ভিনদেশের চিঠি-একজন হূদয়বতী
শেষ রাতে এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙেছে। হাই তুলতে তুলতে টিভিটা ছাড়লাম। ব্রেকিং নিউজে একটি বৃদ্ধাশ্রমে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর। হতাহত অনেক। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, হাসপাতালের দৃশ্য দেখাচ্ছে। হঠাৎ দেখি, সারা শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা এক মহিলা। নাম—ভিকি উইলিয়াম। নিবু নিবু চোখ, অস্পষ্ট স্বরে রন...রন...বলে কাতরাচ্ছে।
তক্ষুনি হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিলাম। গত এপ্রিলে ‘ডিমেনশিয়া’বিষয়ক এক গবেষণাকাজে ওই বৃদ্ধাশ্রমেই গিয়েছিলাম। সেখানেই ভিকির সঙ্গে পরিচয়। বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক অ্যান্ড্রু বলেছিল, ‘ভিকির কিছুই মনে থাকে না।
নিজের নাম, ঠিকানা, বয়স—কিছুই ঠিকমতো বলতে পারে না।’
কত দিন ধরে এই সমস্যায় ভুগছে?
‘বছর দশেক তো হবেই। ২০০১ সালে এক দিন গাড়ি নিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে হারিয়ে গিয়েছিল। তার বাসা, অফিস সিডনিতে অথচ দুই দিন পরে পুলিশ তাকে খুঁজে পেয়েছে মেলবোর্নে। মাঝেমধ্যেই অফিসে না গিয়ে শপিং সেন্টারে চলে যেত। অফিস থেকে ফোন করলে অবাক হয়ে বলত, “আজ তো ছুটির দিন, বিরক্ত করছ কেন?” আবার ছুটির দিনে অফিসে গিয়ে বসে থাকত। অফিসের ফাইলপত্র কোনটা কোথায় রাখত, কিছুই মনে করতে পারত না। একপর্যায়ে চাকরিটাই...ক্রেডিট কার্ডের লিমিট ভুলে গিয়ে ইচ্ছামতো খরচ করত। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ফোনের বিল এমনকি ব্যাংকের কিস্তি দিতেও মনে থাকত না। একপর্যায়ে...যা হয় আরকি—একে একে বাড়িটাও গেল।’
‘আমি কি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?’
একটু পরে ভিকি এল। এসব দেশের বৃদ্ধাদের সাজগোজ যতটা উৎকট হয়, ভিকি সে রকম না। নীল চোখের স্বর্ণকেশী এক ভদ্রমহিলা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছো?’
‘রন আমাকে সিনেমায় নিতে চেয়েছিল...ওরা যেতে দেয়নি।’
‘তাই? রন কি মাঝেমধ্যেই আসে?’
‘মাঝেমধ্যে আসবে কেন? প্রতিদিনই আসে। আমার জন্য গিফট নিয়ে আসে। শুধু আমাকে চিঠি লেখে। কাছেই কোথাও থাকে। দূরে থাকবে কী করে, বলো?’
কথাগুলো বলেই শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অ্যান্ড্রু বলল, ‘কোনো দিন কেউ আসেনি।’ যদিও সে মনে করে, প্রতিদিনই রন আসে। নিজেই লিখে সবাইকে বলে রনের চিঠি। ‘রোনাল্ড হ্যারিস (রন) তার প্রেমিক। ভীষণ ভালোবাসে।’ আমাদের কথার মধ্যেই ভিকি বলল, ‘আমার বালিশটা একটু সরিয়ে দেবে? মাথাটা উঁচু-উঁচু লাগছে।’ ভিকি আমার সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে। বালিশ পেল কোথায়? অ্যান্ড্রুর দিকে তাকালাম। একটু পরেই ভিকি পানি চাইল। পানি না খেয়ে গ্লাস হাতে ‘পানি দাও’, ‘পানি দাও’ করতে লাগল। হাতেই পানির গ্লাস অথচ তার মনে নেই। অ্যান্ড্রু বলল, ‘ভিকি প্রায়ই খেতে চায় না; ঘুমাতে চায় না, গোসল করতে চায় না, ওষুধ খায় না। সারাক্ষণ শুধু রন...রন...করতে থাকে। প্রায়ই বলে, ‘...রন আসবে, আমাকে একটু সাজিয়ে দাও তো।’ একটু পরই আবার বলবে, ‘রন অপেক্ষা করছে...এখনই বেরোতে হবে।’
‘রন কোথায় থাকে? তার সম্পর্কে আর কিছু জানো? ’
কোথায় থাকে জানি না। ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর ভিকি আর সংসার করেনি। সারাটা জীবন একা একা থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালে চলে এসেছি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভিকিসহ অন্যান্য মুমূর্ষু রোগীকে রাখা হয়েছে। ঘটনাস্থলেই মারা গেছে চারজন, হাসপাতালে তিনজন। অনেকেরই আত্মীয়স্বজন এসেছে। ভিকির কেউ আসেনি। তার কাছে গিয়ে বসলাম। একটু পর পর শুধু রন...রন...বলে কাতরাচ্ছে। চোখের পাতা কাঁপছে। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছো, ভিকি?’ কাতর স্বরে সে জিজ্ঞেস করল, ‘রন এসেছ? রন...’
কী উত্তর দেব?
বুঝতে পারলাম না। তার হাতখানি শক্ত করে ধরলাম। মনে হলো, হূদয়টা তো এত দিন পুড়েছেই, এবার দেহটাও পুড়ল। কেন জানি চোখের পানি আর চোখে রাখতে পারলাম না। যে দেশের মানুষ সকালে ভালোবাসি বলে বিকেলে ভুলে যায়, সে দেশে এ রকম হূদয়বতী মানুষও থাকতে পারে? যে জীবনের সবকিছু ভুলে গেছে, শুধু ভালোবাসা ভোলেনি।
শাখাওয়াৎ নয়ন
অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত।
nayonshakhawat@yahoo.com
নিজের নাম, ঠিকানা, বয়স—কিছুই ঠিকমতো বলতে পারে না।’
কত দিন ধরে এই সমস্যায় ভুগছে?
‘বছর দশেক তো হবেই। ২০০১ সালে এক দিন গাড়ি নিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে হারিয়ে গিয়েছিল। তার বাসা, অফিস সিডনিতে অথচ দুই দিন পরে পুলিশ তাকে খুঁজে পেয়েছে মেলবোর্নে। মাঝেমধ্যেই অফিসে না গিয়ে শপিং সেন্টারে চলে যেত। অফিস থেকে ফোন করলে অবাক হয়ে বলত, “আজ তো ছুটির দিন, বিরক্ত করছ কেন?” আবার ছুটির দিনে অফিসে গিয়ে বসে থাকত। অফিসের ফাইলপত্র কোনটা কোথায় রাখত, কিছুই মনে করতে পারত না। একপর্যায়ে চাকরিটাই...ক্রেডিট কার্ডের লিমিট ভুলে গিয়ে ইচ্ছামতো খরচ করত। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ফোনের বিল এমনকি ব্যাংকের কিস্তি দিতেও মনে থাকত না। একপর্যায়ে...যা হয় আরকি—একে একে বাড়িটাও গেল।’
‘আমি কি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?’
একটু পরে ভিকি এল। এসব দেশের বৃদ্ধাদের সাজগোজ যতটা উৎকট হয়, ভিকি সে রকম না। নীল চোখের স্বর্ণকেশী এক ভদ্রমহিলা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছো?’
‘রন আমাকে সিনেমায় নিতে চেয়েছিল...ওরা যেতে দেয়নি।’
‘তাই? রন কি মাঝেমধ্যেই আসে?’
‘মাঝেমধ্যে আসবে কেন? প্রতিদিনই আসে। আমার জন্য গিফট নিয়ে আসে। শুধু আমাকে চিঠি লেখে। কাছেই কোথাও থাকে। দূরে থাকবে কী করে, বলো?’
কথাগুলো বলেই শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অ্যান্ড্রু বলল, ‘কোনো দিন কেউ আসেনি।’ যদিও সে মনে করে, প্রতিদিনই রন আসে। নিজেই লিখে সবাইকে বলে রনের চিঠি। ‘রোনাল্ড হ্যারিস (রন) তার প্রেমিক। ভীষণ ভালোবাসে।’ আমাদের কথার মধ্যেই ভিকি বলল, ‘আমার বালিশটা একটু সরিয়ে দেবে? মাথাটা উঁচু-উঁচু লাগছে।’ ভিকি আমার সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে। বালিশ পেল কোথায়? অ্যান্ড্রুর দিকে তাকালাম। একটু পরেই ভিকি পানি চাইল। পানি না খেয়ে গ্লাস হাতে ‘পানি দাও’, ‘পানি দাও’ করতে লাগল। হাতেই পানির গ্লাস অথচ তার মনে নেই। অ্যান্ড্রু বলল, ‘ভিকি প্রায়ই খেতে চায় না; ঘুমাতে চায় না, গোসল করতে চায় না, ওষুধ খায় না। সারাক্ষণ শুধু রন...রন...করতে থাকে। প্রায়ই বলে, ‘...রন আসবে, আমাকে একটু সাজিয়ে দাও তো।’ একটু পরই আবার বলবে, ‘রন অপেক্ষা করছে...এখনই বেরোতে হবে।’
‘রন কোথায় থাকে? তার সম্পর্কে আর কিছু জানো? ’
কোথায় থাকে জানি না। ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর ভিকি আর সংসার করেনি। সারাটা জীবন একা একা থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালে চলে এসেছি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভিকিসহ অন্যান্য মুমূর্ষু রোগীকে রাখা হয়েছে। ঘটনাস্থলেই মারা গেছে চারজন, হাসপাতালে তিনজন। অনেকেরই আত্মীয়স্বজন এসেছে। ভিকির কেউ আসেনি। তার কাছে গিয়ে বসলাম। একটু পর পর শুধু রন...রন...বলে কাতরাচ্ছে। চোখের পাতা কাঁপছে। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছো, ভিকি?’ কাতর স্বরে সে জিজ্ঞেস করল, ‘রন এসেছ? রন...’
কী উত্তর দেব?
বুঝতে পারলাম না। তার হাতখানি শক্ত করে ধরলাম। মনে হলো, হূদয়টা তো এত দিন পুড়েছেই, এবার দেহটাও পুড়ল। কেন জানি চোখের পানি আর চোখে রাখতে পারলাম না। যে দেশের মানুষ সকালে ভালোবাসি বলে বিকেলে ভুলে যায়, সে দেশে এ রকম হূদয়বতী মানুষও থাকতে পারে? যে জীবনের সবকিছু ভুলে গেছে, শুধু ভালোবাসা ভোলেনি।
শাখাওয়াৎ নয়ন
অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত।
nayonshakhawat@yahoo.com
No comments