দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল-মাছ যেত আগে, এখন যাচ্ছে মানুষ by পাভেল পার্থ
বাংলা অভিধানে হয়তো আরও একটি শব্দ-প্রত্যয় যোগ হতে যাচ্ছে, ‘ভাটায় যাচ্ছি’। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সবচেয়ে বড় উপজেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গ্রামীণ জীবনে এটি এখন সর্বাধিক ব্যবহূত শব্দ। কারণ, প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর শ্যামনগরের নওয়াবেকী, মুন্সিগঞ্জ আর সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল থেকে হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে ঢাকা, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের ইটভাটায়।
আইলা-পরবর্তী সময়ে শ্যামনগরের মূলত গ্রামীণ পুরুষের জীবনে প্রশ্নহীন গন্তব্য হয়েছে শহরের ইটভাটা। ইটভাটার মালিক ও দালালদের ভাষ্য, দেশের সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক এখন মিলছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার টাকায় একেকজন মানুষ ছয় মাসের জন্য ঠিকা খাটছে ইটভাটায়। পাশাপাশি ‘ভাটায় যাচ্ছি’ প্রত্যয়টি আমাদের সামনে মাছ ও মানুষের এক অদ্ভুত সম্পর্ককেও টেনে আনে। আশির দশক থেকে শুরু করে টানা প্রায় ৩০ বছর এ অঞ্চল থেকে শহরে যেত চিংড়ি মাছ, কিন্তু ৩০ বছর পর যাচ্ছে মানুষ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবনের চলমান ভাষাবিজ্ঞানের এই সাম্প্রতিক প্রত্যয় আমাদের হাজির করিয়ে দেয় ঐতিহাসিক স্থানিক ও বৈশ্বিক বৈষম্যের সামনে। সব শব্দ ও প্রত্যয়েরই যেমন একটি রাজনৈতিক শ্রেণী-ইতিহাস থাকে, সাতক্ষীরার গ্রামীণ পুরুষের সাম্প্রতিক এই ইটভাটায় নিরুদ্দেশেরও আছে এক রক্তক্ষয়ী আখ্যান। আর মানুষের এই অন্যায় স্থানান্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাছের ইতিহাস এবং বাণিজ্যিক চিংড়িঘেরের প্রশ্নহীন আঘাত। বৈশ্বিক বাজারে চিংড়িকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিপণ্য হিসেবে জোগান দিতে মরিয়া হয়ে ওঠা এ রাষ্ট্র কখনোই আন্দাজ করতে চায়নি এর করুণ পরিণতি কী হতে পারে! ধনী দেশের জিহ্বার স্বাদ মেটাতে আজ জন্মমাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হওয়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উদ্বাস্তু জনতার দিকে আর ফিরেও তাকাচ্ছে না বৈশ্বিক বাজার, কী বৈষম্যের রাষ্ট্র। কারণ, বৈশ্বিক বাজারি দেনদরবার, কী রাষ্ট্রীয় মনোজগতে এসব উদ্বাস্তু মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই ‘দাস’ হিসেবে চিহ্নিত, যাদের বারবার ঠেলে দেওয়া হয় গনগনে আগুনের দলার ভেতর।
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এক হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার এক উপকূলীয় বাঁধ তৈরি করে নদীগুলো আলাদা করা হয়। শুরু হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। আশির দশকে উপকূলীয় এলাকায় লোনাপানি আটকে শুরু হয় বাণিজ্যিক চিংড়িঘের। শুরু হয় কৃষি থেকে উদ্বাস্তু মানুষের দিনমজুরির জীবন। ১৯৯৪ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলকে চিংড়িঘেরের জন্য অবমুক্ত ঘোষণা করা হয়। গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থাকে কৃষি থেকে জোর করে বাণিজ্যিক চিংড়ি উৎপাদনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় স্থানীয় কৃষিনির্ভর মানুষ হারায় কৃষিকাজের অধিকার। হারিয়ে যায় জল-জলা-জঙ্গল আর জমিনের অধিকার। কৃষিজমিনে জমি চষা, ধান রোপণ, আগাছা নিড়ানি, ধান কাটা ও ধান মাড়াইয়ের নানা পর্যায়ে দরকার হয় কৃষিমজুর। চিংড়িঘের হওয়ায় কৃষিমজুরদের কৃষিজীবিকা উধাও হয়ে যায়। বিশেষত প্রান্তিক ও ভূমিহীন কিষান-কিষানি, যাঁরা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন, তাঁদের অবস্থা হয়ে পড়ে আরও বেশি বিপজ্জনক। শ্যামনগর অঞ্চলে বিলের জমিনে আগে সারা বছর কত কাজ ছিল কিষান নারী, কী পুরুষের। এখন চিংড়িঘেরে মাথাগোনা কয়জন হলেই হয়। নোনার ভেতর চামড়ায় ঘা হয়, শরীর ফুলেফেঁপে যায়। তা-ও ঘেরে ঠিকমত মজুরি নেই, আছে নারী-পুরুষে মজুরিবৈষম্য। আর আছে খাওয়া, কি গোসল, কি ঘরগেরস্থির পানির অভাব। দক্ষিণ-পশ্চিমের পানি ও খাবারের এই কষ্ট একেবারেই মানুষের তৈরি করা। এককালে বর্ষায় স্থানীয় বিলগুলোয় ভেউলো, ছামনা, ভটকা, নাড়ারগোজ, চেচোয়া ও কচুরি পচে মাটিকে করে তুলত শস্যফসলের আঁতুড়ঘর। লালগেতি, খাজুরছড়ি, হোগলা, দাদশাইল, মেলিগৌড়, হরকোচা, ঝিঙ্গেশাইল, বাঁশফুল, দুধেমোটা, হলদেবাটালি, কৈজুড়ি, গোপালভোগ, ছোটনা, খাজুরছড়ি, গেড়মুড়ি, চাপরাইল, বয়ানগেতি, কাটারাঙ্গী, আশফল, শোলিরপোনা, নোনাবালাম, নারিকেলমুচি, পর্বতবালাই, ঘুনশি, পানবোট, পানখাগি, কাকশিল, ঢেউকামিনী, বেগুনবিচি, তালমুগুর, বয়ারবাট, বালাম, আকন্দ, মোটাগেতি—এ রকম অগণিত ধানবীজ কেবল বুনে দিলেই জেগে উঠত তরতাজা ফসলের দিনলিপি। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা পরামর্শক দলের (সিজিআইএআর) মাধ্যমে চালু হওয়া তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ধাক্কা লাগল নোনা উপকূলেও। অনিবার্য বলপ্রয়োগে ধানের জমিন থেকে দেশি জাত সরিয়ে বাণিজ্যের জোর দেখাল তথাকথিত উফশী ও হাইব্রিড বীজ। কৃষিজমিনকে রক্তাক্ত করে তৈরি হলো চিংড়িঘের। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মাছের বিচরণভূমি।
বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০০৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৮০ হাজার ১৫ হেক্টর কৃষিজমিতে চিংড়ি চাষ হতো। ২০০৫ সালে তা বেড়ে প্রশ্নহীনভাবে এক লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৪ হেক্টর জমিতে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় চিংড়িঘেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে জানা গেছে, ২০০৬-২০০৭ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৬২২ হেক্টর এবং চিংড়িঘেরের সংখ্যা চার হাজার ৩৫৫। ১৯৯০-৯১ সালে শ্যামনগর উপজেলার কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর। কিন্তু চিংড়িঘেরের কারণে ২০০৬-২০০৭ সালে কৃষিজমির পরিমাণ ২১ হাজার ৭৫৬ হেক্টরে কমে এসেছে। ১৯৭৪ সাল থেকে গত ২০ বছরে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পায় প্রায় ছয়গুণ। বাংলাদেশের মোট লবণাক্ত এলাকার ৫৭ শতাংশই এই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগর এবং পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনসংলগ্ন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল বরাবরই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় এক প্রান্তিক জনপদ। অথচ এই জনপদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রতিবছর জমা করছে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব। এ অঞ্চলই সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজের জীবন দিয়ে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা।
সুন্দরবনের কোলঘেঁষে শ্যামনগরের দাঁতিনাখালী হুলোতে জন্ম নীলকান্ত মুণ্ডার। একদা জংলা সাফ করে মুণ্ডারা যেসব দলিলহীন বসতজমিন তৈরি করেন, তা ‘হাতকাটালি ভূসম্পত্তি’ নামেই পরিচিত। ১৯৭৮ সালে প্রভাবশালী বাঙালিরা মুণ্ডাদের হাতকাটালি বংশজমি দখল করলে তারা উদ্বাস্তু হয়ে নদী পেরিয়ে গাবুরা গ্রামে চলে যায়। গাবুরা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে নীলকান্তের পরিবার আবার আসে দাঁতিনাখালী, সেখান থেকে ২০০১ সালে আবার পানখালী। ২০১০ সালে আইলার পর ঘরজমিন সব হারিয়ে তারা আশ্রয় নেয় বুড়িগোয়ালিনী সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যারাকে। ১৪ হাজার টাকায় ছয় মাসের জন্য বিক্রি হয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব নীলকান্ত মুণ্ডা গত ১৯ অক্টোবর বরিশালের এক ইটভাটায় চলে গেছেন। নিদারুণভাবে চলতি সময়ে এ অঞ্চল থেকে এক বিশাল অংশের অভিবাসন ঘটছে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কেবল দেশের ভেতর অস্থায়ী বা স্থায়ী স্থানান্তর নয়, শ্যামনগরের জীবিকা ও দুর্যোগ-উদ্বাস্তু মানুষেরা প্রতিদিন দেশের সীমানা ছাড়িয়েও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিদিন দেশের একটি অঞ্চল থেকে সমানে মানুষ কোনো কাজ, কি পানি, কি খাবার, কি আইনের শাসন না পেয়ে চলে যাচ্ছে, যেতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ নির্বিকার রাষ্ট্র এখনো বৈশ্বিক বাজারে চিংড়ি বিকানোর দেনদরবার করছে।
আইলার পরপরই শ্যামনগর হয়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি দাতাসংস্থা ও এনজিওগুলোর ‘উন্নয়ন-গবেষণাগার’। প্রতিদিন শ্যামনগরের গ্রাম কি গ্রামে ‘আইলা-দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন’, ‘পরিবর্তন মোকাবিলা’, ‘খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির’ নামের নতুন সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে। সরকার, কী বেসরকার সবাই মরিয়া হয়ে এ অঞ্চলের জনগণের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা চাইছে। কিন্তু মানুষ এখানে থাকতে পারছে না। শহর থেকে কোলেকাঁখে করে টাকার থলে নিয়ে উন্নয়ন-ফেরিওয়ালারা ঢুকছে গ্রামে। কিন্তু মানুষ জান বাঁচাতে পালাচ্ছে শহরের ইটভাটায়। এ অন্যায় স্থানান্তর ও নিরুদ্দেশ থামানো জরুরি। শ্যামনগর থেকে প্রতিদিন উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া সব মানুষের সামগ্রিক তথ্য ও কারণসহ জনপ্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু বিপর্যয়ের অভিঘাতগুলো এ অঞ্চলে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু বাণিজ্যিক চিংড়িঘের, কী রাসায়নিক কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একক নিয়ন্ত্রণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন অবকাঠামোর বিষয়গুলো এ অঞ্চলের সাম্প্র্রতিক গ্রামীণ জনগণের ইটভাটায় স্থানান্তরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। রাষ্ট্রকে সাহসী মেরুদণ্ড নিয়ে বাজার ও জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক দেনদরবারে বসতে হবে। ভাটায় যাচ্ছি প্রত্যয়ের ব্যাখা ও ইতিহাস জনমানুষের বয়ানে হাজির করতে হবে। জনজীবনবিরোধী সব আঘাত সরিয়ে শ্যামনগরকে মুক্ত করতে দরকার জরুরি এক সামগ্রিক জাতীয় সমন্বয় ও উদ্যোগ। আশা করি, শ্যামনগর ও সাতক্ষীরা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা দ্রুত এ বিষয়ের সুরাহা করতে উদ্যোগী হবেন। নীলকান্ত মুণ্ডারা অচিরেই ফিরে আসবে আবার আপন জন্মমাটিতে, হাতকাটালি জমিনে বাজবে জন্মজয়ের মাদল।
পাভেল পার্থ: গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এক হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার এক উপকূলীয় বাঁধ তৈরি করে নদীগুলো আলাদা করা হয়। শুরু হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। আশির দশকে উপকূলীয় এলাকায় লোনাপানি আটকে শুরু হয় বাণিজ্যিক চিংড়িঘের। শুরু হয় কৃষি থেকে উদ্বাস্তু মানুষের দিনমজুরির জীবন। ১৯৯৪ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলকে চিংড়িঘেরের জন্য অবমুক্ত ঘোষণা করা হয়। গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থাকে কৃষি থেকে জোর করে বাণিজ্যিক চিংড়ি উৎপাদনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় স্থানীয় কৃষিনির্ভর মানুষ হারায় কৃষিকাজের অধিকার। হারিয়ে যায় জল-জলা-জঙ্গল আর জমিনের অধিকার। কৃষিজমিনে জমি চষা, ধান রোপণ, আগাছা নিড়ানি, ধান কাটা ও ধান মাড়াইয়ের নানা পর্যায়ে দরকার হয় কৃষিমজুর। চিংড়িঘের হওয়ায় কৃষিমজুরদের কৃষিজীবিকা উধাও হয়ে যায়। বিশেষত প্রান্তিক ও ভূমিহীন কিষান-কিষানি, যাঁরা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন, তাঁদের অবস্থা হয়ে পড়ে আরও বেশি বিপজ্জনক। শ্যামনগর অঞ্চলে বিলের জমিনে আগে সারা বছর কত কাজ ছিল কিষান নারী, কী পুরুষের। এখন চিংড়িঘেরে মাথাগোনা কয়জন হলেই হয়। নোনার ভেতর চামড়ায় ঘা হয়, শরীর ফুলেফেঁপে যায়। তা-ও ঘেরে ঠিকমত মজুরি নেই, আছে নারী-পুরুষে মজুরিবৈষম্য। আর আছে খাওয়া, কি গোসল, কি ঘরগেরস্থির পানির অভাব। দক্ষিণ-পশ্চিমের পানি ও খাবারের এই কষ্ট একেবারেই মানুষের তৈরি করা। এককালে বর্ষায় স্থানীয় বিলগুলোয় ভেউলো, ছামনা, ভটকা, নাড়ারগোজ, চেচোয়া ও কচুরি পচে মাটিকে করে তুলত শস্যফসলের আঁতুড়ঘর। লালগেতি, খাজুরছড়ি, হোগলা, দাদশাইল, মেলিগৌড়, হরকোচা, ঝিঙ্গেশাইল, বাঁশফুল, দুধেমোটা, হলদেবাটালি, কৈজুড়ি, গোপালভোগ, ছোটনা, খাজুরছড়ি, গেড়মুড়ি, চাপরাইল, বয়ানগেতি, কাটারাঙ্গী, আশফল, শোলিরপোনা, নোনাবালাম, নারিকেলমুচি, পর্বতবালাই, ঘুনশি, পানবোট, পানখাগি, কাকশিল, ঢেউকামিনী, বেগুনবিচি, তালমুগুর, বয়ারবাট, বালাম, আকন্দ, মোটাগেতি—এ রকম অগণিত ধানবীজ কেবল বুনে দিলেই জেগে উঠত তরতাজা ফসলের দিনলিপি। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা পরামর্শক দলের (সিজিআইএআর) মাধ্যমে চালু হওয়া তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ধাক্কা লাগল নোনা উপকূলেও। অনিবার্য বলপ্রয়োগে ধানের জমিন থেকে দেশি জাত সরিয়ে বাণিজ্যের জোর দেখাল তথাকথিত উফশী ও হাইব্রিড বীজ। কৃষিজমিনকে রক্তাক্ত করে তৈরি হলো চিংড়িঘের। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মাছের বিচরণভূমি।
বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০০৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৮০ হাজার ১৫ হেক্টর কৃষিজমিতে চিংড়ি চাষ হতো। ২০০৫ সালে তা বেড়ে প্রশ্নহীনভাবে এক লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৪ হেক্টর জমিতে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় চিংড়িঘেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে জানা গেছে, ২০০৬-২০০৭ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৬২২ হেক্টর এবং চিংড়িঘেরের সংখ্যা চার হাজার ৩৫৫। ১৯৯০-৯১ সালে শ্যামনগর উপজেলার কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর। কিন্তু চিংড়িঘেরের কারণে ২০০৬-২০০৭ সালে কৃষিজমির পরিমাণ ২১ হাজার ৭৫৬ হেক্টরে কমে এসেছে। ১৯৭৪ সাল থেকে গত ২০ বছরে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পায় প্রায় ছয়গুণ। বাংলাদেশের মোট লবণাক্ত এলাকার ৫৭ শতাংশই এই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগর এবং পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনসংলগ্ন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল বরাবরই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় এক প্রান্তিক জনপদ। অথচ এই জনপদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রতিবছর জমা করছে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব। এ অঞ্চলই সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজের জীবন দিয়ে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা।
সুন্দরবনের কোলঘেঁষে শ্যামনগরের দাঁতিনাখালী হুলোতে জন্ম নীলকান্ত মুণ্ডার। একদা জংলা সাফ করে মুণ্ডারা যেসব দলিলহীন বসতজমিন তৈরি করেন, তা ‘হাতকাটালি ভূসম্পত্তি’ নামেই পরিচিত। ১৯৭৮ সালে প্রভাবশালী বাঙালিরা মুণ্ডাদের হাতকাটালি বংশজমি দখল করলে তারা উদ্বাস্তু হয়ে নদী পেরিয়ে গাবুরা গ্রামে চলে যায়। গাবুরা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে নীলকান্তের পরিবার আবার আসে দাঁতিনাখালী, সেখান থেকে ২০০১ সালে আবার পানখালী। ২০১০ সালে আইলার পর ঘরজমিন সব হারিয়ে তারা আশ্রয় নেয় বুড়িগোয়ালিনী সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যারাকে। ১৪ হাজার টাকায় ছয় মাসের জন্য বিক্রি হয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব নীলকান্ত মুণ্ডা গত ১৯ অক্টোবর বরিশালের এক ইটভাটায় চলে গেছেন। নিদারুণভাবে চলতি সময়ে এ অঞ্চল থেকে এক বিশাল অংশের অভিবাসন ঘটছে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কেবল দেশের ভেতর অস্থায়ী বা স্থায়ী স্থানান্তর নয়, শ্যামনগরের জীবিকা ও দুর্যোগ-উদ্বাস্তু মানুষেরা প্রতিদিন দেশের সীমানা ছাড়িয়েও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিদিন দেশের একটি অঞ্চল থেকে সমানে মানুষ কোনো কাজ, কি পানি, কি খাবার, কি আইনের শাসন না পেয়ে চলে যাচ্ছে, যেতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ নির্বিকার রাষ্ট্র এখনো বৈশ্বিক বাজারে চিংড়ি বিকানোর দেনদরবার করছে।
আইলার পরপরই শ্যামনগর হয়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি দাতাসংস্থা ও এনজিওগুলোর ‘উন্নয়ন-গবেষণাগার’। প্রতিদিন শ্যামনগরের গ্রাম কি গ্রামে ‘আইলা-দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন’, ‘পরিবর্তন মোকাবিলা’, ‘খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির’ নামের নতুন সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে। সরকার, কী বেসরকার সবাই মরিয়া হয়ে এ অঞ্চলের জনগণের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা চাইছে। কিন্তু মানুষ এখানে থাকতে পারছে না। শহর থেকে কোলেকাঁখে করে টাকার থলে নিয়ে উন্নয়ন-ফেরিওয়ালারা ঢুকছে গ্রামে। কিন্তু মানুষ জান বাঁচাতে পালাচ্ছে শহরের ইটভাটায়। এ অন্যায় স্থানান্তর ও নিরুদ্দেশ থামানো জরুরি। শ্যামনগর থেকে প্রতিদিন উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া সব মানুষের সামগ্রিক তথ্য ও কারণসহ জনপ্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু বিপর্যয়ের অভিঘাতগুলো এ অঞ্চলে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু বাণিজ্যিক চিংড়িঘের, কী রাসায়নিক কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একক নিয়ন্ত্রণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন অবকাঠামোর বিষয়গুলো এ অঞ্চলের সাম্প্র্রতিক গ্রামীণ জনগণের ইটভাটায় স্থানান্তরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। রাষ্ট্রকে সাহসী মেরুদণ্ড নিয়ে বাজার ও জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক দেনদরবারে বসতে হবে। ভাটায় যাচ্ছি প্রত্যয়ের ব্যাখা ও ইতিহাস জনমানুষের বয়ানে হাজির করতে হবে। জনজীবনবিরোধী সব আঘাত সরিয়ে শ্যামনগরকে মুক্ত করতে দরকার জরুরি এক সামগ্রিক জাতীয় সমন্বয় ও উদ্যোগ। আশা করি, শ্যামনগর ও সাতক্ষীরা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা দ্রুত এ বিষয়ের সুরাহা করতে উদ্যোগী হবেন। নীলকান্ত মুণ্ডারা অচিরেই ফিরে আসবে আবার আপন জন্মমাটিতে, হাতকাটালি জমিনে বাজবে জন্মজয়ের মাদল।
পাভেল পার্থ: গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
No comments