মানবাধিকার বঞ্চিতদের কান্না
তাদের
পরিবারের কেউ নিখোঁজ। কেউ হয়েছেন খুন। কেউ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
সদস্যদের নির্যাতনে হয়েছেন পঙ্গু। দেশজুড়ে হত্যা, গুম, অপহরণ ও নির্যাতনের
শিকার পরিবারের সদস্যরা গতকাল এক হয়েছিলেন রাজধানীতে। আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব
ভুক্তভোগীর চোখের জল আর করুণ আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। ছেলে হারিয়ে
মা-বাবার করুণ আহাজারি। নিখোঁজ ব্যক্তির অপেক্ষায় থাকা স্বজনের বেদনাবিধুর
আকুতি নাড়া দিয়ে যায় উপস্থিত বিশিষ্ট নাগরিকদের। তাদের প্রতি সমবেদনা
জানিয়ে তারা এসব ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি তুলেছেন। একই
সঙ্গে মানবাধিকার বঞ্চিত পরিবারগুলোর পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। মৌলিক
অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের প্রথমপর্বের আলোচনায় অংশ নেন
গুম-খুন ও অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যরা। এতে শুধু বিরোধী
জোটের রাজনৈতিক নেতাকর্মীই নয়, গুমের শিকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতার
পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার ও সংখ্যালঘু
নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যরা অবর্ণনীয় পরিস্থিতি তুলে ধরেন। অবিলম্বে
গুম হওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে খুনের
ঘটনায় মামলা দায়ের করায় উল্টো নানা মহল থেকে স্বজনদের হত্যার হুমকি দেয়া
হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে আসে তাদের বক্তব্যে। রাজধানীতে গুম হওয়া সুবজবাগ থানা
যুবদল সভাপতি মাহবুব হাসান সুজনের স্ত্রী তানজিনা আক্তার বলেন, একবছর হয়ে
গেছে, আমার স্বামীর কোন খোঁজ নেই। দু’টি শিশু সন্তান নিয়ে আমাদের দিন
কিভাবে কাটছে- তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। সরকারের কাছে আমার
অনুরোধ-আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। রাজধানী থেকে গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা
জহিরের মা হোসনে আরা বক্তব্য দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক পর্যায়ে
অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে কয়েকজন তার মাথায় পানি দিয়ে সুস্থ করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিহত শাহীনুর আলমের ভাই মেহেদী হাসান র্যাবের নির্মম
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত বছরের ২৯শে এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
গ্রামের বাড়ি থেকে আমার ভাইকে র্যাব সদস্যরা ধরে ভৈরব ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
নির্মম নির্যাতনের পর তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে
অসুস্থ হয়ে পড়লে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তার
মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা করার পর বিভিন্ন মহল থেকে হত্যার হুমকি দেয়া
হচ্ছে জানিয়ে কিশোর মেহেদী হাসান বলে, আমাকে রোড এক্সিডেন্টে মেরে ফেলার
হুমকি দেয়া হচ্ছে। তার বলছে, মানবাধিকার কর্মী আর সাংবাদিকরা কি তোর ভাইয়ের
বিচার করে দেবে? প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সে বলে,
আমার ভাইয়ের নামে একটা জিডিও ছিল না। বাংলাদেশের কোথাও আমার ভাইয়ের
বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ পান তাহলে আমি মামলা তুলে নেবো।
ঝিনাইদহ থেকে আসা রেণু বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল আমাদের মন্দিরের জায়গা দখল করার পাঁয়তারা করছে। আদালতে মামলা করার পরও প্রশাসন থেকে কোন সহায়তা করা হচ্ছে না। সরকারের কাছে আবেদন-ওই প্রভাবশালী মহল থেকে আমাদের রক্ষা করুন। লক্ষ্মীপুর থেকে আসা মর্জিনা বেগম স্বামী হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, আমার স্বামী ফয়েজ আহমদ একজন ডাক্তার ছিলেন। আমার সামনে থেকে স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় র্যাব সদস্যরা। এরপর ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয়। তার কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো? আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গুম হওয়া যুবদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের শিক্ষিকা আমেনা খাতুন বলেন, শিশু-বয়স থেকে সুমন আমার ছাত্র। এলাকার মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টান যে কোন লোক মারা গেলে সৎকারের জন্য সে এগিয়ে আসতো। স্কুলের কোন ছাত্র বেতন দিতে না পারলে শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়ে সাহায্য করতো। কিন্তু গত বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর তাকে গুম করা হয়। সরকারের কাছে সুমনকে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তার কোন অপরাধ থাকলে আইনের কাছে সোপর্দ করুন।
কুমিল্লা থেকে গুম হওয়া লাকসামের হুমায়ুন কবির পারভেজের ভাই গোলাম ফারুক বলেন, গত বছরের ২৭শে নভেম্বর সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুর সঙ্গে আমার ভাই পারভেজকেও র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের কোন হদিস নেই। এ ঘটনায় থানা মামলা না নেয়ায় আদালতে মামলা দায়ের করি। কিন্তু ওই মামলারও কোন অগ্রগতি নেই। নারায়ণগঞ্জে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের ভাই আবদুস সালাম বলেন, সরকার জনগণের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু তারাই আমার ভাইকে হত্যা করছে। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নূর হোসেন এখনও বিদেশে আছে। শুনেছিলাম তাকে দেশে আনা হবে। আজ আট মাস হলো তাকে দেশে আনা হয়নি। দ্রুত তাকে দেশে আনা ও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সকলের শাস্তি দাবি করছি।
মেহেরপুরে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত তারেক সাইফুল ইসলামের ভাই তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আমার সামনে থেকে আমার ভাইকে র্যাব সদস্যরা ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করেছে। কি দোষ ছিল আমার ভাইয়ের? তার অপরাধ ছিল একটাই, সে বিএনপি করতো।
কুমিল্লায় গুম হওয়া যুবলীগ নেতা রফিকুল হাসানের পিতা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন আবেগতাড়িত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমরা কেন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম? গুম হওয়া মা-বোনদের কান্না আমার সহ্য হয় না। বঙ্গবন্ধুর এই দেহরক্ষী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল দপ্তরে আমি ছেলের জন্য ধরনা দিয়েছি। কেউ আমাকে সান্ত্বনা দেয়নি। সাড়ে ৮ মাস ধরে ছেলের অপেক্ষায় আছি। আমাকে হত্যা করে অন্য কোন দেশে পাঠিয়ে দেন। তারপরও আমার আফসোস থাকবে না। এভাবে ছেলের শোক আর বইতে পারছি না। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার যশোর থেকে আসা সূর্যকান্ত বিশ্বাস ও বিশ্বজিৎ বিশ্বাস নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন। এছাড়া ভাষাগত সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের পক্ষে শহীদ আলী বাবুল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষে হিরণ মিত্র চাকমা বক্তব্য দেন।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি: অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে দেশব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে দু’টি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে গুম-খুন-অপহরণের ঘটনার তদন্তে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে। আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আরেকটি সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি। ড. শাহদীন মালিক বলেন, মানবাধিকার হরণের কথা বলার জন্য বাংলাদেশ হয়নি। বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষিত আছে- তা নিয়ে উল্লাস করার কথা ছিল। কিন্তু এখন প্রতিনিয়তই মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান তিনি। শাহদীন মালিক বলেন, ২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপি সরকার অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে ৫৭ জনকে হত্যা করেছিল। তখন আমরা এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু বিএনপি তখন শোনেনি। এখন তারা র্যাব বিলুপ্তের দাবি জানিয়ে আর্তনাদ করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও যদি গুম-খুনসহ সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে ভবিষ্যতে তাদেরও আর্তনাদ করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকার দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করেছে। পদে পদে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আর যারা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তারা হলো-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকার মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমাদেরকে প্রেস ক্লাবের বাইরে কথা বলতে দেয়া হয় না। আমরা গুম-খুনের শিকার হওয়াদের ছবি বুকে ঝুলিয়ে সারা দেশে সভা করতে চাই। আমাদের কথা বলার সে অধিকার ফিরিয়ে দিন।
বিশিষ্ট কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ২০০৪ সালে র্যাব যখন ক্রসফায়ার শুরু করেছিল তখন রাজপথে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল আমাদের প্রতিবাদে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। আজ যখন এই গুম-খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি তখন কিন্তু আওয়ামী লীগের কাউকে দেখা যায়নি। এতে বোঝা যায়, এই গুম-খুনে সরকারের মৌন সম্মতি রয়েছে। সংঘাতময় রাজনীতির কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারছে না। যেই ক্ষমতায় যায় তারাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিচারবহির্ভূত হত্যায় মেতে ওঠে। এই সংঘাতময় রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা গুম হয়েছে তাদের কি অপরাধ ছিল? তাদের যদি কোন অপরাধ থাকে তাহলে দেশে তো আইন আছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে এসব করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কেউই এখন নিরাপদ নই। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। যারা গুম হয়েছেন তাদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমন কি অনেকে সরকারি দলের কর্মীও রয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের গুম করা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের বিবেকবান মানুষ সোচ্চার হয়েছিলেন। কিন্তু এখনও যারা গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন তাদের বিচার দাবিতে আওয়ামী লীগের অনেকেই সোচ্চার হচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বারের সভাপতি এড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সারা দেশের মানুষ এখন ভীত-সন্ত্রস্ত। সরকারের সুশৃঙ্খল বাহিনী নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার প্রধান আসামি নূর হোসেন সাত মাস আগে কলকাতায় গ্রেপ্তার হলেও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না। অথচ ব্যক্তি উদ্যোগে হত্যার মামলার আসামিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন আমাদের সন্দেহ হচ্ছে- সরকার নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে না। কারণ এই সাত খুনের সঙ্গে শুধু প্রশাসনের লোকজনই নয়, সরকারের অনেকেই জড়িত। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা প্রেস ক্লাবের সামনে স্বজনদের ছবি নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন।
ঝিনাইদহ থেকে আসা রেণু বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল আমাদের মন্দিরের জায়গা দখল করার পাঁয়তারা করছে। আদালতে মামলা করার পরও প্রশাসন থেকে কোন সহায়তা করা হচ্ছে না। সরকারের কাছে আবেদন-ওই প্রভাবশালী মহল থেকে আমাদের রক্ষা করুন। লক্ষ্মীপুর থেকে আসা মর্জিনা বেগম স্বামী হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, আমার স্বামী ফয়েজ আহমদ একজন ডাক্তার ছিলেন। আমার সামনে থেকে স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় র্যাব সদস্যরা। এরপর ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয়। তার কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো? আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গুম হওয়া যুবদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের শিক্ষিকা আমেনা খাতুন বলেন, শিশু-বয়স থেকে সুমন আমার ছাত্র। এলাকার মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টান যে কোন লোক মারা গেলে সৎকারের জন্য সে এগিয়ে আসতো। স্কুলের কোন ছাত্র বেতন দিতে না পারলে শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়ে সাহায্য করতো। কিন্তু গত বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর তাকে গুম করা হয়। সরকারের কাছে সুমনকে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তার কোন অপরাধ থাকলে আইনের কাছে সোপর্দ করুন।
কুমিল্লা থেকে গুম হওয়া লাকসামের হুমায়ুন কবির পারভেজের ভাই গোলাম ফারুক বলেন, গত বছরের ২৭শে নভেম্বর সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুর সঙ্গে আমার ভাই পারভেজকেও র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের কোন হদিস নেই। এ ঘটনায় থানা মামলা না নেয়ায় আদালতে মামলা দায়ের করি। কিন্তু ওই মামলারও কোন অগ্রগতি নেই। নারায়ণগঞ্জে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের ভাই আবদুস সালাম বলেন, সরকার জনগণের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু তারাই আমার ভাইকে হত্যা করছে। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নূর হোসেন এখনও বিদেশে আছে। শুনেছিলাম তাকে দেশে আনা হবে। আজ আট মাস হলো তাকে দেশে আনা হয়নি। দ্রুত তাকে দেশে আনা ও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সকলের শাস্তি দাবি করছি।
মেহেরপুরে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত তারেক সাইফুল ইসলামের ভাই তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আমার সামনে থেকে আমার ভাইকে র্যাব সদস্যরা ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করেছে। কি দোষ ছিল আমার ভাইয়ের? তার অপরাধ ছিল একটাই, সে বিএনপি করতো।
কুমিল্লায় গুম হওয়া যুবলীগ নেতা রফিকুল হাসানের পিতা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন আবেগতাড়িত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমরা কেন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম? গুম হওয়া মা-বোনদের কান্না আমার সহ্য হয় না। বঙ্গবন্ধুর এই দেহরক্ষী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল দপ্তরে আমি ছেলের জন্য ধরনা দিয়েছি। কেউ আমাকে সান্ত্বনা দেয়নি। সাড়ে ৮ মাস ধরে ছেলের অপেক্ষায় আছি। আমাকে হত্যা করে অন্য কোন দেশে পাঠিয়ে দেন। তারপরও আমার আফসোস থাকবে না। এভাবে ছেলের শোক আর বইতে পারছি না। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার যশোর থেকে আসা সূর্যকান্ত বিশ্বাস ও বিশ্বজিৎ বিশ্বাস নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন। এছাড়া ভাষাগত সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের পক্ষে শহীদ আলী বাবুল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষে হিরণ মিত্র চাকমা বক্তব্য দেন।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি: অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে দেশব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে দু’টি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে গুম-খুন-অপহরণের ঘটনার তদন্তে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে। আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আরেকটি সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি। ড. শাহদীন মালিক বলেন, মানবাধিকার হরণের কথা বলার জন্য বাংলাদেশ হয়নি। বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষিত আছে- তা নিয়ে উল্লাস করার কথা ছিল। কিন্তু এখন প্রতিনিয়তই মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান তিনি। শাহদীন মালিক বলেন, ২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপি সরকার অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে ৫৭ জনকে হত্যা করেছিল। তখন আমরা এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু বিএনপি তখন শোনেনি। এখন তারা র্যাব বিলুপ্তের দাবি জানিয়ে আর্তনাদ করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও যদি গুম-খুনসহ সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে ভবিষ্যতে তাদেরও আর্তনাদ করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকার দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করেছে। পদে পদে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আর যারা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তারা হলো-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকার মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমাদেরকে প্রেস ক্লাবের বাইরে কথা বলতে দেয়া হয় না। আমরা গুম-খুনের শিকার হওয়াদের ছবি বুকে ঝুলিয়ে সারা দেশে সভা করতে চাই। আমাদের কথা বলার সে অধিকার ফিরিয়ে দিন।
বিশিষ্ট কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ২০০৪ সালে র্যাব যখন ক্রসফায়ার শুরু করেছিল তখন রাজপথে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল আমাদের প্রতিবাদে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। আজ যখন এই গুম-খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি তখন কিন্তু আওয়ামী লীগের কাউকে দেখা যায়নি। এতে বোঝা যায়, এই গুম-খুনে সরকারের মৌন সম্মতি রয়েছে। সংঘাতময় রাজনীতির কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারছে না। যেই ক্ষমতায় যায় তারাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিচারবহির্ভূত হত্যায় মেতে ওঠে। এই সংঘাতময় রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা গুম হয়েছে তাদের কি অপরাধ ছিল? তাদের যদি কোন অপরাধ থাকে তাহলে দেশে তো আইন আছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে এসব করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কেউই এখন নিরাপদ নই। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। যারা গুম হয়েছেন তাদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমন কি অনেকে সরকারি দলের কর্মীও রয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের গুম করা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের বিবেকবান মানুষ সোচ্চার হয়েছিলেন। কিন্তু এখনও যারা গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন তাদের বিচার দাবিতে আওয়ামী লীগের অনেকেই সোচ্চার হচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বারের সভাপতি এড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সারা দেশের মানুষ এখন ভীত-সন্ত্রস্ত। সরকারের সুশৃঙ্খল বাহিনী নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার প্রধান আসামি নূর হোসেন সাত মাস আগে কলকাতায় গ্রেপ্তার হলেও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না। অথচ ব্যক্তি উদ্যোগে হত্যার মামলার আসামিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন আমাদের সন্দেহ হচ্ছে- সরকার নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে না। কারণ এই সাত খুনের সঙ্গে শুধু প্রশাসনের লোকজনই নয়, সরকারের অনেকেই জড়িত। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা প্রেস ক্লাবের সামনে স্বজনদের ছবি নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন।
No comments