।
আল কুরআনে রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর হাদিসে সুদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রাথমিক যুগের মুফাসসিরগণ রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন। প্রখ্যাত মুফাসসির জারির ইবনে আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নি¤েœ বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘জাহেলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এত এত পরিমাণ বেশি দেবো, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।’ এ ছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছে, ‘যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তাই রিবা বা সুদ।’ হাদিসে আরো বলা হয়েছে, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। বেশকম করলে বা বাকিতে করলে তা সুদি কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী হবে।’ ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার বিখ্যাত তাফসির আহকামুল কুরআনে রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন : ‘জাহেলিয়াতের সময় সুদ ছিল, কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের ওপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।’ ইমাম ফখরউদ্দিন আল রাজি জাহেলি যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জাহেলিয়াতের যুগে রিবা আন-নাসিয়া ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থ ঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু আসল ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।’
ওপরে রিবার যে সংজ্ঞা পেশ করা হয়েছে তার সাথে বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক সুদের কোনো পার্থক্য নেই। কেউ কেউ বলেন, পবিত্র কুরআনে কেবল ভোগ্যঋণের সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু বাণিজ্যিক ঋণের সুদ নিষিদ্ধ নয়। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, বাণিজ্যিক ঋণ নেয় ধনীরা এবং এ ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। তাই ভোগ্যঋণ দিয়ে সুদ আদায়ের েেত্র যে বেইনসাফি ও অমানবিকতা রয়েছে তা উৎপাদনশীল বাণিজ্যিক ঋণের েেত্র নেই। সুতরাং বাণিজ্যিক সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তাদের এ বক্তব্য মোটেও সঠিক নয়। কেননা, পবিত্র কুরআনে সুদ সম্পর্কে যেসব আয়াত এসেছে, সেখানে সুদের কোনো শ্রেণিবিভাগ করা হয়নি। ফলে সব ধরনের সুদই হারাম। ব্যাংকিং সুদ, ভোগ্যঋণের সুদ ও বিনিয়োগ সুদ বা ব্যবসার জন্য গৃহীত ঋণের সুদের মধ্যে পার্থক্য করার বিষয়টি একটি নতুন ধারণা। এ ধারণার প্রবর্তকদের মতে, শুধু ভোগ্যঋণের সুদ হারাম আর ব্যাংকিং সুদ বা বিনিয়োগ সুদ হালাল। তাদের এ ধারণা উম্মাহর সব আলেম ও ফকিহদের মতামত থেকে ভিন্ন। তাদের মতের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর সমর্থন নেই। কেননা, মহান আল্লাহ সব ধরনের সুদ হারাম করেছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের চূড়ান্ত ঘোষণা, ‘আল্লাহ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’
ব্যাংকিং সুদ বৈধ করার প্রবক্তারা বলেন, রাসূল সা:-এর যুগে ব্যাংক ছিল না, এটি খ্রিষ্টীয় ১৭ শতকের উদ্ভাবনÑ তাদের এ ধারণা ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের ২০০০ বছর আগেও ব্যাংকিং লেনদেন চালু ছিল। এনসাইকোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে ব্যাংক-ব্যবস্থার গোড়ার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, “ব্যাবিলনবাসীরা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দেই ব্যাংক-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তবে এর পেছনে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিপুল সম্পদের অধিকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আনুষঙ্গিক কাজ হিসেবেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। ...খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭৫ অব্দ পর্যন্ত ব্যাবিলনে ‘দি ইজিবি ব্যাংক অব ব্যাবিলন’ নামে একটি ব্যাংক ছিল।’’ এই ব্যাংকের রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায়, ব্যাংকটি গ্রাহকদের ক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করত, ফসলের ওপর ঋণ দিত এবং ঋণের নিশ্চয়তাস্বরূপ েেতর ফসল জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। এ ছাড়াও ব্যাংকটি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস জামানত হিসেবে জমা রেখে ঋণ দিত এবং সুদের বিনিময়ে আমানত গ্রহণ করত।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর আগমনের অতি নিকটবর্তী সময়েও বাইজেন্টাইন সম্রাট শাসিত সিরিয়ায় সব ধরনের শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষি খাতে সুদভিত্তিক ঋণের প্রচলন ছিল। সে সময় সুদভিত্তিক ঋণের এতই ব্যাপকতা ছিল যে, সম্রাটকে সুদের হার নির্ধারণপূর্বক আইন জারি করতে হতো। সে সময় সিরিয়ার সাথে আরববাসী, বিশেষ করে মক্কার অধিবাসীদের সুদীর্ঘ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এ বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে আরববাসীরাও বাণিজ্যিক সুদ সম্পর্কে ছিল পূর্ণ সচেতন। এ ছাড়া তৎকালীন আরববাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, সে সময় যেমন ভোগ্যঋণের প্রচলন ছিল, তেমনি বাণিজ্যিক ঋণেরও প্রচলন ছিল। ড. জাওয়াদ আলী জাহেলি যুগের আরবদের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ‘সে সময় সবাই মিলে মুনাফার আশায় বাণিজ্য কাফেলাকে ঋণ দিত।’ ইবনে জারির আত-তাবারি লিখেছেন, বনু আমর গোত্র বনু আল-মুগিরা গোত্রের কাছ থেকে সুদ আদায় করত। ইমাম বুখারি একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। সেখানে দেখা যায়, এক ইসরাইলি অন্য এক ব্যক্তির কাছ থেকে এক হাজার দিরহাম ঋণ নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ঋণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময় যেমন প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক ঋণের প্রচলন ছিল, তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও বাণিজ্যিক ঋণের প্রচলন ছিল। এ বিষয়ে কুরআন-হাদিস ও ইতিহাসে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। ফলে কুরআন নাজিলের সমসাময়িককালে আরববাসীদের কাছে বাণিজ্যিক সুদের ধারণা সুস্পষ্ট ছিল। তাই এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, কুরআন যে সুদ নিষিদ্ধ করেছে তা কেবল ভোগ্যঋণের সুদ, বাণিজ্যিক বা ব্যাংকিং সুদ নয়। প্রকৃতপে সর্বপ্রকার সুদই ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধু ইসলাম নয়; বরং হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধসহ বহু ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ। এমনকি বহু দার্শনিক যেমন প্লেটো, অ্যারিস্টটল, থমাস একুইনো ও মিসাব্যুর মতো দার্শনিকেরা সুদকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গ. সুদ কি মানবিক চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
সুদ মানবিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং এটির জন্মই হয়েছে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। এটির অপকারিতা শুধ ধর্মেই বর্ণিত নয়, বরং আধুনিক অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতেও সুদের কোনো শুভ ফল নেই। অর্থনৈতিক মন্দা, আয়বৈষম্য ও বেকারত্ব সৃষ্টির েেত্র সুদের প্রভাব স্পষ্ট। এ েেত্র লর্ড কিনসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যায় এবং সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বেড়ে যায়। তিনি দেখিয়েছেন, সুদের হার শূন্য হলেই কেবল পূর্ণ বিনিয়োগ সম্ভব হয় এবং দেশের বস্তুগত ও মানবীয় সম্পদের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়াও সুদের আর্থসামাজিক নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। এ ুদ্র পরিসরে তা আলোচনা করার অবকাশ নেই।
পরিশেষে বলা যায়, আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত সুদ কোনোটির মধ্যেই মানবতার জন্য কোনো কল্যাণ নেই এবং উভয়ের অনিবার্য পরিণতি হলো অর্থনৈতিক মন্দা ও আর্থিক অস্থিতিশীলতা। এ থেকে বাঁচার জন্যই কল্যাণধর্মী ইসলামি ব্যাংক-ব্যবস্থার প্রসার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এটি কোনো নতুন ব্যাংকিং দর্শনও নয়; বরং ইসলামি ব্যাংকিংয়ে জমাগ্রহণ নীতির েেত্র বিশিষ্ট সাহাবি হজরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম রা:-এর দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বহু লোক তার কাছে অর্থকড়ি জমা রাখত এবং প্রয়োজনের সময় আংশিক বা সম্পূর্ণই ফেরত নিয়ে যেত। তিনি জনসাধারণের অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ না করে করদ হিসেবে নিতেন। এ সম্পর্কে সহি আল বুখারিতে উল্লেখ রয়েছে, কেউ হজরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম রা:-এর কাছে অর্থকড়ি আমানত হিসেবে রাখার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেন, ‘না, এভাবে নয়; বরং তুমি তা আমার কাছে ঋণ হিসেবে রেখে যাও।’ আব্বাসীয় খলিফা আল মুক্তাদিরের (৯০৮-৯৩২ খ্রি:) আমলে মুসলমানেরা আধুনিক ব্যাংক-ব্যবস্থার বেশির ভাগ মৌলিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এ সময় তারা মুসলিম বিশ্বের সমস্ত সঞ্চিত অর্থকে একত্র করে মূলধন গঠনে সম হয়। দেশ-বিদেশে ব্যবসায় পরিচালনায় সুদমুক্তভাবে অর্থ জোগান দিতেও সম হয়। এ প্রক্রিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে নানাবিধ রাজনৈতিক কারণে মুসলমানেরা তাদের অর্থনৈতিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। এ সময় পশ্চিমা শক্তি মুসলিম বিশ্বের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে ইসলামি ব্যাংক-ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানেরা তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের েেত্র কিছুটা হলেও সফলতা লাভ করেছে। এই মানবদরদি, কল্যাণধর্মী ও সুদমুক্ত ইসলামি ব্যাংক-ব্যবস্থার উন্নয়নে দরদি মনোভাব নিয়ে সবার এগিয়ে আসা কর্তব্য।
লেখক : ইসলামি শরিয়াহ গবেষক
rahmatullah1066@gmail.com
No comments