সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন-জয় হয়েছে জনতার, গণতন্ত্রের by শরিফুল হাসান
নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর চাষাঢ়ায় শামীম ওসমানের পৈতৃক বাড়ি। এখান থেকেই তিনি তাঁর সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চাষাঢ়ার সবগুলো কেন্দ্রেই বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন শামীম ওসমান। এমনকি নিজের ভোটকেন্দ্রেও।
শুধু বাড়ির আশপাশে নয়, নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়টি ওয়ার্ডের ৫৯টি কেন্দ্রের সবকটিতেই শামীম ধরাশায়ী হয়েছেন। ভরাডুবি ঘটেছে তাঁর ভাই সাংসদ নাসিম ওসমানের নির্বাচনী এলাকা বন্দরেও। সেখানকার ৪১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪০টিতেই শামীম হেরেছেন। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জের সাংসদ থাকলেও সেখানে আইভীর চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন।
শুধু ভোটের ব্যবধানই বিশাল নয়, নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে শামীম ওসমানের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। জয় হয়েছে জনতার; গণতন্ত্রের।
শামীম ওসমান এমন পরাজয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, যদিও নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা তাঁদের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলেন।
মনে আছে, ২৫ সেপ্টেম্বর যখন ঢাকা থেকে বাসে করে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছিলাম, আবু তাহের নামে একজন ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। এখন চাই কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটি হলে ৩০ অক্টোবর নীরব ভোট বিপ্লব হয়ে যাবে।’
শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ একজন নির্বাচনের দুই দিন আগেও গর্ব করে বলেছিলেন, তিনিই জয়ী হতে যাচ্ছেন। জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছিল প্রেসক্লাবের সামনে। তাঁদের দাবি, শামীম ওসমান হারতেই পারেন না। ক্ষমতার মোহে এঁরা মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারেননি।
আমি পুরো ৩৭ দিনই খুব কাছ থেকে শামীম ওসমানকে দেখেছি। এক দিনের জন্যও তাঁকে নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হয়নি। সবচেয়ে অবাক হতাম, গণমাধ্যমকে সামলানোর অসাধারণ গুণ তাঁর। প্রথম আলোয় আমি তাঁকে নিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন করছি জানার পরও কখনো তিনি ক্ষুব্ধ হননি। তবে তাঁর হিসাব এলোমেলো হয়ে যায় নির্বাচনের দিন। তখন তাঁকে খুব অস্থির ও উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, ভোটের ফল কী হতে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সেটি নিয়ে সন্দেহ নেই। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান নারায়ণগঞ্জের মানুষের। নির্বাচনের আগে ভোটারদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের সামনেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ছিলেন। তাঁরা ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের ঝামেলায় না গিয়ে চুপচাপ কেন্দ্রে গিয়ে রায় দিয়ে এসেছেন।
ভোটের দিন দুপুরের পর শহরজুড়ে একধরনের স্বস্তি চোখে পড়েছে। সাধারণ মানুষ বেশ উৎফুল্ল ছিল। মানুষ যেন তাঁদের ভোটটা ঠিকমতো দিয়ে আসতে পেরে খুশি। বেলা দুইটার পর শহরে মোটামুটি রব উঠে যায় ‘আইভী’। শামীম ওসমান তখন সাংবাদিকদের গালিগালাজ করছিলেন।
নারায়ণগঞ্জে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সেখানকার রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নির্বাচন কমিশনের তরুণ কর্মকর্তারা। পুলিশ প্রশাসন ও র্যাবও নির্বাচনের দিন নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
তবে শামীম ওসমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বিশ্বাস করতে পারছেন না, লাখো ভোটের ব্যবধানে আইভী জিতবেন। সাংগঠনিক শক্তি থাকলেও একপর্যায়ে নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে শামীম ওসমানের। দেশে ফেরার পর তাঁর আশপাশে নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ছিল।
শামীম ওসমানের পরাজয়ের পেছনে আছেন আরও তিন ওসমান ও তাঁদের কর্মকাণ্ড। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ওসমান পরিবার। বড় ভাই নাসিম ওসমান সাংসদ। তফসিল ঘোষণার পরপরই তিনি বলেছিলেন, ‘শক্তির দিক থেকে নারায়ণগঞ্জে আমরা একচ্ছত্র। আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তি নেই।’ তাঁর এই হুমকির জবাব মানুষ ভোটের মাধ্যমে দিয়েছেন। আরেক ভাই সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, বিকেএমইএ, নারায়ণগঞ্জ চেম্বারসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। ভাতিজা আজমেরী ওসমানকে মানুষ ভয়ের চোখে দেখে।
ওসমান পরিবারকে নগর ভবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়া হবে না—এই ছিল নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রত্যয়।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের শুরু থেকে নাটকীয়তা ছিল। আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া নিয়েও জটিলতা ছিল। আর শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনী না দেওয়াকে মোটেও ভালোভাবে নেয়নি নারায়ণগঞ্জবাসী।
শামীম ওসমান যেমন তাঁর নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে ভোট কম পেয়েছেন, তেমনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর ইতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে সাধারণ মানুষের মনের কোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন আইভী। ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর টানা আট বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কোনো বাহিনী নেই। অনেক উন্নয়নকাজ করেছেন।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান ভোটের রাজনীতিতে আইভীকে এগিয়ে রাখে। তাঁর জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান। আট বছর মেয়র থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই।
আইভীর দৃঢ়তাও ভোটারদের মুগ্ধ করে। দলের সমর্থন পেয়েছেন শামীম ওসমান। প্রতিদিনই ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। আইভীর পক্ষে কোনো কেন্দ্রীয় না থাকলেও জনতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছেন। যেখানেই গেছেন তিনি, পেছনে ছিল জনস্রোত। নির্বাচনের আগমুহূর্তে সেনা মোতায়েন করা হবে না—এমন খবরের পর শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আইভী নগরবাসীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘লক্ষ জনতাই হবে তাঁর সেনাবাহিনী।’
আইভীর ঘনিষ্ঠজনেরা ভোটের হিসাব-নিকাশ করে ভেবেছিলেন, ৬০ থেকে ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে আইভী জয়ী হবেন। তবে নির্বাচনের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে তৈমুর আলম খন্দকার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় অতিরিক্ত ভোট যোগ হয়। তৈমুরের সিদ্ধান্তও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে (ইভিএম) মানুষ স্বাগতই জানিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার ছিলেন চার লাখ চার হাজার ১৮৯ জন। এর অর্ধেকই নারী ভোটার। নারী ভোটকেন্দ্রগুলোতে একচেটিয়া ভোট পেয়েছেন আইভী। তরুণ ভোটারদেরও পছন্দের ছিলেন আইভী। ভোটের আগে বয়স্করা নির্বাচনের আলাপ নিয়ে সংযত থাকলেও তরুণেরা স্পষ্টতই বলেছেন, তাঁরা সন্ত্রাস চান না।
বাংলাদেশের রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের নিয়ে হতাশার কথা শোনা যায় প্রায়ই। প্রশ্ন আছে এ দেশের ভোটারদের পছন্দ নিয়েও। তবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন এই হতাশায় আশার আলো জাগিয়েছে। পেশিশক্তি, অর্থ, ক্ষমতা, গলাবাজি—এই সবকিছুই যে জনতার রায়ে তুচ্ছ, সেটি প্রমাণিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনে। কোথাও কোনো সহিংসতা হয়নি। নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন পরাজিত প্রার্থী। সবাইকে নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নতুন মেয়র।
এমন আরও অনেক ইতিবাচক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে নারায়ণগঞ্জে। তবে নারায়ণগঞ্জই যেন শেষ না হয়, বরং এই উদাহরণই ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। প্রতিটি জেলায় আইভীর মতো নেতৃত্ব গড়ে উঠুক। স্বাধীনতার ৪০ বছরে এসে এ স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।
শরিফুল হাসান: সিনিয়র রিপোর্টার, প্রথম আলো।
hasan06du@yahoo.com
শুধু ভোটের ব্যবধানই বিশাল নয়, নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে শামীম ওসমানের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। জয় হয়েছে জনতার; গণতন্ত্রের।
শামীম ওসমান এমন পরাজয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, যদিও নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা তাঁদের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলেন।
মনে আছে, ২৫ সেপ্টেম্বর যখন ঢাকা থেকে বাসে করে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছিলাম, আবু তাহের নামে একজন ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। এখন চাই কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটি হলে ৩০ অক্টোবর নীরব ভোট বিপ্লব হয়ে যাবে।’
শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ একজন নির্বাচনের দুই দিন আগেও গর্ব করে বলেছিলেন, তিনিই জয়ী হতে যাচ্ছেন। জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছিল প্রেসক্লাবের সামনে। তাঁদের দাবি, শামীম ওসমান হারতেই পারেন না। ক্ষমতার মোহে এঁরা মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারেননি।
আমি পুরো ৩৭ দিনই খুব কাছ থেকে শামীম ওসমানকে দেখেছি। এক দিনের জন্যও তাঁকে নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হয়নি। সবচেয়ে অবাক হতাম, গণমাধ্যমকে সামলানোর অসাধারণ গুণ তাঁর। প্রথম আলোয় আমি তাঁকে নিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন করছি জানার পরও কখনো তিনি ক্ষুব্ধ হননি। তবে তাঁর হিসাব এলোমেলো হয়ে যায় নির্বাচনের দিন। তখন তাঁকে খুব অস্থির ও উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, ভোটের ফল কী হতে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সেটি নিয়ে সন্দেহ নেই। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান নারায়ণগঞ্জের মানুষের। নির্বাচনের আগে ভোটারদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের সামনেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ছিলেন। তাঁরা ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের ঝামেলায় না গিয়ে চুপচাপ কেন্দ্রে গিয়ে রায় দিয়ে এসেছেন।
ভোটের দিন দুপুরের পর শহরজুড়ে একধরনের স্বস্তি চোখে পড়েছে। সাধারণ মানুষ বেশ উৎফুল্ল ছিল। মানুষ যেন তাঁদের ভোটটা ঠিকমতো দিয়ে আসতে পেরে খুশি। বেলা দুইটার পর শহরে মোটামুটি রব উঠে যায় ‘আইভী’। শামীম ওসমান তখন সাংবাদিকদের গালিগালাজ করছিলেন।
নারায়ণগঞ্জে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সেখানকার রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নির্বাচন কমিশনের তরুণ কর্মকর্তারা। পুলিশ প্রশাসন ও র্যাবও নির্বাচনের দিন নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
তবে শামীম ওসমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বিশ্বাস করতে পারছেন না, লাখো ভোটের ব্যবধানে আইভী জিতবেন। সাংগঠনিক শক্তি থাকলেও একপর্যায়ে নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে শামীম ওসমানের। দেশে ফেরার পর তাঁর আশপাশে নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ছিল।
শামীম ওসমানের পরাজয়ের পেছনে আছেন আরও তিন ওসমান ও তাঁদের কর্মকাণ্ড। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ওসমান পরিবার। বড় ভাই নাসিম ওসমান সাংসদ। তফসিল ঘোষণার পরপরই তিনি বলেছিলেন, ‘শক্তির দিক থেকে নারায়ণগঞ্জে আমরা একচ্ছত্র। আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তি নেই।’ তাঁর এই হুমকির জবাব মানুষ ভোটের মাধ্যমে দিয়েছেন। আরেক ভাই সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, বিকেএমইএ, নারায়ণগঞ্জ চেম্বারসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। ভাতিজা আজমেরী ওসমানকে মানুষ ভয়ের চোখে দেখে।
ওসমান পরিবারকে নগর ভবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়া হবে না—এই ছিল নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রত্যয়।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের শুরু থেকে নাটকীয়তা ছিল। আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া নিয়েও জটিলতা ছিল। আর শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনী না দেওয়াকে মোটেও ভালোভাবে নেয়নি নারায়ণগঞ্জবাসী।
শামীম ওসমান যেমন তাঁর নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে ভোট কম পেয়েছেন, তেমনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর ইতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে সাধারণ মানুষের মনের কোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন আইভী। ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর টানা আট বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কোনো বাহিনী নেই। অনেক উন্নয়নকাজ করেছেন।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান ভোটের রাজনীতিতে আইভীকে এগিয়ে রাখে। তাঁর জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান। আট বছর মেয়র থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই।
আইভীর দৃঢ়তাও ভোটারদের মুগ্ধ করে। দলের সমর্থন পেয়েছেন শামীম ওসমান। প্রতিদিনই ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। আইভীর পক্ষে কোনো কেন্দ্রীয় না থাকলেও জনতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছেন। যেখানেই গেছেন তিনি, পেছনে ছিল জনস্রোত। নির্বাচনের আগমুহূর্তে সেনা মোতায়েন করা হবে না—এমন খবরের পর শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আইভী নগরবাসীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘লক্ষ জনতাই হবে তাঁর সেনাবাহিনী।’
আইভীর ঘনিষ্ঠজনেরা ভোটের হিসাব-নিকাশ করে ভেবেছিলেন, ৬০ থেকে ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে আইভী জয়ী হবেন। তবে নির্বাচনের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে তৈমুর আলম খন্দকার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় অতিরিক্ত ভোট যোগ হয়। তৈমুরের সিদ্ধান্তও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে (ইভিএম) মানুষ স্বাগতই জানিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার ছিলেন চার লাখ চার হাজার ১৮৯ জন। এর অর্ধেকই নারী ভোটার। নারী ভোটকেন্দ্রগুলোতে একচেটিয়া ভোট পেয়েছেন আইভী। তরুণ ভোটারদেরও পছন্দের ছিলেন আইভী। ভোটের আগে বয়স্করা নির্বাচনের আলাপ নিয়ে সংযত থাকলেও তরুণেরা স্পষ্টতই বলেছেন, তাঁরা সন্ত্রাস চান না।
বাংলাদেশের রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের নিয়ে হতাশার কথা শোনা যায় প্রায়ই। প্রশ্ন আছে এ দেশের ভোটারদের পছন্দ নিয়েও। তবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন এই হতাশায় আশার আলো জাগিয়েছে। পেশিশক্তি, অর্থ, ক্ষমতা, গলাবাজি—এই সবকিছুই যে জনতার রায়ে তুচ্ছ, সেটি প্রমাণিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনে। কোথাও কোনো সহিংসতা হয়নি। নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন পরাজিত প্রার্থী। সবাইকে নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নতুন মেয়র।
এমন আরও অনেক ইতিবাচক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে নারায়ণগঞ্জে। তবে নারায়ণগঞ্জই যেন শেষ না হয়, বরং এই উদাহরণই ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। প্রতিটি জেলায় আইভীর মতো নেতৃত্ব গড়ে উঠুক। স্বাধীনতার ৪০ বছরে এসে এ স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।
শরিফুল হাসান: সিনিয়র রিপোর্টার, প্রথম আলো।
hasan06du@yahoo.com
No comments