হাতে হাত রেখে! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বড় ভাই অনুগামী হলেন ছোটো ভাইয়ের। একজন আর একজনের সাথী হয়ে চলে গেলেন এমন এক জগতে যেখান থেকে কেউ ফেরেন না। ছিলেন চার ভাই, দুই বোন। একে একে নিভিছে দেউটির মতো চার ভাই আর এক বোন অন্য লোকের বাসিন্দা হয়ে গেলেন।
শিবরাত্রির সলতের মতো জ্বলছেন একমাত্র বোন। প্রার্থনা করি তিনি দীর্ঘায়ু হন, নীরোগ জীবনের অধিকারী হন।
বছর দশেকের ছোট বড় ছিলেন তারা। নাইবউদ্দীন আহমেদ ছিলেন পেশাদার আলোকচিত্রী। বোধকরি বড় ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুকরণ করে ছোট ভাই নওয়াজেশ আহমেদ ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ছোট ভাইয়ের পেশা ছিল অন্য কিছু। বড় ভাইয়ের পেশা সম্পূর্ণই ক্যামেরাভিত্তিক। পেশাজীবী আলোকচিত্রী হিসেবে জীবন শুরু করে চাকরি জীবন শুরু করে ধাপে ধাপে জনসংযোগ বিভাগের উঁচু পদে পদোন্নতিও পেয়েছিলেন তার নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার কারণে।
১৯৬১ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ শাখায় আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন নাইবউদ্দীন আহমেদ। অসম্ভব রকম নরম মনের মানুষ ছিলেন তিনি। কোনোদিন উঁচু কণ্ঠে তাকে কেউ কথা বলতে শুনেছেন বলে মনে হয় না।
চাকরি জীবনে তিন বছর ময়মনসিংহে অবস্থানকালীন প্রায় নিয়মিতই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে। তিনি থাকতেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সুপ্রশস্ত ক্যাম্পাসটি ছিল ছবির মতো সুন্দর। তার প্রতিটি বাড়ির সামনে ছিল বাগান করার মতো জায়গা। অনাবাদি জমির উর্বরতা দেখা যেত ক্যাম্পাসে গেলে। চারদিক সবুজের গালিচায় ঢাকা। চোখ জুড়িয়ে যেত।
ওখানে যারা থাকতেন, তারা হয়তো প্রকৃতির অমোঘ আকর্ষণেই বাগানপ্রেমী হয়ে উঠতেন। সামান্য পরিশ্রমে ফুলে ফলে, শাক-সবজিতে হাসতো বাগান।
নাইবউদ্দীন ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। গ্রামের বাড়ি আর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নলগোলা নদীকে যেন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সবুজে ছাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আর তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে। ক্যাম্পাসের নিরিবিলি পরিবেশে তিনি প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন।
আমরা যারা ঢাকার বাইরে কোথাও চাকরির কারণে যাই, চোখেমুখে অন্ধকার দেখি। হাঁশফাঁশ করি কখন ঢাকায় যেতে পারব তার জন্য। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকামুখী ট্রেনে চেপে বসি। যেন দম নিতে যাচ্ছি।
তখনকার দিনে সুন্দরবন আর দ্রুতযান নামে দুটি মেল ট্রেন ঢাকা থেকে খুলনা ও রংপুরের মধ্যে আসা-যাওয়া করত। মেল ট্রেন, কিন্তু ময়মনসিংহে স্বল্পবিরতির স্টপেজ ছিল ট্রেন দু’টির।
বিকেলে ট্রেন দু’টি ঢাকার দিকে যেত আর সকালে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসত। আমাদের জন্য খুব উপযোগী সময়। অফিস শেষে ট্রেনে চাপতাম আর সকালে ঢাকা থেকে এসে অফিস করা যেত। প্রতি সপ্তাহে এটাই ছিল রুটিন। ট্রেনে তখন প্রথম শ্রেণীর টিকিটের দাম বারো টাকা। আমাদের দু’জনের সংসার। মাসে চারবার আসা-যাওয়ায় কোনো সমস্যা হতো না। চালের মন তখন মাত্র ২০/২২ টাকা। ১৫ সের চালে অনায়াসে আমাদের মাস যায়।
কিন্তু নাইবউদ্দীন আহমেদ ময়মনসিংহেই থেকে যেতেন। ঢাকার আকর্ষণ তাকে তেমন টানতে পারত না। অফিস, বাসা আর অবসর সময়ে বাগানের পরিচর্যা, ফটোগ্রাফি এ নিয়েই ছিল তার জীবন। ভাবীও সুন্দর থিতু হয়েছিলেন ময়মনসিংহের নিস্তরঙ্গ জীবনে।
নাইবউদ্দীন ভাইদের ওদিকে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম। কী যে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতেন আমাদের! ফেরার পথে দিয়ে দিতেন এক গাদা তরিতরকারি, তাদের বাগানের। যতোই বলি না কেন, দু’জন মানুষের সংসার। এত তরিতরকারি খাওয়ার লোক নেই, শুনতেন না।
ছোট ভাইয়ের মতোই তিনিও ছিলেন মিতবাক। মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকত।
তার সহকর্মী ছিলেন নওয়াব নামের তরুণ এক আলোক চিত্রশিল্পী। সহকর্মীকে খুব স্নেহের সঙ্গে কাজ শেখাতেন।
প্রায় সময়ই তাকে পাঠিয়ে দিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দায়িত্ব দিয়ে বলতেন, দায়িত্ব না পেলে কাজ শিখবেন কেমন করে!
চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ঢাকায় পৈতৃক আবাসে উঠেছিলেন গ্রিন রোডে। ভাইবোনদের বাসা লাগোয়া।
সেদিন বোনের বাসায় ছিলেন, সেখান থেকেই হাসপাতালে নেয়া হয় অসুস্থ অবস্থায়। সেই যাওয়াই হলো শেষ যাওয়া।
মানিকগঞ্জের পারিল নওয়াঠা গ্রামে পারিবারিক গোরস্তানে শেষ শয্যা রচিত হয়েছে তার। নভেম্বর মাসে (২৪) সেখানেই শায়িত হয়েছেন ছোটো ভাই নওয়াজেস আহমেদ।
তাদের গ্রামের বাড়িতে প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষে কিংবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যে বার্ষিক অনুষ্ঠান হতো, এবার তা আর হবে না।
কেমন করেই বা হবে! ১৪ ডিসেম্বর গেলেন তিনি। আগের মাসে ছোটো ভাই। অনুষ্ঠানের প্রাণ দুই ভাই ছাড়া এই অনুষ্ঠান যে অকল্পনীয়!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
No comments