সচিব ও মন্ত্রীর জবাবদিহি by এ এম এম শওকত আলী
১৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। শোনা যায়, তাঁর আমলে এটা ষষ্ঠ বৈঠক। মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে এতগুলো বৈঠক করার অর্থ_প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনের দক্ষতা ও সচলতা নিয়ে সন্দিহান। ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পর থেকেই তিনি একাধিকবার এ বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বর্তমান বৈঠক প্রমাণ করে যে তাঁর এ শঙ্কা এখনো রয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনে গতিশীলতা সঞ্চারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশও দিয়েছিলেন। যদি কোনো আইন বা বিধি গতিশীলতা নিশ্চিত করার পথে অন্তরায় হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট আইনি বিধির প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্যও তিনি সচিবদের কাছে প্রস্তাব চেয়েছিলেন। এ পর্যন্ত কতজন সচিব কয়টি প্রস্তাব দিয়েছেন তা জানা নেই। পত্রিকান্তরে কেবল একটি বা দুটি বিধি শোধনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। এগুলো সবই সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিধি সম্পর্কিত।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে মন্ত্রণালয়ের কাজে গতিশীলতা নির্ভর করে মন্ত্রী ও সচিবের পারস্পরিক দক্ষতা ছাড়াও সুসম্পর্কের ওপর। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাসহ সহায়তা প্রদানকারী অন্য কর্মচারীদের। এই দুটি বিষয় আইন বা বিধি দ্বারা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাঁরা সবাই একে অন্যের পরিপূরক। মন্ত্রীর যেমন রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা (সব ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়), তেমনি সচিব ও বড় কর্মকর্তাদের রয়েছে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। তাঁদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রও মোটামুটি সুস্পষ্ট করা আছে। সরকারের রুলস অব বিজনেস বা কার্য সম্পাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নামক পুস্তিকায় এ বিষয়টি রয়েছে। এতে সচিব ও মন্ত্রীর পারস্পরিক অধিক্ষেত্রও চিহ্নিত। ব্রিটিশ আমলেই সরকারি কার্য সম্পাদন বিধি প্রণীত হয়। এরপর সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তনও করা হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ বিধির বলে সচিব ছিলেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এর সঙ্গে সচিব ছিলেন মুখ্য হিসাব কর্মকর্তাও। শেষোক্ত বিষয়টির কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন না হলেও প্রথমটির হয়েছে। ১৯৯৬ সালের সংশোধনীর বলে সচিব এখন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান। একই বছর মন্ত্রীকে এ বিধিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর সঙ্গে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে যদি মন্ত্রী কোনো সাধারণ আদেশ বা বিশেষ আদেশ প্রদান করেন, তাহলে সচিবের জন্য তা অবশ্যই পালনীয়।
আদর্শিক দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোতে মন্ত্রীর প্রাধান্য অবশ্যই কাম্য। তবে বিধিতে এ কথাও বলা প্রয়োজন ছিল যে মন্ত্রীর আদেশ অবশ্যই আইনসংগত হতে হবে। সচিবের দায়িত্ব হলো, মন্ত্রীর কোনো আদেশ আইন বা বিধিসম্মত না হলে তা পালনের আগে মন্ত্রীর নজরে আনা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা এটা ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না। এখানেই প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তবে বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা বিষয়টিকে আমলাতান্ত্রিক বাধা সৃষ্টি হিসেবে দেখেন। তাঁরা এ জন্য অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। অন্যদিকে স্বল্পসংখ্যক সচিবই এ ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে আরেকটি বাস্তবতা হলো, এ কারণেই কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব সম্পর্কে চিড় ধরে, তখনই সচিব অন্যত্র বদলি বা ওএসডি হয়ে থাকেন। এটাই প্রতিষ্ঠিত রীতি। ব্যতিক্রম যৎসামান্য থাকলেও থাকতে পারে। এ সম্পর্কে আরো বাস্তবতা রয়েছে, যেমন_মন্ত্রী সাধারণত মৌখিক নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন। এসব ক্ষেত্রে সচিব যদি নির্দেশটি সংশ্লিষ্ট নথিতে লিপিবদ্ধ করার পর আদেশ জারির আগে মন্ত্রীর কাছে নথি প্রেরণ করেন, তাহলেও অনেক মন্ত্রী অসন্তুষ্ট হন। তাঁরা সাধারণত বলেন, কেন আমার কথা লিখেছেন।
এ ধরনের মৌখিক আদেশ লিপিবদ্ধ করা সব ক্ষেত্রে না হলেও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিতান্তই আবশ্যক। উদাহরণ হলো, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত প্রস্তাব বা উচ্চতর আদালতের কোনো আদেশ-নির্দেশের দ্রুত বা যথাসময়ে বাস্তবায়ন। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে সচিবকেই সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির কাছে সব ধরনের সরকারি অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়। এ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় মহা হিসাবরক্ষকের নিরীক্ষাসংক্রান্ত আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য। সরকারি কার্য সম্পাদন বিধিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের অর্থ ব্যয় করার বিষয়ে প্রচলিত আর্থিক বিধিবিধানসহ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা সচিবের দায়িত্ব। এসব ক্ষেত্রে কোনো কারণে যদি মন্ত্রীর কোনো সিদ্ধান্ত বা অনুরোধ বাস্তবায়নে সচিব রাজি না হন, তাহলেও বিপদ।
এ বৈঠকের ওপর একটি সম্পাদকীয় মন্তব্যে কিছু বলা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হলো, সচিবদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নিরপেক্ষতাসহ স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়টি আপেক্ষিক। বিষয়টি অনেকাংশে সচিবের মানসিক দৃঢ়তা বা মনোবলের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়তার তারতম্য থাকাই স্বাভাবিক। মন্ত্রীদের জন্য মন্ত্রণালয় পরিচালনার বিষয়টি মানসিক দৃষ্টিকোণের নিরিখেও বিশ্লেষণ করা সম্ভব। অন্তত বেশির ভাগ মন্ত্রী মনে করেন যে সচিব যেহেতু তাঁর অধীন কর্মকর্তা, সেহেতু মন্ত্রী যে আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেবেন তা অবশ্যই পালন করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো মানে অবাধ্যতা। এ ধরনের মনমানসিকতার জন্যও মন্ত্রণালয়ের কাজে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। অধীন কর্মকর্তাকে নিছক আজ্ঞাবহ হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক নয়; বরং একজন পরিপূরক শক্তি হিসেবেই দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধার। তা না হলে দলগতভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে একটি জনশ্রুতি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। শোনা যায়, কোনো এক মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগে নতুন সচিব নিযুক্ত হন। ওই সচিব তাঁর মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য সময় প্রার্থনা করেন। মন্ত্রীর উক্তি ছিল, 'কেন? তিনি তাঁর কাজ করবেন। আমি আমার কাজ করব।' এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। তবে একেবারেই বিরল নয়। এই মানসিকতা কখনো মন্ত্রণালয়কে সচল করবে না। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ও সচেতন। মন্ত্রণালয়ে সরকারের গৃহীত নীতি দ্রুত বাস্তবায়নে সচিব যে মন্ত্রীর কনিষ্ঠ পার্টনার, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। দুজনেরই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সব শেষে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারি প্রশাসন একটি বিশাল যন্ত্র। ওই দৃষ্টিকোণে বিচার করলে শুধু মন্ত্রী বা সচিবের দক্ষতার ওপরই সার্বিক গতিশীলতা নির্ভরশীল নয়। এই বিশাল প্রশাসনিক যন্ত্রের প্রতিটি স্তরে দক্ষতা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন হলো_এক. নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রার্থীর প্রাথমিক নিয়োগ, দুই. কার্যকর প্রাথমিক নিয়োগ-পরবর্তী প্রশিক্ষণসহ চাকরিরত ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, তিন. দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও নিয়োগ নিশ্চিতকরণ, চার. মাঠপর্যায়ে দক্ষতা-সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি এবং চার. যথাসময়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। বলা বাহুল্য, এসবেরই যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করতে না পারলে জনপ্রশাসনে দক্ষতা আশা করা যায় না। কেবল বৈঠকের পর বৈঠক করে এর সমাধান সম্ভব নয়। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বৈঠকও জরুরি। তবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হলো চিহ্নিত সমস্যার কার্যকর সমাধান।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে মন্ত্রণালয়ের কাজে গতিশীলতা নির্ভর করে মন্ত্রী ও সচিবের পারস্পরিক দক্ষতা ছাড়াও সুসম্পর্কের ওপর। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাসহ সহায়তা প্রদানকারী অন্য কর্মচারীদের। এই দুটি বিষয় আইন বা বিধি দ্বারা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাঁরা সবাই একে অন্যের পরিপূরক। মন্ত্রীর যেমন রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা (সব ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়), তেমনি সচিব ও বড় কর্মকর্তাদের রয়েছে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। তাঁদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রও মোটামুটি সুস্পষ্ট করা আছে। সরকারের রুলস অব বিজনেস বা কার্য সম্পাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নামক পুস্তিকায় এ বিষয়টি রয়েছে। এতে সচিব ও মন্ত্রীর পারস্পরিক অধিক্ষেত্রও চিহ্নিত। ব্রিটিশ আমলেই সরকারি কার্য সম্পাদন বিধি প্রণীত হয়। এরপর সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তনও করা হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ বিধির বলে সচিব ছিলেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এর সঙ্গে সচিব ছিলেন মুখ্য হিসাব কর্মকর্তাও। শেষোক্ত বিষয়টির কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন না হলেও প্রথমটির হয়েছে। ১৯৯৬ সালের সংশোধনীর বলে সচিব এখন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান। একই বছর মন্ত্রীকে এ বিধিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর সঙ্গে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে যদি মন্ত্রী কোনো সাধারণ আদেশ বা বিশেষ আদেশ প্রদান করেন, তাহলে সচিবের জন্য তা অবশ্যই পালনীয়।
আদর্শিক দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোতে মন্ত্রীর প্রাধান্য অবশ্যই কাম্য। তবে বিধিতে এ কথাও বলা প্রয়োজন ছিল যে মন্ত্রীর আদেশ অবশ্যই আইনসংগত হতে হবে। সচিবের দায়িত্ব হলো, মন্ত্রীর কোনো আদেশ আইন বা বিধিসম্মত না হলে তা পালনের আগে মন্ত্রীর নজরে আনা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা এটা ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না। এখানেই প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তবে বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা বিষয়টিকে আমলাতান্ত্রিক বাধা সৃষ্টি হিসেবে দেখেন। তাঁরা এ জন্য অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। অন্যদিকে স্বল্পসংখ্যক সচিবই এ ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে আরেকটি বাস্তবতা হলো, এ কারণেই কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব সম্পর্কে চিড় ধরে, তখনই সচিব অন্যত্র বদলি বা ওএসডি হয়ে থাকেন। এটাই প্রতিষ্ঠিত রীতি। ব্যতিক্রম যৎসামান্য থাকলেও থাকতে পারে। এ সম্পর্কে আরো বাস্তবতা রয়েছে, যেমন_মন্ত্রী সাধারণত মৌখিক নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন। এসব ক্ষেত্রে সচিব যদি নির্দেশটি সংশ্লিষ্ট নথিতে লিপিবদ্ধ করার পর আদেশ জারির আগে মন্ত্রীর কাছে নথি প্রেরণ করেন, তাহলেও অনেক মন্ত্রী অসন্তুষ্ট হন। তাঁরা সাধারণত বলেন, কেন আমার কথা লিখেছেন।
এ ধরনের মৌখিক আদেশ লিপিবদ্ধ করা সব ক্ষেত্রে না হলেও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিতান্তই আবশ্যক। উদাহরণ হলো, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত প্রস্তাব বা উচ্চতর আদালতের কোনো আদেশ-নির্দেশের দ্রুত বা যথাসময়ে বাস্তবায়ন। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে সচিবকেই সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির কাছে সব ধরনের সরকারি অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়। এ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় মহা হিসাবরক্ষকের নিরীক্ষাসংক্রান্ত আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য। সরকারি কার্য সম্পাদন বিধিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের অর্থ ব্যয় করার বিষয়ে প্রচলিত আর্থিক বিধিবিধানসহ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা সচিবের দায়িত্ব। এসব ক্ষেত্রে কোনো কারণে যদি মন্ত্রীর কোনো সিদ্ধান্ত বা অনুরোধ বাস্তবায়নে সচিব রাজি না হন, তাহলেও বিপদ।
এ বৈঠকের ওপর একটি সম্পাদকীয় মন্তব্যে কিছু বলা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হলো, সচিবদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নিরপেক্ষতাসহ স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়টি আপেক্ষিক। বিষয়টি অনেকাংশে সচিবের মানসিক দৃঢ়তা বা মনোবলের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়তার তারতম্য থাকাই স্বাভাবিক। মন্ত্রীদের জন্য মন্ত্রণালয় পরিচালনার বিষয়টি মানসিক দৃষ্টিকোণের নিরিখেও বিশ্লেষণ করা সম্ভব। অন্তত বেশির ভাগ মন্ত্রী মনে করেন যে সচিব যেহেতু তাঁর অধীন কর্মকর্তা, সেহেতু মন্ত্রী যে আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেবেন তা অবশ্যই পালন করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো মানে অবাধ্যতা। এ ধরনের মনমানসিকতার জন্যও মন্ত্রণালয়ের কাজে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। অধীন কর্মকর্তাকে নিছক আজ্ঞাবহ হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক নয়; বরং একজন পরিপূরক শক্তি হিসেবেই দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধার। তা না হলে দলগতভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে একটি জনশ্রুতি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। শোনা যায়, কোনো এক মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগে নতুন সচিব নিযুক্ত হন। ওই সচিব তাঁর মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য সময় প্রার্থনা করেন। মন্ত্রীর উক্তি ছিল, 'কেন? তিনি তাঁর কাজ করবেন। আমি আমার কাজ করব।' এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। তবে একেবারেই বিরল নয়। এই মানসিকতা কখনো মন্ত্রণালয়কে সচল করবে না। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ও সচেতন। মন্ত্রণালয়ে সরকারের গৃহীত নীতি দ্রুত বাস্তবায়নে সচিব যে মন্ত্রীর কনিষ্ঠ পার্টনার, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। দুজনেরই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সব শেষে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারি প্রশাসন একটি বিশাল যন্ত্র। ওই দৃষ্টিকোণে বিচার করলে শুধু মন্ত্রী বা সচিবের দক্ষতার ওপরই সার্বিক গতিশীলতা নির্ভরশীল নয়। এই বিশাল প্রশাসনিক যন্ত্রের প্রতিটি স্তরে দক্ষতা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন হলো_এক. নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রার্থীর প্রাথমিক নিয়োগ, দুই. কার্যকর প্রাথমিক নিয়োগ-পরবর্তী প্রশিক্ষণসহ চাকরিরত ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, তিন. দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও নিয়োগ নিশ্চিতকরণ, চার. মাঠপর্যায়ে দক্ষতা-সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি এবং চার. যথাসময়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। বলা বাহুল্য, এসবেরই যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করতে না পারলে জনপ্রশাসনে দক্ষতা আশা করা যায় না। কেবল বৈঠকের পর বৈঠক করে এর সমাধান সম্ভব নয়। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বৈঠকও জরুরি। তবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হলো চিহ্নিত সমস্যার কার্যকর সমাধান।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
No comments