কল্পকথার গল্প-সংসার সুখের হয় বাজারের গুণে! by আলী হাবিব
মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে_এমন কথা কোনো দিন কি শোনা গেছে? আকাশ ভেঙে পড়লে আর থাকল কী? কিন্তু আকাশ থেকে, মানে ওই মহাশূন্য থেকে মহাকাশযান ভেঙে পড়েছে। নাসার একটি কৃত্রিম উপগ্রহ ভেঙে পড়েছে পৃথিবীতে। না, মানুষের মাথায় পড়েনি। পড়েছে সাগরে। রক্ষা মানুষের।
সাগরের গর্ভে না পড়ে ভূপৃষ্ঠে পড়লে সেটা সত্যিকার অর্থেই মানুষের জন্য মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো দশা হতো। আমাদের দেশই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? আমাদের দেশেও পড়েছে। না, মহাকাশযানের ভগ্নাংশ নয়, পড়েছে একটি বরফখণ্ড। সেই বরফখণ্ডের ওজন ২০ কেজি। চিন্তার বিষয়। এই ২০ কেজি ওজনের বরফখণ্ড কারো মাথায় পড়লে কী হতো?
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি, মহাকাশযানের ভগ্নাংশ পড়েনি। তার পরও মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিকার অর্থেই যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাথায়। কোনো এক অদৃশ্য চাপে মানুষ যেন চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবে দেখলে মনে হবে, এই তো মানুষ বেশ হাঁটছে, চলছে, বেড়াচ্ছে। বাজার করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, দিব্যি সংসার করছে। কিন্তু আসলেই কি দিব্যি চালিয়ে যেতে পারছে মানুষ? একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে, কোনো কিছুই স্বাভাবিক নেই। অন্দরে উঁকি দিলেই দেখা যাবে সংকুচিত হয়ে আসা জীবনধারা। জানা যাবে, সিংহভাগের সংসার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
সংসারে সঙ সেজে বসে থাকাটাই যেন এখন সার হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের জন্য। চলছে না। আগের মতো গতি নেই। কোনোভাবেই আর টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেমন করেই বা সম্ভব? নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির যে প্রতিযোগিতা বাজারজুড়ে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকের বুকেই অত দম নেই। এই দমের সঙ্গে ট্যাঁকের ও টাকার সম্পর্কটা খুব গভীর। আগে অনেকেরই বাইরের চেহারা দেখে ট্যাঁকের আকার-আকৃতি অনুধাবন করা যেত না। এখন করা যায়। এখন মুখ দেখেই বুঝতে পারা যায়, কার ট্যাঁকের স্ফীতি কেমন।
আজকের দিনে বাজারের যা অবস্থা, তাতে সব কিছু সামলে রাখা দায়। বাজারে রোজ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ফলে আগের মতো ঠাট বজায় রাখা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের বিপত্তিটা এখানেই। শুধু বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হলে তবু কথা ছিল। প্রতিযোগিতা এখন অনেক কিছুর সঙ্গে। একদিক দিয়ে বাড়লে চারদিক থেকে বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও সিন্ডিকেট নামের এক অদৃশ্য ভূতের উপস্থিতির কথা শোনা যেত। বলা হতো, বাজার সিন্ডিকেট বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। অদৃশ্য সেই ভূতের পাশাপাশি এখন আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে বাজার। এখন যেকোনো একটি জিনিসের দাম বেড়ে গেলে বাজারের অন্য পণ্যের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। এই সেদিন, বলা নেই, কওয়া নেই বাড়িয়ে দেওয়া হলো জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম। প্রভাবটা সরাসরি চলে এল বাজারে। যাঁরা জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা হয়তো রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি কবিতাটির কথা মনে রেখেছিলেন। সখীদের নিয়ে 'সান সমাপন' শেষে ঘরে ফেরার সময় একটু ঠাণ্ডা লেগেছিল। পথে ছিল গরিব কিছু প্রজার বাড়ি। সেই বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো রানির একটু উষ্ণতার জন্য। রানির জন্য সেটা সামান্য ক্ষতি হলেও ওই ঝুপড়ি ঘরের সামান্য মানুষগুলোর জন্য ক্ষতিটা ছিল অসামান্য। সে রকমই জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম সামান্য বাড়ানো হলেও সাধারণ মানুষের জন্য সেটা যে অসামান্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে গণপরিবহনে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। কারণ যে ট্রাক বা লরিতে পণ্য পরিবহন করতে হয়, সে বাহনটি চলে জ্বালানি তেলে বা সিএনজিকে। তেল ও সিএনজির দাম যখন বেড়েছে, তখন পরিবহন ব্যয় তো বাড়বেই। সেই ব্যয় সংকুলান হবে কেমন করে? সাধারণ ভোক্তার পকেট কেটেই সেটা আদায় করে নেওয়া হবে। জ্বালানি তেল ও সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির খেসারত শেষ পর্যন্ত সাধারণকেই দিতে হচ্ছে। ওদিকে আবার সিন্ডিকেট যে হাত গুটিয়ে বসে আছে, এমন কথা কে হলফ করে বলতে পারে। চলছে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা। বাজারে কয়েকটি জিনিস আছে, যেগুলোর দাম যখন-তখন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন চলছে তেল-চিনির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা। একটু সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কাজটা আমাদের দেশে যত সহজে করা যায়, অন্য কোথাও বোধহয় এত সহজ নয়। আমাদের বিকল্প কোনো বাজার নেই। মানুষ যে অন্য কোথাও যাবে, তার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই বাজারে যেতে হচ্ছে।
আগের দিনে অবস্থাটা এমন ছিল না। সে আমলে স্বল্প খরচে মানুষের দিন চলে যেত। কিন্তু আজকের দিনে তেমনটি আর হওয়ার জো নেই। আজ পথে বের হলেই পয়সা গুনতে হয়। এখন পয়সা খরচের অনেক পথ আছে। আগে এমনটি ছিল না। আগের দিনের মানুষ খেরোখাতায় লিখে রাখত প্রতিদিনের হিসাব। এখন সে হিসাব দেখলে চমকে উঠতে হবে। চোখ কপালে উঠবে অনেকের। আগের দিনের মানুষ এখানে-সেখানে যেতে আগ্রহী ছিল। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সবার। রীতিমতো একটা বার্ষিক রুটিন করা হতো। কখন, কোথায় যেতে হবে, তার একটা তালিকা থাকত। আজকের দিনে মানুষ নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত, স্বজনের খোঁজ রাখার সুযোগ নেই। আজকের দিনে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে অনেকেরই মুখ কালো হয়ে যায়। 'খাওয়াব কী'_এই চিন্তায় কুঞ্চিত হয় কপালের রেখা। কেন এমন হচ্ছে? বাজারের কারণে। বাজার মানুষের শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। সুখের ঘরে বেদনার অসুখ ভর করেছে এই বাজারের কারণে। মানুষের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে বাজার।
এক ভদ্রলোকের গল্প বলা যাক। এই নিরীহ ভদ্রলোক স্বভাবে কোনো দিন ঘরকুনো ছিলেন না। ইদানীং হয়েছেন। আগে বন্ধুদের সঙ্গে বেশ চুটিয়ে আড্ডা মারতেন। ইদানীং এড়িয়ে চলেন। আগে মাঝেমধ্যে সিনেমা-থিয়েটারে যেতেন। শেষ কবে ও পথ মাড়িয়েছেন, এখন আর মনে করতে পারেন না। সব কিছুই এখন এড়িয়ে চলেন, 'নহিলে খরচ বাড়ে!' খরচ বাড়ানোর উপায় নেই। মাসের শুরুতে বেতনের টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। অনেক দিনের অভ্যাস। রোজ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে স্ত্রীর কাছে হাত পাতেন। স্ত্রী হাতে যেটা তুলে দেন, তাতেই দিনটা কাটিয়ে দেন। ভদ্রলোক একদিন খেয়াল করলেন, আগের মতো স্ত্রীর মুখে হাসি নেই। পাত্তা দিলেন না। ভাবলেন, দেবতারাও তো নারীর মনের কথা জানতে পারেন না। তিনি স্ত্রীর হাসি লাপাত্তা হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে কী করবেন? কিন্তু কয়েক দিন যেতেই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া গেল না। খাওয়ার টেবিলে আগে যে স্ত্রীকে পেতেন, এখন যেন তাকে খুঁজে পান না। কোথায় যেন প্রাণের অভাব। ভাবলেন, এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। খুব ভালো করেই জানেন, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'। সেই ভরকেন্দ্রটির আকাশ এভাবে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকলে তো সমূহ বিপদ! ভদ্রলোক কারণ খুঁজতে শুরু করলেন। পেয়েও গেলেন।
তিনি তো মাসের বেতন পেয়ে স্ত্রীর হাতে টাকা তুলে দিয়ে খালাস। সেই টাকায় সংসার চলছে কি না, সে খবর রাখতে যান না। বাজার করেন স্ত্রী নিজে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন যে আসে না, তা নয়। আসে। আপ্যায়ন করতে হয়। মাসের শুরুতে বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন ইত্যাদি দেওয়ার পর হাতে যা থাকে, তা দিয়ে কেমন করে চলে সংসার! না, ভদ্রমহিলা তো ম্যাজিক জানেন না। তাহলে? ভদ্রলোকের কাছে সব কিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আর চলছে না। বেতনের টাকায় সংসার চালাতে গিয়ে এত দিনের প্রেমময়ী স্ত্রী আজ গোমড়ামুখো। না, এটা তো দেখা যায় না। ভদ্রলোক সিদ্ধান্ত নিলেন স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কেমন করে সেটা সম্ভব? বাড়িতে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সহজ কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না। ধরে বসলেন এক বন্ধুকে। একটা উপায় খুঁজে বের করে দিতে হবে। বন্ধু উপায় বাতলে দিলেন। হাতের কাছে টাকাপ্রাপ্তির এমন সুযোগ, তিনি আগে জানতেন না। আজকাল অফিসে দেখেছেন কিছু কেতাদুরস্ত স্মার্ট তরুণের আনাগোনা। তাঁরা ঋণের পসারী। ভদ্রলোক আগে কোনো দিন ঋণ করেননি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, অফিসের অনেকেই আজ ঋণগ্রস্ত। সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি হলো না তাঁর_'ঋণং কৃত্ত্বা'। যা থাকে কপালে! দেশ চলছে ধারের টাকায়। তিনি তো কোন্ ছার! ধরে বসলেন একজনকে। অল্পদিনেই হাতে এসে গেল টাকা। সাপ্তাহিক ছুুটির আগের দিন টাকা পকেটে পুরে হাজির হয়ে গেলেন বাড়িতে। পরদিন সকালে নিজেই উদ্যোগী হয়ে বাজারে গেলেন। মনের মতো করে বাজার করলেন। ব্যাগ উজাড় করে বাজার ঢেলে দিলেন রান্নাঘরের মেঝেয়। দুপুরেই মধ্যেই স্ত্রীর মুখের চেহারা পাল্টে গেল। তিনি দেখলেন, তাঁর স্ত্রীর মুখে আবার আগের মতোই হাসি ফিরেছে। ছেলেমেয়েরাও হাসিমুখ। স্ত্রী ও সন্তানদের হাসিমুখ দেখতে দেখতে ভদ্রলোক ভাবলেন, পুরনো একটা প্রবাদ এখন পাল্টে দেওয়া দরকার। আগে তো শুনেছেন, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'; এখন পাল্টে দিয়ে বলতে হবে, 'সংসার সুখের হয় বাজারের গুণে!' ঋণ করে হলেও বাজার করতে পেরেছেন বলেই না ঘরে আনন্দের বন্যা বইছে!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি, মহাকাশযানের ভগ্নাংশ পড়েনি। তার পরও মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিকার অর্থেই যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাথায়। কোনো এক অদৃশ্য চাপে মানুষ যেন চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবে দেখলে মনে হবে, এই তো মানুষ বেশ হাঁটছে, চলছে, বেড়াচ্ছে। বাজার করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, দিব্যি সংসার করছে। কিন্তু আসলেই কি দিব্যি চালিয়ে যেতে পারছে মানুষ? একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে, কোনো কিছুই স্বাভাবিক নেই। অন্দরে উঁকি দিলেই দেখা যাবে সংকুচিত হয়ে আসা জীবনধারা। জানা যাবে, সিংহভাগের সংসার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
সংসারে সঙ সেজে বসে থাকাটাই যেন এখন সার হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের জন্য। চলছে না। আগের মতো গতি নেই। কোনোভাবেই আর টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেমন করেই বা সম্ভব? নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির যে প্রতিযোগিতা বাজারজুড়ে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকের বুকেই অত দম নেই। এই দমের সঙ্গে ট্যাঁকের ও টাকার সম্পর্কটা খুব গভীর। আগে অনেকেরই বাইরের চেহারা দেখে ট্যাঁকের আকার-আকৃতি অনুধাবন করা যেত না। এখন করা যায়। এখন মুখ দেখেই বুঝতে পারা যায়, কার ট্যাঁকের স্ফীতি কেমন।
আজকের দিনে বাজারের যা অবস্থা, তাতে সব কিছু সামলে রাখা দায়। বাজারে রোজ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ফলে আগের মতো ঠাট বজায় রাখা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের বিপত্তিটা এখানেই। শুধু বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হলে তবু কথা ছিল। প্রতিযোগিতা এখন অনেক কিছুর সঙ্গে। একদিক দিয়ে বাড়লে চারদিক থেকে বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও সিন্ডিকেট নামের এক অদৃশ্য ভূতের উপস্থিতির কথা শোনা যেত। বলা হতো, বাজার সিন্ডিকেট বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। অদৃশ্য সেই ভূতের পাশাপাশি এখন আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে বাজার। এখন যেকোনো একটি জিনিসের দাম বেড়ে গেলে বাজারের অন্য পণ্যের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। এই সেদিন, বলা নেই, কওয়া নেই বাড়িয়ে দেওয়া হলো জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম। প্রভাবটা সরাসরি চলে এল বাজারে। যাঁরা জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা হয়তো রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি কবিতাটির কথা মনে রেখেছিলেন। সখীদের নিয়ে 'সান সমাপন' শেষে ঘরে ফেরার সময় একটু ঠাণ্ডা লেগেছিল। পথে ছিল গরিব কিছু প্রজার বাড়ি। সেই বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো রানির একটু উষ্ণতার জন্য। রানির জন্য সেটা সামান্য ক্ষতি হলেও ওই ঝুপড়ি ঘরের সামান্য মানুষগুলোর জন্য ক্ষতিটা ছিল অসামান্য। সে রকমই জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম সামান্য বাড়ানো হলেও সাধারণ মানুষের জন্য সেটা যে অসামান্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে গণপরিবহনে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। কারণ যে ট্রাক বা লরিতে পণ্য পরিবহন করতে হয়, সে বাহনটি চলে জ্বালানি তেলে বা সিএনজিকে। তেল ও সিএনজির দাম যখন বেড়েছে, তখন পরিবহন ব্যয় তো বাড়বেই। সেই ব্যয় সংকুলান হবে কেমন করে? সাধারণ ভোক্তার পকেট কেটেই সেটা আদায় করে নেওয়া হবে। জ্বালানি তেল ও সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির খেসারত শেষ পর্যন্ত সাধারণকেই দিতে হচ্ছে। ওদিকে আবার সিন্ডিকেট যে হাত গুটিয়ে বসে আছে, এমন কথা কে হলফ করে বলতে পারে। চলছে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা। বাজারে কয়েকটি জিনিস আছে, যেগুলোর দাম যখন-তখন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন চলছে তেল-চিনির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা। একটু সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কাজটা আমাদের দেশে যত সহজে করা যায়, অন্য কোথাও বোধহয় এত সহজ নয়। আমাদের বিকল্প কোনো বাজার নেই। মানুষ যে অন্য কোথাও যাবে, তার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই বাজারে যেতে হচ্ছে।
আগের দিনে অবস্থাটা এমন ছিল না। সে আমলে স্বল্প খরচে মানুষের দিন চলে যেত। কিন্তু আজকের দিনে তেমনটি আর হওয়ার জো নেই। আজ পথে বের হলেই পয়সা গুনতে হয়। এখন পয়সা খরচের অনেক পথ আছে। আগে এমনটি ছিল না। আগের দিনের মানুষ খেরোখাতায় লিখে রাখত প্রতিদিনের হিসাব। এখন সে হিসাব দেখলে চমকে উঠতে হবে। চোখ কপালে উঠবে অনেকের। আগের দিনের মানুষ এখানে-সেখানে যেতে আগ্রহী ছিল। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সবার। রীতিমতো একটা বার্ষিক রুটিন করা হতো। কখন, কোথায় যেতে হবে, তার একটা তালিকা থাকত। আজকের দিনে মানুষ নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত, স্বজনের খোঁজ রাখার সুযোগ নেই। আজকের দিনে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে অনেকেরই মুখ কালো হয়ে যায়। 'খাওয়াব কী'_এই চিন্তায় কুঞ্চিত হয় কপালের রেখা। কেন এমন হচ্ছে? বাজারের কারণে। বাজার মানুষের শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। সুখের ঘরে বেদনার অসুখ ভর করেছে এই বাজারের কারণে। মানুষের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে বাজার।
এক ভদ্রলোকের গল্প বলা যাক। এই নিরীহ ভদ্রলোক স্বভাবে কোনো দিন ঘরকুনো ছিলেন না। ইদানীং হয়েছেন। আগে বন্ধুদের সঙ্গে বেশ চুটিয়ে আড্ডা মারতেন। ইদানীং এড়িয়ে চলেন। আগে মাঝেমধ্যে সিনেমা-থিয়েটারে যেতেন। শেষ কবে ও পথ মাড়িয়েছেন, এখন আর মনে করতে পারেন না। সব কিছুই এখন এড়িয়ে চলেন, 'নহিলে খরচ বাড়ে!' খরচ বাড়ানোর উপায় নেই। মাসের শুরুতে বেতনের টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। অনেক দিনের অভ্যাস। রোজ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে স্ত্রীর কাছে হাত পাতেন। স্ত্রী হাতে যেটা তুলে দেন, তাতেই দিনটা কাটিয়ে দেন। ভদ্রলোক একদিন খেয়াল করলেন, আগের মতো স্ত্রীর মুখে হাসি নেই। পাত্তা দিলেন না। ভাবলেন, দেবতারাও তো নারীর মনের কথা জানতে পারেন না। তিনি স্ত্রীর হাসি লাপাত্তা হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে কী করবেন? কিন্তু কয়েক দিন যেতেই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া গেল না। খাওয়ার টেবিলে আগে যে স্ত্রীকে পেতেন, এখন যেন তাকে খুঁজে পান না। কোথায় যেন প্রাণের অভাব। ভাবলেন, এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। খুব ভালো করেই জানেন, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'। সেই ভরকেন্দ্রটির আকাশ এভাবে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকলে তো সমূহ বিপদ! ভদ্রলোক কারণ খুঁজতে শুরু করলেন। পেয়েও গেলেন।
তিনি তো মাসের বেতন পেয়ে স্ত্রীর হাতে টাকা তুলে দিয়ে খালাস। সেই টাকায় সংসার চলছে কি না, সে খবর রাখতে যান না। বাজার করেন স্ত্রী নিজে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন যে আসে না, তা নয়। আসে। আপ্যায়ন করতে হয়। মাসের শুরুতে বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন ইত্যাদি দেওয়ার পর হাতে যা থাকে, তা দিয়ে কেমন করে চলে সংসার! না, ভদ্রমহিলা তো ম্যাজিক জানেন না। তাহলে? ভদ্রলোকের কাছে সব কিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আর চলছে না। বেতনের টাকায় সংসার চালাতে গিয়ে এত দিনের প্রেমময়ী স্ত্রী আজ গোমড়ামুখো। না, এটা তো দেখা যায় না। ভদ্রলোক সিদ্ধান্ত নিলেন স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কেমন করে সেটা সম্ভব? বাড়িতে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সহজ কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না। ধরে বসলেন এক বন্ধুকে। একটা উপায় খুঁজে বের করে দিতে হবে। বন্ধু উপায় বাতলে দিলেন। হাতের কাছে টাকাপ্রাপ্তির এমন সুযোগ, তিনি আগে জানতেন না। আজকাল অফিসে দেখেছেন কিছু কেতাদুরস্ত স্মার্ট তরুণের আনাগোনা। তাঁরা ঋণের পসারী। ভদ্রলোক আগে কোনো দিন ঋণ করেননি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, অফিসের অনেকেই আজ ঋণগ্রস্ত। সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি হলো না তাঁর_'ঋণং কৃত্ত্বা'। যা থাকে কপালে! দেশ চলছে ধারের টাকায়। তিনি তো কোন্ ছার! ধরে বসলেন একজনকে। অল্পদিনেই হাতে এসে গেল টাকা। সাপ্তাহিক ছুুটির আগের দিন টাকা পকেটে পুরে হাজির হয়ে গেলেন বাড়িতে। পরদিন সকালে নিজেই উদ্যোগী হয়ে বাজারে গেলেন। মনের মতো করে বাজার করলেন। ব্যাগ উজাড় করে বাজার ঢেলে দিলেন রান্নাঘরের মেঝেয়। দুপুরেই মধ্যেই স্ত্রীর মুখের চেহারা পাল্টে গেল। তিনি দেখলেন, তাঁর স্ত্রীর মুখে আবার আগের মতোই হাসি ফিরেছে। ছেলেমেয়েরাও হাসিমুখ। স্ত্রী ও সন্তানদের হাসিমুখ দেখতে দেখতে ভদ্রলোক ভাবলেন, পুরনো একটা প্রবাদ এখন পাল্টে দেওয়া দরকার। আগে তো শুনেছেন, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'; এখন পাল্টে দিয়ে বলতে হবে, 'সংসার সুখের হয় বাজারের গুণে!' ঋণ করে হলেও বাজার করতে পেরেছেন বলেই না ঘরে আনন্দের বন্যা বইছে!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments