সংযত মুদ্রানীতি-আর্থিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক
সংযত মুদ্রানীতি নামে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এর ফলে চলতি জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পাবে। কিন্তু এতে দেশে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিম্নগতির রাশ টেনে ধরার যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তা অর্জিত হবে কি?
এমনিতেই রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক নয়, তার ওপর সংকোচনমূলক মূদ্রানীতির কারণে ব্যাংকের সুদ হার বৃদ্ধি ও ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আরও হ্রাস পাবে বলে সার্বিক বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়ে রাজস্ব আয় আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। নির্বাচন সামনে থাকায় সরকারের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে অর্থ সাশ্রয়ের যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে তা আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য কি-না সন্দেহ। আর্থিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে আর কোনো বিকল্প কি ছিল না! ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরার যে কথা বলা হয়েছে তার কোনো লক্ষণ কি আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি? অবশ্যই না। তাই নতুন ব্যবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমবেই, এ কথা হলফ করে বলা যায় না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি ও অন্যান্য পন্থায় অর্থনীতির যে অবৈধ ক্ষেত্র রয়েছে তাতে এসবের ওপর চাপ পড়ার সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রের অর্থের একটি বিরাট অংশ লেনদেনে ব্যবহৃত হয়। তাই একশ্রেণীর লোকের হাতে অর্থের জোগান কিন্তু থেকেই যাবে। ফলে প্রচলিত পণ্যমূল্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে কিছুটা হ্রাস পেলেও অপ্রচলিত পণ্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকার কারণে গড় মূল্যস্ফীতি কতটা কমবে তা হলফ করে কারও পক্ষেই আগাম বলা সম্ভব নয়। তবে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির একটা সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই সম্ভাবনাকে কল্পনা করেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যালান্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতির উন্নতি ও রিজার্ভ বৃদ্ধির আশা করছে। এখানেও কিন্তু আছে। যদি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী না বৃদ্ধি পায় তাহলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতি নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হতে পারে। তখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের দ্বারস্থ হওয়া লাগতে পারে। না হয় নির্দিষ্ট কোনো দেশের ব্যাংকের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করতে হতে পারে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হলে তখন কাঠামোগত পরিবর্তনসহ অনেক শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হতে হবে। এতে সরকারের অর্থ খরচের স্বাধীনতাও কমে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি কোনো মর্যাদাশীল জাতির কাম্য হতে পারে না। তাই আমরা চাইব, সংযত মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতির যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তা যেন পূরণ হয়। এ জন্য সরকারকে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তার ঋণ গ্রহণ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিলাস সামগ্রীসহ সার্বিক আমদানিও হ্রাস করতে হবে। তবে এই মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগে ভাটা পড়বে। নতুন শিল্পোদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ হ্রাস পাবে। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চিন্তা এখনই করতে হবে।
No comments