বন্দিদের ওপর সিআইএ’র নৃশংস নির্যাতন- বিচার দাবি জাতিসংঘের
বন্দিদের ওপর সিআইএ’র নৃশংস নির্যাতনের রিপোর্ট ফাঁস হওয়ার পর তোলপাড় চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ ঘটনায় জড়িত মার্কিন কর্মকর্তাদের বিচার করার দাবি তুলেছে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কিছু ভুল করেছে। জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার অন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড কাউন্টার টেররিজম বেন এমারসন বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনের যে সব সিনিয়র কর্মকর্তা নির্যাতনের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তা অনুমোদন দিয়েছিলেন তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দায়ীদের বিচার করতে আইনগতভাবে বাধ্য যুক্তরাষ্ট্র। এদের বিচারের আওতায় আনা যুক্তরাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রোথ বলেন, সিআইএ যে নির্যাতন করেছে তা ক্রিমিনাল কার্যক্রম। একে কখনওই মেনে নেয়া যায় না। যদি এর বিচার করা না হয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টরা নির্যাতনের এই নীতি গ্রহণ করতে পারেন। এর আগে সিআইএ’র বিরুদ্ধে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের যে অভিযোগ করা হয়েছিল প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে নির্যাতন ছিল তার চেয়েও ভয়াবহ। এর মধ্যে কোন বন্দিকে একটানা ১৮০ ঘণ্টা পীড়ন করা হয়েছে। গুহ্যদ্বার দিয়ে খাদ্য প্রবেশ করানো হয়েছে শরীরে। বমি না করা পর্যন্ত ওয়াটারবোর্ডিং করা হয়েছে। এমন ভয়াবহ নির্যাতনে এক বন্দির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। তাকে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে। অন্য একজন মারা যায় হাইপোথার্মিয়াতে। হোয়াইট হাউজ, কংগ্রেস, সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত এ সব নির্যাতন সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল খালিদ শেখ মোহাম্মদ। তাকে শাস্তি হিসেবে ১৮৩ বার ওয়াটারবোর্ডিং করা হয়। আরেক জঙ্গি নেতা আবু জুবাইদাকে ওয়াটারবোর্ডিংয়ের পর তার মুখ হয়ে যায়। সেই খোলা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে বুদ্বুুদ। তখন তিনি ছিলেন একেবারে অসাড়। কোন সাড়া ছিল না তার দেহে। ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর এতে জড়িত সন্দেহে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কিছু মানুষকে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয় কিউবার কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে বন্দিশিবিরে। সেখানে বন্দিদের ওপর চালানো হয় নৃশংস নির্যাতন। এ বিষয়টি প্রথম প্রকাশ হয় ২০০২ সালে। তখন ছবিতে দেখা যায় ওই বন্দিশিবিরের বন্দিদের পায়ে শিকল পরানো, গায়ে কমলা রঙের পোশাক। এক বন্দিকে এতটাই নৃশংসভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল যে, তিনি কথা বলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। আরেক বন্দিকে একটি লোহার রডের সঙ্গে ২২ ঘণ্টা হাত ওপরে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আরেক বন্দিকে মেঝেতে নগ্ন করে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সিআইএ এসব কাজ করতে গিয়ে বৃটেনের এমআই ৫, এমআই ৬ ও তৎকালীন টনি ব্লেয়ারের সমর্থন নিয়েছে। কিন্তু তারা প্রতিক্ষণ মিথ্যা তথ্য দিয়েছে সবাইকে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি সিআইএ’র যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা মূল রিপোর্টের সারমর্ম। পুরো রিপোর্ট ৬০০০ পৃষ্ঠারও বেশি। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিআইএ সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এ লক্ষ্যে কোন কাজই করে নি। ওই রিপোর্টে যে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলা হয়েছে, তা হলো- ১. বন্দিদের কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য বা তাদের সহযোগিতা আদায়ে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল তা কার্যকর ছিল না। ২. সিআইএ বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব কৌশল অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে তা কোন কাজে আসে নি। ৩. বন্দিদের ওপর সিআইএ’র জিজ্ঞাসাবাদ ছিল নৃশংস। তারা নীতিনির্ধারণ প্রণয়নকারী ও অন্যদের কাছে যেমনটা বর্ণনা করেছে, তাদের এ কৌশল ছিল তার চেয়েও ভয়াবহ। ৪. সিআইএ’র অধীনে বন্দিদের অবস্থা ছিল নিষ্ঠুর। ৫. আইন মন্ত্রণালয়ে অসত্য তথ্য পাঠিয়েছে সিআইএ। এতে তাদের অধীনে বন্দিত্ব ও ইন্টারোগেশন প্রোগ্রামের যথাযথ বিশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হয়। ৬. এ কর্মসূচিতে কংগ্রেসের নজরদারি বাধাগ্রস্ত করেছে অথবা সক্রিয়ভাবে এড়িয়ে গেছে সিআইএ। ৭. হোয়াইট হাউস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা যাতে কার্যকর নজরদারি করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিল তারা। ৮. এ কর্মসূচির ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রম ছিল জটিল। ৯. সিআইএ’র ইন্সপেক্টর জেনারেলের অফিস যাতে নজরদারি করতে না পারে সে জন্য বাধা সৃষ্টি করে সিআইএ। ১০. শুধু সমন্বিতভাবে কিছু তথ্য মিডিয়ার কাছে প্রকাশ করে সিআইএ। তাতেও ভুল তথ্য দেয়া হয়। ১১. আটক রাখা ও জিজ্ঞাসাবাদ কর্মসূচি শুরু করা হয় নির্ধারিত সময়ের আগেই। তখন তারা অপ্রস্তুত ছিল। ১২. ২০০২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে সিআইএ ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৩. বন্দিদের দমনমূলক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এটা অনুমোদন করে নি আইন মন্ত্রণালয় অথবা সিআইএ সদর দপ্তর। ১৪. কি পরিমাণ বন্দি রয়েছে সে সম্পর্কে যথার্থ সংখ্যা প্রকাশ করে নি তারা। যারা আটক রাখার আইনি মাপকাঠির মধ্যে পড়ে না তাদেরকেও আটক রাখা হয়েছে। ১৫. সিআইএর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশে যে সমালোচনা, আপত্তি তোলা হয়েছিল সে বিষয় তারা কানেই লাগায় নি। ১৬. সিআইএ’র ডিটেনশন অ্যান্ড ইন্টারোগেশন প্রোগ্রাম যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাকে সারা বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
No comments