দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠন প্রসঙ্গে by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য নির্মূলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আদলে একটি ইউনিয়ন গঠন সময়ের দাবি। গত ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় লোকসভায় হিরেন মুখার্জি স্মারক বক্তৃতায় তিনি এ প্রস্তাব করেন।
বক্তৃতায় তার প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনি বলেন, আসুন আমরা স্বপ্ন দেখি ২০৩০ সালে চমত্কারভাবে সক্রিয় এক দক্ষিণ এশিয়ান ইউনিয়ন, যেখানে লাগবে না কোনো ভিসা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সফর নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে না কোনো শুল্ক কর্মকর্তা। জাতীয় পতাকার পাশে থাকবে একটি অভিন্ন পতাকা, থাকবে অভিন্ন মুদ্রা এবং অভিন্ন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পলিসির জন্য বিশাল ক্ষেত্র। আসুন স্বপ্ন দেখি, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের বুকে দক্ষিণ এশিয়াকে দারিদ্র্যমুক্ত অঞ্চল বানাব। চলুন আমরা প্রস্তুতি নেই বিশ্বকে এই চ্যালেঞ্জ জানাতে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় একজনও দরিদ্র লোক নেই।
ড. ইউনূস দক্ষিণ এশিয়ায় নির্ভরযোগ্য সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, বিকশিত আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ বাকি সব সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যাপকভিত্তিক সৃষ্টিশীল ও কার্যকর সামাজিক ব্যবসা চালু করার কথা বলেন।
সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে এমন ধরনের ব্যবসা যেখানে একজন বিনিয়োগকারী নিজের ব্যক্তিগত লাভ ছাড়াই বিনিয়োগ করেন। আবার এটাও সত্য, সামাজিক ব্যবসা নিজের খরচেই পর্যাপ্ত আয় করতে পারেন। এ ব্যবসাকে সম্প্রসারণ বা সমাজের কল্যাণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য এখানে ব্যবসায়ের মুনাফা ও বিনিয়োগ করা হয়। সামাজিক ব্যবসা লোকসানহীন এমন কোম্পানি যাতে লাভ বণ্টন না করে একটি সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য উত্সর্গীকৃত। এ ধরনের ব্যবসা মানব প্রকৃতির স্বার্থশূন্য দিকটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। আমাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোতে এ ব্যবসার কথা নেই।
তিনি বলেন, আমাদের বাণিজ্য বিশ্বের ছবি পাল্টাতে শুরু করেছে। আমরা এখন দু’ধরনের ব্যবসা দেখতে পাচ্ছি। এক ধরনের ব্যবসা শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য, বাকি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদের সহায়তা প্রদান। এক ধরনের ব্যবসায়ের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যদের কথা বিবেচনায় না এনে শুধু মালিকের সর্বোচ্চ লাভের চিন্তা, অপর ব্যবসায়ের টার্গেট হচ্ছে সদস্যদের কল্যাণের জন্য সবকিছু করা, এখানে মালিকের লাভের জন্য কিছু করা হয় না। হ্যাঁ, এ ধরনের ব্যবসায়ে মালিক মানবতার সেবার আনন্দ ছাড়া আর কিছুই পান না।
যে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই দারিদ্র্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, দারিদ্র্য আমাদেরই তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোর হীনতা থেকে উদ্ভূত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অপূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি। এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগণকেই ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
যুগের পর যুগ এসব প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে, দরিদ্রদের ঋণ দেয়া যায় না। আর সবাই এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান তাদেরই ঋণ দেয়, যারা বিশ্বটাকে চুষে খান। গ্রামীণ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ নীতিমালাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রমাণ করে দিয়েছে, টেকসই পদ্ধতিতে দরিদ্রদেরও ঋণ দেয়া যায়। (সূত্র : আমার দেশ, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৯)
ভারতীয় লোকসভায় দেয়া ড. ইউনূসের বক্তৃতায় পাওয়া যাবে কয়েকটি জিনিস— ১. ড. ইউনূস তার গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্রদের ঋণ দেয়ার নতুন ব্যবস্থা তৈরি করেছেন; ২. এ ঋণ দারিদ্রপীড়িত জনগণকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করছে; ৩. গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছে মানুষ একমুখী জীব নয়, বহুমুখী জীব; ৪. ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী দু’ধরনের ব্যবসার কথা বলা হচ্ছে, এক ধরনের ব্যবসা হচ্ছে মালিকের লাভের জন্য, আর অন্যটি হচ্ছে সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণের জন্য। সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণের জন্য তিনি সামাজিক ব্যবসার কথা বলছেন এবং এ সামাজিক ব্যবসা তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে শুরু করেছেন তারও উল্লেখ করেছেন; ৫. হৃদয়ের সবটুকু চাওয়া-পাওয়া দিয়ে তিনি বিশ্বাস করেন মানবাধিকারের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া উচিত; ৬. সামাজিক ব্যবসা প্রসারের মাধ্যমে বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করা বা দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানো তার লক্ষ্য।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা এবং কাজ একরকম হলে আমরা সবাই খুশি হতাম। কিন্তু বাস্তবতা বলে তার কথা এবং কাজের মধ্যে স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়। নোবেল পাওয়ার পর তার নিজস্ব লেখাতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি দশ টাকা সুদে টাকা কিনি’, ‘আর বিক্রি করি বিশ টাকা সুদে’। তার একথাটিও সত্য নয়। গ্রামীণ ব্যাংক যে শর্তে দরিদ্র নারীদের ঋণ দেয় সেই শর্ত অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, ঋণের সুদ শতকরা বিশ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, কিন্তু পরিশোধের ধারায় তা বেড়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সুদ দাঁড়ায় শতকরা ৪০ টাকারও বেশি।
দ্বিতীয়ত, দরিদ্রদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি মানবাধিকারের কথা বলেছেন, কিন্তু দেখা যায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে, ঘরের টিন, টেবিল, চেয়ার, গরু-ছাগল ইত্যাদি জোর করে তারা নিয়ে যায়। এটা যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন এমন রিপোর্ট আমরা পত্রিকার মাধ্যমে পাই।
তৃতীয়ত, ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি দু’ধরনের ব্যবসার কথা বলেছেন। কিন্তু দেখা যায় তার গ্রামীণফোনের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি পুরনো ধরনের ব্যবসার পথই অনুসরণ করে চলেছেন। গ্রামীণফোনের অংশীদার কোম্পানি টেলিনরের অংশ শতকরা ৬২ ভাগ এবং গ্রামীণ টেলিকমের অংশ ৩৮ ভাগ। মুনাফার বেশিরভাগ অংশই এক্ষেত্রে টেলিনরের ঘরে জমা পড়ে। ধরেই নিলাম তখন তার মধ্যে সদ্য আবিষ্কৃত সামাজিক ব্যবসার বিষয়টি দানা বেঁধে ওঠেনি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময় থেকেই এ নতুন ধরনের ব্যবসার কথা তিনি বলছেন। জনগণের কল্যাণে নিবেদিত এ ব্যবসার প্রতি আন্তরিক হলে বিশ্বের জনগণের দুর্দশা সৃষ্টিতে যারা সিদ্ধহস্ত তাদের সঙ্গে তার বিরোধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমরা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করি। তাই তো আমরা দেখি, বিশ্বব্যাপী জনগণের দুর্দশা সৃষ্টি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে সিদ্ধহস্ত যুক্তরাষ্ট্র যখন তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দেয় তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো প্রতিবাদ না করে সানন্দে তা গ্রহণ করেন। হৃদয়ে যার সব সময় মানবাধিকারের বিষয়টি কাজ করে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই মেডেল গ্রহণ লজ্জার কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেটা হয়নি।
যে কোনো দেশের অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সেই অর্থনীতিতে সৃষ্ট উদ্বৃত্তমূল্য বা মুনাফার সংরক্ষণ এবং তা নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাপী এভাবেই বিভিন্ন রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। কোথাওবা সেটার গতি মন্থর, আবার কোথাওবা সেটা দ্রুতগতিসম্পন্ন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন চলছে, তখন সেখানে নতুন মূল্যও সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এ নতুন মূল্যের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে সেটা দেখার বিষয়। আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যের নিয়ন্ত্রক যদি আমরা হয়ে থাকি এবং তা যদি উত্পাদনমূলক খাতে বিনিয়োগ হয় তবে এ দেশের অর্থনীতির বিকাশের প্রশ্নে নতুন নতুন উত্পাদনক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা কোনো সমস্যা নয়। দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষকে বিশাল কর্মযজ্ঞে টেনে এনে দারিদ্র্যমুক্ত করাও কষ্টকর কিছু নয়। কিন্তু আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট নতুন মূল্যের নিয়ন্ত্রণকর্তা যদি ভিন্ন কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা হয়ে থাকে, তবে এ দেশের অর্থনীতির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হবে, উত্পাদণক্ষেত্র সম্প্রসারণে ভাটা পড়বে, দারিদ্র্য বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটাই ঘটছে। এদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট নতুন মূল্যের ওপর আমাদের দেশীয় নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে, বিদেশি বহুজাতিক বৃহত্ পুঁজির দ্বারা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট নতুন মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কারণে কথায় কথায় বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার খবরদারি আমরা হজম করি। অমুক শর্ত মানো, তমুক শর্ত মানো বলে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে তারা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে এসব বিদেশি সংস্থা ও আগ্রাসী বহুজাতিক বৃহত্ পুঁজির খবরদারির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে উচিত কাজ হতো। নিজের দেশে সৃষ্ট মূল্য নিজ দেশে ধরে রাখার এবং এ মূল্য নতুন নতুন উত্পাদনক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করতে পারলে এ দেশে দারিদ্র্য বলে শব্দটি এক দশকেই দূর হয়ে যেত। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে পারতাম। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যেমন নিজেদের সম্মানজনক অবস্থান বহাল রেখে তা করতে পারছে, দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রেও আমরা সেটা করতে পারতাম। কিন্তু আমরা জানি, আমরা বা আমাদের দেশের অর্থনীতি সেই অবস্থায় নেই, ফলে দেশীয় অর্থনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখার যোগ্যতা অর্জন করা ছাড়া দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করি না কেন তা আমাদের জন্য হিতকর হবে না। স্বভাবতই দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের আগেই আমাদের সেই অবস্থায় পৌঁছাতে হবে, যে অবস্থা আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করার রাজনৈতিক যোগ্যতা সৃষ্টি করে। আমরা যদি সেটা না করে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের দিকে অগ্রসর হই তবে তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক হবে, যা আমাদের দেশের জনগণের কল্যাণার্থে কাম্য নয়।
ড. ইউনূস ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাহরণ টেনে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছেন, সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূসকে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, আর সেটা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি আধিপত্যবাদী শক্তি, আমাদের দেশের মতো দেশগুলোর গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য যা মোটেই সহায়ক নয়। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সব রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রশ্নে যা যা করণীয় সে বিষয়ে আমরা মনোযোগী হলে এবং একযোগে কাজ করলে গণতান্ত্রিক বিকাশের সাফল্য জাতিকে আরও বৃহত্ পরিসরে নিয়ে যেতে পারবে অর্থাত্ শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন নয়—বিশ্বব্যাপী সব রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি একক ইউনিয়ন গঠনে আমরা সক্ষম হবো। গড়ে উঠবে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা, যা আধিপত্যবাদী শক্তির পতন নিশ্চিত করবে। আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়। আধিপত্যবাদমুক্ত বিশ্ব আমাদের কাম্য। সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূস যদি একমত হন তবে বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশ যে পথে উন্মুক্ত হবে বা হতে পারে সে পথেই তাকে হাঁটতে হবে, আর এ কাজটি করা সম্ভব বিশ্বব্যাপী যেসব রাষ্ট্রের অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাকে বাধামুক্ত করে।
প্রত্যেকটি দেশ তার নিজ দেশীয় অর্থনীতির প্রশ্নে স্বাধীন এবং নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালনে যাতে সক্ষম হয়ে ওঠে সে ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করাই হবে এক্ষেত্রে প্রধান কাজ। বহুজাতিক পুঁজির অংশীদারিত্বে পরিচালিত ড. ইউনূসের ‘সামাজিক ব্যবসা’ এ ক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রাখতে সক্ষম হবে তা ভবিষ্যত্ই বলে দেবে। তবে মনে হয় না, যে পুঁজি বিশ্বব্যাপী আধিপত্য কায়েম এবং তা টিকিয়ে রাখার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের পাহাড় গড়ে তুলেছে সেই পুঁজি আমাদের দেশের বা আমাদের মতো দেশগুলোর অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশকে উন্মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হবে। সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের উচিত হবে বহুজাতিক পুঁজির অংশীদারিত্ব নিয়ে তিনি যেসব ব্যবসা করছেন তার সব তথ্য জনসমক্ষে হাজির করা। এ কাজে স্বচ্ছতা থাকলে জনগণ ড. ইউনূসকে হয়তোবা ভিন্নভাবে বিবেচনার যোগ্য মনে করতে পারে, আর যদি তা না হয় তবে ভাবতে হবে ড. ইউনূসের দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাবের পেছনে অন্য কোনো মতলব আছে, যা বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা না করে আধিপত্যবাদকেই উত্সাহিত করবে।
ড. ইউনূস দক্ষিণ এশিয়ায় নির্ভরযোগ্য সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, বিকশিত আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ বাকি সব সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যাপকভিত্তিক সৃষ্টিশীল ও কার্যকর সামাজিক ব্যবসা চালু করার কথা বলেন।
সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে এমন ধরনের ব্যবসা যেখানে একজন বিনিয়োগকারী নিজের ব্যক্তিগত লাভ ছাড়াই বিনিয়োগ করেন। আবার এটাও সত্য, সামাজিক ব্যবসা নিজের খরচেই পর্যাপ্ত আয় করতে পারেন। এ ব্যবসাকে সম্প্রসারণ বা সমাজের কল্যাণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য এখানে ব্যবসায়ের মুনাফা ও বিনিয়োগ করা হয়। সামাজিক ব্যবসা লোকসানহীন এমন কোম্পানি যাতে লাভ বণ্টন না করে একটি সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য উত্সর্গীকৃত। এ ধরনের ব্যবসা মানব প্রকৃতির স্বার্থশূন্য দিকটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। আমাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোতে এ ব্যবসার কথা নেই।
তিনি বলেন, আমাদের বাণিজ্য বিশ্বের ছবি পাল্টাতে শুরু করেছে। আমরা এখন দু’ধরনের ব্যবসা দেখতে পাচ্ছি। এক ধরনের ব্যবসা শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য, বাকি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদের সহায়তা প্রদান। এক ধরনের ব্যবসায়ের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যদের কথা বিবেচনায় না এনে শুধু মালিকের সর্বোচ্চ লাভের চিন্তা, অপর ব্যবসায়ের টার্গেট হচ্ছে সদস্যদের কল্যাণের জন্য সবকিছু করা, এখানে মালিকের লাভের জন্য কিছু করা হয় না। হ্যাঁ, এ ধরনের ব্যবসায়ে মালিক মানবতার সেবার আনন্দ ছাড়া আর কিছুই পান না।
যে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই দারিদ্র্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, দারিদ্র্য আমাদেরই তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোর হীনতা থেকে উদ্ভূত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অপূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি। এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগণকেই ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
যুগের পর যুগ এসব প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে, দরিদ্রদের ঋণ দেয়া যায় না। আর সবাই এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান তাদেরই ঋণ দেয়, যারা বিশ্বটাকে চুষে খান। গ্রামীণ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ নীতিমালাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রমাণ করে দিয়েছে, টেকসই পদ্ধতিতে দরিদ্রদেরও ঋণ দেয়া যায়। (সূত্র : আমার দেশ, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৯)
ভারতীয় লোকসভায় দেয়া ড. ইউনূসের বক্তৃতায় পাওয়া যাবে কয়েকটি জিনিস— ১. ড. ইউনূস তার গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্রদের ঋণ দেয়ার নতুন ব্যবস্থা তৈরি করেছেন; ২. এ ঋণ দারিদ্রপীড়িত জনগণকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করছে; ৩. গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছে মানুষ একমুখী জীব নয়, বহুমুখী জীব; ৪. ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী দু’ধরনের ব্যবসার কথা বলা হচ্ছে, এক ধরনের ব্যবসা হচ্ছে মালিকের লাভের জন্য, আর অন্যটি হচ্ছে সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণের জন্য। সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণের জন্য তিনি সামাজিক ব্যবসার কথা বলছেন এবং এ সামাজিক ব্যবসা তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে শুরু করেছেন তারও উল্লেখ করেছেন; ৫. হৃদয়ের সবটুকু চাওয়া-পাওয়া দিয়ে তিনি বিশ্বাস করেন মানবাধিকারের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া উচিত; ৬. সামাজিক ব্যবসা প্রসারের মাধ্যমে বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করা বা দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানো তার লক্ষ্য।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা এবং কাজ একরকম হলে আমরা সবাই খুশি হতাম। কিন্তু বাস্তবতা বলে তার কথা এবং কাজের মধ্যে স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়। নোবেল পাওয়ার পর তার নিজস্ব লেখাতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি দশ টাকা সুদে টাকা কিনি’, ‘আর বিক্রি করি বিশ টাকা সুদে’। তার একথাটিও সত্য নয়। গ্রামীণ ব্যাংক যে শর্তে দরিদ্র নারীদের ঋণ দেয় সেই শর্ত অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, ঋণের সুদ শতকরা বিশ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, কিন্তু পরিশোধের ধারায় তা বেড়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সুদ দাঁড়ায় শতকরা ৪০ টাকারও বেশি।
দ্বিতীয়ত, দরিদ্রদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি মানবাধিকারের কথা বলেছেন, কিন্তু দেখা যায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে, ঘরের টিন, টেবিল, চেয়ার, গরু-ছাগল ইত্যাদি জোর করে তারা নিয়ে যায়। এটা যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন এমন রিপোর্ট আমরা পত্রিকার মাধ্যমে পাই।
তৃতীয়ত, ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি দু’ধরনের ব্যবসার কথা বলেছেন। কিন্তু দেখা যায় তার গ্রামীণফোনের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি পুরনো ধরনের ব্যবসার পথই অনুসরণ করে চলেছেন। গ্রামীণফোনের অংশীদার কোম্পানি টেলিনরের অংশ শতকরা ৬২ ভাগ এবং গ্রামীণ টেলিকমের অংশ ৩৮ ভাগ। মুনাফার বেশিরভাগ অংশই এক্ষেত্রে টেলিনরের ঘরে জমা পড়ে। ধরেই নিলাম তখন তার মধ্যে সদ্য আবিষ্কৃত সামাজিক ব্যবসার বিষয়টি দানা বেঁধে ওঠেনি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময় থেকেই এ নতুন ধরনের ব্যবসার কথা তিনি বলছেন। জনগণের কল্যাণে নিবেদিত এ ব্যবসার প্রতি আন্তরিক হলে বিশ্বের জনগণের দুর্দশা সৃষ্টিতে যারা সিদ্ধহস্ত তাদের সঙ্গে তার বিরোধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমরা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করি। তাই তো আমরা দেখি, বিশ্বব্যাপী জনগণের দুর্দশা সৃষ্টি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে সিদ্ধহস্ত যুক্তরাষ্ট্র যখন তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দেয় তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো প্রতিবাদ না করে সানন্দে তা গ্রহণ করেন। হৃদয়ে যার সব সময় মানবাধিকারের বিষয়টি কাজ করে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই মেডেল গ্রহণ লজ্জার কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেটা হয়নি।
যে কোনো দেশের অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সেই অর্থনীতিতে সৃষ্ট উদ্বৃত্তমূল্য বা মুনাফার সংরক্ষণ এবং তা নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাপী এভাবেই বিভিন্ন রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। কোথাওবা সেটার গতি মন্থর, আবার কোথাওবা সেটা দ্রুতগতিসম্পন্ন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন চলছে, তখন সেখানে নতুন মূল্যও সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এ নতুন মূল্যের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে সেটা দেখার বিষয়। আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যের নিয়ন্ত্রক যদি আমরা হয়ে থাকি এবং তা যদি উত্পাদনমূলক খাতে বিনিয়োগ হয় তবে এ দেশের অর্থনীতির বিকাশের প্রশ্নে নতুন নতুন উত্পাদনক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা কোনো সমস্যা নয়। দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষকে বিশাল কর্মযজ্ঞে টেনে এনে দারিদ্র্যমুক্ত করাও কষ্টকর কিছু নয়। কিন্তু আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট নতুন মূল্যের নিয়ন্ত্রণকর্তা যদি ভিন্ন কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা হয়ে থাকে, তবে এ দেশের অর্থনীতির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হবে, উত্পাদণক্ষেত্র সম্প্রসারণে ভাটা পড়বে, দারিদ্র্য বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটাই ঘটছে। এদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট নতুন মূল্যের ওপর আমাদের দেশীয় নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে, বিদেশি বহুজাতিক বৃহত্ পুঁজির দ্বারা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট নতুন মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কারণে কথায় কথায় বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার খবরদারি আমরা হজম করি। অমুক শর্ত মানো, তমুক শর্ত মানো বলে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে তারা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে এসব বিদেশি সংস্থা ও আগ্রাসী বহুজাতিক বৃহত্ পুঁজির খবরদারির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে উচিত কাজ হতো। নিজের দেশে সৃষ্ট মূল্য নিজ দেশে ধরে রাখার এবং এ মূল্য নতুন নতুন উত্পাদনক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করতে পারলে এ দেশে দারিদ্র্য বলে শব্দটি এক দশকেই দূর হয়ে যেত। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে পারতাম। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যেমন নিজেদের সম্মানজনক অবস্থান বহাল রেখে তা করতে পারছে, দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রেও আমরা সেটা করতে পারতাম। কিন্তু আমরা জানি, আমরা বা আমাদের দেশের অর্থনীতি সেই অবস্থায় নেই, ফলে দেশীয় অর্থনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখার যোগ্যতা অর্জন করা ছাড়া দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করি না কেন তা আমাদের জন্য হিতকর হবে না। স্বভাবতই দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের আগেই আমাদের সেই অবস্থায় পৌঁছাতে হবে, যে অবস্থা আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করার রাজনৈতিক যোগ্যতা সৃষ্টি করে। আমরা যদি সেটা না করে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের দিকে অগ্রসর হই তবে তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক হবে, যা আমাদের দেশের জনগণের কল্যাণার্থে কাম্য নয়।
ড. ইউনূস ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাহরণ টেনে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছেন, সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূসকে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, আর সেটা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি আধিপত্যবাদী শক্তি, আমাদের দেশের মতো দেশগুলোর গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য যা মোটেই সহায়ক নয়। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সব রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রশ্নে যা যা করণীয় সে বিষয়ে আমরা মনোযোগী হলে এবং একযোগে কাজ করলে গণতান্ত্রিক বিকাশের সাফল্য জাতিকে আরও বৃহত্ পরিসরে নিয়ে যেতে পারবে অর্থাত্ শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন নয়—বিশ্বব্যাপী সব রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি একক ইউনিয়ন গঠনে আমরা সক্ষম হবো। গড়ে উঠবে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা, যা আধিপত্যবাদী শক্তির পতন নিশ্চিত করবে। আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়। আধিপত্যবাদমুক্ত বিশ্ব আমাদের কাম্য। সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূস যদি একমত হন তবে বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশ যে পথে উন্মুক্ত হবে বা হতে পারে সে পথেই তাকে হাঁটতে হবে, আর এ কাজটি করা সম্ভব বিশ্বব্যাপী যেসব রাষ্ট্রের অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাকে বাধামুক্ত করে।
প্রত্যেকটি দেশ তার নিজ দেশীয় অর্থনীতির প্রশ্নে স্বাধীন এবং নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালনে যাতে সক্ষম হয়ে ওঠে সে ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করাই হবে এক্ষেত্রে প্রধান কাজ। বহুজাতিক পুঁজির অংশীদারিত্বে পরিচালিত ড. ইউনূসের ‘সামাজিক ব্যবসা’ এ ক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রাখতে সক্ষম হবে তা ভবিষ্যত্ই বলে দেবে। তবে মনে হয় না, যে পুঁজি বিশ্বব্যাপী আধিপত্য কায়েম এবং তা টিকিয়ে রাখার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের পাহাড় গড়ে তুলেছে সেই পুঁজি আমাদের দেশের বা আমাদের মতো দেশগুলোর অর্থনীতির গণতান্ত্রিক বিকাশকে উন্মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হবে। সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের উচিত হবে বহুজাতিক পুঁজির অংশীদারিত্ব নিয়ে তিনি যেসব ব্যবসা করছেন তার সব তথ্য জনসমক্ষে হাজির করা। এ কাজে স্বচ্ছতা থাকলে জনগণ ড. ইউনূসকে হয়তোবা ভিন্নভাবে বিবেচনার যোগ্য মনে করতে পারে, আর যদি তা না হয় তবে ভাবতে হবে ড. ইউনূসের দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাবের পেছনে অন্য কোনো মতলব আছে, যা বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা না করে আধিপত্যবাদকেই উত্সাহিত করবে।
No comments