ফিলিস্তিন : দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার by ফরিদুল আলম
ফিলিস্তিন ইস্যু ঘুরেফিরে আবার বর্তমান সময়ের বহুল আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিন সরকার তার স্বাধীন অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করবে_প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের এই ঘোষণার পর এবং মার্কিন সরকার তা প্রতিহত করবে_বারাক ওবামার এ জাতীয় হুমকির পর এবারের জাতিসংঘের অধিবেশন বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। ফিলিস্তিন সরকার দুই বছর ধরে এই সময়টির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
২০০৯ সালের আগস্ট মাসে ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী সালাম ফায়েদ ঘোষণা করেন, ২০১১ সালে তারা পশ্চিম তীর ও গাজা এবং পুরো জেরুজালেমের সমন্বয়ে ইসরায়েলি দখলদারমুক্ত একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবেন, যা 'ফায়েদ পরিকল্পনা' নামে খ্যাত। বিশ্বে ফিলিস্তিনই একমাত্র রাষ্ট্র যে ৬০ বছরেরও অধিককাল ধরে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ সাত বিলিয়ন জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানালেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, বরং দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তথা আরব প্রাণ হারিয়েছে এবং লাখ লাখ আরব মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ফিলিস্তিনের আজকের সমস্যার মূল উৎপত্তি ১৯১৭ সালের 'ব্যালফোর ঘোষণা', যার মাধ্যমে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত ফিলিস্তিন অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সে সময় ফিলিস্তিনসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনের জনগণের আত্মপরিচয় উদ্ধারের সংগ্রাম। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসর, জর্দান ও সিরিয়ার যুদ্ধে ইসরায়েল এর আগে নির্ধারিত আরব সীমারেখা অতিক্রম করে এবং পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। ১৯৬৯ সালে ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক আল-আকসা মসজিদে অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় আরব রাষ্ট্রগুলো মুসলমানদের রক্ষা ও তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য অরগানাইজেশন ফর ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ওআইসি ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানসহ ইসরায়েলের সঙ্গে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নানা কর্মকাণ্ড গ্রহণ করলেও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি ইসরায়েলকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের বিনিময়েও বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বারবার। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে মক্কায় অনুষ্ঠিত ওআইসির বিশেষ সভায় সংস্থাটির পরবর্তী ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয় এবং ওই কর্মপরিকল্পনার ১(৯) অনুচ্ছেদে বলা হয়, 'সব সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৪২৫ নম্বর রেজুলেশন অনুযায়ী ইসরায়েল কর্তৃক অধিকৃত ফিলিস্তিন ও লেবানন ভূখণ্ড উদ্ধারকল্পে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যেও তাদের কর্মপ্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।' কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওআইসি আরব তথা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এর মূল কারণ, সংস্থাটির প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্র সৌদি আরবসহ আরো কিছু সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা যুক্তরাষ্ট্র তথা ইসরায়েলের স্বার্থকেই সংহত করেছে, ফলে সংস্থাটির বৃহত্তর ঐক্যে ধরেছে ফাটল।
ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রক্ষায় একটি স্বতন্ত্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। প্রথমত, একদিকে অধিকৃত ভূখণ্ডে পাঁচ লাখেরও বেশি ইসরায়েলি অবৈধভাবে বসবাস করছে; অন্যদিকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তথা আরব মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে শরণার্থী হিসেবে করুণ জীবন যাপন করছে। ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ও ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিলিয়ে ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থীগোষ্ঠী। দ্বিতীয়ত, ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং তদনুযায়ী ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে বিবদমান সীমান্ত সমস্যার সমাধানকল্পে যে ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নামক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ১৯৯৩ সালে 'ডেটন চুক্তি' স্বাক্ষরের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান করে, যা ওই সময়ে একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে পরিগণিত হয়। এ লক্ষ্যে ২০০০ সালে 'ক্যাম্প ডেভিড' চুক্তি ব্যর্থ হলে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার অর্জনে 'ইন্তিফাদা' বা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি যেমন_রেজুলেশন ৩২৩৭ (১৯৭৪) অনুযায়ী জাতিসংঘ নৈতিকভাবে ফিলিস্তিনের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাকে অবজারভার রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে, রেজুলেশন ৪৬৫ (১৯৮০) অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ ১৯৪৯ সালের বেসামরিক নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে। যার অর্থ দাঁড়ায়, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল কর্তৃক ভূমি দখল ছিল অবৈধ আগ্রাসন। চতুর্থত, রেজুলেশন ১৩৯৭ (২০০২) অনুযায়ী জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেয় এবং ফিলিস্তিনের প্রতি ইন্তিফাদার নামে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন পরিহার করার আহ্বান জানায়। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের সশস্ত্র আন্দোলন পরিহার করলেও জাতিসংঘসহ গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেনি। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যুক্তি দেখিয়েছেন যে ২০ বছর ধরে চলমান শান্তি প্রচেষ্টার মাধ্যমে কোনো কিছুই অর্জিত হয়নি এবং পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক শর্ত ছিল যে স্বাধীনতার দাবির অন্তত দুই বছর আগে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য অর্জন করতে হবে, তা তারা ইতিমধ্যে অর্জন করে ফেলেছে। সেই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও গুরুত্ব দেন।
যদিও ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি ইতিপূর্বে ব্যাপক সমর্থন দেখা গেছে, কিন্তু জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য তাদের আবেদনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী রয়েছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। এর মূল কারণ হলো, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে এ ধরনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে নিরাপত্তা পরিষদে তাদের 'ভেটো' ক্ষমতা প্রয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল এমনকি অনেক মুসলিম রাষ্ট্রও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। নিয়ম অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য হতে ইচ্ছুক রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে মহাসচিবের কাছে আবেদন করতে হয়। মহাসচিব আবেদনটি সরাসরি পাঠিয়ে দেন নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে পাঁচ স্থায়ী সদস্যের কেউ যদি এ ব্যাপারে ভেটো প্রয়োগ করে, তবে তা আর সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করার প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে তার বর্তমান 'অবজারভার স্টেট'-এর স্থলে 'নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট'-এর স্বীকৃতি প্রদান করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন পড়বে সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১২৯ ভোট। যা ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে। বর্তমানে একমাত্র ভ্যাটিকানই এ ধরনের স্বীকৃতির অধিকারী।
ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘ লালিত স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আরবদের অনৈক্য যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী তাদের ভেতরকার অনৈক্যও। বর্তমানে ফিলিস্তিনি জনগণ মূলত 'হামাস' ও 'ফাত্তাহ'_এই দুই ভাগে বিভক্ত থাকলেও তাদের আন্দোলনের ধরন কিন্তু এক নয়; বরং বিভিন্ন সময় হামাসের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতে হয়েছে গোটা ফিলিস্তিনি জাতিকে। যদিও সাম্প্র্রতিক মিসর-ইসরায়েল এবং তুরস্ক-ইসরায়েল তিক্ত সম্পর্কের কারণে মিসর এবং তুরস্ক দুটি দেশই তাদের কূটনৈতিক সমর্থনের শতভাগ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সম্প্র্রসারিত করবে, কিন্তু আরব লীগ ও ওআইসির ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। যতক্ষণ না আরব লিগ এবং ওআইসি ম্যান্ডেট অনুযায়ী তাদের ভূমিকা পালন করবে, ততক্ষণ ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ফিলিস্তিনের আজকের সমস্যার মূল উৎপত্তি ১৯১৭ সালের 'ব্যালফোর ঘোষণা', যার মাধ্যমে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত ফিলিস্তিন অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সে সময় ফিলিস্তিনসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনের জনগণের আত্মপরিচয় উদ্ধারের সংগ্রাম। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসর, জর্দান ও সিরিয়ার যুদ্ধে ইসরায়েল এর আগে নির্ধারিত আরব সীমারেখা অতিক্রম করে এবং পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। ১৯৬৯ সালে ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক আল-আকসা মসজিদে অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় আরব রাষ্ট্রগুলো মুসলমানদের রক্ষা ও তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য অরগানাইজেশন ফর ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ওআইসি ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানসহ ইসরায়েলের সঙ্গে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নানা কর্মকাণ্ড গ্রহণ করলেও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি ইসরায়েলকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের বিনিময়েও বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বারবার। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে মক্কায় অনুষ্ঠিত ওআইসির বিশেষ সভায় সংস্থাটির পরবর্তী ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয় এবং ওই কর্মপরিকল্পনার ১(৯) অনুচ্ছেদে বলা হয়, 'সব সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৪২৫ নম্বর রেজুলেশন অনুযায়ী ইসরায়েল কর্তৃক অধিকৃত ফিলিস্তিন ও লেবানন ভূখণ্ড উদ্ধারকল্পে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যেও তাদের কর্মপ্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।' কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওআইসি আরব তথা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এর মূল কারণ, সংস্থাটির প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্র সৌদি আরবসহ আরো কিছু সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা যুক্তরাষ্ট্র তথা ইসরায়েলের স্বার্থকেই সংহত করেছে, ফলে সংস্থাটির বৃহত্তর ঐক্যে ধরেছে ফাটল।
ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রক্ষায় একটি স্বতন্ত্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। প্রথমত, একদিকে অধিকৃত ভূখণ্ডে পাঁচ লাখেরও বেশি ইসরায়েলি অবৈধভাবে বসবাস করছে; অন্যদিকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তথা আরব মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে শরণার্থী হিসেবে করুণ জীবন যাপন করছে। ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ও ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিলিয়ে ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থীগোষ্ঠী। দ্বিতীয়ত, ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং তদনুযায়ী ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে বিবদমান সীমান্ত সমস্যার সমাধানকল্পে যে ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নামক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ১৯৯৩ সালে 'ডেটন চুক্তি' স্বাক্ষরের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান করে, যা ওই সময়ে একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে পরিগণিত হয়। এ লক্ষ্যে ২০০০ সালে 'ক্যাম্প ডেভিড' চুক্তি ব্যর্থ হলে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার অর্জনে 'ইন্তিফাদা' বা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি যেমন_রেজুলেশন ৩২৩৭ (১৯৭৪) অনুযায়ী জাতিসংঘ নৈতিকভাবে ফিলিস্তিনের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাকে অবজারভার রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে, রেজুলেশন ৪৬৫ (১৯৮০) অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ ১৯৪৯ সালের বেসামরিক নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে। যার অর্থ দাঁড়ায়, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল কর্তৃক ভূমি দখল ছিল অবৈধ আগ্রাসন। চতুর্থত, রেজুলেশন ১৩৯৭ (২০০২) অনুযায়ী জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেয় এবং ফিলিস্তিনের প্রতি ইন্তিফাদার নামে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন পরিহার করার আহ্বান জানায়। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের সশস্ত্র আন্দোলন পরিহার করলেও জাতিসংঘসহ গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেনি। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যুক্তি দেখিয়েছেন যে ২০ বছর ধরে চলমান শান্তি প্রচেষ্টার মাধ্যমে কোনো কিছুই অর্জিত হয়নি এবং পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক শর্ত ছিল যে স্বাধীনতার দাবির অন্তত দুই বছর আগে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য অর্জন করতে হবে, তা তারা ইতিমধ্যে অর্জন করে ফেলেছে। সেই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও গুরুত্ব দেন।
যদিও ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি ইতিপূর্বে ব্যাপক সমর্থন দেখা গেছে, কিন্তু জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য তাদের আবেদনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী রয়েছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। এর মূল কারণ হলো, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে এ ধরনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে নিরাপত্তা পরিষদে তাদের 'ভেটো' ক্ষমতা প্রয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল এমনকি অনেক মুসলিম রাষ্ট্রও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। নিয়ম অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য হতে ইচ্ছুক রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে মহাসচিবের কাছে আবেদন করতে হয়। মহাসচিব আবেদনটি সরাসরি পাঠিয়ে দেন নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে পাঁচ স্থায়ী সদস্যের কেউ যদি এ ব্যাপারে ভেটো প্রয়োগ করে, তবে তা আর সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করার প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে তার বর্তমান 'অবজারভার স্টেট'-এর স্থলে 'নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট'-এর স্বীকৃতি প্রদান করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন পড়বে সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১২৯ ভোট। যা ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে। বর্তমানে একমাত্র ভ্যাটিকানই এ ধরনের স্বীকৃতির অধিকারী।
ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘ লালিত স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আরবদের অনৈক্য যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী তাদের ভেতরকার অনৈক্যও। বর্তমানে ফিলিস্তিনি জনগণ মূলত 'হামাস' ও 'ফাত্তাহ'_এই দুই ভাগে বিভক্ত থাকলেও তাদের আন্দোলনের ধরন কিন্তু এক নয়; বরং বিভিন্ন সময় হামাসের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতে হয়েছে গোটা ফিলিস্তিনি জাতিকে। যদিও সাম্প্র্রতিক মিসর-ইসরায়েল এবং তুরস্ক-ইসরায়েল তিক্ত সম্পর্কের কারণে মিসর এবং তুরস্ক দুটি দেশই তাদের কূটনৈতিক সমর্থনের শতভাগ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সম্প্র্রসারিত করবে, কিন্তু আরব লীগ ও ওআইসির ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। যতক্ষণ না আরব লিগ এবং ওআইসি ম্যান্ডেট অনুযায়ী তাদের ভূমিকা পালন করবে, ততক্ষণ ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments