চরাচর-তিন গ্রামে তিন ঘণ্টা by দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
স্বাধীন দেশে গরু আর মানুষে একসঙ্গে বসবাস! কথাটি শুনে সচেতন পাঠকমাত্রই অবাক হতে পারেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের বাস্তর রূপ এখন এটাই। স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের এই বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পঁচাত্তরে দেশের পটপরিবর্তনের পর আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু হয় সোনার বাংলা গড়ার সেই স্বপ্নের। কিন্তু বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন।
বাংলাদেশকে একটি মধ্য-আয়ের দেশে নিয়ে যেতে হলে গ্রামগঞ্জের মানুষের দিকে নজর দিতে হবে। তাদের সুখ-দুঃখের কথা জানতে হবে। কারণ গ্রামের কৃষকদের বাদ দিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখা যাবে না। কৃষি আমাদের প্রধান অর্থনীতি। আর এই কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত গ্রামের কৃষকরাই আজ ভলো নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে যখন মহাজোট সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন গ্রামের কৃষক তার হালের গরু হারিয়ে রাতের আঁধারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বেশ কিছুদিন ধরেই কানে আসছে, আজ এ-গায়ের তো কাল ও-গায়ের গরু চুরি হয়ে গেছে। চুরির আতঙ্কে গ্রামের লোকজন বাড়ির গোয়ালঘরের সামনে বসে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। কেউ বা গোয়ালঘরে মশার কয়েল জ্বালিয়ে গরুর সঙ্গে ঘুমাচ্ছে। সচ্ছল কৃষকরা ঘুমানোর আগে তাদের শোয়ার ঘরে (পাকা ঘরে) গরু নিয়ে বেঁধে রাখছে। এমনকি চোরের ভয়ে গৃহস্থরা রান্নাঘরেও গরু নিয়ে রাখছে। এর সত্যতা যাচাই করতে সম্প্রতি এক রাতে তিন ঘণ্টা কাটিয়ে এলাম শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের মাইজদিহি, ভাগলপুর ও মীননগর গ্রামে। কৃষকদের দুঃখের কথা আর তাঁদের কান্না দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। কৃষক রাসেন্দ্র পাল বললেন, 'চোরের ভয়ে কয়েল জ্বালিয়ে গরুর সঙ্গে গোয়ালঘরেই ঘুমাই। কারণ গরুই আমার সম্পদ। এটা নিয়া গেলে তো আমি সর্বহারা।' শৈল্য বৈদ্য ও টুকন বৈদ্য জানান, চুরির ভয়ে তাঁরা রান্নাঘরে গরু রাখছেন। পাঁচ-ছয় মাস আগে বুধু মিয়ার দুটি গরু চুরি হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তিনটি গরু আছে। আবারও গরুচুরির ভয়ে তিনি রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত গোয়ালঘরের সামনে রাত জেগে বসে থাকেন। কথা হলো সুজিত পাল, মন্নান মিয়া, সত্যরঞ্জন পাল (মাস্টার) ও মনোহর পালের সঙ্গে। সবাই গরুচুরির আতঙ্কে আছেন। কেউ গরুর সঙ্গে গোয়ালঘরে ঘুমাচ্ছেন, কেউ বা শোয়ার ঘরে গরু নিয়ে রাখছেন। দিন দিন গরুচুরির ঘটনা বাড়তে থাকায় তাঁরা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা সরকারপ্রধানের কাছে প্রশ্ন রাখেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা যদি জনগণকেই দিতে হবে, তাহলে আর পুলিশের দরকার কী? কৃষকদের এই কান্না, এই আর্তনাদ কি দায়িত্বশীলদের কানে পেঁৗছে? একসময় মনোহর পাল তাঁর জমিতে চাষ করা আলু, মুখি নিজ উপজেলা ছাড়িয়ে গাড়ি ভর্তি করে পাঠাতেন জেলা শহরে। কিন্তু চুরির ভয়ে গরু বিত্রিু করে দেওয়ায় এখন আর ফসল ফলাতে পারছেন না। এই বাস্তবতা গোপন রেখেই মফস্বলের কর্মকর্তরা সব ভালোর ফিরিস্তি গেয়ে জেলা প্রশাসনে তাঁদের নিজ নিজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে রিপোর্ট করছেন বা জানিয়ে দিচ্ছেন। জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে রাজধানী ঢাকা। টেবিলে টেবিলে শুধু ভালোর বন্দনা। এভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন আমলারা। এটি শুধু ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশের ৪৮০টি উপজেলার মধ্যে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার একটিমাত্র ইউনিয়নের চিত্র, এরকম দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই এ বাংলায় আরো আছে।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
No comments