যুক্তি তর্ক গল্প-আরব বসন্তে সাম্রাজ্যবাদী ছায়া by আবুল মোমেন
যুক্তরাষ্ট্রই বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। পশ্চিমের উন্নত বিশ্ব, যার মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডও আছে, তারাও কি যুক্তরাষ্ট্রের পরোয়া না করার মতো স্বাধীন? সম্প্রতি আফগান-ইরাক যুদ্ধের মাধ্যমে এটি আর অস্পষ্ট নেই যে তাদের যুক্তরাষ্ট্রকে সমীহ করেই চলতে হয়। একমাত্র ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বাজার ও অর্থনীতির স্বার্থে তারা মাঝেমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অগ্রাহ্য করে থাকে।
কিন্তু বিশ্বমুরব্বি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার তারা মেনে নেয়। ন্যাটোর একক অভিভাবক তো যুক্তরাষ্ট্রই।
তাই এটি সহজ হিসাব, সাদ্দাম বা গাদ্দাফির মতো স্বাধীনচেতা, হয়তো তাদের বিচারে অবাধ্য, কোনো রাষ্ট্রনায়ককে শায়েস্তা করায় যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহ থাকবে। তাদের অগ্রাহ্য করাও যায়নি, কারণ লিবিয়া ও ইরাক দুটি দেশই তেলসমৃদ্ধ। দুটি দেশেই দেখা গেল অবাধ্য শাসককে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তেল ও পুনর্গঠনসহ সব ব্যবসা-বাণিজ্য করায়াত্ত করে নিতে শুরু করেছে। গাদ্দাফির পতনের পর একটুও সময় নষ্ট না করে ব্রিটিশ মন্ত্রী তাঁদের ব্যবসায়ীদের ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত লিবিয়ায় গিয়ে ‘কাজ’ ধরে নেওয়ার বুদ্ধি বাতলে দিয়েছেন।
বিশ্বের তেলখনির সিংহভাগের মালিক বহুকালই আরব বিশ্ব, কিন্তু তেলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বহুজাতিক কোম্পানির মালিক হলো পশ্চিমা ধনকুবেরেরা, সেই গত শতাব্দীর গোড়ায় জর্জিয়া-আজারবাইজানে যখন তেল তোলা হচ্ছে তখন থেকে। জ্বালানি তেলের ব্যবসার ওপর এই একচ্ছত্র আধিপত্য হারাতে রাজি নয় পশ্চিম। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের বিচিত্র নীতির প্রয়োগ দেখছি আমরা। সাদ্দাম-গাদ্দাফিরা তাদের বিচারে স্বৈরাচারী, সেসব দেশে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। পাল্টা প্রশ্ন অবশ্যই করা যাবে—মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র সৌদি আরবে কি গণতন্ত্র আছে? আমিরশাহিতে? আর ইসরায়েলকে মুসলিমপ্রধান তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পুলিশ-রাষ্ট্র হিসেবে ভূমিকা পালনের বিনিময়ে অনৈতিক সমর্থন দেওয়া হচ্ছে না?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা উঠবে, ইরাক ও লিবিয়ার জনমতের ভিত্তিতেই কি গণতন্ত্রের জন্য আগ্রাসনের দায়িত্ব নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশ এবং ন্যাটো? গণতন্ত্রের ভিত্তি তো হলো জনমত। তিউনিসিয়া বা মিসরে, সম্প্রতি সিরিয়া ও ইয়েমেনে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে গণ-অভ্যুত্থান ঘটতে দেখেছি আমরা। তাতে নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিতে পারে বাইরের দেশ। কিন্তু ইরাকে সরাসরি যুদ্ধ চালিয়েছে তারা, আর লিবিয়ায় প্রথমে অস্ত্র-গোলাবারুদ দিয়ে একটি বিদ্রোহী দল দাঁড় করানো হয়েছে, তারপর সরাসরি ন্যাটো বাহিনীও যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ঘটাতে চেয়েছে তারা, যাতে জনমতের ভিন্নতা ও প্রকৃতি বোঝা যাওয়ার আগেই পরিবর্তনের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আফগানিস্তান ও ইরাকে পশ্চিমাদের সমাধানের ছক কাজে আসেনি। বিভক্তি ও হানাহানি একটুও বন্ধ হয়নি, শান্তি ও গণতন্ত্র মিথ্যা হয়ে থাকল। এ অবস্থায় তারা লিবিয়ায়ও একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটাল।
কিন্তু তৃতীয় প্রসঙ্গটি তাদের কি অস্বস্তিতে ফেলে না? বিধ্বস্ত ও অশান্ত দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের—যা অবশ্যই অনৈতিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত, সব ব্যয়ভার তারা চাপিয়ে দিচ্ছে ভুক্তভোগী দেশটির ওপর। ইরাকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তেলব্যবসা ও পুনর্গঠনের কাজ হাতে নিয়েছে তারা, যা ইরাকেরই তেলের আয় থেকে মেটানো হচ্ছে। আফগানিস্তানে এখনো তারা লাভের মুখ দেখেনি। কিন্তু ইরাক তাদের জন্য লাভজনক বিনিয়োগ। সম্ভবত তাতেই তারা লিবিয়ায় বিনিয়োগে উৎসাহ পেয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের জন্য যুদ্ধ একটি ‘ভালো’ বিনিয়োগ! মিসর ও তিউনিসিয়ায় তাদের বন্ধু সরকারই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এসব দেশ কূটনৈতিক স্বার্থ পূরণ করলেও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হিসেবে তত আকর্ষণীয় নয়। পরিবর্তনের পক্ষে যেহেতু জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে, তাতে তারা আপত্তি জানায়নি। কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে যুক্ত হয়নি, আগ বাড়িয়ে দায় নেয়নি।
আরব বিশ্বের বাস্তবতায় ইরাক ছিল আধুনিক একটি দেশ, যার জীবনযাত্রার মান, নারীর স্বাধীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে উন্নত। ইতালির উপনিবেশ হিসেবে আর বাদশাহ ইদ্রিসের আমলে লিবিয়া পড়েছিল মধ্যযুগের জীবনযাত্রায়। ৪০ বছরে মুয়াম্মার গাদ্দাফি গোত্রবিভক্ত সমাজকে সম্পূর্ণ না হলেও একটা কার্যকর ঐক্য এনে দিয়েছেন, শিক্ষার বিস্তার ৮০ শতাংশের ওপরে তুলেছেন, সবার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, তেলের কমিশন, শিক্ষাসহ সব রকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। পশ্চাৎপদ জনগণের জন্য কল্যাণ রাষ্ট্রই ছিল গাদ্দাফির লিবিয়া। উচ্চশিক্ষিত নাগরিক আর ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য এটি অবশ্যই স্বৈরশাসনই ছিল। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে শুরু করা সমাজে সত্যিকারের নাগরিক জাগরণ ও অধিকার-চেতনার বিকাশ হতে আরও সময়ের প্রয়োজন। পশ্চিমা বিশ্বের ধ্যানধারণায় লালিত জনগোষ্ঠী বস্তুত জনবিচ্ছিন্ন, তাদের পক্ষে নিজ নিজ দেশে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব তো নয়ই, দেশ ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই কঠিন। আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই বা ইরাকে নূর-ই জালালের পরিণতি দেখেই তা বোঝা যায়। মিসরেও পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এল-বারাদি ঠিক বিদ্রোহী জনগণের কাছে একক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেননি।
বস্তুত আরব বিশ্বের দুর্বলতাও এখানেই। ইসলামের প্রথম পর্বে নবীর নেতৃত্বে গোত্রবিভক্ত সমাজে যে জাগরণ ও ঐক্য সূচিত হয়েছিল, তা স্থায়িত্ব পাওয়ার আগেই খলিফাদের আমল থেকেই আবার বিভক্তির লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে, ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্র আরব থেকে বাগদাদ এবং পরে কর্দোভায় সরে যায়। ফলে আরব সমাজে, উত্তর আফ্রিকার আরব সমাজে তো বটেই, জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেনি, জাতীয় ঐক্য ও জাগরণ পূর্ণতা পায়নি। এখানে বিংশ শতাব্দীতে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেভাবে দেশের মানচিত্র এঁকেছে, তাতে ভৌগোলিক বা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কোনো শর্তই বিবেচিত হয়নি। একমাত্র বিবেচ্য হয়েছে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ। মানচিত্রে তাকালে দেখা যাবে আফ্রিকার, বিশেষত উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো যেন রুল টেনে আঁকা হয়েছে। মূলত বিবেচনায় ছিল তাদের মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অধিকার ও ব্যবসা সুরক্ষা করা। তারা এ কাজ সহজেই করতে পেরেছে, কারণ সেখানকার জনগণ সচেতন নয়, এমন কোনো সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন-জাগরণ ঘটেনি, যার ভিত্তিতে জাতিগঠনের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি ত্বরান্বিত ও সম্পন্ন হতে পারে। ধর্ম—আমাদের অভিজ্ঞতাতেও জেনেছি, এককভাবে জাতিগঠনের বাহন হতে পারে না। তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সংস্কৃতি, যা গোত্রে গোত্রে ভিন্ন।
আফগানিস্তান বা ইরাকে হানাহানি চলছে বিভক্ত সমাজের নানা গোত্র ও উপসম্প্রদায়ের মধ্যে। লিবিয়াতেও একই পরিণতির আশঙ্কা করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ ও জাগ্রত জাতিই হলো সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও নীলনকশা ঠেকানোর সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। এ কারণেই ইরানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে মার্কিন-বৈরী সরকার আজ ৩২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও, তারা বারবার মার্কিন অভিভাবকত্বকে অগ্রাহ্য ও নাকাল করলেও, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে ভয় পাচ্ছে। এখানেই শক্তিশালী একনায়কেরও দুর্বলতা। এ রকম ব্যবস্থায় কোনোভাবে একনায়কের পতন ঘটাতে পারলে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ বা প্রতিবাদের সম্ভাবনা থাকে না। কারণ একনায়ক নিজেকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা ও শক্তির বলয় তৈরি করে শাসন চালায়, তাতে জাতির জন্য অনেক কল্যাণ করাও সম্ভব; যেমন সাদ্দাম ও গাদ্দাফি স্বদেশে করেছেন, কিন্তু নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য তাঁদের ব্যবস্থাপত্র যেমন গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে দুর্বল, তেমনি কার্যকারিতার দিক থেকেও। তাঁরা সাধারণত ভিন্নমতকে শক্ত হাতে দমন করেন, যা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সম্ভব। কিন্তু বিদেশি আগ্রাসনের ক্ষেত্রে জনসমর্থনই একমাত্র কার্যকর প্রতিষেধক হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ অত্যন্ত কৌশলে মুষ্টিমেয় বিরোধী মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বস্তুত নিজেদের মিডিয়াসহ সব মেকানিজম ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বাকি কাজটা সম্পন্ন করে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি গালভরা বুলি ওই অস্থির সময়ে জনগণকে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যখন বাস্তবের অন্য চেহারা, যা আরও কদাকার ও হতাশাজনক, দেখতে শুরু করে তখন আর ভুল সংশোধনের উপায় থাকে না। এভাবে আরব বসন্ত সূচনাতেই কি ব্যর্থ হয়ে যাবে!
আরব জনগণের ভালো আরব জনগণ ছাড়া আর কারও পক্ষেই চাওয়া ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং এটাই অন্য যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। কোনো সমাজে আলোড়ন ও জাগরণের কাজ হতে হবে তাদেরই সমাজের ভেতর থেকে, যেমন আমাদের সমাজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ করেছেন। সমাজে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের কাজও হতে হবে একইভাবে ভেতর থেকে, যেমনভাবে আমাদের দেশে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজি সুভাষ, মাস্টারদা সূর্যসেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় জাগরণ, পরিবর্তন, ঐক্য ও আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আধুনিকতা কিছুই আমদানি-রপ্তানির বিষয় নয়। ধারণাগুলো বাইরে থেকে নেওয়া যায়, কিন্তু তা নিজ নিজ সমাজের বাস্তবতায়ই ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিকশিত হবে। এটাই নিয়ম, এটাই বাস্তবতা।
সাদ্দাম বা গাদ্দাফি স্বৈরাচারী কি নয়, সেটা সে দেশের মানুষই নির্ধারণ করবে। তাঁদের রাখবে না ফেলে দেবে, সেটাও তাদেরই এখতিয়ারের বিষয়। সমাজের প্রস্তুতির আগেই অতি উৎসাহী বিদেশিদের হস্তক্ষেপে পরিবর্তন ঘটানো হলে তার ফল ভালো হয় না। বরং তাতে সমাজের স্বাভাবিক পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যা প্রায়ই সমাজপ্রগতিকে বিলম্বিত করে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments