রোকেয়া কী নামে স্বাক্ষর করতেন by একেএম শাহনাওয়াজ
বাংলার নারী জাগরণের অগ্রপথিক রোকেয়া
সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পার হল দু’দিন আগে। কিন্তু
ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যে দুঃখ করেছিলাম প্রায় এক যুগ আগে, তার উপশম হল না
এখনও। মহীয়সী রোকেয়া ইতিহাসচর্চাবিমুখ আমাদের সমাজ বাস্তবতায় খণ্ডিত হয়ে
গেলেন। এতে কালের অলিন্দে রোকেয়ার কৃতিত্ব প্রজন্মের কাছে ধূসর হয়েছে। দিন
দিন ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফিকে হয়ে যেতে পারে সহজেই। নারীবাদী চর্চা যারা করেন,
নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বলয় থেকে বের করে আনতে চান, তাদের উপলব্ধিতে
প্রথম আনতে হবে ‘বেগম’ শব্দ চয়ন ও প্রয়োগের ভ্রান্তি। আমরা যারা ইতিহাস
গবেষণা পদ্ধতি মানার চেষ্টা করি, তারা জানি এক একটি বিশেষ শব্দ কীভাবে
ইতিহাসের ঘটনা ও সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব শব্দের ভুল ব্যবহার বিভ্রান্ত
করতে পারে ইতিহাসের সত্যকে। এসব অসাবধানী শব্দ চয়ন যুগ যুগ ধরে বিনা বাধায়
চলে; তবে ইতিহাসের শুদ্ধতার স্বার্থে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রথম সুযোগেই এ থেকে
বেরিয়ে আসা উচিত।
মনে পড়ে, প্রায় এক যুগ আগে একই বিষয়ে ইতিহাসের সত্য বিকৃতির আশংকায় একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধ লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘বেগমের খোলসে অবরোধবাসিনী রোকেয়া’। সেই লেখাটি সুধী মহলে খুব একটা নাড়া দিতে পারেনি। প্রশ্নটি নিয়ে কেউ নতুন করে ভাবতে চাননি। আমার স্বজন একজন বাংলার অধ্যাপিকা, একই সঙ্গে যিনি একজন কথাসাহিত্যিকও, লেখাটি পড়ে বরঞ্চ আমাকে মৃদু তিরস্কার করেছিলেন। বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ব্যবহারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ‘বেগম রোকেয়া’, এ নিয়ে আবার বিতর্ক তোলা কেন! আমি বুঝলাম এখানে নতুন করে যুক্তি দেয়া বৃথা। যেখানে ইতিহাসচর্চায় যুক্ত সুধীজন এসব নিয়ে ভাবতে চান না, সেখানে অধ্যাপিকা সরল দৃষ্টিতে বিচার করলে কতটুকুই বা দোষ দেয়া যায়! তবে ভালো লেগেছিল কলকাতার সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেলিফোন পেয়ে। ঘটনাক্রমে লেখাটি তার নজরে এসেছিল। তিনি আমার অনুমতি নিয়ে লেখাটি কলকাতার দুটি কাগজে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা পশ্চিমবঙ্গে একটি বড় সংগঠন পরিচালনা করেন। নাম জওঠঊজ। সংগঠনটির প্রধান কাজ রোকেয়া চর্চা করা। অনেকটা আমার শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের বইপড়া আন্দোলনের মতো। তারা রোকেয়া চর্চা ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্কুল-কলেজে। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হল, তারা আমার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে সাংগঠনিকভাবে ‘বেগম রোকেয়া’ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন এ সংগঠনটি তাদের সব প্রকাশনায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নাম লেখেন। আমার যুক্তিগুলো তুলে ধরছি।
এক. ‘বেগম’ শব্দটি রোকেয়ার নামের কোনো অংশ নয়। রোকেয়ার লেখা বইগুলোতে তিনি নিজ নাম লিখেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। স্কুল যখন পরিচালনা করতেন তখন দাফতরিক প্রয়োজনে চিঠিপত্রে যে স্বাক্ষর দিতেন তাতে সাধারণত লিখতেন আর.এস. হোসেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক চিঠিপত্রে স্বাক্ষর করতেন রোকেয়া বা রুকু নামে। বোঝা যায়, একজন মুসলিম মহিলাকে সম্মান দেখিয়ে ‘বেগম’ বলা হয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কি হতে পারে ‘জনাব কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’?
দুই. ‘বেগম’ শব্দটি যদি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম মহিলার পরিচিতির পরিপূরক হয়, তবে একসময় নারী প্রগতির পুরোধা হিসেবে রোকেয়ার ঔজ্জ্বল্য খণ্ডিত হতে পারে। কারণ তখন কৌতূহলী কারও মনে হতে পারে উনিশ শতকে রোকেয়া আর কতটা নারী প্রগতির পক্ষে সমাজকে এগিয়ে দিতে পেরেছিলেন, যিনি নারীত্বের প্রতীক ‘বেগম’ নিজের নামের সঙ্গে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি! সেসময় তো জনে জনে বলা যাবে না এ অপকীর্তিটি পরবর্তীকালের অসতর্ক বাঙালির।
তিন. রোকেয়ার আত্মকথা পড়লে জানতে পারি, সেই সাধারণ রুকুর মহীয়সী রোকেয়া হওয়ার পেছনে দু’জন পুরুষের অবদানকে বড় করে দেখেছেন রোকেয়া। একজন তার ভাই ইব্রাহিম সাবের। তিনি সে যুগে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে গভীর রাতে নিভৃতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বোনকে ইংরেজি শেখাতেন। এভাবে রোকেয়াকে আধুনিকমনস্ক করে তুলেছিলেন তিনি। অন্যজন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন। যিনি স্ত্রীর নারী শিক্ষা বিস্তারের আগ্রহকে সম্মান জানিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে স্ত্রীর মেয়েদের জন্য স্কুল গড়ার আকাক্সক্ষা যাতে বাস্তবায়িত হয় সে জন্য রেখে গিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। রোকেয়ার নারী অগ্রগতির আন্দোলনে পুরুষ বিদ্বেষ ছিল না। ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অচলায়তন ভাঙার লড়াই। তাই নিজের নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করতে পেরেছিলেন অবলীলায়।
আমরা ইতিহাসচর্চাবিমুখ থাকায় বা গভীরভাবে সমকাল বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া ভুল শব্দ ব্যবহার করে ইতিহাসের সত্যে পৌঁছার পথে বাধা সৃষ্টি করি। ‘বেগম’কে নামের অংশ বানাতে গিয়ে এমন সংকট অনেক সৃষ্টি করেছি।
এ দেশে ইতিহাস গবেষকদের একটি বড় অংশ প্রচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস- বিশেষ করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিল্প ইতিহাসচর্চা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। দুর্ভাগ্য এই যে, নিজ গবেষণা ক্ষেত্র না হওয়ায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের নতুন গবেষণালব্ধ তথ্য জানার আগ্রহও তেমন একটা দেখাতে পারেননি। এ কারণে এক যুগেরও আগে মুদ্রা-শিলালিপি ও স্থাপত্যের মতো আঁকর সূত্র বিশ্লেষণ করে ঢাকা নগরীর প্রাচীনত্ব নিয়ে সেমিনার হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জার্নালে প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। প্রামাণ্যভাবে উপস্থাপিত তথ্যে বলা হয়েছে, প্রায় হাজার বছর আগেও ঢাকায় নাগরিক জীবনের অস্তিত্ব ছিল। লিপি প্রমাণে স্পষ্ট হয়েছে প্রায় ছয়শ’ বছর আগে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার একটি বড় অঞ্চলে স্বাধীন সুলতানরা প্রদেশ গড়ে তুলেছিলেন যার নাম ছিল মুবারকাবাদ। এ প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকায়। তারপরও ঢাকার বয়স চারশ’ বছর বলে প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে সাধারণ মানুষকে চারশ’ বছরে আটকে ফেলা হয়েছে। এ রাজধানী ঢাকার প্রাচীনত্ব জানার একটি শিলালিপি এখনও সাঁটা রয়েছে নারিন্দা মসজিদের গায়ে। ‘মোসামাৎ বখত বিনত’ নামে একজন মুসলিম মহিলা এ মসজিদটি ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু বখত বিনতের দুর্ভাগ্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতোই। কারণ ইতিহাস গবেষক থেকে সাধারণ লেখক সবাই নারিন্দার এ মসজিদের নাম লিখেছেন ‘বিনত বিবির মসজিদ’। উল্লিখিত এ শিলালিপি ছাড়া বখত বিনতকে জানার আর কোনো সূত্র নেই। শিলালিপির কোথাও ‘বিবি’ কথাটির উল্লেখ নেই। ধারণা করা যায়, বখত বিনত একজন মুসলিম মহিলা হওয়ায় কোনো এক অসাবধান উচ্চারণে ‘বিনত বিবি’ হয়ে গেছেন। গবেষকরাও গবেষণার রীতি পদ্ধতি না মেনে গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে মসজিদের নির্মাতাকে ‘বিনত বিবি’ বলে ফেলেছেন। অগ্র পশ্চাতে আর কিছু না থাকায় আজ ঢাকার ইতিহাস পুনর্লিখনে গবেষকরা ইতিহাস-বিচ্যুতিতে ভুগতে পারেন। নারিন্দা মসজিদের এ শিলালিপিটি ছিল ফার্সি ভাষায় লেখা। লিপি সাক্ষ্য থেকে তথ্য নিলে বখত বিনতকে আরেকটু স্পষ্ট করা যেত। কারণ সেখানে নির্মাতাকে একটু বিস্তারিত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মোসামাৎ বখত বিনত দোখতারে মারাহমাত’ অর্থাৎ জনৈক মারাহমাতের কন্যা মোসামাৎ বখত বিনত। এখন অসতর্ক লেখা ও বলায় ‘বখত বিনত’ পিতৃপরিচয় হারিয়ে ‘বিনত বিবি’ হয়ে ইতিহাসকে সূত্রচ্যুত করে ফেলেছেন। বখত বিনত নন, আমরাই মূর্খের মতো এ কর্মটি করেছি।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে একই দুর্ভাগ্য বরণ করছি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়সহ রোকেয়া সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠান- যেখানে এখনও রোকেয়া বা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের আগে ‘বেগম’ ঝুলে আছে, সেখান থেকে ‘বেগম’ ছেঁটে দেয়া আশু জরুরি। যদি ইতিহাসে মহীয়সী রোকেয়ার কৃতিত্বকে উজ্জ্বল রাখতে চাই, তবে ‘বেগম’ রক্ষা করার মতো কোনো যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
আমি ধন্যবাদ জানাই ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে’র চারজন শিক্ষার্থীকে। যাদের কথা ছাপা হয়েছে গত ৮ ডিসেম্বরের যুগান্তরে সুরঞ্জনা পাতায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের ভুল প্রয়োগ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রজন্মের এই সচেতনতা আমাদের আশাবাদী হতে শক্তি জোগায়। আমরা অমন পীড়াদায়ক ‘বেগম’ থেকে উপমহাদেশের নারী প্রগতির অগ্রনায়ক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে মুক্তি দিয়ে নিজেদের অজ্ঞানতার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মনে পড়ে, প্রায় এক যুগ আগে একই বিষয়ে ইতিহাসের সত্য বিকৃতির আশংকায় একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধ লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘বেগমের খোলসে অবরোধবাসিনী রোকেয়া’। সেই লেখাটি সুধী মহলে খুব একটা নাড়া দিতে পারেনি। প্রশ্নটি নিয়ে কেউ নতুন করে ভাবতে চাননি। আমার স্বজন একজন বাংলার অধ্যাপিকা, একই সঙ্গে যিনি একজন কথাসাহিত্যিকও, লেখাটি পড়ে বরঞ্চ আমাকে মৃদু তিরস্কার করেছিলেন। বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ব্যবহারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ‘বেগম রোকেয়া’, এ নিয়ে আবার বিতর্ক তোলা কেন! আমি বুঝলাম এখানে নতুন করে যুক্তি দেয়া বৃথা। যেখানে ইতিহাসচর্চায় যুক্ত সুধীজন এসব নিয়ে ভাবতে চান না, সেখানে অধ্যাপিকা সরল দৃষ্টিতে বিচার করলে কতটুকুই বা দোষ দেয়া যায়! তবে ভালো লেগেছিল কলকাতার সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেলিফোন পেয়ে। ঘটনাক্রমে লেখাটি তার নজরে এসেছিল। তিনি আমার অনুমতি নিয়ে লেখাটি কলকাতার দুটি কাগজে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা পশ্চিমবঙ্গে একটি বড় সংগঠন পরিচালনা করেন। নাম জওঠঊজ। সংগঠনটির প্রধান কাজ রোকেয়া চর্চা করা। অনেকটা আমার শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের বইপড়া আন্দোলনের মতো। তারা রোকেয়া চর্চা ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্কুল-কলেজে। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হল, তারা আমার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে সাংগঠনিকভাবে ‘বেগম রোকেয়া’ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন এ সংগঠনটি তাদের সব প্রকাশনায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নাম লেখেন। আমার যুক্তিগুলো তুলে ধরছি।
এক. ‘বেগম’ শব্দটি রোকেয়ার নামের কোনো অংশ নয়। রোকেয়ার লেখা বইগুলোতে তিনি নিজ নাম লিখেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। স্কুল যখন পরিচালনা করতেন তখন দাফতরিক প্রয়োজনে চিঠিপত্রে যে স্বাক্ষর দিতেন তাতে সাধারণত লিখতেন আর.এস. হোসেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক চিঠিপত্রে স্বাক্ষর করতেন রোকেয়া বা রুকু নামে। বোঝা যায়, একজন মুসলিম মহিলাকে সম্মান দেখিয়ে ‘বেগম’ বলা হয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কি হতে পারে ‘জনাব কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’?
দুই. ‘বেগম’ শব্দটি যদি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম মহিলার পরিচিতির পরিপূরক হয়, তবে একসময় নারী প্রগতির পুরোধা হিসেবে রোকেয়ার ঔজ্জ্বল্য খণ্ডিত হতে পারে। কারণ তখন কৌতূহলী কারও মনে হতে পারে উনিশ শতকে রোকেয়া আর কতটা নারী প্রগতির পক্ষে সমাজকে এগিয়ে দিতে পেরেছিলেন, যিনি নারীত্বের প্রতীক ‘বেগম’ নিজের নামের সঙ্গে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি! সেসময় তো জনে জনে বলা যাবে না এ অপকীর্তিটি পরবর্তীকালের অসতর্ক বাঙালির।
তিন. রোকেয়ার আত্মকথা পড়লে জানতে পারি, সেই সাধারণ রুকুর মহীয়সী রোকেয়া হওয়ার পেছনে দু’জন পুরুষের অবদানকে বড় করে দেখেছেন রোকেয়া। একজন তার ভাই ইব্রাহিম সাবের। তিনি সে যুগে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে গভীর রাতে নিভৃতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বোনকে ইংরেজি শেখাতেন। এভাবে রোকেয়াকে আধুনিকমনস্ক করে তুলেছিলেন তিনি। অন্যজন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন। যিনি স্ত্রীর নারী শিক্ষা বিস্তারের আগ্রহকে সম্মান জানিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে স্ত্রীর মেয়েদের জন্য স্কুল গড়ার আকাক্সক্ষা যাতে বাস্তবায়িত হয় সে জন্য রেখে গিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। রোকেয়ার নারী অগ্রগতির আন্দোলনে পুরুষ বিদ্বেষ ছিল না। ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অচলায়তন ভাঙার লড়াই। তাই নিজের নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করতে পেরেছিলেন অবলীলায়।
আমরা ইতিহাসচর্চাবিমুখ থাকায় বা গভীরভাবে সমকাল বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া ভুল শব্দ ব্যবহার করে ইতিহাসের সত্যে পৌঁছার পথে বাধা সৃষ্টি করি। ‘বেগম’কে নামের অংশ বানাতে গিয়ে এমন সংকট অনেক সৃষ্টি করেছি।
এ দেশে ইতিহাস গবেষকদের একটি বড় অংশ প্রচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস- বিশেষ করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিল্প ইতিহাসচর্চা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। দুর্ভাগ্য এই যে, নিজ গবেষণা ক্ষেত্র না হওয়ায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের নতুন গবেষণালব্ধ তথ্য জানার আগ্রহও তেমন একটা দেখাতে পারেননি। এ কারণে এক যুগেরও আগে মুদ্রা-শিলালিপি ও স্থাপত্যের মতো আঁকর সূত্র বিশ্লেষণ করে ঢাকা নগরীর প্রাচীনত্ব নিয়ে সেমিনার হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জার্নালে প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। প্রামাণ্যভাবে উপস্থাপিত তথ্যে বলা হয়েছে, প্রায় হাজার বছর আগেও ঢাকায় নাগরিক জীবনের অস্তিত্ব ছিল। লিপি প্রমাণে স্পষ্ট হয়েছে প্রায় ছয়শ’ বছর আগে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার একটি বড় অঞ্চলে স্বাধীন সুলতানরা প্রদেশ গড়ে তুলেছিলেন যার নাম ছিল মুবারকাবাদ। এ প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকায়। তারপরও ঢাকার বয়স চারশ’ বছর বলে প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে সাধারণ মানুষকে চারশ’ বছরে আটকে ফেলা হয়েছে। এ রাজধানী ঢাকার প্রাচীনত্ব জানার একটি শিলালিপি এখনও সাঁটা রয়েছে নারিন্দা মসজিদের গায়ে। ‘মোসামাৎ বখত বিনত’ নামে একজন মুসলিম মহিলা এ মসজিদটি ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু বখত বিনতের দুর্ভাগ্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতোই। কারণ ইতিহাস গবেষক থেকে সাধারণ লেখক সবাই নারিন্দার এ মসজিদের নাম লিখেছেন ‘বিনত বিবির মসজিদ’। উল্লিখিত এ শিলালিপি ছাড়া বখত বিনতকে জানার আর কোনো সূত্র নেই। শিলালিপির কোথাও ‘বিবি’ কথাটির উল্লেখ নেই। ধারণা করা যায়, বখত বিনত একজন মুসলিম মহিলা হওয়ায় কোনো এক অসাবধান উচ্চারণে ‘বিনত বিবি’ হয়ে গেছেন। গবেষকরাও গবেষণার রীতি পদ্ধতি না মেনে গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে মসজিদের নির্মাতাকে ‘বিনত বিবি’ বলে ফেলেছেন। অগ্র পশ্চাতে আর কিছু না থাকায় আজ ঢাকার ইতিহাস পুনর্লিখনে গবেষকরা ইতিহাস-বিচ্যুতিতে ভুগতে পারেন। নারিন্দা মসজিদের এ শিলালিপিটি ছিল ফার্সি ভাষায় লেখা। লিপি সাক্ষ্য থেকে তথ্য নিলে বখত বিনতকে আরেকটু স্পষ্ট করা যেত। কারণ সেখানে নির্মাতাকে একটু বিস্তারিত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মোসামাৎ বখত বিনত দোখতারে মারাহমাত’ অর্থাৎ জনৈক মারাহমাতের কন্যা মোসামাৎ বখত বিনত। এখন অসতর্ক লেখা ও বলায় ‘বখত বিনত’ পিতৃপরিচয় হারিয়ে ‘বিনত বিবি’ হয়ে ইতিহাসকে সূত্রচ্যুত করে ফেলেছেন। বখত বিনত নন, আমরাই মূর্খের মতো এ কর্মটি করেছি।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে একই দুর্ভাগ্য বরণ করছি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়সহ রোকেয়া সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠান- যেখানে এখনও রোকেয়া বা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের আগে ‘বেগম’ ঝুলে আছে, সেখান থেকে ‘বেগম’ ছেঁটে দেয়া আশু জরুরি। যদি ইতিহাসে মহীয়সী রোকেয়ার কৃতিত্বকে উজ্জ্বল রাখতে চাই, তবে ‘বেগম’ রক্ষা করার মতো কোনো যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
আমি ধন্যবাদ জানাই ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে’র চারজন শিক্ষার্থীকে। যাদের কথা ছাপা হয়েছে গত ৮ ডিসেম্বরের যুগান্তরে সুরঞ্জনা পাতায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের ভুল প্রয়োগ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রজন্মের এই সচেতনতা আমাদের আশাবাদী হতে শক্তি জোগায়। আমরা অমন পীড়াদায়ক ‘বেগম’ থেকে উপমহাদেশের নারী প্রগতির অগ্রনায়ক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে মুক্তি দিয়ে নিজেদের অজ্ঞানতার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments