আর কত অপেক্ষা, আর কত কান্না- মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি
(ছবি:-১ গুম-খুন
হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভার
আয়োজন করেছিল মৌলিক অধিকার রক্ষা কমিটি। সেখানে অনেকেই হাজির হয়েছিলেন
প্রিয়জনদের ছবি হাতে নিয়েl) (ছবি:-২ আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য
দেন শাহদীন মালিক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন
(বাঁ থেকে) মাহমুদুর রহমান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সারা হোসেন ও শাহনাজ হুদাl
ছবি: প্রথম আলো) বাবার
জন্য কাঁদছে সন্তান, সন্তানের জন্য মা। স্বামীর জন্য কাঁদছে স্ত্রী,
ভাইয়ের জন্য ভাই। মঞ্চে একেকজন যখন গুম-অপহরণ বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত
স্বজনদের জন্য কাঁদছিলেন, তখন সেই কান্না সংক্রমিত হচ্ছিল পুরো মিলনায়তনে।
মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজে আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।
গতকাল বুধবার এমনটাই ছিল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনের পরিবেশ। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি ‘মানবাধিকার হরণ: এ কী পরিস্থিতিতে দেশ’ শীর্ষক এই সভার আয়োজন করে। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিকের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে গুম-খুন বন্ধ এবং আগামী ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে দুটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়।
সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠান শুরুর আগেই প্রেসক্লাব মিলনায়তনের দেয়াল ভরে যায় গুম আর বিনা বিচারে নিহত হওয়া মানুষের ছবি ও ফেস্টুনে। ‘আর কত দিন অপেক্ষা করব বাবার জন্য’, ‘আমার সন্তান কোথায়’—এমন সব দাবি আর নিখোঁজদের ছবি টাঙিয়ে দেন স্বজনেরা।
সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসানের স্ত্রী তানজিনা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এক বছর আগে আমার স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে আর খোঁজ নেই। দুই সন্তান নিয়ে আমাদের দিনগুলো যে কীভাবে কাটছে, তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আপনারা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেন...।’
লক্ষ্মীপুরে নিহত জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির চিকিৎসক ফয়েজ আহমদের স্ত্রী মার্জিয়া বেগম বলেন, ‘আমি কাউকে বোঝাতে পারব না, সেই রাতটা কী ভয়াবহ ছিল। রাতের আঁধারে র্যাব এসে আমার স্বামীকে গুলি করে মারল। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না। এই নৃশংসতার বিচার চাই।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নামে সারা দেশে কোথাও কোনো মামলা বা জিডি নেই। আমার ভাইয়ের কাছে এলাকায় কেউ এক টাকাও পাবে না, সে কাউকে একটা গালিও দেয়নি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, ‘আমার ভাইয়ের নামে যদি আপনি একটি অভিযোগ দেখাতে পারেন, আমি ওয়াদা করে যাচ্ছি, আমি আর মামলা করতে আসব না।’
মেহেদী বলেন, র্যাবের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত ৬ মে মারা যান তাঁর ভাই শাহনূর আলম। ২৯ এপ্রিল র্যাবের একটি দল শাহনূরকে ধরে ভৈরব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে রাত ১১টা থেকে একটা পর্যন্ত তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় শাহনূরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারাগারে পাঠানো হয়। ৬ মে কুমিল্লা হাসপাতালে মারা যান তিনি।
মেহেদী জানান, ২০ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করার পর ১ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন নাহারের আদালতে মামলা করেন। ৪ জুন এফআইআর করার নির্দেশ দিলে পরদিনই নাজমুন নাহারকে ওই আদালত থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে আপিল করা হলে হাইকোর্ট যখন আবার এফআইআর করার নির্দেশ দেন, তখন বিভিন্ন মহল থেকে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন জানান, শুধু যে বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা সাধারণ মানুষ গুমের শিকার হচ্ছেন তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও এর শিকার। তিনি জানান, তাঁর ছেলে কুমিল্লা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবলীগের নেতা কাজী রকিবুল হাসানকে আট মাস আগে তুলে নিয়ে গেছে র্যাব। সাবেক সেনাসদস্য হিসেবে তিনি র্যাব সদর দপ্তর, সেনাপ্রধানসহ সব জায়গায় ছোটাছুটি করেছেন। কিন্তু ছেলের কোনো খোঁজ পাননি। আবদুল মতিন আহাজারি করে বলেন, ‘আমি এই দেশ স্বাধীন করেছি। আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। নইলে আমাকে মেরে ফেলুন।’
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গুম হন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের নেতা সেলিম রেজা ওরফে পিন্টু। তাঁর ভাই ইসমাইল বলেন, ‘আর কত গুম হলে প্রধানমন্ত্রী গুম বন্ধের নির্দেশ দেবেন?’
সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে নিহত আমিনুর রহমানের ভাই রেজাউল করিমও বিচার চেয়ে বক্তব্য দেন। আমিনুর সাতক্ষীরা পৌর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনী সহিংসতার শিকার যশোরের মালোপাড়ার বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘তখন আমাদের পাশে সবাই ছিল। প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্কুল করে দেওয়াসহ তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু একটাও পূরণ হয়নি।’
রাজধানীর মিরপুর বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা শহীদ আলী বাহাদুর বলেন, ‘জায়গা দখল করার জন্য নয়জনেক পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আজকে ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছি।’
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মো. রফিক বলেন, ‘সেনাবাহিনী ওই এলাকায় আবাসনের জন্য কয়েক হাজার বিঘা জমি নিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে এলাকাবাসী ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে আমার ছেলে জামাল নিহত হয়। এর পর থেকে আমি সব সময় গোয়েন্দা নজরদারিতে আছি। আজ এ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছি। বাড়িতে ফিরে আমার কী হবে জানি না।’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খানের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন মেহেরপুরের তারেক সাইফুল ইসলামের ছোট ভাই তৌফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার সাবেক সাংসদ হুমায়ুন কবিরের ভাই গোলাম ফারুক, আদিবাসী নেতা সোহেল হাজং, ঝিনাইদহের আদিবাসী রেনু বিশ্বাস, যশোরের বাঘারপাড়ার সূর্য বিশ্বাস প্রমুখ।
একদিন আপনারাও বিপদে পড়বেন: সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে বক্তব্য দেন লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ‘ক্রসফায়ার’ চালু হয়। কয়েকটি ক্রসফায়ার হয়ে যাওয়ার পর আমি সেটা বন্ধে প্রেসক্লাবের সামনে একা অবস্থান নিয়েছিলাম। সে সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগসহ অনেকেই আমাকে সমর্থন দেন। আজকে তাঁরা কেউ নেই। তাতে মনে হয়, গুম-খুনে তাঁদের মৌন সম্মতি আছে।’
দেশের সংঘাতময় রাজনীতির কারণেই গুম-খুন, ক্রসফায়ার হচ্ছে মন্তব্য করে আবুল মকসুদ বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজ দেখছি শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ানো। কিন্তু কমিশনের মূল কাজ হতে হবে গুম-খুনের অভিযোগ তদন্ত করা।’
মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘র্যাব করেছিল বিএনপি। আজকে তারা বলছে, আমাদের র্যাব থেকে বাঁচাও। এখন যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আমরা চাই না, কখনো আপনারাও চিৎকার করেন।’ ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই গুম-খুনের প্রতিটি ঘটনা তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আরেকটি কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘৫ জানুয়ারি আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় অধিকার হরণ করা হয়েছে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এখন তাঁর বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এ যেন মগের মুল্লুক।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের সবার নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। আমরা এগুলো দেখেও না দেখার ভান করতে পারি, কানে তুলা দিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু এর পর যে আমরাই কেউ গুম-খুন হয়ে যাব না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একসময় যে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ছিল ডাবের মতো, আজ সেটি লাশের নদীতে পরিণত হয়েছে প্রভাবশালী গডফাদারের কারণে। তাঁর সন্দেহ, সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে সরকার ফিরিয়ে আনতে চায় না। কারণ, তাঁকে ফিরিয়ে আনলে আরও অনেক গডফাদারের নাম বেরিয়ে পড়বে।
এ ছাড়া আইনজীবী সারা হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান শাহনাজ হুদা গুম-খুন ঘটনার তদন্ত করে বিচারের দাবি জানান। অনুষ্ঠান শেষে স্বজনহারা ব্যক্তিরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন।
গতকাল বুধবার এমনটাই ছিল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনের পরিবেশ। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি ‘মানবাধিকার হরণ: এ কী পরিস্থিতিতে দেশ’ শীর্ষক এই সভার আয়োজন করে। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিকের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে গুম-খুন বন্ধ এবং আগামী ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে দুটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়।
সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠান শুরুর আগেই প্রেসক্লাব মিলনায়তনের দেয়াল ভরে যায় গুম আর বিনা বিচারে নিহত হওয়া মানুষের ছবি ও ফেস্টুনে। ‘আর কত দিন অপেক্ষা করব বাবার জন্য’, ‘আমার সন্তান কোথায়’—এমন সব দাবি আর নিখোঁজদের ছবি টাঙিয়ে দেন স্বজনেরা।
সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসানের স্ত্রী তানজিনা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এক বছর আগে আমার স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে আর খোঁজ নেই। দুই সন্তান নিয়ে আমাদের দিনগুলো যে কীভাবে কাটছে, তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আপনারা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেন...।’
লক্ষ্মীপুরে নিহত জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির চিকিৎসক ফয়েজ আহমদের স্ত্রী মার্জিয়া বেগম বলেন, ‘আমি কাউকে বোঝাতে পারব না, সেই রাতটা কী ভয়াবহ ছিল। রাতের আঁধারে র্যাব এসে আমার স্বামীকে গুলি করে মারল। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না। এই নৃশংসতার বিচার চাই।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নামে সারা দেশে কোথাও কোনো মামলা বা জিডি নেই। আমার ভাইয়ের কাছে এলাকায় কেউ এক টাকাও পাবে না, সে কাউকে একটা গালিও দেয়নি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, ‘আমার ভাইয়ের নামে যদি আপনি একটি অভিযোগ দেখাতে পারেন, আমি ওয়াদা করে যাচ্ছি, আমি আর মামলা করতে আসব না।’
মেহেদী বলেন, র্যাবের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত ৬ মে মারা যান তাঁর ভাই শাহনূর আলম। ২৯ এপ্রিল র্যাবের একটি দল শাহনূরকে ধরে ভৈরব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে রাত ১১টা থেকে একটা পর্যন্ত তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় শাহনূরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারাগারে পাঠানো হয়। ৬ মে কুমিল্লা হাসপাতালে মারা যান তিনি।
মেহেদী জানান, ২০ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করার পর ১ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন নাহারের আদালতে মামলা করেন। ৪ জুন এফআইআর করার নির্দেশ দিলে পরদিনই নাজমুন নাহারকে ওই আদালত থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে আপিল করা হলে হাইকোর্ট যখন আবার এফআইআর করার নির্দেশ দেন, তখন বিভিন্ন মহল থেকে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন জানান, শুধু যে বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা সাধারণ মানুষ গুমের শিকার হচ্ছেন তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও এর শিকার। তিনি জানান, তাঁর ছেলে কুমিল্লা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবলীগের নেতা কাজী রকিবুল হাসানকে আট মাস আগে তুলে নিয়ে গেছে র্যাব। সাবেক সেনাসদস্য হিসেবে তিনি র্যাব সদর দপ্তর, সেনাপ্রধানসহ সব জায়গায় ছোটাছুটি করেছেন। কিন্তু ছেলের কোনো খোঁজ পাননি। আবদুল মতিন আহাজারি করে বলেন, ‘আমি এই দেশ স্বাধীন করেছি। আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। নইলে আমাকে মেরে ফেলুন।’
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গুম হন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের নেতা সেলিম রেজা ওরফে পিন্টু। তাঁর ভাই ইসমাইল বলেন, ‘আর কত গুম হলে প্রধানমন্ত্রী গুম বন্ধের নির্দেশ দেবেন?’
সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে নিহত আমিনুর রহমানের ভাই রেজাউল করিমও বিচার চেয়ে বক্তব্য দেন। আমিনুর সাতক্ষীরা পৌর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনী সহিংসতার শিকার যশোরের মালোপাড়ার বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘তখন আমাদের পাশে সবাই ছিল। প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্কুল করে দেওয়াসহ তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু একটাও পূরণ হয়নি।’
রাজধানীর মিরপুর বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা শহীদ আলী বাহাদুর বলেন, ‘জায়গা দখল করার জন্য নয়জনেক পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আজকে ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছি।’
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মো. রফিক বলেন, ‘সেনাবাহিনী ওই এলাকায় আবাসনের জন্য কয়েক হাজার বিঘা জমি নিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে এলাকাবাসী ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে আমার ছেলে জামাল নিহত হয়। এর পর থেকে আমি সব সময় গোয়েন্দা নজরদারিতে আছি। আজ এ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছি। বাড়িতে ফিরে আমার কী হবে জানি না।’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খানের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন মেহেরপুরের তারেক সাইফুল ইসলামের ছোট ভাই তৌফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার সাবেক সাংসদ হুমায়ুন কবিরের ভাই গোলাম ফারুক, আদিবাসী নেতা সোহেল হাজং, ঝিনাইদহের আদিবাসী রেনু বিশ্বাস, যশোরের বাঘারপাড়ার সূর্য বিশ্বাস প্রমুখ।
একদিন আপনারাও বিপদে পড়বেন: সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে বক্তব্য দেন লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ‘ক্রসফায়ার’ চালু হয়। কয়েকটি ক্রসফায়ার হয়ে যাওয়ার পর আমি সেটা বন্ধে প্রেসক্লাবের সামনে একা অবস্থান নিয়েছিলাম। সে সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগসহ অনেকেই আমাকে সমর্থন দেন। আজকে তাঁরা কেউ নেই। তাতে মনে হয়, গুম-খুনে তাঁদের মৌন সম্মতি আছে।’
দেশের সংঘাতময় রাজনীতির কারণেই গুম-খুন, ক্রসফায়ার হচ্ছে মন্তব্য করে আবুল মকসুদ বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজ দেখছি শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ানো। কিন্তু কমিশনের মূল কাজ হতে হবে গুম-খুনের অভিযোগ তদন্ত করা।’
মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘র্যাব করেছিল বিএনপি। আজকে তারা বলছে, আমাদের র্যাব থেকে বাঁচাও। এখন যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আমরা চাই না, কখনো আপনারাও চিৎকার করেন।’ ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই গুম-খুনের প্রতিটি ঘটনা তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আরেকটি কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘৫ জানুয়ারি আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় অধিকার হরণ করা হয়েছে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এখন তাঁর বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এ যেন মগের মুল্লুক।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের সবার নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। আমরা এগুলো দেখেও না দেখার ভান করতে পারি, কানে তুলা দিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু এর পর যে আমরাই কেউ গুম-খুন হয়ে যাব না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একসময় যে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ছিল ডাবের মতো, আজ সেটি লাশের নদীতে পরিণত হয়েছে প্রভাবশালী গডফাদারের কারণে। তাঁর সন্দেহ, সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে সরকার ফিরিয়ে আনতে চায় না। কারণ, তাঁকে ফিরিয়ে আনলে আরও অনেক গডফাদারের নাম বেরিয়ে পড়বে।
এ ছাড়া আইনজীবী সারা হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান শাহনাজ হুদা গুম-খুন ঘটনার তদন্ত করে বিচারের দাবি জানান। অনুষ্ঠান শেষে স্বজনহারা ব্যক্তিরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন।
No comments