সদরে অন্দরে-শিক্ষা যেন পণ্য বলে গণ্য না হয় by মোস্তফা হোসেইন
সবাই চায় তার সন্তানটি দেশের সেরা স্কুলগুলোর একটিতে ভর্তির সুযোগ পাক। উদ্দেশ্য সেখানে ভর্তি হতে পারলে শিক্ষাসুবিধা নিশ্চিত হবে। আখেরে ভালো ফল করাও সম্ভব হবে। শুধু ফলই নয়, কোনো কোনো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে পারলে অভিভাবক নিশ্চিন্ত হন, অন্তত তাঁর সন্তানটি খারাপ পরিবেশে মেশার তেমন সুযোগ পাচ্ছে না। সংগত এ আকাঙ্ক্ষাকেই কাজে লাগাচ্ছে বড় শহরগুলোর কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
তারা ভর্তির সময় বিশাল অঙ্কের টাকা আদায় করে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। আদায়ের সূত্র হিসেবে কখনো বলা হয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কখনো বলা হয় শিক্ষাব্যয় ইত্যাদির কথা। অভিভাবকমহলে এ নিয়ে ক্ষোভ আছে অনেক দিন ধরে। কেউ কিছুই বলতে পারছেন না। যিনি সন্তান ভর্তি করানোর জন্য এনেছেন, তাঁকে তো মুখে তালা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। এটা সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে। আর যাঁর সন্তানের পক্ষে ভর্তি হওয়া সম্ভব হলো না, তাঁর আসলে কিছু বলার ক্ষমতাই থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আবার যাঁর সন্তান ভর্তি করানোর সুযোগ পাননি, তিনি জানেন এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেও কোনো লাভ হবে না। তাঁর সন্তানকে সেখানে ভর্তি করাতে হলে প্রয়োজন হবে নির্ধারিত টাকা। ফলে দেশের ভালো স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে বিত্ত একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিত্তবানরা টাকা দিয়ে ভর্তি করাতে গিয়ে অনেকেই আবার এটাকে স্বাভাবিক ভাবছেন। শুধু তা-ই নয়, নিজের সন্তানকে সেখানে ভর্তি করাতে পারছেন_এটা ভেবেই অধিক তৃপ্তি পান তিনি। বিত্তবানদের কেউ কেউ মনে করেন, তিনি নামিদামি স্কুলটিতে টাকা দিতে পেরে নিজেই ধন্য হয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে জনদাবি বলে এককভাবে কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। সেখানে পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য স্পষ্টই থেকে যায়। বড় স্কুলগুলো কোন কারণে অধিক হারে টাকা নিচ্ছে, এ বিষয়টি নিয়ে মৌন থাকাই যেন উচিত। ঢাকার আইডিয়াল স্কুল কিংবা এ রকম আরো কিছু স্কুল ভর্তির সময় অধিক টাকা নিচ্ছে। কেন নিচ্ছে তারা অতিরিক্ত টাকা? এর পেছনে কি আদৌ কোনো যুক্তি নেই? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই কথা হয় আইডিয়াল স্কুলের জ্যেষ্ঠ এক শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি বললেন, আইডিয়াল স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা ৪৬৩। এর মধ্যে ১১১ জন সরকারের কাছ থেকে মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন এমপিওর মাধ্যমে। এই ১১১ জনকে মূল বেতনের বাইরে আরো অর্থ দিতে হয়। বাকি তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষককে সমুদয় বেতনই দিতে হয় স্কুলের তহবিল থেকে। এখন বাড়তি টাকা যদি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া না হয়, তাহলে শিক্ষকের বেতন দেওয়া হবে কোথা থেকে? একই শিক্ষকের কাছ থেকে জানা গেল, স্কুল সৃষ্টির পর থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ৪০ লাখ টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটিকে অবকাঠামোগত ব্যয় বাবদ খরচ করতে হয়েছে ৫০ কোটি টাকার বেশি। আরো টাকা খরচ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বনশ্রী কিংবা মুগদা শাখার কথা বাদ রেখেও যদি শুধু মতিঝিল শাখার কথা ধরা হয়, তাহলেই বোঝা যাবে কত টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হয় এই স্কুল পরিচালনা করতে। মতিঝিল শাখা এখন সাততলা হতে যাচ্ছে।
মুগদা শাখায় এ বছর ৩৯ জন অভিভাবক টাকা দিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই দাতা সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছেন। এটা সরকার অনুমোদিত পথেই পাওয়া গেছে। তাঁরা দুই থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। নিয়মমাফিক দাতা সদস্য হিসেবে তাঁরা স্কুল ব্যবস্থাপনার কাজেও যুক্ত হয়ে থাকেন।
অর্থ ফেরত দিতে হলে : সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কি স্কুলগুলো টাকা ফেরত দিতে পারবে? যদি টাকা ফেরত দেয়, তাহলে তাদের অবস্থা কী হবে? এবারও ঢাকার আইডিয়াল স্কুলের প্রসঙ্গই আনা যায়। ১৭ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীর বসার জন্য যে ভবন দরকার, তা বর্তমান অবকাঠামো সুবিধায় সম্ভব নয়। ভবন কি সরকার তৈরি করে দেবে? শিক্ষার্থীর অতিরিক্ত চাপ সইতে গিয়ে মতিঝিল শাখাকে সাততলা পর্যন্ত বর্ধিত করা হচ্ছে। মুগদায় নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। যেহেতু সরকারি সহযোগিতা নেই, তারপর যদি অনুদানের টাকা ফেরত দিতে হয়, তাহলে সেগুলো কি বন্ধ করে দিতে হবে না? তাহলে আগামী মার্চ থেকে নতুন ক্লাসকক্ষে যাওয়ার জন্য যেসব ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করছে, তারা যাবে কোথায়?
অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়ে ব্যতিক্রমী কৌশল : ভর্তির সময় অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য স্বচ্ছ থাকছে, অর্থাৎ অনুদানের টাকা যথাযথ রসিদের বিনিময়ে আদায় করছে। কোনো প্রতিষ্ঠান আবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। তারা টাকা আদায় করলেও রসিদ দিতে চায় না। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান আছে, যারা ভর্তির সময় আংশিক টাকা নিয়ে বাকি টাকা কিস্তিতে আদায় করে নিচ্ছে। এমন সংবাদ জানা গেছে খিলগাঁও এলাকার দুটি প্রাইভেট স্কুলের বিষয়ে। মাথাপিছু ২০ থেকে ২৩ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করলেও এককালীন নিচ্ছে মাত্র চার-পাঁচ হাজার টাকা। বাকি টাকা পরে মাসিক ভিত্তিতে আদায় করার পরিকল্পনা করে রেখেছে। এতে ভর্তিকালীন যে চাপ, তা তাদের সহ্য করতে হচ্ছে না। জানুয়ারি মাসের পর ভর্তির বিষয়টি মানুষ ভুলে যেতে থাকে আর তারাও সেই ভুলে যাওয়াকেই কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নেওয়ার কাজ সেরে নেয়।
শিক্ষার মান ও কোচিং : কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ এটি। কিন্তু শিক্ষার পরিবেশগত কারণে কোচিং আর প্রাইভেট টিউশনি যেভাবে আমাদের এখানে শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে নিয়েছে, তাকে কি আদৌ বন্ধ করা সম্ভব? আর যদি আইন করে বন্ধ করে দেওয়াও হয়, তাহলেও কি শিক্ষাব্যবস্থায় তা আদৌ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে?
এই কোচিং এবং প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কোচিংকে দুইভাবে প্রকাশ করা যায়। একটি হচ্ছে যৌথভাবে শিক্ষায়তনেই কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষকের মাধ্যমে সেটা পরিচালিত হতে পারে। আবার ভাড়া করা বাড়িতে শিক্ষক কিংবা অপেশাদার শিক্ষক দিয়ে পরিচালনা করা। যদি দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে শিক্ষায়তনে বিষয়ভিত্তিক আলাদা ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়, তাও কোচিং, যেমন_আমাদের দেশে এসএসসি কিংবা জেএসসি পরীক্ষার আগে স্কুলগুলো করে থাকে।
সরকারও চায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করে দিতে। কিন্তু স্কুলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের কোচিং চালু রাখতে হবে। আবার প্রাইভেট পড়ানোর যে সনাতনি পদ্ধতি আছে, তাকেও বাদ দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সরকার অনধিক ১০ জন ছাত্র পড়ানোর যে নিয়ম করতে যাচ্ছে, তাকেও ভালো না বলার উপায় নেই।
কোচিং না করিয়ে কি শিক্ষার্থীদের ভালো ফল পাওয়া সম্ভব নয়? ঢাকার নামিদামি এক স্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, শিক্ষাদান পদ্ধতিতে যত দিন আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব না হবে, তত দিন তা সম্ভব হবে না। অন্তত ডাক্তারদের যেমন প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করা সম্ভব হয় না, তেমনি শিক্ষকের ক্ষেত্রেও তা সম্ভব নয়। কারণ শিক্ষার্থীকে প্রায় সর্বোতভাবে শিক্ষকের ওপর নির্ভর করতে হয়।
একটি সেকশনে শিক্ষার্থী থাকার কথা ৬০ জন। কিন্তু এই সংখ্যা ঠিক রাখতে পারে খুব কমসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই। ধরা যাক, ৬০ জন শিক্ষার্থী নিয়েই ক্লাস চালানো হলো। একজন শিক্ষকের পক্ষে কি এই ৬০ জনকে মাত্র ৩৫ মিনিটের একটি পিরিয়ডে কোনো বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব? অথচ আমেরিকা, কানাডা কিংবা জাপানের মতো দেশে প্রতি ১২ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন। ফলে আমাদের এখানকার পদ্ধতির কারণেই শিক্ষার্থী দুর্বল হয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, একটি স্কুল প্রকৃত অর্থে বছরে ১০০ দিনের বেশি ক্লাস করতে পারে না। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীকে দুর্বলই থেকে যেতে হয়। এই দুর্বলতা কাটাতে কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন তার অভিভাবক।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক ফলপ্রাপ্তির পরও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার মান কিভাবে আরো বাড়ানো যায় তা খতিয়ে দেখতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুলেই লেখাপড়া শেষ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। ধাপে ধাপে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি সেকশনে ৬০ জনের পরিবর্তে ৩০ জন শিক্ষার্থীর পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
mhussain_71@yahoo.com
No comments