চলছে ভ্রুণ হত্যা by আদিত্য আরাফাত
পৌষের হাড় কাঁপানো এক সকাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রী ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের সামনে হাতে ক্লিনিকের রিপোর্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক তরুণী। চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি! মাঝে মাঝে ক্লিনিকের রিপোর্ট খুলে দেখছেন । একসময় ডাক্তারের রুম খুললেন হাসপাতালের এক নারীকর্মী।
রুম খোলার সঙ্গে সঙ্গে তরুণী ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে হাসপাতালের ওই কর্মী বলেন-‘আরে আরে... কই ঢুকছেন আপনি....ডাক্তার আপা না আসা পর্যন্ত ভেতরে যাওয়া নিষেধ।’ তরুণী বলেন-‘দেখুন আমি দাঁড়াতে পারছি না, বিপদে পড়ে অনেক দূর থেকে এসেছি। আমি ভেতরে এসে আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।’ হাসপাতালের স্টাফ বাঁধা দেন। মৃদু কথা কাটাকাটি হয়। এসময় রুমে প্রবেশ করেন স্ত্রী রোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ। রুমে প্রবেশ করতেই ডাক্তার জানতে চান-‘কী হয়েছে?’ তরুণী বলেন-‘আপা আমি বিপদে পড়েছি... আপনাকে বুঝিয়ে বলছি....।’
মিনিট কয়েক পর মেয়েটি চোখ মুছতে মুছতে ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হন। পেশাগত পরিচয় দিয়ে তরুণীর কাছে বিষয় জানতে চাইলে কিছুই বলে না। মুখ মুছতে মুছতে তরুণী হেঁটে চলে যায়। কৌতূহলী হয়ে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করে বিষয়টি জানতে চাই। ডাক্তার এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না। একপর্যায়ে নাম না বলার শর্তে ঘটনাটি বলতে রাজী হন।
হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জানান, মেয়েটি এসেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। সাড়ে পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্বা। পাঁচ মাস অবস্থায় গর্ভপাত নিরাপদ নয়। তাছাড়া তরুণী অবিবাহিত।
ডাক্তার বললেন, ‘প্রতিদিন এমন অনেকেই আসেন। নতুন কিছু নয়।’
একটুখানি অসতর্কতায় অনাকাঙ্ক্ষিভাবে নারীর গর্ভে মানবভ্রুণের সৃষ্টি হয়। অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে অনেক নারীই গর্ভপাতের পথ বেঁচে নেন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত করতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যবরণ করেন। সারা বিশ্বেই বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। সেই সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে গর্ভপাতও। এই অস্বস্তিকর-অমানবিক নির্মমমতার যজ্ঞে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। কখনো সমাজ ও পরিবারে দুর্নাম থেকে বাঁচতে, কখনো পরিবারকে ছোট রাখতে নারীরা গর্ভপাতের পথ বেঁছে নেন।
রাজধানীর একটি মেরিস্টোপস ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় এক কোণে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন সামিনা (প্রকৃত নাম নয়)। তার স্বামী কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিছুক্ষণ পর পর সামিনার কাছে এসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। সামিনা দুই কন্যা সন্তানের জননী। বর্তমানে অন্তঃস্বত্বা। আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টে ওঠে আসে গর্ভের ভ্রণটি কন্যা সন্তানের। সে কারণে এই সন্তানটি ভূমিষ্ঠ করাতে রাজি নন তার স্বামী। কিন্তু সামিনার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার স্বামীর মন গলাতে পারেনি। তার সাফ কথা, ছেলে না হলে আর কোনো সন্তানের প্রয়োজন নেই। বাধ্য হয়ে সামিনাকে ঝুঁকি নিয়েই গর্ভপাত করানো হলো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (অবস্) গাইনি বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক ফেরদৌসি ইসলাম বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এমন গর্ভপাতের কারণে নারীদের প্রাণহানি ঘটছে।’
তিনি জানান, একান্ত যদি গর্ভপাত বা এম আর করানো হয় তাহলে যেন সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারাই করানো হয়।
গর্ভপাত নিয়ে রয়েছে পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি
উইকিপিডিয়ায় গর্ভপাতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘গর্ভপাত বলতে সন্তান প্রসবের আগে, সাধারণত গর্ভধারণের প্রথম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে, জরায়ু থেকে ভ্রণের অপসারণ ও বিনষ্টকরণকে বোঝায়।’
বিশ্বজুড়েই গর্ভপাতের পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিবাদীরা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করছেন। বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ও বিভিন্ন ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি সরাসরি শিশুহত্যা। কেননা ভ্রণ মানেই হচ্ছে শিশুর আকার।
অন্যদিকে গর্ভপাতের পক্ষে যারা তারা বলছেন ভ্রুণহত্যা মানেই শিশুহত্যা নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে ভ্রণ যদি মানবের পুরোপুরি আকারে রূপান্তর না হয় তাহলে তা শিশুহত্যা হতে পারে না। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে গর্ভপাত নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। ধর্মীয়ভাবে গর্ভপাত নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত ঘটনার শিকার নারীর সম্মানের কথা ভেবে গর্ভপাত করানো হয়। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক যোগ হয়েছে পুত্র সন্তানকাংখীদের মনোভাব- যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে গর্ভস্থ মেয়ে ভ্রূণকে হত্যা করা হয় গর্ভপাতের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের গর্ভপাত আইন
বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশের গর্ভপাত আইন (১৮৬০-এর ব্রিটিশ পেনাল কোড) অনুযায়ী- অন্তঃসত্ত্বার জীবন বাঁচানো ছাড়া অন্য কোনো কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্ষণ, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণ, ভ্রণের বিকলাঙ্গতা এসব কারণেও গর্ভপাত আইনসিদ্ধ নয়। অবশ্য গর্ভপাতের আইনের উইকি তথ্য অনুযায়ী ১২ সপ্তাহের মধ্যে করলে এ সমস্ত ক্ষেত্রে গর্ভপাত গ্রহণযোগ্য।
কারা করচ্ছেন
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, পরিবার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠান, কয়েকটি ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায় গর্ভপাত করতে যারা আসছেন তাদের মধ্যে ১৬ বছরের কিশোরী থেকে মধ্য বয়স্ক নারীও রয়েছেন। বিয়ের আগে অনেকেই অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে গর্ভবতী হওয়ায় বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ক্লিনিকের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বর্তমানে গর্ভপাত করাতে যারা আসছেন তাদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীর সংখ্যা বেশি। লোকলজ্জার ভয়ে তারা গোপনে বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভের ভ্রণ নষ্ট করে আসেন।’
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানান, বিবাহিতদের মধ্যে যারা আসছেন তাদের মধ্যে নতুন দম্পত্তির সংখ্যা বেশি। বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যে অসতর্কতার কারণে গর্ভবতী হওয়ায় অনেকেই গর্ভপাতের পথ বেছে নিচ্ছেন। অন্যদিকে একাধিক সন্তান থাকার পর অসতর্কতার কারণে যেসব নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন তারাও গর্ভপাত কছেন। এছাড়া সন্তাব প্রসবের জন্য মায়ের জীবন হুমকির মুখে থাকবে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শে গর্ভপাত করানো হচ্ছে।
তবে গর্ভপাতের ওপর সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়ে যে বিষয়টি অনেক শিক্ষিত পুরুষের মধ্যেও দেখা গেছে তা হলো, আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে মেয়েশিশু জানতে পেরেই স্বামীর নির্দেশে গর্ভপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক নারীই। বর্তমানে আলট্রাসনোগ্রামে সাধারণত ভ্রুণের পাঁচ মাস বয়সে লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব হয়।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানিয়েছেন, এ সময় গর্ভপাত ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতের ফলে নারীর বন্ধ্যাত্ব, শারীরিক, মানসিক সমস্যাসহ মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেক।
চলছে গলাকাটা ব্যবসা!
বিভিন্ন ক্লিনিক ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গর্ভপাতের নামে চলছে গলাকাটা ব্যবসা। রাজধানীর আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লিনিক মালিকরা নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায় অবৈধভাবে গর্ভপাতই বেশি করানো হচ্ছে। বিশেষ করে গর্ভপাত করতে গিয়ে যেসব নারী স্বামীকে উপস্থিত করতে পারছেন না বা যাদের স্বামী নেই তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চুক্তিতে গর্ভপাত করানো হচ্ছে। গর্ভপাত ঘটানোর সময় মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই তা নজরে আসে। তাছাড়া শত শত ঘটনা থেকে যাচ্ছে অন্তরালে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেখানে মাত্র পাঁচ শ’ টাকায় এমআর করার সুযোগ রয়েছে সেখানে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লিনিক ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নিচ্ছে। একশ্রেণীর দালাল অবৈধভাবে এ কাজে জড়িত রয়েছেন।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতাল, প্রজনন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কিছু দালাল রয়েছে। এসব দালালরা নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন। প্রাইভেট ক্লিনিকের সঙ্গে এসব দালালচক্র কমিশন ভিত্তিতে কাজ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গর্ভপাত করাতে আসা এক নারী জানালেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে নানা কৈফিয়ত দিতে হয় তাই বাধ্য হয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে দালালের মাধ্যমে করতে বাধ্য।
রাজধানীর একটি ক্লিনিকের কর্ণধার নাম না বলার স্বর্তে স্বীকার করলেন, মোটা অংকের টাকা নিলেও এতে তারা নারীর উপকারই করছেন।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা এলাকার বেশকিছু অখ্যাত ক্লিনিকে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে গর্ভপাত করছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলাশহরগুলোর ক্লিনিকে নার্সদের মাধ্যমেও অনেকেই গর্ভপাত করছেন।
বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ
দেশে বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর স্বল্পতা বা মজুদ শূন্যতার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানব ও অর্থনীতির ওপর।
বড়ি, ইনজেকশন ও কনডমের স্বল্পতা বা মজুদহীনতা বা অনিয়মিত সরবরাহ বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রতিবছর অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮শ’ জন নারী। যাদের ৯০ হাজার ২শ’ ৪০ জন এ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে ‘এমআর’ ও ২২ হাজার ৫শ’ ৬০ জন ‘অ্যাবরশন’ করছেন।
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি) এবং হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এইচডিআরসি) ২০১০ সালের গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, সারাদেশে ৩০৬ জন গর্ভপাত করছেন।
তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে প্রকৃত এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। রাজধানীর উল্লেখযোগ্য ২৫টি প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও ক্লিনিকে ঘুরে জানা যায়, এসব হাসপাতালে দৈনিক শতাধিকের বেশি গর্ভপাত হচ্ছে। ধারণা করা যায়, শুধু রাজধানীতেই দৈনিক গর্ভপাত হচ্ছে ২শ’র বেশি। সে হিসেবে ধারণা করা যায় সারা দেশে দৈনিক দেড় হাজারের বেশি গর্ভপাত হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও জানিয়েছেন, সারাদেশে দৈনিক গর্ভপাত দেড় হাজারের কম হবে না। কেননা গ্রামের অনেকেই এখনও হোমিও ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দ্বারা গর্ভপাত করছেন; যাদের তালিকা সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে উঠে আসছে না।
এফপিএবি ও এইচডিআরসি’র ২০১০ সালের প্রতিবেদনে ওঠে আসে, জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করছেন মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ দশমিক ৮ ভাগ নারী-পুরুষ। প্রতিবছর ১ লাখ ৬০ হাজার ৫শ’ ৮৫ জন নানা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিশেষ করে খাবার বড়ি, ইনজেকশন ও কনডমের স্বল্পতা বা পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সাইন্স বিভাগের শিক্ষক ও প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী জানান, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি শুরু হওয়ার প্রায় চার দশক পরও মাত্র অর্ধেক দম্পতিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও শতকরা ১৭ দশমিক ৬ ভাগ আগ্রহী দম্পতিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দিতে পারছে না পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। আর গ্রহণকারীদের অনেকেই নিয়মিত সামগ্রী না পাওয়ার কারণে নানাভাবে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
গর্ভধারণের নিশ্চয়তা
মিনিট কয়েক পর মেয়েটি চোখ মুছতে মুছতে ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হন। পেশাগত পরিচয় দিয়ে তরুণীর কাছে বিষয় জানতে চাইলে কিছুই বলে না। মুখ মুছতে মুছতে তরুণী হেঁটে চলে যায়। কৌতূহলী হয়ে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করে বিষয়টি জানতে চাই। ডাক্তার এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না। একপর্যায়ে নাম না বলার শর্তে ঘটনাটি বলতে রাজী হন।
হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জানান, মেয়েটি এসেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। সাড়ে পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্বা। পাঁচ মাস অবস্থায় গর্ভপাত নিরাপদ নয়। তাছাড়া তরুণী অবিবাহিত।
ডাক্তার বললেন, ‘প্রতিদিন এমন অনেকেই আসেন। নতুন কিছু নয়।’
একটুখানি অসতর্কতায় অনাকাঙ্ক্ষিভাবে নারীর গর্ভে মানবভ্রুণের সৃষ্টি হয়। অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে অনেক নারীই গর্ভপাতের পথ বেঁচে নেন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত করতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যবরণ করেন। সারা বিশ্বেই বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। সেই সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে গর্ভপাতও। এই অস্বস্তিকর-অমানবিক নির্মমমতার যজ্ঞে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। কখনো সমাজ ও পরিবারে দুর্নাম থেকে বাঁচতে, কখনো পরিবারকে ছোট রাখতে নারীরা গর্ভপাতের পথ বেঁছে নেন।
রাজধানীর একটি মেরিস্টোপস ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় এক কোণে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন সামিনা (প্রকৃত নাম নয়)। তার স্বামী কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিছুক্ষণ পর পর সামিনার কাছে এসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। সামিনা দুই কন্যা সন্তানের জননী। বর্তমানে অন্তঃস্বত্বা। আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টে ওঠে আসে গর্ভের ভ্রণটি কন্যা সন্তানের। সে কারণে এই সন্তানটি ভূমিষ্ঠ করাতে রাজি নন তার স্বামী। কিন্তু সামিনার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার স্বামীর মন গলাতে পারেনি। তার সাফ কথা, ছেলে না হলে আর কোনো সন্তানের প্রয়োজন নেই। বাধ্য হয়ে সামিনাকে ঝুঁকি নিয়েই গর্ভপাত করানো হলো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (অবস্) গাইনি বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক ফেরদৌসি ইসলাম বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এমন গর্ভপাতের কারণে নারীদের প্রাণহানি ঘটছে।’
তিনি জানান, একান্ত যদি গর্ভপাত বা এম আর করানো হয় তাহলে যেন সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারাই করানো হয়।
গর্ভপাত নিয়ে রয়েছে পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি
উইকিপিডিয়ায় গর্ভপাতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘গর্ভপাত বলতে সন্তান প্রসবের আগে, সাধারণত গর্ভধারণের প্রথম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে, জরায়ু থেকে ভ্রণের অপসারণ ও বিনষ্টকরণকে বোঝায়।’
বিশ্বজুড়েই গর্ভপাতের পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিবাদীরা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করছেন। বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ও বিভিন্ন ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি সরাসরি শিশুহত্যা। কেননা ভ্রণ মানেই হচ্ছে শিশুর আকার।
অন্যদিকে গর্ভপাতের পক্ষে যারা তারা বলছেন ভ্রুণহত্যা মানেই শিশুহত্যা নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে ভ্রণ যদি মানবের পুরোপুরি আকারে রূপান্তর না হয় তাহলে তা শিশুহত্যা হতে পারে না। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে গর্ভপাত নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। ধর্মীয়ভাবে গর্ভপাত নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত ঘটনার শিকার নারীর সম্মানের কথা ভেবে গর্ভপাত করানো হয়। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক যোগ হয়েছে পুত্র সন্তানকাংখীদের মনোভাব- যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে গর্ভস্থ মেয়ে ভ্রূণকে হত্যা করা হয় গর্ভপাতের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের গর্ভপাত আইন
বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশের গর্ভপাত আইন (১৮৬০-এর ব্রিটিশ পেনাল কোড) অনুযায়ী- অন্তঃসত্ত্বার জীবন বাঁচানো ছাড়া অন্য কোনো কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্ষণ, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণ, ভ্রণের বিকলাঙ্গতা এসব কারণেও গর্ভপাত আইনসিদ্ধ নয়। অবশ্য গর্ভপাতের আইনের উইকি তথ্য অনুযায়ী ১২ সপ্তাহের মধ্যে করলে এ সমস্ত ক্ষেত্রে গর্ভপাত গ্রহণযোগ্য।
কারা করচ্ছেন
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, পরিবার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠান, কয়েকটি ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায় গর্ভপাত করতে যারা আসছেন তাদের মধ্যে ১৬ বছরের কিশোরী থেকে মধ্য বয়স্ক নারীও রয়েছেন। বিয়ের আগে অনেকেই অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে গর্ভবতী হওয়ায় বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ক্লিনিকের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বর্তমানে গর্ভপাত করাতে যারা আসছেন তাদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীর সংখ্যা বেশি। লোকলজ্জার ভয়ে তারা গোপনে বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভের ভ্রণ নষ্ট করে আসেন।’
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানান, বিবাহিতদের মধ্যে যারা আসছেন তাদের মধ্যে নতুন দম্পত্তির সংখ্যা বেশি। বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যে অসতর্কতার কারণে গর্ভবতী হওয়ায় অনেকেই গর্ভপাতের পথ বেছে নিচ্ছেন। অন্যদিকে একাধিক সন্তান থাকার পর অসতর্কতার কারণে যেসব নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন তারাও গর্ভপাত কছেন। এছাড়া সন্তাব প্রসবের জন্য মায়ের জীবন হুমকির মুখে থাকবে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শে গর্ভপাত করানো হচ্ছে।
তবে গর্ভপাতের ওপর সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়ে যে বিষয়টি অনেক শিক্ষিত পুরুষের মধ্যেও দেখা গেছে তা হলো, আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে মেয়েশিশু জানতে পেরেই স্বামীর নির্দেশে গর্ভপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক নারীই। বর্তমানে আলট্রাসনোগ্রামে সাধারণত ভ্রুণের পাঁচ মাস বয়সে লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব হয়।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানিয়েছেন, এ সময় গর্ভপাত ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতের ফলে নারীর বন্ধ্যাত্ব, শারীরিক, মানসিক সমস্যাসহ মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেক।
চলছে গলাকাটা ব্যবসা!
বিভিন্ন ক্লিনিক ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গর্ভপাতের নামে চলছে গলাকাটা ব্যবসা। রাজধানীর আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লিনিক মালিকরা নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায় অবৈধভাবে গর্ভপাতই বেশি করানো হচ্ছে। বিশেষ করে গর্ভপাত করতে গিয়ে যেসব নারী স্বামীকে উপস্থিত করতে পারছেন না বা যাদের স্বামী নেই তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চুক্তিতে গর্ভপাত করানো হচ্ছে। গর্ভপাত ঘটানোর সময় মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই তা নজরে আসে। তাছাড়া শত শত ঘটনা থেকে যাচ্ছে অন্তরালে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেখানে মাত্র পাঁচ শ’ টাকায় এমআর করার সুযোগ রয়েছে সেখানে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লিনিক ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নিচ্ছে। একশ্রেণীর দালাল অবৈধভাবে এ কাজে জড়িত রয়েছেন।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতাল, প্রজনন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কিছু দালাল রয়েছে। এসব দালালরা নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন। প্রাইভেট ক্লিনিকের সঙ্গে এসব দালালচক্র কমিশন ভিত্তিতে কাজ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গর্ভপাত করাতে আসা এক নারী জানালেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে নানা কৈফিয়ত দিতে হয় তাই বাধ্য হয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে দালালের মাধ্যমে করতে বাধ্য।
রাজধানীর একটি ক্লিনিকের কর্ণধার নাম না বলার স্বর্তে স্বীকার করলেন, মোটা অংকের টাকা নিলেও এতে তারা নারীর উপকারই করছেন।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা এলাকার বেশকিছু অখ্যাত ক্লিনিকে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে গর্ভপাত করছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলাশহরগুলোর ক্লিনিকে নার্সদের মাধ্যমেও অনেকেই গর্ভপাত করছেন।
বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ
দেশে বাড়ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর স্বল্পতা বা মজুদ শূন্যতার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানব ও অর্থনীতির ওপর।
বড়ি, ইনজেকশন ও কনডমের স্বল্পতা বা মজুদহীনতা বা অনিয়মিত সরবরাহ বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রতিবছর অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮শ’ জন নারী। যাদের ৯০ হাজার ২শ’ ৪০ জন এ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে ‘এমআর’ ও ২২ হাজার ৫শ’ ৬০ জন ‘অ্যাবরশন’ করছেন।
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি) এবং হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এইচডিআরসি) ২০১০ সালের গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, সারাদেশে ৩০৬ জন গর্ভপাত করছেন।
তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে প্রকৃত এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। রাজধানীর উল্লেখযোগ্য ২৫টি প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও ক্লিনিকে ঘুরে জানা যায়, এসব হাসপাতালে দৈনিক শতাধিকের বেশি গর্ভপাত হচ্ছে। ধারণা করা যায়, শুধু রাজধানীতেই দৈনিক গর্ভপাত হচ্ছে ২শ’র বেশি। সে হিসেবে ধারণা করা যায় সারা দেশে দৈনিক দেড় হাজারের বেশি গর্ভপাত হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও জানিয়েছেন, সারাদেশে দৈনিক গর্ভপাত দেড় হাজারের কম হবে না। কেননা গ্রামের অনেকেই এখনও হোমিও ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দ্বারা গর্ভপাত করছেন; যাদের তালিকা সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে উঠে আসছে না।
এফপিএবি ও এইচডিআরসি’র ২০১০ সালের প্রতিবেদনে ওঠে আসে, জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করছেন মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ দশমিক ৮ ভাগ নারী-পুরুষ। প্রতিবছর ১ লাখ ৬০ হাজার ৫শ’ ৮৫ জন নানা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিশেষ করে খাবার বড়ি, ইনজেকশন ও কনডমের স্বল্পতা বা পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সাইন্স বিভাগের শিক্ষক ও প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী জানান, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি শুরু হওয়ার প্রায় চার দশক পরও মাত্র অর্ধেক দম্পতিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও শতকরা ১৭ দশমিক ৬ ভাগ আগ্রহী দম্পতিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দিতে পারছে না পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। আর গ্রহণকারীদের অনেকেই নিয়মিত সামগ্রী না পাওয়ার কারণে নানাভাবে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
গর্ভধারণের নিশ্চয়তা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নার্গিস আকতার বলেন, অনেক মহিলা পিরিয়ড মিস করলেই বুঝতে পারেন তিনি অন্ত:স্বত্বা কিনা তার আভাস পান । অনেকে আবার শরীরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করেন। হয়ত স্তন সামান্য স্ফীতি, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা ও খাবারে অনীহা ইত্যাদি হলে।
তিনি জানান, প্রথমেই করা দরকার একটা প্রেগনেন্সি টেস্ট। এতে প্রেগনেন্সিজনিত হরমোন এইচসিজি (হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন) বেড়েছে কিনা দেখা হয়। ভ্রণ যে মুহূর্তে জরায়ুর দেওয়ালে সেঁটে বসে, রক্তে এই হরমোন সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় এবং এর কাণ্ড ঘটে পরবর্তী পিরিয়ড শুরুর আগেই। তবে ফলাফল পজিটিভ হতে পিরিয়ড মিস করার অন্তত এক সপ্তাহ বাদে প্রস্রাবটা পরীক্ষা করা জরুরি। যেসব মহিলা অপেক্ষাকৃত বয়স্কা এবং যাদের পিরিয়ড অনিয়মিত, তাদের প্রেগনেন্সি নির্ণয় কিন্তু বিলম্বিত হতে পারে। কোনো ডাক্তার হয় পরীক্ষা করে বুঝলেন, নয়ত অন্য কোনো কারণে আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে গিয়ে ধরা পড়ল।
কখন গর্ভপাত করতে হবে?
রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, গর্ভপাতের বিষয়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা দরকার। তার মতামত বোঝা দরকার যাতে সহজে যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। তবে অনেক সময় পরিবারভুক্ত নন যেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মেডিক্যাল পেশাদার নয়ত মনোবিদ-কাউন্সেলর-এর সঙ্গে কথা বলেও লাভবান হওয়া যায়। দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ হচ্ছে-যদি প্রেগন্যান্সি চলার ফলে মায়ের জীবন বিপন্ন হয় তাহলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে গর্ভপাত করতে হবে। এছাড়া প্রেগনেন্ট মহিলার স্থায়ী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকলে গর্ভপাত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানান, যদি সদ্য প্রেগনেন্সি হয়ে থাকে (৭ সপ্তাহের কম) তা হলে মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগনেন্সির পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এতে অস্ত্রোপচার এড়ানো যায় তবে কিছু বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে। কিছু নারীর ক্ষেত্রে এ রাস্তায় কাজ হয় না। তখন জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ায় মাধ্যমে শল্য চিকিৎসায় জরায়ু শূন্য করার প্রয়োজন পড়ে।
মিফেপ্রিস্টোন (এক ধরনের হরমোন যা প্রোজেস্টেরন উৎপাদন বন্ধ করে এবং প্রেগনেন্সি বজায় রাখার সংকট দেখা দেয়) ট্যাবলেট মুখে খাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। সামান্য কিছু মহিলার তাতে অল্প রক্তক্ষরণ এবং ব্যথা শুরু হয়। দু’দিন বাদে প্রোজেস্টেরনের ভ্যাজাইনাল ট্যাবলেট (পেসারি) যৌনিপথে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন দেখা দেয় যাতে জরায়ুর সঙ্কোচন শুরু হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে। জরায়ু দেওয়াল ভাঙতে শুরু করে এবং প্রচণ্ড ভারী ব্লিডিংয়ে গর্ভস্থ ভ্রুণ ছিটকে বেরিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ১০ দিন অবধি ব্লিডিং চলতে পারে। ২ সপ্তাহের মধ্যে একবার ফলোআপ পরামর্শদানের প্রয়োজন হয়, যাতে দেখা হয় কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হলো কিনা।
অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে গর্ভপাত
তিনি জানান, প্রথমেই করা দরকার একটা প্রেগনেন্সি টেস্ট। এতে প্রেগনেন্সিজনিত হরমোন এইচসিজি (হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন) বেড়েছে কিনা দেখা হয়। ভ্রণ যে মুহূর্তে জরায়ুর দেওয়ালে সেঁটে বসে, রক্তে এই হরমোন সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় এবং এর কাণ্ড ঘটে পরবর্তী পিরিয়ড শুরুর আগেই। তবে ফলাফল পজিটিভ হতে পিরিয়ড মিস করার অন্তত এক সপ্তাহ বাদে প্রস্রাবটা পরীক্ষা করা জরুরি। যেসব মহিলা অপেক্ষাকৃত বয়স্কা এবং যাদের পিরিয়ড অনিয়মিত, তাদের প্রেগনেন্সি নির্ণয় কিন্তু বিলম্বিত হতে পারে। কোনো ডাক্তার হয় পরীক্ষা করে বুঝলেন, নয়ত অন্য কোনো কারণে আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে গিয়ে ধরা পড়ল।
কখন গর্ভপাত করতে হবে?
রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, গর্ভপাতের বিষয়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা দরকার। তার মতামত বোঝা দরকার যাতে সহজে যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। তবে অনেক সময় পরিবারভুক্ত নন যেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মেডিক্যাল পেশাদার নয়ত মনোবিদ-কাউন্সেলর-এর সঙ্গে কথা বলেও লাভবান হওয়া যায়। দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ হচ্ছে-যদি প্রেগন্যান্সি চলার ফলে মায়ের জীবন বিপন্ন হয় তাহলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে গর্ভপাত করতে হবে। এছাড়া প্রেগনেন্ট মহিলার স্থায়ী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকলে গর্ভপাত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানান, যদি সদ্য প্রেগনেন্সি হয়ে থাকে (৭ সপ্তাহের কম) তা হলে মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগনেন্সির পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এতে অস্ত্রোপচার এড়ানো যায় তবে কিছু বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে। কিছু নারীর ক্ষেত্রে এ রাস্তায় কাজ হয় না। তখন জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ায় মাধ্যমে শল্য চিকিৎসায় জরায়ু শূন্য করার প্রয়োজন পড়ে।
মিফেপ্রিস্টোন (এক ধরনের হরমোন যা প্রোজেস্টেরন উৎপাদন বন্ধ করে এবং প্রেগনেন্সি বজায় রাখার সংকট দেখা দেয়) ট্যাবলেট মুখে খাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। সামান্য কিছু মহিলার তাতে অল্প রক্তক্ষরণ এবং ব্যথা শুরু হয়। দু’দিন বাদে প্রোজেস্টেরনের ভ্যাজাইনাল ট্যাবলেট (পেসারি) যৌনিপথে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন দেখা দেয় যাতে জরায়ুর সঙ্কোচন শুরু হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে। জরায়ু দেওয়াল ভাঙতে শুরু করে এবং প্রচণ্ড ভারী ব্লিডিংয়ে গর্ভস্থ ভ্রুণ ছিটকে বেরিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ১০ দিন অবধি ব্লিডিং চলতে পারে। ২ সপ্তাহের মধ্যে একবার ফলোআপ পরামর্শদানের প্রয়োজন হয়, যাতে দেখা হয় কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হলো কিনা।
অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে গর্ভপাত
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা বলেন, ওটিতে হালকা জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার মাধ্যমে গর্ভপাত করানো হয়। ১২ সপ্তাহ অবধি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গর্ভপাতের পরামর্শ দেওয়া হবে। অস্ত্রোপচার শুরুর এক ঘণ্টা বা তারও কিছু আগে যোনিপথে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন পেসারি প্রবেশ করাবেন। এতে জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্স সামান্য শিখিল হবে এবং খুলে যাবে। কখনো কখনো অস্ত্রোপচারের আগে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে মন শান্ত করা হয়। অস্ত্রোপচার কক্ষে যোনিদ্বার সাফ করার পর সেখানে স্পেকুলাম ঢুকিয়ে জরায়ুমুখ দেখা হয়। তাকে ফরসেপস্ দিয়ে স্থিরভাবে ধরে এবার ডাইলেট ব্যবহার করে পথটা খুলে দেওয়া হয়। তারপর জরায়ুর মধ্যে সরু প্লাস্টিক টিউব ঢুকিয়ে তা সাকশন যন্ত্রে যুক্ত করা হয়। এটা প্রেগন্যান্সিকে ধীরে ধীরে স্থানচ্যুত করে। এবার ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ার পর জরায়ু সত্যি খালি হলো কিনা তা দেখার জন্য কিউরেট যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটা ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় নেয়। কয়েক ঘণ্টা আচ্ছন্ন ভাব থাকে, একটু অসুস্থবোধ হতে পারে।
১২ থেকে ১৩ সপ্তাহের পর যে কোনো গর্ভপাত বেশ জটিল ব্যাপার। হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়মিত কিছু নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ভ্যাজাইনাল পেসারি দেওয়া হয় যোনিপথে। তাতে জরায়ুতে লেবার বা প্রসবের মতো সঙ্কোচন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্স খুলে যায়। এখানে ব্যথা নিবারণের ব্যবস্থা রাখতে হয় এবং দেখা গেছে ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নার্সের সহায়তায় প্রেগনেন্সি নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়।
গর্ভপাতে যেসব বিপদজনক কৌশল অবলম্বন করা হয়
বাংলাদেশে দুটি শিক্ষাদানরত হাসপাতাল, দুটি জেলা হাসপাতাল ও চারটি থানা কমপ্লেক্সসহ ৮ টি কেন্দ্রে ৬১০ জন মহিলার এক গবেষণায় দেখা যায় যে, অনেক গর্ভবতী নারী এ ধরণের বিপদজ্জনক বিপদজনক কৌশল অবলম্বন করে চলেছে।
গর্ভপাতে ব্যবহ্রত পদ্ধতিসমূহ
শতাংশ
জরায়ুতে কঠিন পদার্থ দিয়ে কাঠি ঢুকানো
৩২.৫
ইনজেকশন/ক্যাপসুল/ট্যাবলেট/খাওয়ার বড়ি
২৬.৬
দেশীয় টেবলেট/মিশ্রন
১৭.৫
অভিশ্বসন/মাসিক নিয়ন্ত্রন
২২.১
প্রসারণ/চাঁদন
৪.৬
জরায়ুর ভিতরে পরিনিষেচন
২.৩
তলপেটে চাপদান
০.৬
অন্যান্য উপায়ে
২.৯
(সারনির তথ্য সূত্র-বাংলাপিডিয়া)
৩ কারণে মৃত্যু!
ডা. ইফফাত আরা বলেন, গর্ভপাতের সময় মূলত ৩টি কারণে মৃত্যু হতে পারে। অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ, ইনফেকশন ও খাদ্যনালী ফুটো হয়ে গেলে মৃত্যু হতে পারে। তিনি জানান, যত দ্রুত অর্থাৎ কম সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করা যায়, জটিলতার সম্ভাবনা তত কম। ৩ মাসের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা গর্ভপাত করা যায় ততই বিপদের ঝুঁকি কম থাকে।
গর্ভপাতের পর যে জটিলতা সবচেয়ে দেখা দেয় তা হচ্ছে সংক্রমণ। তাতে ব্যথা, অস্বাভাবিক ডিসচার্জ এবং গর্ভপাতের পরও দীর্ঘায়িত ব্লিডিং।
প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মেরী স্টোপসের পরিচালক (প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট) কাজী গোলাম রসুল বলেন, অনিরাপদ গর্ভপাতের পর ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, জরায়ু, মূত্রনালি এবং অন্ত্রনালি ছিদ্র হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা ছিঁড়ে এক হয়ে যাওয়া, বন্ধ্যাত্বের শিকার হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হন নারীরা।
(উৎস-প্রজনন-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা, বাংলাপিডিয়া)
প্রয়োজন যৌন সচেতনতা
বিশেষজ্ঞরা ডাক্তাররা জানান, ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’- এ স্লোগানের সঙ্গে যোগ করে বলেছেন, বাঁচতে হলে জানতেও হবে মানতে হবে। যৌন শিক্ষা শুধু যে এইডস থেকে মুক্ত করতে পারে তা নয়, সংক্রামক অনেক রোগসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক সংক্রামক রোগের পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নারী শরীরে সন্তান নিয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নার্গিস আকতার বলেন, ‘শারীরিক কারণে অনেক নারী স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। তাঁদের স্বামীরাও কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করেন না। তাই কোনো কোনো নারীকে দু-তিনবার পর্যন্ত এমআর করে দিতে হচ্ছে।’
তিনি জানান, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভে আসা সন্তান না রাখতে চাইলে তার পথও খোলা আছে। নারীর শেষ মাসিকের প্রথম দিন হিসাবে ৬ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে এমআর বা মাসিক নিয়মিত করার পদ্ধতি (যে কোনো কারণে মাসিক বন্ধ থাকলে তা নিয়মিত করে দেওয়া) বৈধ।
তিনি বলেন, ‘অনেক স্বামী নিজে সচেতন না হয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে এমআরকেই বেছে নেন। এটা যে স্ত্রীর শারীরিক ক্ষতির কারণ, তা আমলে নেন না।’
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানিয়েছেন, নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও যৌন শিক্ষায় সচেতন থাকতে হবে।
এশিয়ায় ১০ কোটি ১৭ লাখ কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা
বিশ্বজুড়েই বাড়ছে গর্ভপাত। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডাসহ এশিয়াতেও আশঙ্খাজনকভাবে গর্ভপাতের হার ক্রমাগত বাড়ছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফির অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর লিঙ্গ চিহ্নিত করে গর্ভপাত ঘটানোর হার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে এশিয়ায়। বিশেষত ভারতে মেয়েশিশু গর্ভপাতের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
জাতিসংঘের ২০১১ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এশিয়ার ১০ কোটি ১৭ লাখ কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার বড় অংশটিই হচ্ছে ভারতে। ফলে দেশটিতে দিন দিন কমে যাচ্ছে কন্যাসন্তানের সংখ্যা।
ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণেই এ রকম নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। দম্পতিরা আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের মাধ্যমে গর্ভজাত সন্তানকে শনাক্ত করে এবং শিশুকন্যা হলে তার গর্ভপাত ঘটায়। এ অবস্থায় কিছু দিন আগে পোর্টেবল আল্ট্রাসনো মেশিন ব্যবহারের দায়ে মুম্বাইয়ের মেডিক্যাল কলেজের একজন রেডিওলজিস্টের বিরুদ্ধে সেখানকার হাইকোর্টে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আলজাজিরা সূত্রে জানা যায়, কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ভারতের ডা. নিলাম সিং। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ সম্পর্কে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, দেশের প্রাচীন রীতিনীতিই মূলত গর্ভপাতের প্রধান কারণ। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন বংশ রক্ষার জন্য ছেলেসন্তান জরুরি। এই ধ্যানধারণা যে শুধু অশিক্ষিত ও দরিদ্র পরিবারের বেশি তা নয়; শিক্ষিত ও ধনী পরিবারগুলোতেও একই ধরনের সংস্কৃতির চর্চা চলে। আর তাদের এই চিন্তাধারার কারণে বলি হচ্ছে শত-সহস্র কন্যাশিশুর ভ্রূণ। অর্থনৈতিক বৈষম্য কন্যাশিশু হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
ভারতের মতো আমাদের দেশে আশঙ্ক্ষাজনকভাবে মেয়ে ভ্রুণ হত্যা না হলেও ক্রমাগত ভ্রুণ হত্যা বাড়ছেই।
আল্ট্রাসনোগ্রাফির অপব্যবহারের কারণে মেয়ে শিশু ভ্রুণ নষ্ট করছেন অনেকেই।
বিশ্বজুড়েই এখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভ্রুণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করার আগেই মায়ের গর্ভেই শিশুকে হত্যা করা সহজাত প্রকৃতি বিরোধী। কাজেই সচেতন থাকতে হবে নারী-পুরুষ উভয়কেই। মানবতাবাদীরা মনে করেন, পৃথিবীর রং, গন্ধ, ফুল, পাখি দেখার অধিকার রয়েছে ভ্রুণ শিশুর।
১২ থেকে ১৩ সপ্তাহের পর যে কোনো গর্ভপাত বেশ জটিল ব্যাপার। হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়মিত কিছু নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ভ্যাজাইনাল পেসারি দেওয়া হয় যোনিপথে। তাতে জরায়ুতে লেবার বা প্রসবের মতো সঙ্কোচন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্স খুলে যায়। এখানে ব্যথা নিবারণের ব্যবস্থা রাখতে হয় এবং দেখা গেছে ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নার্সের সহায়তায় প্রেগনেন্সি নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়।
গর্ভপাতে যেসব বিপদজনক কৌশল অবলম্বন করা হয়
বাংলাদেশে দুটি শিক্ষাদানরত হাসপাতাল, দুটি জেলা হাসপাতাল ও চারটি থানা কমপ্লেক্সসহ ৮ টি কেন্দ্রে ৬১০ জন মহিলার এক গবেষণায় দেখা যায় যে, অনেক গর্ভবতী নারী এ ধরণের বিপদজ্জনক বিপদজনক কৌশল অবলম্বন করে চলেছে।
গর্ভপাতে ব্যবহ্রত পদ্ধতিসমূহ
শতাংশ
জরায়ুতে কঠিন পদার্থ দিয়ে কাঠি ঢুকানো
৩২.৫
ইনজেকশন/ক্যাপসুল/ট্যাবলেট/খাওয়ার বড়ি
২৬.৬
দেশীয় টেবলেট/মিশ্রন
১৭.৫
অভিশ্বসন/মাসিক নিয়ন্ত্রন
২২.১
প্রসারণ/চাঁদন
৪.৬
জরায়ুর ভিতরে পরিনিষেচন
২.৩
তলপেটে চাপদান
০.৬
অন্যান্য উপায়ে
২.৯
(সারনির তথ্য সূত্র-বাংলাপিডিয়া)
৩ কারণে মৃত্যু!
ডা. ইফফাত আরা বলেন, গর্ভপাতের সময় মূলত ৩টি কারণে মৃত্যু হতে পারে। অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ, ইনফেকশন ও খাদ্যনালী ফুটো হয়ে গেলে মৃত্যু হতে পারে। তিনি জানান, যত দ্রুত অর্থাৎ কম সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করা যায়, জটিলতার সম্ভাবনা তত কম। ৩ মাসের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা গর্ভপাত করা যায় ততই বিপদের ঝুঁকি কম থাকে।
গর্ভপাতের পর যে জটিলতা সবচেয়ে দেখা দেয় তা হচ্ছে সংক্রমণ। তাতে ব্যথা, অস্বাভাবিক ডিসচার্জ এবং গর্ভপাতের পরও দীর্ঘায়িত ব্লিডিং।
প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মেরী স্টোপসের পরিচালক (প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট) কাজী গোলাম রসুল বলেন, অনিরাপদ গর্ভপাতের পর ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, জরায়ু, মূত্রনালি এবং অন্ত্রনালি ছিদ্র হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা ছিঁড়ে এক হয়ে যাওয়া, বন্ধ্যাত্বের শিকার হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হন নারীরা।
(উৎস-প্রজনন-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা, বাংলাপিডিয়া)
প্রয়োজন যৌন সচেতনতা
বিশেষজ্ঞরা ডাক্তাররা জানান, ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’- এ স্লোগানের সঙ্গে যোগ করে বলেছেন, বাঁচতে হলে জানতেও হবে মানতে হবে। যৌন শিক্ষা শুধু যে এইডস থেকে মুক্ত করতে পারে তা নয়, সংক্রামক অনেক রোগসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক সংক্রামক রোগের পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নারী শরীরে সন্তান নিয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নার্গিস আকতার বলেন, ‘শারীরিক কারণে অনেক নারী স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। তাঁদের স্বামীরাও কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করেন না। তাই কোনো কোনো নারীকে দু-তিনবার পর্যন্ত এমআর করে দিতে হচ্ছে।’
তিনি জানান, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভে আসা সন্তান না রাখতে চাইলে তার পথও খোলা আছে। নারীর শেষ মাসিকের প্রথম দিন হিসাবে ৬ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে এমআর বা মাসিক নিয়মিত করার পদ্ধতি (যে কোনো কারণে মাসিক বন্ধ থাকলে তা নিয়মিত করে দেওয়া) বৈধ।
তিনি বলেন, ‘অনেক স্বামী নিজে সচেতন না হয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে এমআরকেই বেছে নেন। এটা যে স্ত্রীর শারীরিক ক্ষতির কারণ, তা আমলে নেন না।’
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানিয়েছেন, নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও যৌন শিক্ষায় সচেতন থাকতে হবে।
এশিয়ায় ১০ কোটি ১৭ লাখ কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা
বিশ্বজুড়েই বাড়ছে গর্ভপাত। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডাসহ এশিয়াতেও আশঙ্খাজনকভাবে গর্ভপাতের হার ক্রমাগত বাড়ছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফির অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর লিঙ্গ চিহ্নিত করে গর্ভপাত ঘটানোর হার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে এশিয়ায়। বিশেষত ভারতে মেয়েশিশু গর্ভপাতের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
জাতিসংঘের ২০১১ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এশিয়ার ১০ কোটি ১৭ লাখ কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার বড় অংশটিই হচ্ছে ভারতে। ফলে দেশটিতে দিন দিন কমে যাচ্ছে কন্যাসন্তানের সংখ্যা।
ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণেই এ রকম নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। দম্পতিরা আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের মাধ্যমে গর্ভজাত সন্তানকে শনাক্ত করে এবং শিশুকন্যা হলে তার গর্ভপাত ঘটায়। এ অবস্থায় কিছু দিন আগে পোর্টেবল আল্ট্রাসনো মেশিন ব্যবহারের দায়ে মুম্বাইয়ের মেডিক্যাল কলেজের একজন রেডিওলজিস্টের বিরুদ্ধে সেখানকার হাইকোর্টে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আলজাজিরা সূত্রে জানা যায়, কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ভারতের ডা. নিলাম সিং। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ সম্পর্কে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, দেশের প্রাচীন রীতিনীতিই মূলত গর্ভপাতের প্রধান কারণ। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন বংশ রক্ষার জন্য ছেলেসন্তান জরুরি। এই ধ্যানধারণা যে শুধু অশিক্ষিত ও দরিদ্র পরিবারের বেশি তা নয়; শিক্ষিত ও ধনী পরিবারগুলোতেও একই ধরনের সংস্কৃতির চর্চা চলে। আর তাদের এই চিন্তাধারার কারণে বলি হচ্ছে শত-সহস্র কন্যাশিশুর ভ্রূণ। অর্থনৈতিক বৈষম্য কন্যাশিশু হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
ভারতের মতো আমাদের দেশে আশঙ্ক্ষাজনকভাবে মেয়ে ভ্রুণ হত্যা না হলেও ক্রমাগত ভ্রুণ হত্যা বাড়ছেই।
আল্ট্রাসনোগ্রাফির অপব্যবহারের কারণে মেয়ে শিশু ভ্রুণ নষ্ট করছেন অনেকেই।
বিশ্বজুড়েই এখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভ্রুণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করার আগেই মায়ের গর্ভেই শিশুকে হত্যা করা সহজাত প্রকৃতি বিরোধী। কাজেই সচেতন থাকতে হবে নারী-পুরুষ উভয়কেই। মানবতাবাদীরা মনে করেন, পৃথিবীর রং, গন্ধ, ফুল, পাখি দেখার অধিকার রয়েছে ভ্রুণ শিশুর।
No comments