ওরা জনগণের কণ্ঠ রোধ করতে চায় by আতাউস সামাদ
জীবনজুড়ে দেখলাম, আমার স্বপ্নগুলো মুহূর্তের ব্যবধানে ভেঙে যায়, আশাবাদ ধ্বংস হয়ে যায় দিন না পার হতেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে মাত্র গত পরশু শনিবার ইংরেজিতে একটা লেখা শেষ করেছিলাম এই বলে, ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মোটামুটি স্বস্তিদায়ক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন ও পক্ষপাতহীন সমাজ গড়ার পথে বাংলাদেশকে এখনও বহু দূর যেতে হবে।
এ দেশে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। দুর্নীতি গভীরভাবে গেড়ে আছে। কিন্তু যেহেতু দেশে একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদের অস্তিত্ব আছে তাই অভাব-অভিযোগের কথা বলা সম্ভব হচ্ছে, সংবাদপত্র আনুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ থেকে মুক্ত আছে এবং বিরোধী দল সংসদের ভেতরে ও বাইরে কথা বলতে পারছে। ফলে জনগণ অন্তত এটুকু দেখতে পাচ্ছে যে, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে।’ কিন্তু সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় জেনে হতভম্ব হলাম যে, আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি এম আবদুল্লাহর ওপর চার মোটরসাইকেল আরোহী হামলা করে প্রথমে আর্মি স্টেডিয়ামের কাছে তার গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়, তারপর পিছু ধাওয়া করে এসে বনানীর কাকলি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য তার মোটরযানটি থেমে গেলে তারা তাকে ইট দিয়ে আঘাত করে। এ হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি কোনোমতে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়েন। তাকে ধরতে না পেরে হেলমেট ও গগলস পরা হামলাকারীরা তখন তার গাড়ির চালককে ধরে বেধড়ক পিটুনি দেয়। সে তাকে বাঁচানোর জন্য আর্তনাদ করতে থাকলে সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন একজন র্যাব কর্মকর্তা এগিয়ে আসেন। তাকে দেখে হামলাকারীরা অকুস্থল ত্যাগ করে। তারপর পুলিশ এসে জনাব আবদুল্লাহর গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়। তবে পুলিশ তার কাছ থেকে কোনো মামলা নেয়নি, কেবল একটি অভিযোগপত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করেছে। তবে তারা নিজেদের মতো করে একটা জিডি করেছে।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে এরকম কয়েকজন মোটরসাইকেল আরোহী আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে ওই একই রাস্তায় একই কায়দায় অনুসরণ করে তার গাড়ির ওপর বোমাসদৃশ একটি বস্তু নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়।
শনিবার রাতে যখন আমি টেলিফোনে জনাব আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলি তখন তাকে সন্ত্রস্ত ও বিচলিত মনে হচ্ছিল।
আসলেও তার সন্ত্রস্ত হওয়ার কথা। একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে পরিশ্রম করে তৈরি করা রিপোর্ট লেখার অপরাধে তার প্রাণনাশের চেষ্টা হবে এতটা তিনি বা তার সহকর্মীরা কেউ ভাবতে পারেননি। গত বৃহস্পতিবার আমার দেশ পত্রিকায় তার লেখা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় যে, পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য বিদেশি কোম্পানি শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার বিনিময়ে মুচাই নামক একস্থানে একটা কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ বিনা টেন্ডারে দিয়ে দিয়েছে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার। পেট্রোবাংলায় একটা জোর অভিমত আছে যে, মুচাইতে এখন গ্যাসের যে চাপ আছে তাতে ওখানে আগামী দশ বছর কোনো কম্প্রেসার বসানোর প্রয়োজন হবে না। এরপরও শেভরনকে ওই কাজ দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি আছে। এরই মধ্যে আবু সিদ্দিকী নামে পেট্রোবাংলায় কর্মরত এক ব্যক্তি সরকারের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠান যে, শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় কাজটি পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি সংক্রান্ত উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয় ৫ মিলিয়ন ডলার উেকাচ গ্রহণ করেছেন। আরও অভিযোগ, এর মধ্যে দুই মিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নাম করে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় তদন্ত করার জন্য অভিযোগপত্রটি পেট্রোবাংলার কাছে পাঠায়। জবাবে পেট্রোবাংলা মন্ত্রণালয়কেই বিষয়টি তদন্ত করতে অনুরোধ করে এ কথা বলে যে, অভিযোগপত্রে উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম আছে এবং বিষয়টি স্পর্শকাতর।
জনাব আবদুল্লাহ রিপোর্টটি দেয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নেন যে, এরকম একটি অভিযোগপত্র সরকারের কাছে প্রকৃতপক্ষেই গেছে এবং মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলায় বিষয়টি নিয়ে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এমন সব ‘উচ্চপর্যায়ের’ ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু এদের মধ্যে দু’জন বিদেশে থাকায় ও মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বিজয় দিবসের কর্মসূচিতে কয়েকদিন ধরে নিজ নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় ফোন ধরতে অপারগ হলে তাত্ক্ষণিকভাবে তাদের মন্তব্য পাননি। এসবই তার রিপোর্টে বলা আছে।
জনাব আবদুল্লাহর প্রতিবেদনে এও লেখা হয়েছে যে, জ্বালানি সচিব জনাব মোহাম্মদ মোহসিন বলেছেন, অভিযোগটি সঠিক বলে মনে হয় না। পরের দিন শুক্রবারের পত্রিকায় আমার দেশ জানায়, তারা বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবাদলিপি পেয়েছে, যা তারা শনিবার প্রকাশ করবে। প্রতিবাদলিপিটির পুরোটা ও প্রতিবেদকের বক্তব্য পাশাপাশি বড় করে প্রথম পাতার উপরদিকে শনিবার দিন প্রকাশ করে আমার দেশ। সরকারি প্রতিবাদলিপিতে আলোচ্য অভিযোগগুলো অস্বীকার করা হয় এবং বলা হয়, ‘বিভ্রান্তিকর প্রচারণার মাধ্যমে যেসব সম্মানিত ব্যক্তির চরিত্র হননের অপচেষ্টা করা হচ্ছে তারা সঙ্গত কারণেই এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন।’ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়েছে, কম্প্রেসার সংক্রান্ত অভিযোগটি ‘বেনামি এবং আবু সিদ্দিকী কথিত অভিযোগটি উত্থাপন করেননি।’ তবুও বাস্তবতা হচ্ছে, অভিযোগের মূল ভিত্তি শেভরনকে বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়ার বিষয়টি সরকার স্বীকার করে নিয়েছে। আমার দেশ তার বক্তব্যে বলে, তারা এরকম আইনি ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন এবং এমন ধরনের হুমকি দিলেন যা দেশের আইনবিরোধী। গত বৃহস্পতিবারই, অর্থাত্ যেদিন সকালে আলোচ্য প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় সেদিনই আওয়ামী লীগ দলের আয়োজন করা বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ক্ষান্ত হন। আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না। মানুষ প্রতিহত করলে আপনারা রাস্তায় বের হতে পারবেন না। আমরা আপনাকে চলতে দেব না।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ ওই সভায় বলেন, ‘মাহমুদুর রহমানকে হুশিয়ার করতে চাই, অভিযোগ সত্য প্রমাণ করতে না পারলে আপনাদের জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করা হবে।’ গত পরশু আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি জনাব আবদুল্লাহকে পরিচয় গোপনকারী মোটরসাইকেল আরোহীরা ধাওয়া করে শারীরিক হামলা করার পর প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগ নেতারা গত বৃহস্পতিবার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন তা কার্যকর করা আরম্ভ হয়ে গেছে। ফলে এই নিবন্ধের শুরুতে আমার অন্য একটা লেখায় ‘সংবাদপত্র আনুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ থেকে মুক্ত আছে’ মর্মে মন্তব্য করে আমি তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করার ব্যাপারে যে যিকঞ্চিত আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম তা একেবারে উবে গেছে। কারণ বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা আইন বা আনুষ্ঠানিক বিধি-নিষেধের পথে না গিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা ও নির্যাতন করার রাস্তা ধরতে তাদের অনুসারীদের উস্কে দিয়ে ত্রাসের মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করতে পারেন কিনা তা পরখ করতে নেমেছেন বলে দেখাই যাচ্ছে। তাতে কাজ হলে আর সরকারিভাবে সেন্সরশিপ প্রয়োগ করার প্রয়োজন কী! তাছাড়া যে ওই কাজটি করে বিদেশে তার বদনাম হয়। আর আমরা জানি যে, দেশে যে যা-ই বলুক বিদেশে নাম কিনতে আওয়ামী লীগের শখ বেশি, আর সে জন্য তারা তত্পরও খুব।
এদিকে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের কাজে ক্রমাগতই বিরক্তি প্রকাশ করে চলেছেন। প্রবীণ নেত্রী ও বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও জনাব মাহমুদুর রহমানের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘মাহমুদুর রহমান ও তার দল বিএনপির ২২ জানুয়ারির ষড়যন্ত্রের নির্বাচন না হওয়ায় মনে জ্বালা ধরে আছে। পত্রিকায় নানা খবর পরিবেশন করছে, যা খুশি তা-ই ছাপতে থাকবে, এটা চলতে পারে না। যা খবর না, তা পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।’ (সূত্র : আমার দেশ) তার বক্তব্যের রাজনৈতিক বা বিএনপির বিষয়টির উত্তর ওই দল দেবে এবং চাইলে জনাব মাহমুদুর রহমানও দিতে পারেন। বাকি অংশটা, অর্থাত্ কোনটা খবর কোনটা নয়, কোন খবরটা জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় আর কোনটা বিভ্রান্তিমূলক তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে যদি পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় (তবে কবরের শান্তি নয়)। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ নিজে ও তিনি যাদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন তারাও ভদ্র বিতর্কে উপকৃত হতে পারেন। কিন্তু বোমাবাজ, লাঠিয়াল, ইট নিক্ষেপকারী ও কালো চশমাপরা মোটরসাইকেল আরোহী আততায়ীদের যারা ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে বা তাদের দ্বারা ব্যবহৃত ওই দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সেরকম কথাবার্তা বলার সুযোগ নেই। আমরা চাই আইন এসব হামলাকারীকে শায়েস্তা করুক। তা না হলে অসহায় নির্যাতিতরাও জনতার আদালতে বিচার চাইবে। লগি-বৈঠার আদলের গণআদালত হলে তার দেয়া শাস্তিটা সুখকর যে হয় না তা তো এখনকার ক্ষমতাসীনরাই ভালো করে জানেন। তবু আমরা আইনের কথা বলব আর জনগণের কাছে আবেদন জানাব যে, তারা যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী ও নির্যাতনকারীদের প্রতিরোধ করেন। সাংবাদিকরা বহু ক্ষেত্রেই জনগণের চোখ, কান ও কণ্ঠ। শাসকরা (তারা যে দলেরই হোক) ও প্রভাবশালীরা যদি আইনের অপব্যবহার করে ও দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করে সাংবাদিকদের তাদের প্রকৃত কর্তব্য পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারে, তাহলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা অনেক কিছুই জানতে পারবেন না আর কোনো কিছুই বলতে পারবেন না। জনগণের জন্য এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার সময় এখনই। গত এক বছরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে বহু। তাদের কারও কারও পরিবারের নিরীহ সদস্যদের সামনেই বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। তাদের মালিকানাধীন সামান্য দোকানপাটে আগুন দেয়া হয়েছে। দেশের বহু জনপদ এখন সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ গত শনিবার প্রকাশিত তার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ২২৯টি। আর এসব হামলায় নিহত হয়েছেন তিনজন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন একাত্তরজন। এই তথ্য কোনো সাংবাদিক সংগঠন বা সংবাদপত্রের কাছ থেকে এলে আরও খুশি হতাম। আমাদের কাজটা অধিকার করেছে বলে তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর সাংবাদিক আবদুল্লাহ ও তার গাড়িচালকের ওপর হামলাকারীদের জানাই ঘৃণা।
সঙ্গে একটা প্রশ্ন রইল। এ গুরুত্বপূর্ণ সড়কের যে জায়গায় জনাব আবদুল্লাহর ওপর শনিবার এবং এর আগে জনাব মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা হয়েছিল সেই এলাকায়, আমাদের বিবেচনায় সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ নজরদারি থাকার কথা। এখন তারা কি ওই হামলাকারীদের ধরার চেষ্টা করবেন?
এ লেখাটা শেষ করার আগে দাবি জানাচ্ছি, শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজটা যেভাবে দেয়া হয়েছে তাতে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা স্বচ্ছ ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করা হোক।
লেখকঃ সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে এরকম কয়েকজন মোটরসাইকেল আরোহী আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে ওই একই রাস্তায় একই কায়দায় অনুসরণ করে তার গাড়ির ওপর বোমাসদৃশ একটি বস্তু নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়।
শনিবার রাতে যখন আমি টেলিফোনে জনাব আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলি তখন তাকে সন্ত্রস্ত ও বিচলিত মনে হচ্ছিল।
আসলেও তার সন্ত্রস্ত হওয়ার কথা। একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে পরিশ্রম করে তৈরি করা রিপোর্ট লেখার অপরাধে তার প্রাণনাশের চেষ্টা হবে এতটা তিনি বা তার সহকর্মীরা কেউ ভাবতে পারেননি। গত বৃহস্পতিবার আমার দেশ পত্রিকায় তার লেখা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় যে, পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য বিদেশি কোম্পানি শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার বিনিময়ে মুচাই নামক একস্থানে একটা কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ বিনা টেন্ডারে দিয়ে দিয়েছে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার। পেট্রোবাংলায় একটা জোর অভিমত আছে যে, মুচাইতে এখন গ্যাসের যে চাপ আছে তাতে ওখানে আগামী দশ বছর কোনো কম্প্রেসার বসানোর প্রয়োজন হবে না। এরপরও শেভরনকে ওই কাজ দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি আছে। এরই মধ্যে আবু সিদ্দিকী নামে পেট্রোবাংলায় কর্মরত এক ব্যক্তি সরকারের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠান যে, শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় কাজটি পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি সংক্রান্ত উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয় ৫ মিলিয়ন ডলার উেকাচ গ্রহণ করেছেন। আরও অভিযোগ, এর মধ্যে দুই মিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নাম করে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় তদন্ত করার জন্য অভিযোগপত্রটি পেট্রোবাংলার কাছে পাঠায়। জবাবে পেট্রোবাংলা মন্ত্রণালয়কেই বিষয়টি তদন্ত করতে অনুরোধ করে এ কথা বলে যে, অভিযোগপত্রে উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম আছে এবং বিষয়টি স্পর্শকাতর।
জনাব আবদুল্লাহ রিপোর্টটি দেয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নেন যে, এরকম একটি অভিযোগপত্র সরকারের কাছে প্রকৃতপক্ষেই গেছে এবং মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলায় বিষয়টি নিয়ে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এমন সব ‘উচ্চপর্যায়ের’ ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু এদের মধ্যে দু’জন বিদেশে থাকায় ও মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বিজয় দিবসের কর্মসূচিতে কয়েকদিন ধরে নিজ নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় ফোন ধরতে অপারগ হলে তাত্ক্ষণিকভাবে তাদের মন্তব্য পাননি। এসবই তার রিপোর্টে বলা আছে।
জনাব আবদুল্লাহর প্রতিবেদনে এও লেখা হয়েছে যে, জ্বালানি সচিব জনাব মোহাম্মদ মোহসিন বলেছেন, অভিযোগটি সঠিক বলে মনে হয় না। পরের দিন শুক্রবারের পত্রিকায় আমার দেশ জানায়, তারা বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবাদলিপি পেয়েছে, যা তারা শনিবার প্রকাশ করবে। প্রতিবাদলিপিটির পুরোটা ও প্রতিবেদকের বক্তব্য পাশাপাশি বড় করে প্রথম পাতার উপরদিকে শনিবার দিন প্রকাশ করে আমার দেশ। সরকারি প্রতিবাদলিপিতে আলোচ্য অভিযোগগুলো অস্বীকার করা হয় এবং বলা হয়, ‘বিভ্রান্তিকর প্রচারণার মাধ্যমে যেসব সম্মানিত ব্যক্তির চরিত্র হননের অপচেষ্টা করা হচ্ছে তারা সঙ্গত কারণেই এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন।’ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়েছে, কম্প্রেসার সংক্রান্ত অভিযোগটি ‘বেনামি এবং আবু সিদ্দিকী কথিত অভিযোগটি উত্থাপন করেননি।’ তবুও বাস্তবতা হচ্ছে, অভিযোগের মূল ভিত্তি শেভরনকে বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়ার বিষয়টি সরকার স্বীকার করে নিয়েছে। আমার দেশ তার বক্তব্যে বলে, তারা এরকম আইনি ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন এবং এমন ধরনের হুমকি দিলেন যা দেশের আইনবিরোধী। গত বৃহস্পতিবারই, অর্থাত্ যেদিন সকালে আলোচ্য প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় সেদিনই আওয়ামী লীগ দলের আয়োজন করা বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ক্ষান্ত হন। আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না। মানুষ প্রতিহত করলে আপনারা রাস্তায় বের হতে পারবেন না। আমরা আপনাকে চলতে দেব না।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ ওই সভায় বলেন, ‘মাহমুদুর রহমানকে হুশিয়ার করতে চাই, অভিযোগ সত্য প্রমাণ করতে না পারলে আপনাদের জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করা হবে।’ গত পরশু আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি জনাব আবদুল্লাহকে পরিচয় গোপনকারী মোটরসাইকেল আরোহীরা ধাওয়া করে শারীরিক হামলা করার পর প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগ নেতারা গত বৃহস্পতিবার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন তা কার্যকর করা আরম্ভ হয়ে গেছে। ফলে এই নিবন্ধের শুরুতে আমার অন্য একটা লেখায় ‘সংবাদপত্র আনুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ থেকে মুক্ত আছে’ মর্মে মন্তব্য করে আমি তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করার ব্যাপারে যে যিকঞ্চিত আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম তা একেবারে উবে গেছে। কারণ বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা আইন বা আনুষ্ঠানিক বিধি-নিষেধের পথে না গিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা ও নির্যাতন করার রাস্তা ধরতে তাদের অনুসারীদের উস্কে দিয়ে ত্রাসের মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করতে পারেন কিনা তা পরখ করতে নেমেছেন বলে দেখাই যাচ্ছে। তাতে কাজ হলে আর সরকারিভাবে সেন্সরশিপ প্রয়োগ করার প্রয়োজন কী! তাছাড়া যে ওই কাজটি করে বিদেশে তার বদনাম হয়। আর আমরা জানি যে, দেশে যে যা-ই বলুক বিদেশে নাম কিনতে আওয়ামী লীগের শখ বেশি, আর সে জন্য তারা তত্পরও খুব।
এদিকে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের কাজে ক্রমাগতই বিরক্তি প্রকাশ করে চলেছেন। প্রবীণ নেত্রী ও বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও জনাব মাহমুদুর রহমানের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘মাহমুদুর রহমান ও তার দল বিএনপির ২২ জানুয়ারির ষড়যন্ত্রের নির্বাচন না হওয়ায় মনে জ্বালা ধরে আছে। পত্রিকায় নানা খবর পরিবেশন করছে, যা খুশি তা-ই ছাপতে থাকবে, এটা চলতে পারে না। যা খবর না, তা পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।’ (সূত্র : আমার দেশ) তার বক্তব্যের রাজনৈতিক বা বিএনপির বিষয়টির উত্তর ওই দল দেবে এবং চাইলে জনাব মাহমুদুর রহমানও দিতে পারেন। বাকি অংশটা, অর্থাত্ কোনটা খবর কোনটা নয়, কোন খবরটা জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় আর কোনটা বিভ্রান্তিমূলক তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে যদি পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় (তবে কবরের শান্তি নয়)। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ নিজে ও তিনি যাদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন তারাও ভদ্র বিতর্কে উপকৃত হতে পারেন। কিন্তু বোমাবাজ, লাঠিয়াল, ইট নিক্ষেপকারী ও কালো চশমাপরা মোটরসাইকেল আরোহী আততায়ীদের যারা ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে বা তাদের দ্বারা ব্যবহৃত ওই দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সেরকম কথাবার্তা বলার সুযোগ নেই। আমরা চাই আইন এসব হামলাকারীকে শায়েস্তা করুক। তা না হলে অসহায় নির্যাতিতরাও জনতার আদালতে বিচার চাইবে। লগি-বৈঠার আদলের গণআদালত হলে তার দেয়া শাস্তিটা সুখকর যে হয় না তা তো এখনকার ক্ষমতাসীনরাই ভালো করে জানেন। তবু আমরা আইনের কথা বলব আর জনগণের কাছে আবেদন জানাব যে, তারা যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী ও নির্যাতনকারীদের প্রতিরোধ করেন। সাংবাদিকরা বহু ক্ষেত্রেই জনগণের চোখ, কান ও কণ্ঠ। শাসকরা (তারা যে দলেরই হোক) ও প্রভাবশালীরা যদি আইনের অপব্যবহার করে ও দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করে সাংবাদিকদের তাদের প্রকৃত কর্তব্য পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারে, তাহলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা অনেক কিছুই জানতে পারবেন না আর কোনো কিছুই বলতে পারবেন না। জনগণের জন্য এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার সময় এখনই। গত এক বছরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে বহু। তাদের কারও কারও পরিবারের নিরীহ সদস্যদের সামনেই বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। তাদের মালিকানাধীন সামান্য দোকানপাটে আগুন দেয়া হয়েছে। দেশের বহু জনপদ এখন সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ গত শনিবার প্রকাশিত তার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ২২৯টি। আর এসব হামলায় নিহত হয়েছেন তিনজন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন একাত্তরজন। এই তথ্য কোনো সাংবাদিক সংগঠন বা সংবাদপত্রের কাছ থেকে এলে আরও খুশি হতাম। আমাদের কাজটা অধিকার করেছে বলে তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর সাংবাদিক আবদুল্লাহ ও তার গাড়িচালকের ওপর হামলাকারীদের জানাই ঘৃণা।
সঙ্গে একটা প্রশ্ন রইল। এ গুরুত্বপূর্ণ সড়কের যে জায়গায় জনাব আবদুল্লাহর ওপর শনিবার এবং এর আগে জনাব মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা হয়েছিল সেই এলাকায়, আমাদের বিবেচনায় সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ নজরদারি থাকার কথা। এখন তারা কি ওই হামলাকারীদের ধরার চেষ্টা করবেন?
এ লেখাটা শেষ করার আগে দাবি জানাচ্ছি, শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজটা যেভাবে দেয়া হয়েছে তাতে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা স্বচ্ছ ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করা হোক।
লেখকঃ সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
No comments