পরিবেশ ব্যবস্থাপনা-শস্যখেত ও ছায়া সুনিবিড় গৃহ by জিয়া উদ্দিন আহমেদ
প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যের মাঝে সংঘাত ও সমন্বয় এক চিরন্তন সত্য, তবে এর প্রকৃত রূপ প্রায়ই আমাদের অগোচরে থেকে যায়। আমাদের উচ্চ জনঘনত্ব ও সম্পদস্বল্পতার বহুমুখী জীবতাত্ত্বিক প্রভাব আজও অনেকাংশেই অজানা। বিশ্বে ন্যূনতম মাথাপিছু জমির উত্তরাধিকারী হিসেবে আবাদি জমির তীব্র সংকট আমাদের জন্য নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।
এই পরিস্থিতির নানা জটিলতায় আমরা বিভ্রান্ত, অতীতের ছায়া সুনিবিড় গ্রামবাংলার সুপরিচিত চিত্রটিতেও আজ সংঘাতের প্রকাশ লক্ষণীয়।
নতুন জমি-সৃষ্টি যখন দুরূহ, জমি-সঞ্চয় তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদেরা জমি-সঞ্চয়ের হিসাবে নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। কৃষিক্ষেত্রে জমিতে সর্বোচ্চ উৎপাদন জমি-সঞ্চয়ের মূল লক্ষ্য, অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে ন্যূনতম সময়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদন। এখানে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে জমির অবকাঠামো (সেচব্যবস্থা ও পানিনিষ্কাশন), জমির ভৌত-রাসায়নিক ভারসাম্য (পুষ্টিমাত্রা সুরক্ষা ও রাসায়নিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ) এবং উন্নত মানের উৎপাদন-রসদ (উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি) ব্যবহার। সবুজ বিপ্লবের অংশ হিসেবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসব অবকাঠামো উন্নয়নে বিগত কয়েক দশকে আমাদের দেশেও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ বর্তমানে ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার; এবং তা উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। বিরাট জনসংখ্যার আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের ফলে প্রতিবছর প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার আবাদি জমি হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে ২০৫০ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ হয়তো ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটারে নেমে যাবে। অন্যদিকে নতুন জমি-সৃষ্টির সম্ভাবনা আমাদের খুবই কম। দেশের দক্ষিণে উপকূলীয় অঞ্চলে ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার কিছু অংশে জমি-অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আমাদের জন্য এটুকুই জমি-সৃষ্টির সম্ভাব্য সুযোগ, তাই জমি-সঞ্চয়ের বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আমাদের অতিঘন জনবসতি ও নিবিড় বনায়নের প্রেক্ষাপটে অন্য একটি মাত্রা কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। শস্য উৎপাদনে সূর্যালোকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসলের ওপর ছায়ার নেতিবাচক প্রভাব সুবিদিত। কৃষি বনায়নের সম্ভাবনা পরীক্ষা করার জন্য আশি ও নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ধান, গম, ভুট্টা, ডাল ইত্যাদি শস্যখেতে পরীক্ষামূলকভাবে নানা ধরনের গাছ লাগানোর কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের নানা এলাকায়, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হয়েছে অনেক দিন, তবে ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। এসব গবেষণা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট, সেটি হলো শস্যখেতে বৃক্ষরোপণ শস্যের ফলন কমিয়ে দেয় এবং মূলত সেটি হয় বৃক্ষছায়ার কারণে। এর প্রতিকারে যেসব ব্যবস্থার কথা বলা হয়, যেমন—গাছের ডালপালা ও শিকড় কেটে দেওয়া ও কম ঘনত্বে গাছ লাগানো, সেগুলো ছায়ার নেতিবাচক প্রভাব নিরোধে কার্যকর হলেও কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি ।
দেশে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে গ্রামের বাড়িগুলো উঁচু জায়গায় তৈরি করা হয়। চারপাশে ধানখেত, মাঝখানে দাঁড়িয়ে নানা আকারের বাড়ি, নানা ধরনের বৃক্ষরাজিবেষ্টিত। বসতবাড়িসংলগ্ন ফসলের খেতে সূর্যালোক প্রাপ্তি এবং পানি ও পুষ্টি সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। তবে আমাদের বৃক্ষ-কৃষ্টির সঙ্গে সংঘাতময় এ ধরনের একটি নেতিবাচক বিষয় নিয়ে অতীতে আমাদের ভাবনার কারণ ছিল না। বর্তমানে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, আজ জমি আমাদের উৎপাদনের দুর্লভতম উৎস। অর্থনীতিবিদেরা জমির এই অনন্য অবস্থানের প্রতি সজাগ ও জমি-সঞ্চয়ের প্রতি তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০১ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে (পৌরসভার বাইরে) বসতবাড়ির সংখ্যা আড়াই কোটি উল্লেখ করেছে। বর্তমানে বসতবাড়ি সংখ্যায় ও আকারে আরও বেড়েছে। একটি বসতবাড়ির বৃক্ষছায়া দিনের কখন, কত সময় ধরে ও কী পরিমাণ জমিতে ছায়া বিস্তার করে থাকে, সে হিসাব পাওয়া কঠিন। অনেক কৃষকের অভিমত হচ্ছে, দিনের বেশি সময় ধরে ধানখেতের যে অংশ ছায়া আচ্ছাদিত থাকে, সেখানে উৎপাদন ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ কম হয়।
সাধারণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমাদের গ্রামাঞ্চলে শস্য ফলনের ওপর ছায়ার সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবের কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। ধরা যাক, প্রতি বসতবাড়িসংলগ্ন ০.০৫ একর জমি (১৫ বর্গগজ এলাকা) বৃক্ষছায়া প্রভাবিত। বাস্তবে ছায়ার পরিমাণ হয়তো আরও বেশি হবে। তা ছাড়া রয়েছে প্রায় দুই লাখ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ ইত্যাদি আর ব্যাপক রাস্তাঘাট, যার সবই উঁচুমাত্রায় বৃক্ষ আচ্ছাদিত। আড়াই কোটি বাড়ির কারণে বাড়িপ্রতি ০.০৫ একর হিসাবে মোট ১২.৫ লাখ একর বা পাঁচ লাখ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বছরে হেক্টরপ্রতি চাল উৎপাদন চার টন হলে, আর এই পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ৫০ শতাংশ ফলন হ্রাস হলে প্রতিবছর ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হবে। বর্তমানে দেশে বছরে তিন কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়, সেই বিচেনায় এই পরিমাণ শস্যহানি নিতান্ত নগণ্য নয়। দেশে দিন দিন বসতবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, ফসল উৎপাদনে এর প্রকৃত অভিঘাত ও এর সম্ভাব্য প্রতিকার নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা আজ উপেক্ষণীয় নয়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ছায়াজনিত ক্ষতির মাত্রা যদি যথার্থই তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়, তবে এর প্রতিকারের পথ খুঁজতে হবে। সেটি বসতবাড়িসংলগ্ন গাছপালা নিধন করে নয়, বরং এর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। এভাবে যদি জনবসতি ও উৎপাদনের মাঝে সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয়, তবে অমঙ্গল কোথায়? প্রশ্ন জাগে, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের কৃষকের হাতে তার খেতে শস্যের ফলন পরীক্ষামূলক খেতের চেয়ে কেন কম? বলা বাহুল্য, অত্যুচ্চ জনঘনত্বের প্রেক্ষাপটে বৃক্ষছায়া-আচ্ছাদনের জৈবিক ও ভৌত প্রভাব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত আর এ নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনার কথাও শোনা যায় না। আমাদের ভৌগোলিক অঞ্চলটিতে সবুজের আধিক্য বৈশ্বিক সূর্যরশ্মি বিকিরণের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে কি না, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে সূর্যরশ্মি বিকিরণের তথ্য-উপাত্ত আমাদের দেশে বর্তমানে নিতান্তই অপ্রতুল। এই গবেষণার ক্ষেত্রটি সম্ভবত ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। আমরা সবুজ শক্তি ব্যবহার ও সবুজ ভবিষ্যতের কল্পনা করি, এ জন্য আমাদের ভূখণ্ডে বৈশ্বিক সূর্যরশ্মির মাত্রা এবং স্থান-কাল ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ও বিকীর্ণ সূর্যরশ্মির পরিমাণ ও বিস্তৃতি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন।
খাদ্যনিরাপত্তার প্রয়োজনে জমিতে সামান্য পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধিও আমাদের জন্য অবহেলার বিষয় নয়। অত্যুচ্চ জনঘনত্ব ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে কৃষির উৎপাদন ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বৃক্ষছায়া নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিষয়টি আমাদের জীবতাত্ত্বিক বাস্তবতার অনুপূরক ও এর প্রতি বৈজ্ঞানিক মনোযোগ বিলাসিতা নয়। প্রতিকার বৃক্ষায়ন পরিহার নয়, বরং গ্রামের বসতবাড়ি ও স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ—এসব গণপ্রতিষ্ঠান এবং রাস্তার পাশে বৃক্ষায়নের বৈজ্ঞানিক বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে হয়তো এ ক্ষেত্রে ঈপ্সিত সুফল আসতে পারে।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ: অতিথি অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments