সাড়ে সাত কোটির প্রত্যেকেরই স্ট্যাটাস নির্ধারণ করুন by মোঃ আলী হায়দার
মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার
সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে ১৫ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা
গেছে। মজার বিষয় হল, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ ছাড়াই শুধু
মুক্তিযোদ্ধা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের
নাতি-পুতিদের পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এ
ধরনের তুঘলকি কাণ্ড কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা
গেছে, ১৯৭১ সালের ১১ ক্যাটাগরির ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত
করা হবে। তারা হলেন- ১. যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সীমান্ত অতিক্রম
করে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। ২. যেসব পেশাজীবী
বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ৩.
যারা মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ৪.
সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ৫.
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত তৎকালীন
পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের যথাক্রমে এমএনএ ও এমপিএরা। ৬.
পাকবাহিনী ও তার সহযোগী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত নারীরা। ৭. স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলীরা। ৮. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের
খেলোয়াড়রা। ৯. মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ডাক্তার, নার্স,
সহকারীরা। ১০. মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের কর্মচারীরা। ১১.
মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের
জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের নেতারা।
সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাড়া উল্লিখিত ১১ ক্যাটাগরির যেসব ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। মুক্তিযোদ্ধা একটি বিশাল ব্যঞ্জনা, একে এত সরলীকরণ করা যুক্তিযুক্ত নয়। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ক্যাম্পে নাম লেখালেই কি মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়? মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারা যুদ্ধ করারও সুযোগ পায়নি। যারা ভারতে গিয়ে নিরাপদে থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গেয়েছেন বা ফুটবল খেলেছেন বা মুজিবনগর সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; তাদের সঙ্গে রণাঙ্গনে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বনে-জঙ্গলে খেয়ে না খেয়ে যারা পাকবাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করেছেন, তাদের একই কাতারে ফেলা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্তা বলা যায় না। মুক্তিযোদ্ধা কারা তা মুক্তিযোদ্ধা শব্দের মধ্যেই বলা আছে। মুক্তির জন্য যারা যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। যারা যুদ্ধ করেনি, তারা কখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হতে পারেন না। তাই যারা রণাঙ্গনে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কেবল তাদেরই মুক্তিযোদ্ধা বলা যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য যারা গান গেয়ে, ফুটবল খেলে বা প্রবাসী সরকারের চাকরি করে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের ‘সহযোগী’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন, তবে তারা কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হলে মুক্তিযোদ্ধাদের শৈর্য-বীর্য, গৌরব ও আত্মত্যাগকে খাটো করা হবে।
লক্ষণীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর যারা ২৫ মার্চ রাতেই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছেন, তাদের ৪নং ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে! আর যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে কেবল নাম লিপিবদ্ধ করেছেন, তাদের ১নং ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে! অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রধান যোগ্যতাই ধরা হয়েছে সীমান্ত অতিক্রম করা। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী সীমান্ত অতিক্রম না করে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটির সদস্য না হয়ে ’৭১ সালে যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তারা কেউই মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবেন না! মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী অথবা নরসিংদীর শিবপুরের বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা- যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা কেউই মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবেন না!!
১৯৭১ সালে যেসব নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিতা (ধর্ষিতা) হয়েছেন তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে! স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর দালাল-রাজাকারদের দ্বারা যেসব নারী ধর্ষিতা হয়েছিল, তাদের বীরঙ্গনা আখ্যায়িত করে সম্মানিত করেছিলেন। শেখ মুজিব যাদের বীরঙ্গনা আখ্যায়িত করেছিলেন তাদের সেই পদবি পরিবর্তন করা শেখ মুজিবের প্রতি চরম অবমাননার সামিল বলেই আমি মনে করি।
তাছাড়া ধর্ষিতারা মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে? ধর্ষণ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কোটি কোটি মানুষ পাকবাহিনী কর্তৃক বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তাহলে তাদেরও তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা উচিত।
আশ্চর্যের বিষয় হল, মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বেঁধে দিয়েছে। ১৫ বছরের নিচে কেউ মুক্তিযেদ্ধা হলেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে! মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বেঁধে দেয়ার ক্ষমতা কে দিয়েছে? মহান মুক্তিযুদ্ধ ভূতাপেক্ষ তারিখ থেকে কার্যকর করার মতো কোনো সরকারি আদেশ নয়। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বয়সের কোনো শর্ত ছিল না, তাই ১৫ বছর বয়সের নিচে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিরল গৌরব হরণ করার কোনো অধিকার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের আছে বলে মনে করি না। এ ক্ষেত্রে ১৫ বছরের কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করার কাজটি কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের একটি দাড়ি, কমা সেমিকলন পরিবর্তনের ক্ষমতা কারও নেই।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না; এটা ছিল একটা গণযুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুষ্টিমেয় দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছাড়া দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা, সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, সরকারি কর্মচারী এবং ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষ অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য কোনো শর্ত ছিল না, ছিল না কোনো নির্দিষ্ট বয়স। যে যেভাবে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর শর্ত আরোপ করে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের কোনো অবকাশ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র এক কোটি মানুষ প্রাণের ভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে এক ভয়াবহ দুঃসহ-দুঃস্বপ্নের সময় অতিবাহিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করেছে। তাদের জান-মাল-ইজ্জতের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। সেটা যে কী এক ভয়াবহ অবস্থা ছিল, তা এ মুক্ত স্বাধীন দেশে থেকে কোনোভাবেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেবল ভুক্তভোগীরাই তা উপলব্ধি করতে পারে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও অবরুদ্ধ সাড়ে ছয় কোটি মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা করেছে। নিজেরা অভুক্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে; ওষুধ, রসদ সরবরাহ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মর্যাদা কী, তা নির্ধারণ করা হয়নি। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদে থেকে গান গেয়ে, ফুটবল খেলে বা মুজিবনগর সরকারের অধীনে বেতন নিয়ে চাকরি করে এখন যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হতে পারে; তবে যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তারা কী হিসেবে গণ্য হবে? এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এনায়েত উল্লাহ খানের সেই বিখ্যাত নিবন্ধ ‘সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলেবারেটর’-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণের যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তাতে কেবল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত গমনকারীদের বিষয় বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যারা সীমান্ত অতিক্রম করেনি- সেই সাড়ে ছয় কোটি মানুষের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে কি এ সাড়ে ছয় কোটি মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না? এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। তাই শুধু মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করলেই হবে না, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস দেশে অবরুদ্ধ সাড়ে ছয় কোটি জনগণের স্ট্যাটাস কী তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কারণ, ৩০ লাখ মানুষ এদের মধ্য থেকেই শহীদ হয়েছে, এদের মধ্য থেকেই ৩ লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে। এদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই পাক হায়েনাদের হিংস আক্রমণে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এদের আত্মত্যাগ খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোনো কিছু পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। কিন্তু এখন ভাতা, ইনক্রিমেন্ট, বর্ধিত চাকরি, কোটা সুবিধা ইত্যাদি প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে খাটো করা হচ্ছে। চাকরির বর্ধিত সুবিধা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা সুবিধা ইত্যাদি অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ভোগ করতে পারছে না। কারণ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা যে সুবিধা ভোগ করতে পারে না; সে সুবিধা না দেয়াই যুক্তিযুক্ত। কেননা এতে সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া ঢালাওভাবে সুবিধা দেয়া ঠিক নয়। যেমন প্রয়োজন না থাকলেও অনেক সচ্ছল ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়া হচ্ছে। এভাবে ঢালাওভাবে সুবিধা না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। ঢালাওভাবে সুযোগ সুবিধা দেয়ার কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সনদ জাল হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া ঠিক আছে; তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-পুতিকে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কোনো যুক্তি নেই।
মোঃ আলী হায়দার : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাড়া উল্লিখিত ১১ ক্যাটাগরির যেসব ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। মুক্তিযোদ্ধা একটি বিশাল ব্যঞ্জনা, একে এত সরলীকরণ করা যুক্তিযুক্ত নয়। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ক্যাম্পে নাম লেখালেই কি মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়? মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারা যুদ্ধ করারও সুযোগ পায়নি। যারা ভারতে গিয়ে নিরাপদে থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গেয়েছেন বা ফুটবল খেলেছেন বা মুজিবনগর সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; তাদের সঙ্গে রণাঙ্গনে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বনে-জঙ্গলে খেয়ে না খেয়ে যারা পাকবাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করেছেন, তাদের একই কাতারে ফেলা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্তা বলা যায় না। মুক্তিযোদ্ধা কারা তা মুক্তিযোদ্ধা শব্দের মধ্যেই বলা আছে। মুক্তির জন্য যারা যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। যারা যুদ্ধ করেনি, তারা কখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হতে পারেন না। তাই যারা রণাঙ্গনে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কেবল তাদেরই মুক্তিযোদ্ধা বলা যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য যারা গান গেয়ে, ফুটবল খেলে বা প্রবাসী সরকারের চাকরি করে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের ‘সহযোগী’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন, তবে তারা কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হলে মুক্তিযোদ্ধাদের শৈর্য-বীর্য, গৌরব ও আত্মত্যাগকে খাটো করা হবে।
লক্ষণীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর যারা ২৫ মার্চ রাতেই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছেন, তাদের ৪নং ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে! আর যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে কেবল নাম লিপিবদ্ধ করেছেন, তাদের ১নং ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে! অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রধান যোগ্যতাই ধরা হয়েছে সীমান্ত অতিক্রম করা। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী সীমান্ত অতিক্রম না করে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটির সদস্য না হয়ে ’৭১ সালে যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তারা কেউই মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবেন না! মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী অথবা নরসিংদীর শিবপুরের বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা- যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা কেউই মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবেন না!!
১৯৭১ সালে যেসব নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিতা (ধর্ষিতা) হয়েছেন তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে! স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর দালাল-রাজাকারদের দ্বারা যেসব নারী ধর্ষিতা হয়েছিল, তাদের বীরঙ্গনা আখ্যায়িত করে সম্মানিত করেছিলেন। শেখ মুজিব যাদের বীরঙ্গনা আখ্যায়িত করেছিলেন তাদের সেই পদবি পরিবর্তন করা শেখ মুজিবের প্রতি চরম অবমাননার সামিল বলেই আমি মনে করি।
তাছাড়া ধর্ষিতারা মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে? ধর্ষণ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কোটি কোটি মানুষ পাকবাহিনী কর্তৃক বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তাহলে তাদেরও তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা উচিত।
আশ্চর্যের বিষয় হল, মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বেঁধে দিয়েছে। ১৫ বছরের নিচে কেউ মুক্তিযেদ্ধা হলেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে! মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বেঁধে দেয়ার ক্ষমতা কে দিয়েছে? মহান মুক্তিযুদ্ধ ভূতাপেক্ষ তারিখ থেকে কার্যকর করার মতো কোনো সরকারি আদেশ নয়। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বয়সের কোনো শর্ত ছিল না, তাই ১৫ বছর বয়সের নিচে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিরল গৌরব হরণ করার কোনো অধিকার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের আছে বলে মনে করি না। এ ক্ষেত্রে ১৫ বছরের কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করার কাজটি কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের একটি দাড়ি, কমা সেমিকলন পরিবর্তনের ক্ষমতা কারও নেই।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না; এটা ছিল একটা গণযুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুষ্টিমেয় দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছাড়া দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা, সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, সরকারি কর্মচারী এবং ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষ অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য কোনো শর্ত ছিল না, ছিল না কোনো নির্দিষ্ট বয়স। যে যেভাবে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর শর্ত আরোপ করে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের কোনো অবকাশ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র এক কোটি মানুষ প্রাণের ভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে এক ভয়াবহ দুঃসহ-দুঃস্বপ্নের সময় অতিবাহিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করেছে। তাদের জান-মাল-ইজ্জতের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। সেটা যে কী এক ভয়াবহ অবস্থা ছিল, তা এ মুক্ত স্বাধীন দেশে থেকে কোনোভাবেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেবল ভুক্তভোগীরাই তা উপলব্ধি করতে পারে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও অবরুদ্ধ সাড়ে ছয় কোটি মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা করেছে। নিজেরা অভুক্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে; ওষুধ, রসদ সরবরাহ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মর্যাদা কী, তা নির্ধারণ করা হয়নি। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদে থেকে গান গেয়ে, ফুটবল খেলে বা মুজিবনগর সরকারের অধীনে বেতন নিয়ে চাকরি করে এখন যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হতে পারে; তবে যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তারা কী হিসেবে গণ্য হবে? এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এনায়েত উল্লাহ খানের সেই বিখ্যাত নিবন্ধ ‘সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলেবারেটর’-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণের যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তাতে কেবল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত গমনকারীদের বিষয় বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যারা সীমান্ত অতিক্রম করেনি- সেই সাড়ে ছয় কোটি মানুষের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে কি এ সাড়ে ছয় কোটি মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না? এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। তাই শুধু মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করলেই হবে না, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস দেশে অবরুদ্ধ সাড়ে ছয় কোটি জনগণের স্ট্যাটাস কী তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কারণ, ৩০ লাখ মানুষ এদের মধ্য থেকেই শহীদ হয়েছে, এদের মধ্য থেকেই ৩ লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে। এদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই পাক হায়েনাদের হিংস আক্রমণে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এদের আত্মত্যাগ খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোনো কিছু পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। কিন্তু এখন ভাতা, ইনক্রিমেন্ট, বর্ধিত চাকরি, কোটা সুবিধা ইত্যাদি প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে খাটো করা হচ্ছে। চাকরির বর্ধিত সুবিধা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা সুবিধা ইত্যাদি অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ভোগ করতে পারছে না। কারণ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা যে সুবিধা ভোগ করতে পারে না; সে সুবিধা না দেয়াই যুক্তিযুক্ত। কেননা এতে সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া ঢালাওভাবে সুবিধা দেয়া ঠিক নয়। যেমন প্রয়োজন না থাকলেও অনেক সচ্ছল ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়া হচ্ছে। এভাবে ঢালাওভাবে সুবিধা না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। ঢালাওভাবে সুযোগ সুবিধা দেয়ার কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সনদ জাল হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া ঠিক আছে; তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-পুতিকে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কোনো যুক্তি নেই।
মোঃ আলী হায়দার : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
No comments