সরল গরল-দীপু মনির সঙ্গে হিনা রাব্বানির ‘দুর্ঘটনা’ by মিজানুর রহমান খান
তিস্তা নিয়ে ড. মনমোহনের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকের অগ্রগতির খবর ঢাকায় পৌঁছার আগেই বাংলাদেশ ভারতের কারণে পাকিস্তানের কাছে এক ইস্যুতে একরকম হেরে গেছে। এতে পাকিস্তানের ইতিহাসের কনিষ্ঠতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের খুব খুশি হওয়ারই কথা। কারণ, তিনি ভাবতে পারেন যে দীপু মনিকে এক রাউন্ড হারিয়ে দিতে পেরেছেন। এতে হিনা তাঁর পাশে দিল্লিকে পেয়েছেন।
দীপু মনি শেষ পর্যন্ত দেখলেন, দিল্লি তাঁর পাশে নেই। আর হিনা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সঙ্গে তাঁর দেশের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি তুলে ধরেন এভাবে—পাকিস্তানকে ইইউর বাণিজ্যছাড় প্রদান পরিকল্পনায় বাংলাদেশের আপত্তির বিষয়টি তিনি বড়জোর একটি ‘দুর্ঘটনা’ মনে করেন।
৮ ও ৯ নভেম্বর রয়টার্সের দুটি প্রতিবেদন পড়ে অবাক হয়েছিলাম। এ এমনভাবে লেখা, যার অবিকল অনুবাদ পড়ে কারও মনে হতে পারে, বাংলাদেশের হলোটা কী! ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বন্যাদুর্গত পাকিস্তানের জন্য বাণিজ্যসুবিধা দিতে চায়। আর বাংলাদেশ তাতে খামোখা বাগড়া দিচ্ছে। জেনেভায় দুই দিন আগে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে, তাতে আপত্তি তুলেছে ঢাকা। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ঈষৎ আহত বোধ করতে পারে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ এলডিসির ৪৮টি দেশের অন্যতম। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি দেশগুলো ইইউর বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক বেচতে পারে। এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো বাড়তি অনুকম্পা নয়। পাকিস্তান ও ভারত এলডিসি নয়, মর্যাদায় তারা এলডিসির ওপরে—উন্নয়নশীল। কিন্তু পাকিস্তান এখন এলডিসির ভান ধরতে চাইছে।
বাংলাদেশ গত অর্থবছরে ইইউতে প্রায় সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র রপ্তানি করেছিল, যা ছিল তার মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আসে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে উন্নয়নশীল দেশের গোত্রভুক্ত। এ কারণে ইইউ যখন তার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মিত্র পাকিস্তানকে মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ভারত তাতে সম্মতি দেয়নি। অনেকে মনে করেছিলেন, ভারতের আপত্তি নীতিগত। কারণ, পাকিস্তান বা কোনো একটি দেশকে বিধি ভেঙে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও একই ধরনের সুবিধা আশা করতে পারে। কিন্তু সেই ভারত হঠাৎ মন পাল্টাল।
পাকিস্তানের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি এ বছরের জুলাইয়ে ভারতে গিয়ে বেশ নজর কেড়েছিলেন। এর তিন মাস আগে ভারত সফরে যান ইউসুুফ রাজা গিলানি। গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহমিনা জানজুয়া সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে আশ্বস্ত করেছেন যে ৭০টি আইটেমে বিশেষ শুল্কসুবিধা দিতে ইইউর পরিকল্পনার বিরোধিতা তাঁরা করবেন না। হিনার কাছেও দিল্লি তা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাহমিনা আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘এখনো বাধা যায়নি। কারণ, অন্যান্য দেশেরও আপত্তি রয়েছে।’
২০১০ সালে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা হয়। দুই কোটি মানুষ বন্যাদুর্গত হয়। ২০১০-১১ সালে দেশটির জিডিপির ২ শতাংশ ও ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি মার খায়। বেকারত্ব ১০ শতাংশ বাড়ে বলেও অনুমিত হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ইইউর শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তানকে বিশেষ বাণিজ্যসুবিধার নামে সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত শুধু ইইউ পার্লামেন্টেই নয়, ডব্লিউটিওতেও অনুমোদিত হতে হবে। সোমবারে জেনেভায় সেই বৈঠকই বসেছিল।
ইইউভুক্ত পোশাক উৎপাদনকারী ইতালি, ফ্রান্স ও পর্তুগালও বিশেষ বাণিজ্যসুবিধার নামে সহায়তা প্রদান নীতির বিরোধিতা করে। তবে পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। শ্রীলঙ্কা চুপচাপ ছিল। ইইউ তাদেরও একবার এ ধরনের সুবিধা দিয়েছিল। ভারতের যুক্তি ছিল প্রথাগত, কিন্তু ঠুনকো নয়। ভারত বলেছিল, বন্যাদুর্গত পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান অবশ্যই সমর্থনযোগ্য; কিন্তু তা বৈষম্যমূলক বাণিজ্যসুবিধার ছদ্মাবরণে কেন। ভারতীয় একজন বাণিজ্য নেগোশিয়েটর বলেছিলেন, এটা একটা ভয়ংকর দৃষ্টান্ত স্থাপন এবং তা মুক্ত বাণিজ্যনীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে। তাঁর কথায়, ‘এটা বাণিজ্য ভিন্নমুখীকরণ। শ্রীলঙ্কা কিংবা বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের কী হবে? পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্বিপাকে পড়েছে বলে তাদেরও এর মাশুল গুনতে হবে?’ (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ এপ্রিল ২০১১)
বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও মাশুল গুনতে হবে। তাকে এখন ইইউর বাজারে পাকিস্তানের সঙ্গে তেজি প্রতিযোগিতা উতরিয়ে তবে বিদেশি মুদ্রা ঘরে আনতে হবে। কিন্তু ভারত প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণে না নামলে বাংলাদেশের হয়তো আপত্তি করার কথা ছিল না। এমনও নয় যে ওই সময়ে তাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করছিল; বরং গত বছরের মার্চের ‘মোহালি চেতনায়’ (ক্রিকেট খেলা দেখা) মনমোহন-গিলানি তখন উদ্ভাসিত। ভারত ‘নীতিগত’ অবস্থান থেকে বিরোধিতা করলেও বিশ্ব কিন্তু পাক-ভারতের চির বৈরিতার আলোকেই তা পরখ করেছে। সে কারণে মালদ্বীপের আদ্দু সিটি থেকে পাঠানো রয়টার্স প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে, তাই ভারত সংকেত দিয়েছে যে তারা আর ইইউর পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করবে না। কিন্তু বদনামটা পড়ল যেন বাংলাদেশের কাঁধেই। ব্রাসেলস ডেটলাইনে রয়টার্স ৮ নভেম্বরে আরও একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়: ‘কূটনীতিকেরা মঙ্গলবার ব্রাসেলসে বলেছেন, বন্যাবিধ্বস্ত পাকিস্তানের জন্য ইইউর বাণিজ্যসুবিধার নামে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইউরোপ ও পাকিস্তান বহুদিন ধরে আশায় ছিল যে তারা জেনেভায় সোমবারে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য কূটনীতিকদের বৈঠকে ওই প্রস্তাব অনুমোদন করে নেবে। কিন্তু একটি বাংলাদেশি অভিযোগ তা কার্যকরভাবে প্রতিহত করেছে। বাংলাদেশ একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে বলে যে এ বিষয়ে তাদের উৎকণ্ঠা আছে।’
ঢাকা যখন দেখল ইইউ অটল, ভারতও তার পাশে নেই, তখনো তারা কেন বাধা দিল, আবার কেনই বা দ্রুত পিছটান দিল—তা আমরা জানি না। তবে রয়টার্স ৯ নভেম্বর মালদ্বীপ থেকে পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েসের একটি দ্বিধান্বিত ও দ্ব্যর্থক উদ্ধৃতি প্রকাশ করেছে। তাঁর উক্তি—‘সার্কের উপরি হিসেবে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে এখানে কথা বলেছেন। আমি জেনেভায় খতিয়ে দেখব...। আমি যতদূর জানি, আমাদের এটা (অভিযোগ) প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা।’ এ উক্তি হয়তো সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি কিংবা পররাষ্ট্রসচিব অসতর্ক ছিলেন।
বিজিএমইএর সভাপতি মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে ৯ নভেম্বর ফোনে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ কেন এবং কী বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, তা তিনি শুনেছেন। কিন্তু বিস্তারিত জানা নেই। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেনি।’ পাকিস্তানিরা যদিও বলছে যে প্রস্তাবিত ইইউ-সুবিধা মাত্র দুই বছরের জন্য। সে কারণে বাংলাদেশকে তেমন খেসারত দিতে হবে না। কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিরাট উদ্বেগজনক।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার কারণ হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ ঠিক আপত্তি তোলেনি। তবে গোড়াতেই এ বিষয়ে কথা তুলে কিছুটা হলেও তার লাভ হয়েছে।’ পাকিস্তান শূন্য শুল্কসুবিধা পেলে ইউরোপে বাংলাদেশের বিরাট বাজার হাতছাড়া হতে পারে। তাই বাংলাদেশ, বিশেষ করে তার সর্বাধিক রপ্তানিপ্রবণ আটটি আইটেমে (তৈরি পোশাক) সংরক্ষণ চেয়েছিল। ছয়টিতে তা নিশ্চিত করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব পণ্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বিনা শুল্কে ঢুকবে। কিন্তু তার বেশি হলেই পাকিস্তানকে শুল্ক দিতে হবে।
গত ১২ অক্টোবরে প্রকাশিত এক পাকিস্তানি সমীক্ষামতে আট আইটেমের (ওভেন ও নিটেড গার্মেন্টসসহ) ৭৪ ক্যাটাগরিতে পাকিস্তান ২০০৯ সালে ৮৫৫ মিলিয়ন ইউরোর পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রস্তাবিত সুবিধা পেলে তারা প্রায় ২৫০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরোর অতিরিক্ত রপ্তানি বাড়াতে পারবে। এর অনেকটা বাংলাদেশের ভাগ থেকেই যেতে পারে।
আশা করি, আমরা অচিরেই এ বিষয়ে সরকারের একটি ব্যাখ্যা পাব। তবে আপাতত জিজ্ঞাসা হলো, সোমবারের জেনেভায় বাংলাদেশ দুর্ঘটনার শিকার, না দুর্ঘটনার উদ্গাতা? ঢাকায় সরকারি সূত্রের দাবি, ডব্লিউটিওর ৭ নভেম্বরের সভায় বাংলাদেশ নয়, বরং ব্রাজিলের আপত্তির কারণে সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু এ খবর কোথাও দেখিনি। হিনা রাব্বানি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে তারা (ঢাকা) আমাদের অবহিত করেছে যে এটা আসলে একটা দুর্ঘটনা বৈ কিছু নয়।’ এ বক্তব্য সঠিক হলে বলা যায়, ডা. দীপু মনি হিনা রাব্বানির সঙ্গে একটা ‘কূটনৈতিক দুর্ঘটনায়’ নিপতিত হয়েছেন। পাকিস্তানের গণমাধ্যমও বলেছে, ভারত নয়, আটকে দিল বাংলাদেশ।
সবচেয়ে লক্ষণীয়, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে বন্ধু বাংলাদেশকে ‘ত্যাগ করে’ চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে কালক্ষেপণ করেনি। ২ নভেম্বর পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা ভারতকে বহু প্রতীক্ষিত দ্বিপক্ষীয় বিশেষ বাণিজ্যসুবিধা (এমএফএন মর্যাদা) প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর মধ্যে একটা লেনদেন আঁচ করা যায়। এই আঁচ আমাদের গায়ে লাগছে—এমন এক বাতাবরণে ঢাকা যেন দিল্লির সঙ্গে ‘লেনদেন’ কূটনীতি বিসর্জন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
৮ ও ৯ নভেম্বর রয়টার্সের দুটি প্রতিবেদন পড়ে অবাক হয়েছিলাম। এ এমনভাবে লেখা, যার অবিকল অনুবাদ পড়ে কারও মনে হতে পারে, বাংলাদেশের হলোটা কী! ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বন্যাদুর্গত পাকিস্তানের জন্য বাণিজ্যসুবিধা দিতে চায়। আর বাংলাদেশ তাতে খামোখা বাগড়া দিচ্ছে। জেনেভায় দুই দিন আগে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে, তাতে আপত্তি তুলেছে ঢাকা। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ঈষৎ আহত বোধ করতে পারে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ এলডিসির ৪৮টি দেশের অন্যতম। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি দেশগুলো ইইউর বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক বেচতে পারে। এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো বাড়তি অনুকম্পা নয়। পাকিস্তান ও ভারত এলডিসি নয়, মর্যাদায় তারা এলডিসির ওপরে—উন্নয়নশীল। কিন্তু পাকিস্তান এখন এলডিসির ভান ধরতে চাইছে।
বাংলাদেশ গত অর্থবছরে ইইউতে প্রায় সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র রপ্তানি করেছিল, যা ছিল তার মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আসে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে উন্নয়নশীল দেশের গোত্রভুক্ত। এ কারণে ইইউ যখন তার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মিত্র পাকিস্তানকে মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ভারত তাতে সম্মতি দেয়নি। অনেকে মনে করেছিলেন, ভারতের আপত্তি নীতিগত। কারণ, পাকিস্তান বা কোনো একটি দেশকে বিধি ভেঙে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও একই ধরনের সুবিধা আশা করতে পারে। কিন্তু সেই ভারত হঠাৎ মন পাল্টাল।
পাকিস্তানের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি এ বছরের জুলাইয়ে ভারতে গিয়ে বেশ নজর কেড়েছিলেন। এর তিন মাস আগে ভারত সফরে যান ইউসুুফ রাজা গিলানি। গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহমিনা জানজুয়া সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে আশ্বস্ত করেছেন যে ৭০টি আইটেমে বিশেষ শুল্কসুবিধা দিতে ইইউর পরিকল্পনার বিরোধিতা তাঁরা করবেন না। হিনার কাছেও দিল্লি তা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাহমিনা আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘এখনো বাধা যায়নি। কারণ, অন্যান্য দেশেরও আপত্তি রয়েছে।’
২০১০ সালে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা হয়। দুই কোটি মানুষ বন্যাদুর্গত হয়। ২০১০-১১ সালে দেশটির জিডিপির ২ শতাংশ ও ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি মার খায়। বেকারত্ব ১০ শতাংশ বাড়ে বলেও অনুমিত হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ইইউর শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তানকে বিশেষ বাণিজ্যসুবিধার নামে সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত শুধু ইইউ পার্লামেন্টেই নয়, ডব্লিউটিওতেও অনুমোদিত হতে হবে। সোমবারে জেনেভায় সেই বৈঠকই বসেছিল।
ইইউভুক্ত পোশাক উৎপাদনকারী ইতালি, ফ্রান্স ও পর্তুগালও বিশেষ বাণিজ্যসুবিধার নামে সহায়তা প্রদান নীতির বিরোধিতা করে। তবে পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। শ্রীলঙ্কা চুপচাপ ছিল। ইইউ তাদেরও একবার এ ধরনের সুবিধা দিয়েছিল। ভারতের যুক্তি ছিল প্রথাগত, কিন্তু ঠুনকো নয়। ভারত বলেছিল, বন্যাদুর্গত পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান অবশ্যই সমর্থনযোগ্য; কিন্তু তা বৈষম্যমূলক বাণিজ্যসুবিধার ছদ্মাবরণে কেন। ভারতীয় একজন বাণিজ্য নেগোশিয়েটর বলেছিলেন, এটা একটা ভয়ংকর দৃষ্টান্ত স্থাপন এবং তা মুক্ত বাণিজ্যনীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে। তাঁর কথায়, ‘এটা বাণিজ্য ভিন্নমুখীকরণ। শ্রীলঙ্কা কিংবা বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের কী হবে? পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্বিপাকে পড়েছে বলে তাদেরও এর মাশুল গুনতে হবে?’ (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ এপ্রিল ২০১১)
বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও মাশুল গুনতে হবে। তাকে এখন ইইউর বাজারে পাকিস্তানের সঙ্গে তেজি প্রতিযোগিতা উতরিয়ে তবে বিদেশি মুদ্রা ঘরে আনতে হবে। কিন্তু ভারত প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণে না নামলে বাংলাদেশের হয়তো আপত্তি করার কথা ছিল না। এমনও নয় যে ওই সময়ে তাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করছিল; বরং গত বছরের মার্চের ‘মোহালি চেতনায়’ (ক্রিকেট খেলা দেখা) মনমোহন-গিলানি তখন উদ্ভাসিত। ভারত ‘নীতিগত’ অবস্থান থেকে বিরোধিতা করলেও বিশ্ব কিন্তু পাক-ভারতের চির বৈরিতার আলোকেই তা পরখ করেছে। সে কারণে মালদ্বীপের আদ্দু সিটি থেকে পাঠানো রয়টার্স প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে, তাই ভারত সংকেত দিয়েছে যে তারা আর ইইউর পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করবে না। কিন্তু বদনামটা পড়ল যেন বাংলাদেশের কাঁধেই। ব্রাসেলস ডেটলাইনে রয়টার্স ৮ নভেম্বরে আরও একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়: ‘কূটনীতিকেরা মঙ্গলবার ব্রাসেলসে বলেছেন, বন্যাবিধ্বস্ত পাকিস্তানের জন্য ইইউর বাণিজ্যসুবিধার নামে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইউরোপ ও পাকিস্তান বহুদিন ধরে আশায় ছিল যে তারা জেনেভায় সোমবারে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য কূটনীতিকদের বৈঠকে ওই প্রস্তাব অনুমোদন করে নেবে। কিন্তু একটি বাংলাদেশি অভিযোগ তা কার্যকরভাবে প্রতিহত করেছে। বাংলাদেশ একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে বলে যে এ বিষয়ে তাদের উৎকণ্ঠা আছে।’
ঢাকা যখন দেখল ইইউ অটল, ভারতও তার পাশে নেই, তখনো তারা কেন বাধা দিল, আবার কেনই বা দ্রুত পিছটান দিল—তা আমরা জানি না। তবে রয়টার্স ৯ নভেম্বর মালদ্বীপ থেকে পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েসের একটি দ্বিধান্বিত ও দ্ব্যর্থক উদ্ধৃতি প্রকাশ করেছে। তাঁর উক্তি—‘সার্কের উপরি হিসেবে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে এখানে কথা বলেছেন। আমি জেনেভায় খতিয়ে দেখব...। আমি যতদূর জানি, আমাদের এটা (অভিযোগ) প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা।’ এ উক্তি হয়তো সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি কিংবা পররাষ্ট্রসচিব অসতর্ক ছিলেন।
বিজিএমইএর সভাপতি মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে ৯ নভেম্বর ফোনে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ কেন এবং কী বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, তা তিনি শুনেছেন। কিন্তু বিস্তারিত জানা নেই। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেনি।’ পাকিস্তানিরা যদিও বলছে যে প্রস্তাবিত ইইউ-সুবিধা মাত্র দুই বছরের জন্য। সে কারণে বাংলাদেশকে তেমন খেসারত দিতে হবে না। কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিরাট উদ্বেগজনক।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার কারণ হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ ঠিক আপত্তি তোলেনি। তবে গোড়াতেই এ বিষয়ে কথা তুলে কিছুটা হলেও তার লাভ হয়েছে।’ পাকিস্তান শূন্য শুল্কসুবিধা পেলে ইউরোপে বাংলাদেশের বিরাট বাজার হাতছাড়া হতে পারে। তাই বাংলাদেশ, বিশেষ করে তার সর্বাধিক রপ্তানিপ্রবণ আটটি আইটেমে (তৈরি পোশাক) সংরক্ষণ চেয়েছিল। ছয়টিতে তা নিশ্চিত করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব পণ্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বিনা শুল্কে ঢুকবে। কিন্তু তার বেশি হলেই পাকিস্তানকে শুল্ক দিতে হবে।
গত ১২ অক্টোবরে প্রকাশিত এক পাকিস্তানি সমীক্ষামতে আট আইটেমের (ওভেন ও নিটেড গার্মেন্টসসহ) ৭৪ ক্যাটাগরিতে পাকিস্তান ২০০৯ সালে ৮৫৫ মিলিয়ন ইউরোর পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রস্তাবিত সুবিধা পেলে তারা প্রায় ২৫০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরোর অতিরিক্ত রপ্তানি বাড়াতে পারবে। এর অনেকটা বাংলাদেশের ভাগ থেকেই যেতে পারে।
আশা করি, আমরা অচিরেই এ বিষয়ে সরকারের একটি ব্যাখ্যা পাব। তবে আপাতত জিজ্ঞাসা হলো, সোমবারের জেনেভায় বাংলাদেশ দুর্ঘটনার শিকার, না দুর্ঘটনার উদ্গাতা? ঢাকায় সরকারি সূত্রের দাবি, ডব্লিউটিওর ৭ নভেম্বরের সভায় বাংলাদেশ নয়, বরং ব্রাজিলের আপত্তির কারণে সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু এ খবর কোথাও দেখিনি। হিনা রাব্বানি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে তারা (ঢাকা) আমাদের অবহিত করেছে যে এটা আসলে একটা দুর্ঘটনা বৈ কিছু নয়।’ এ বক্তব্য সঠিক হলে বলা যায়, ডা. দীপু মনি হিনা রাব্বানির সঙ্গে একটা ‘কূটনৈতিক দুর্ঘটনায়’ নিপতিত হয়েছেন। পাকিস্তানের গণমাধ্যমও বলেছে, ভারত নয়, আটকে দিল বাংলাদেশ।
সবচেয়ে লক্ষণীয়, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে বন্ধু বাংলাদেশকে ‘ত্যাগ করে’ চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে কালক্ষেপণ করেনি। ২ নভেম্বর পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা ভারতকে বহু প্রতীক্ষিত দ্বিপক্ষীয় বিশেষ বাণিজ্যসুবিধা (এমএফএন মর্যাদা) প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর মধ্যে একটা লেনদেন আঁচ করা যায়। এই আঁচ আমাদের গায়ে লাগছে—এমন এক বাতাবরণে ঢাকা যেন দিল্লির সঙ্গে ‘লেনদেন’ কূটনীতি বিসর্জন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments