ছড়িয়ে পড়ছে ফার্নেস অয়েল
সুন্দরবনের
চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর মৃগামারী এলাকায় ডুবে যাওয়া ওটি সাউদার্ন
স্টার-৭ ট্যাংকার থেকে ফার্নেস অয়েল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
জোয়ার-ভাটার কারণে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নদীসহ ২০ থেকে ২৫
কিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য
হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে চরম হুমকির মুখে পড়েছে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী
ডলফিন, মাছ ও গাছপালা। এদিকে এ ঘটনায় নিখোঁজ ট্যাংকারটির মাস্টার মোখলেছুর
রহমানের এখনও সন্ধান মেলেনি।
এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি করেছে বনবিভাগ। এ ব্যাপারে একটি মামলা করা হয়েছে। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা বেলাল হোসেনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সন্ধ্যা ৭টা) ট্যাংকারটি উদ্ধার অভিযান শুরু হয়নি। যুগান্তরের খুলনা ব্যুরো, বাগেরহাট, মংলা ও শরণখোলা প্রতিনিধির পাঠানো খবর-
খুলনা ব্যুরো : খুলনা পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন দৈনিক যুগান্তরকে জানান, ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা সমন্বয়ে যৌথভাবে ঘটনাস্থল পর্যাবেক্ষণ (সুপরভিশন) করেছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। তেল যাতে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য নৌবাহিনী প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নদীতে ভাসমান শোলা দিয়ে তেল আটকিয়ে দিয়েছে। নদী থেকে তেল শুষে নেয়ার পদক্ষেপও নেয়া হবে। তবে নদীতে জোয়ারের কারণে তেল সুন্দরবনের ল্যান্ডে উঠে পড়েছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় নদীতে ও নদী তীরবর্তী ভূমিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্যের ওপর সুদূরপ্রসারী মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এবং এ অঞ্চলের নদ-নদীর জলজ প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। জোয়ার-ভাটার কারণে এই তেল সুন্দরবন ছাড়িয়ে খুলনা শহর পর্যন্ত বিস্তার ঘটবে। ইতিমধ্যে নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রকিবুর রহমান, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বনবিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাগেরহাট : বনের ভেতর বেশ কয়েকবার সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল কিংকারসহ ছোটবড় বেশ কয়েকটি নৌ দুর্ঘটনা ঘটলেও সুন্দরবনের অভ্যন্তরে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনা এটাই প্রথম।
এদিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় ১০০ কোটি টাকার উপরে ক্ষতির আশংকার কথা উল্লেখ করে বুধবার দুপুরে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মংলা থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মংলা থানায় দায়ের করা এ মামলায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ডুবে যাওয়া অয়েল ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এর মালিকপক্ষকে আসামি করা হয়েছে।
ট্যাংকারে থাকা ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে সুন্দরবনের নদ-নদীতে। জরুরি অবস্থায়ও নদী থেকে ভাসমান তেল শোধনের ব্যবস্থা না থাকায় সুন্দরবনের প্রাণিকুলের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করছে বনবিভাগ। একই আশংকা প্রকাশ করেছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাও। তাদের মতে সুন্দরবনের নদীতে ভাসমান তেল সেখানকার উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীর জন্য বেশ ক্ষতির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকারের পাশেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ডলফিনের জন্য ৩টি অভয়াশ্রম এখন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। শ্যালা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীতে ভাসমান তেল ছড়িয়ে পড়ার পর ১৫-২০ মিনিট পর পর পানির উপরিঅংশে জেগে ওঠা ডলফিনদের আর দেখা মিলছে না।
এ ব্যাপারে বাগেরহাট মাজেদা বেগম কৃষি ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ এবং সরকারি পিসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ উদ্ভিদবিদ প্রফেসর শেখ বুলবুল কবির বলেন, সুন্দরবনের ব্যাপক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ায় (ডিও) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাওয়ায় ডলফিনসহ অন্য প্রাণিকুল ক্ষতিতে পড়বে।
এদিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় পানি দূষণ রোধে বিশেষ পাউডার ছিটানোর কথা জানিয়েছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, বিশেষ এ পাউডার নদীর পানিতে ভাসমান তেলকে নিচের দিকে তলিয়ে যেতে সাহায্য করবে এবং অক্সিজেন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। চট্টগ্রাম থেকে কাণ্ডারি-১০ নামের এই জাহাজ থেকে তৈলাক্ত পানির ওপর দূর থেকে এক ধরনের পাউডার ছিটানো হবে বলে মন্ত্রী জানান।
এদিকে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটিতে চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন, স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম, ঢাংমারী রেঞ্জ কর্মকর্তা প্রলব চন্দ্র রায়কে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
শরণখোলা : ডুবন্ত ট্যাংকার থেকে বেড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগামারী, জয়মনি, আন্দারমানিক, নন্দবালা, হাড়বাড়িয়া, চাঁদপাই, শরণখোলা রেঞ্জের তাম্বুলবুনিয়া, হরিনটানাসহ বিস্তীর্ণ নদ-নদী ও খালে ছড়িয়ে পড়েছে। জেলে-বাওয়ালী ও লোকালয়ের লোকজন যে যেভাবে পারছে তারা ড্রাম নিয়ে শ্যালা নদী থেকে তেল সংগ্রহ করছে। ট্যাংকারের মালিক আমির হোসেন ফরিদ ঘটনাস্থল থেকে বিকাল সাড়ে তিনটায় মোবাইল ফোনে জানান, নিখোঁজ মাস্টার মোখলেছুর রহমানকে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জাহাজটি উদ্ধারে দুটি ট্যাংকার জাহাজ আনা হয়েছে। তাছাড়া, নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ আনার জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে। এসব কাজে বনবিভাগ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ অন্যদের সহযোগিতা তিনি পাচ্ছেন বলে জানান। তিনি আরও জানান, ১১৯ ফুট দীর্ঘ, ২৪ ফুট প্রস্থ ও চারশ’ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাংকারে ৬টি তেলের চেম্বার রয়েছে। এর প্রত্যেকটি থেকে এখন তেল বেরোচ্ছে। মংলা নৌবাহিনী সূত্রে জানা যায়, ট্যাংকারটি দ্রুত উদ্ধারের জন্য তাদের জাহাজ বিএনএস শাহ্ পরান দুপুর ১২টায় মংলা থেকে ঘটনাস্থলে রওনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফার্নেস অয়েল বনজ ও জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে যে ক্ষতি হবে, তা পূরণ হওয়ার নয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মো. আইয়াজ হোসেন চিশতি এ প্রসঙ্গে বলেন, সুন্দরবন শুধু ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নয়। জলজ প্রাণীর প্রজনন ক্ষেত্রও বটে। এ ঘটনায় মাছ, কুমির, সাপ ও ডলফিনসহ সব প্রকার জলজ প্রাণীর যে ক্ষতি সাধন হবে, তা পূরণ হওয়ার নয়। ফরেস্টি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মাহামুদ হোসেন বলেন, যেহেতু তেলগুলো রিফাইন তেল। এতে ক্ষতি হয় বেশি। তবে, ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করছে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপকতার উপর। জোয়ার-ভাটায় এর বিস্তৃতি ঘটে বেশি। এভাবে বিস্তৃতি হয়ে বনের মাটির সঙ্গে গিয়ে এ তেল মিশে যায়। এতে গাছের শ্বাসমূলে তেলের আস্তরণ পড়ে। তাতে বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, এ ফার্নেস অয়েলে পানিতে অক্সিজেন কমিয়ে দেবে এবং মাছসহ জলজ প্রাণী অক্সিজেন সংকটে ভুগবে। গাছপালার শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হবে। এতে মারা যেতে পারে গাছপালা ও জলজ প্রাণী। এক কথায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে।
মংলা : নৌবাহিনীর জাহাজে ডুবুরি থাকলেও তেল সরানোর মতো আধুনিক সরঞ্জাম নেই বলে জানিয়েছেন নৌবাহিনীর ডুবুরি দল। জাহাজটির নিখোঁজ মাস্টার মোখলেছুরের কোনে সন্ধান বুধবার সকাল পর্যন্ত পাননি উদ্ধারকারীরা। ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে ‘টোটাল’ নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে। ট্যাংকারটির ৬টি হাউসে থাকা প্রায় সব ফার্নেস অয়েল বেরিয়ে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বলে বন কর্মকর্তারা জানান।
সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার টানে এলাকা জুড়ে ভাসছে জ্বালানি তেল। জোয়ার-ভাটার টানে ভাসমান তেলের বিস্তার ঘটছে ক্রমেই। অর্ধ ডুবন্ত ট্যাংক উদ্ধার ও নিখোঁজ মাস্টারের উদ্ধারে বিরতিহীনভাবে স্থানীয় ডুবুরি দল, কোস্টগার্ড ও বনবিভাগ অভিযান চলছে। ডুবে যাওয়া কার্গো মালিক পক্ষের দাবি এ দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতিপূরণ দাবি করে মংলা থানায় মামলা হয়েছে। ট্যাংকার মালিক গ্র“পের ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। এ দিকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ মাছ ও জলজ প্রাণীর অপূরণীয় ক্ষতির আশংকা বনবিভাগের। সম্ভাব্য একশ’ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ উল্লেখ করে মঙ্গলবার রাতে মংলা থানায় মামলা করেছে বনবিভাগ।
এ দিকে বুধবার সকালে ডুবন্ত ট্যাংকারটি উদ্ধারে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী নৌযান ‘প্রত্যয়’ এবং বরিশাল থেকে ‘নির্ভীক’ দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তবে এ দিন বিকাল নাগাদ উদ্ধারকারী নৌযান দুটি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র খুলনা বিভাগের উপ-পরিচালক আশরাফ হোসেন জানান, উদ্ধারকারী ওই নৌযান দুটি পৌঁছলে প্রাথমিক সার্ভে এবং উদ্ধার কাজ শুরু হবে। তবে উদ্ধার কাজ শেষ করতে সম্ভাব্য কত দিন লাগবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি তিনি।
এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি করেছে বনবিভাগ। এ ব্যাপারে একটি মামলা করা হয়েছে। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা বেলাল হোসেনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সন্ধ্যা ৭টা) ট্যাংকারটি উদ্ধার অভিযান শুরু হয়নি। যুগান্তরের খুলনা ব্যুরো, বাগেরহাট, মংলা ও শরণখোলা প্রতিনিধির পাঠানো খবর-
খুলনা ব্যুরো : খুলনা পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন দৈনিক যুগান্তরকে জানান, ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা সমন্বয়ে যৌথভাবে ঘটনাস্থল পর্যাবেক্ষণ (সুপরভিশন) করেছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। তেল যাতে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য নৌবাহিনী প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নদীতে ভাসমান শোলা দিয়ে তেল আটকিয়ে দিয়েছে। নদী থেকে তেল শুষে নেয়ার পদক্ষেপও নেয়া হবে। তবে নদীতে জোয়ারের কারণে তেল সুন্দরবনের ল্যান্ডে উঠে পড়েছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় নদীতে ও নদী তীরবর্তী ভূমিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্যের ওপর সুদূরপ্রসারী মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এবং এ অঞ্চলের নদ-নদীর জলজ প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। জোয়ার-ভাটার কারণে এই তেল সুন্দরবন ছাড়িয়ে খুলনা শহর পর্যন্ত বিস্তার ঘটবে। ইতিমধ্যে নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রকিবুর রহমান, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বনবিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাগেরহাট : বনের ভেতর বেশ কয়েকবার সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল কিংকারসহ ছোটবড় বেশ কয়েকটি নৌ দুর্ঘটনা ঘটলেও সুন্দরবনের অভ্যন্তরে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনা এটাই প্রথম।
এদিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় ১০০ কোটি টাকার উপরে ক্ষতির আশংকার কথা উল্লেখ করে বুধবার দুপুরে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মংলা থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মংলা থানায় দায়ের করা এ মামলায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ডুবে যাওয়া অয়েল ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এর মালিকপক্ষকে আসামি করা হয়েছে।
ট্যাংকারে থাকা ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে সুন্দরবনের নদ-নদীতে। জরুরি অবস্থায়ও নদী থেকে ভাসমান তেল শোধনের ব্যবস্থা না থাকায় সুন্দরবনের প্রাণিকুলের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করছে বনবিভাগ। একই আশংকা প্রকাশ করেছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাও। তাদের মতে সুন্দরবনের নদীতে ভাসমান তেল সেখানকার উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীর জন্য বেশ ক্ষতির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকারের পাশেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ডলফিনের জন্য ৩টি অভয়াশ্রম এখন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। শ্যালা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীতে ভাসমান তেল ছড়িয়ে পড়ার পর ১৫-২০ মিনিট পর পর পানির উপরিঅংশে জেগে ওঠা ডলফিনদের আর দেখা মিলছে না।
এ ব্যাপারে বাগেরহাট মাজেদা বেগম কৃষি ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ এবং সরকারি পিসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ উদ্ভিদবিদ প্রফেসর শেখ বুলবুল কবির বলেন, সুন্দরবনের ব্যাপক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ায় (ডিও) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাওয়ায় ডলফিনসহ অন্য প্রাণিকুল ক্ষতিতে পড়বে।
এদিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় পানি দূষণ রোধে বিশেষ পাউডার ছিটানোর কথা জানিয়েছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, বিশেষ এ পাউডার নদীর পানিতে ভাসমান তেলকে নিচের দিকে তলিয়ে যেতে সাহায্য করবে এবং অক্সিজেন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। চট্টগ্রাম থেকে কাণ্ডারি-১০ নামের এই জাহাজ থেকে তৈলাক্ত পানির ওপর দূর থেকে এক ধরনের পাউডার ছিটানো হবে বলে মন্ত্রী জানান।
এদিকে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটিতে চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন, স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম, ঢাংমারী রেঞ্জ কর্মকর্তা প্রলব চন্দ্র রায়কে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
শরণখোলা : ডুবন্ত ট্যাংকার থেকে বেড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগামারী, জয়মনি, আন্দারমানিক, নন্দবালা, হাড়বাড়িয়া, চাঁদপাই, শরণখোলা রেঞ্জের তাম্বুলবুনিয়া, হরিনটানাসহ বিস্তীর্ণ নদ-নদী ও খালে ছড়িয়ে পড়েছে। জেলে-বাওয়ালী ও লোকালয়ের লোকজন যে যেভাবে পারছে তারা ড্রাম নিয়ে শ্যালা নদী থেকে তেল সংগ্রহ করছে। ট্যাংকারের মালিক আমির হোসেন ফরিদ ঘটনাস্থল থেকে বিকাল সাড়ে তিনটায় মোবাইল ফোনে জানান, নিখোঁজ মাস্টার মোখলেছুর রহমানকে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জাহাজটি উদ্ধারে দুটি ট্যাংকার জাহাজ আনা হয়েছে। তাছাড়া, নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ আনার জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে। এসব কাজে বনবিভাগ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ অন্যদের সহযোগিতা তিনি পাচ্ছেন বলে জানান। তিনি আরও জানান, ১১৯ ফুট দীর্ঘ, ২৪ ফুট প্রস্থ ও চারশ’ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাংকারে ৬টি তেলের চেম্বার রয়েছে। এর প্রত্যেকটি থেকে এখন তেল বেরোচ্ছে। মংলা নৌবাহিনী সূত্রে জানা যায়, ট্যাংকারটি দ্রুত উদ্ধারের জন্য তাদের জাহাজ বিএনএস শাহ্ পরান দুপুর ১২টায় মংলা থেকে ঘটনাস্থলে রওনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফার্নেস অয়েল বনজ ও জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে যে ক্ষতি হবে, তা পূরণ হওয়ার নয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মো. আইয়াজ হোসেন চিশতি এ প্রসঙ্গে বলেন, সুন্দরবন শুধু ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নয়। জলজ প্রাণীর প্রজনন ক্ষেত্রও বটে। এ ঘটনায় মাছ, কুমির, সাপ ও ডলফিনসহ সব প্রকার জলজ প্রাণীর যে ক্ষতি সাধন হবে, তা পূরণ হওয়ার নয়। ফরেস্টি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মাহামুদ হোসেন বলেন, যেহেতু তেলগুলো রিফাইন তেল। এতে ক্ষতি হয় বেশি। তবে, ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করছে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপকতার উপর। জোয়ার-ভাটায় এর বিস্তৃতি ঘটে বেশি। এভাবে বিস্তৃতি হয়ে বনের মাটির সঙ্গে গিয়ে এ তেল মিশে যায়। এতে গাছের শ্বাসমূলে তেলের আস্তরণ পড়ে। তাতে বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, এ ফার্নেস অয়েলে পানিতে অক্সিজেন কমিয়ে দেবে এবং মাছসহ জলজ প্রাণী অক্সিজেন সংকটে ভুগবে। গাছপালার শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হবে। এতে মারা যেতে পারে গাছপালা ও জলজ প্রাণী। এক কথায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে।
মংলা : নৌবাহিনীর জাহাজে ডুবুরি থাকলেও তেল সরানোর মতো আধুনিক সরঞ্জাম নেই বলে জানিয়েছেন নৌবাহিনীর ডুবুরি দল। জাহাজটির নিখোঁজ মাস্টার মোখলেছুরের কোনে সন্ধান বুধবার সকাল পর্যন্ত পাননি উদ্ধারকারীরা। ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে ‘টোটাল’ নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে। ট্যাংকারটির ৬টি হাউসে থাকা প্রায় সব ফার্নেস অয়েল বেরিয়ে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বলে বন কর্মকর্তারা জানান।
সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার টানে এলাকা জুড়ে ভাসছে জ্বালানি তেল। জোয়ার-ভাটার টানে ভাসমান তেলের বিস্তার ঘটছে ক্রমেই। অর্ধ ডুবন্ত ট্যাংক উদ্ধার ও নিখোঁজ মাস্টারের উদ্ধারে বিরতিহীনভাবে স্থানীয় ডুবুরি দল, কোস্টগার্ড ও বনবিভাগ অভিযান চলছে। ডুবে যাওয়া কার্গো মালিক পক্ষের দাবি এ দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতিপূরণ দাবি করে মংলা থানায় মামলা হয়েছে। ট্যাংকার মালিক গ্র“পের ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। এ দিকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ মাছ ও জলজ প্রাণীর অপূরণীয় ক্ষতির আশংকা বনবিভাগের। সম্ভাব্য একশ’ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ উল্লেখ করে মঙ্গলবার রাতে মংলা থানায় মামলা করেছে বনবিভাগ।
এ দিকে বুধবার সকালে ডুবন্ত ট্যাংকারটি উদ্ধারে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী নৌযান ‘প্রত্যয়’ এবং বরিশাল থেকে ‘নির্ভীক’ দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তবে এ দিন বিকাল নাগাদ উদ্ধারকারী নৌযান দুটি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র খুলনা বিভাগের উপ-পরিচালক আশরাফ হোসেন জানান, উদ্ধারকারী ওই নৌযান দুটি পৌঁছলে প্রাথমিক সার্ভে এবং উদ্ধার কাজ শুরু হবে। তবে উদ্ধার কাজ শেষ করতে সম্ভাব্য কত দিন লাগবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি তিনি।
No comments