খোলা হাওয়া-ঈদের অভিজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ঈদের দিনে পরিচিতরা হাত মেলান, কোলাকুলি করেন; ছোটরা বড়দের সালাম করে। এই একটা দিন মানুষ সব অশান্তি ভুলে আনন্দ করে, যদিও ঈদের আগে পকেট কাটা যায় প্রায় সবারই। রোজার ঈদে এই পকেট কাটাটা এক মাস ধরে, বেশ রয়েসয়ে করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বক্রা-ঈদে তাঁদের হাতে সময় থাকে কম।


ফলে যা করার তা ঈদের আগের দু-তিন দিনেই করতে হয়। কাগজে দেখেছি, এবার গরু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে গরু-সংকট তৈরি করে কুড়ি হাজার টাকার গরু পঞ্চাশ হাজারে চালিয়ে দিয়েছেন। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক সারা রাত দৌড়াদৌড়ি করে গরু কিনতে না পেরে অসুস্থই হয়ে পড়লেন। তার পরও ঈদের দিন তিনি দুঃখ ভুলে আনন্দ করলেন। দাওয়াত করে মানুষ খাওয়ালেন। কিন্তু একসময় কষ্ট নিয়ে আমাকে বললেন, ঈদের দিনটাতেও, ভাই, তাঁরা একে অপরকে আক্রমণ করলেন। তাঁরা কি ঈদের দিনটাতেও ছুটি নেন না?
‘তাঁরা’ মানে আমাদের নেতা-নেত্রীরা। সারা বছর তাঁরা শুধু আক্রমণের ভাষায় কথা বলেন, একে অপরকে কটুকাটব্য শোনান। কথা যদি থান ইট হতো, তাহলে এত দিনে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একজন নেতাও হয়তো অক্ষত থাকতেন না! ভাগ্য ভালো, কথার কোনো বস্তুরূপ নেই। ভদ্রলোকের অভিযোগ শুনে টিভি খুললাম। তাঁর অভিযোগ যে যথার্থ, তারও প্রমাণ পেলাম। শুক্রবার কাগজে পড়লাম, সিলেটে একটি দলের বড় নেতা প্রতিপক্ষ দলের এক বড় নেতার সঙ্গে বুক মেলাতে রাজি হননি।
আমার ধারণা, এই উদাহরণ আগামী ঈদগুলোতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এই সিলেটেরই হাটে-বাজারে যখন মানুষ বাগিবতণ্ডায় লিপ্ত হতো, আমার ছেলেবেলা, শুনতাম কেউ একজন অবধারিতভাবেই বলছে, ‘আত্ থাকতে মুখে কেনে?’ হাতই যদি আছে, তো গলাবাজি করে কী লাভ? পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, দেশের রাজনীতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে কথার বস্তুরূপ গ্রহণ, যথা—থান ইট হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নরসিংদীতে জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমানের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, যুক্তি-তর্কে পারা না গেলে থান ইটও নয়, একেবারে বুলেটে পরিণত করে ফেলে যায় মুখের কথাকে।
এই ঈদে এ ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞা। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, এই ঈদে আমার মনে হয়েছে, নেতা-নেত্রীদের বাগ্যুদ্ধ যেহেতু ঈদ-পার্বণও মানে না, এই যুদ্ধ প্রতিদিনের হবে, আরও তীব্র হবে, এবং বস্তুরূপ ধারণ করবে। ‘হাত থাকতে মুখে কেন’, এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়বে অনেকেই। ইতিমধ্যেই আমরা বিবিধ হুংকার শুনেছি: ঈদের পরই বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়া হবে, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু হবে, ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, ঈদের দিনটাকেও এই উত্তাপ থেকে আর বাঁচানো গেল না।

২.
এই ঈদে আমার দ্বিতীয় অভিজ্ঞা অর্থনীতি নিয়ে। তবে ঠিক ঈদের দিনেই যে এটি তৈরি হয়েছে, তা নয়, হয়েছে ঈদের কিছুদিন আগে থেকে, এবং ঈদের পরের প্রত্যাশিত কিছু ঘটনার সময়কাল নিয়ে। এ বিষয়টাও একটু পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করব। অভিজ্ঞা বলে কথা!
ঈদের আগে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনীতি ও সরকারের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মোটা দাগে প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে, সরকারের এই ব্যবস্থাপনাটা দুর্বল; অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়; কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার বিরাট অঙ্কের টাকা নিচ্ছে এবং শুধু শুধু ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে নানান খাতে। সরকারকে চার দফা পরামর্শও দিয়েছে সিপিডি, যা দেখে আমার হঠাৎ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শের কথা মনে পড়ে গেল। এই মনে পড়ার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার আগে একটা বিষয় আমি কবুল করে নিই: আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, অর্থনীতির তত্ত্ব-তর্ক আমার জ্ঞান-বুদ্ধির বাইরে, এবং বিশ্ব ও দেশীয় অর্থনীতির হালচাল নিয়ে কোনো মন্তব্য করাটাও আমার শোভা পায় না। তবে, অর্থনীতি না বুঝলেও অর্থনীতির ভেতরেই আমি আছি, যেমন—আপনারাও আছেন; অর্থনীতি ভালো হলে সুফলটা বুঝি, খারাপ হলে কুফলটাও হাড়ে হাড়ে টের পাই। আমি প্রতি সপ্তাহে বাজারে যাই; চাল, ডাল, মাছ, সবজি কিনি। রিকশা, সিএনজিতে চড়ি, অর্থনীতির নানা খাতের সঙ্গে, পরোক্ষে হলেও, একটা সম্পর্ক নিয়ে চলি। তাই, যে অর্থনীতি আমার ওপর প্রতিদিন অভিঘাত ফেলে, তা নিয়ে কথা বলাটা খুব যে অনধিকার চর্চা হয়ে যায়, তা স্বীকার করি না। অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বাহাস করার ধৃষ্টতা আমার নেই, কিন্তু তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের অধিকারটা তো নিশ্চয় আছে। এই লেখাটাতে সেই অধিকার প্রয়োগ করে এবার ঈদের দ্বিতীয় অভিজ্ঞার একটা খতিয়ান দেওয়ার চেষ্টা করব।
সিপিডির চার দফা পরামর্শের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শের সাদৃশ্যের কথা বলেছিলাম—এই সাদৃশ্যটা বেশ স্পষ্ট। বিশ্বব্যাংক বলে আসছে, সরকারের উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সিপিডিও বলছে। আমরাও বলছি। কিন্তু আমরা যা বলছি না, অথচ বিশ্বব্যাংক ও সিপিডি বলছে, তা হচ্ছে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি কমানো। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভর্তুকি দেওয়ার বিধান নেই, বিশ্বব্যাংকও এর বিরুদ্ধে। ভালো কথা; কিন্তু মুক্তবাজারের সোনার কেল্লা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকেরা যে বিশাল বিশাল ভর্তুকি পায় সরকার থেকে, তার কী হবে? সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহাগলনের পর যে বড় বড় ব্যাংককে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘বেইল-আউট’ করল, অর্থাৎ ভর্তুকির অক্সিজেন দিয়ে বাঁচাল, তার কী হবে? এই বিরাট বিরাট ঠাকুরেরা চাহিবামাত্র ভর্তুকি পাবে, শুধু ভর্তুকি পাবে না বাংলাদেশের গরিব মানুষ, কৃষক, মেহনতি জন, গরিবি হালে হলেও, গরিব সরকারের গরিব হাত থেকে হলেও? আরেকটি পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি, যা দেখে বিশ্বব্যাংক নিশ্চয় হাততালি দিয়েছে, এবং তা হলো, তেল-গ্যাসের দাম ধাপে ধাপে বাড়ানো। কাগজে যেদিন বেরোল এই পরামর্শগুলো, আমি এক শ ভাগ নিশ্চিতি নিয়ে এক সহকর্মীকে বলেছি, আর কোনো পরামর্শ না মানলেও এ পরামর্শটি অতি অবশ্যই সরকার মানবে। তবে যে দ্রুততায় এটি মেনেছে সরকার, তা আমার মতো সুনিশ্চিত জনকেও লজ্জায় ফেলেছে। তবে, সিপিডির দুটি পরামর্শ আমার কাছে পরস্পরবিরোধী মনে হয়েছে—একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে তেল-গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরামর্শ। তেলের দাম বাড়লে যে ভয়ানক অরাজকতা নামে পরিবহন ভাড়া থেকে নিয়ে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখীকরণে, তাতে আমার মতো একজন অ-অর্থনীতিবিদও হলফ করে বলতে পারি, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে তেলের এই নতুন মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দেবে। তাহলে একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং অন্যদিকে একে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দেওয়ার সুপারিশ কেন? একি এ জন্য যে, আমাদের অর্থনীতিটা রাবড়ি-তৈরির নিয়মে চলে? রাবড়ি-তৈরি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ঘন দুধ জ্বাল দেওয়ার জন্য পাত্রের নিচে থাকে গনগনে আগুন, অথচ ওই দুধ জমানোর জন্য পাত্রের ওপরে চলে সপাট পাখার বাতাস!
ভর্তুকির প্রসঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, সরকার যে তেল কিনছে প্রতি মাসে, তার এক বিরাট অংশ চলে যাচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার কোম্পানিগুলোর কাছে, ভর্তুকি হারে। অর্থাৎ প্রাইভেট পাওয়ার কোম্পানি সরকার থেকে ভর্তুকি হারে তেল কিনছে, যে ভর্তুকি দিচ্ছি আমরা, অর্থাৎ আম-জনতা! পাওয়ার কোম্পানিগুলো কতটা বিদ্যুৎ জোগান দিচ্ছে জাতীয় গ্রিডে, তার হিসাব আমরা জানি না। কিন্তু এই প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে সরকার কেন তেল দেবে; কেন তারা বৈশ্বিক দরে হয় সরকার থেকে নয়তো বাজার থেকে নিজেরা তেল কিনবে না, সে প্রশ্ন কেউ করছে না। কেন করছে না? আমাদের পয়সায় তেল কিনে এ কোম্পানিগুলো কতটা বিদ্যুৎ কত দামে আমাদের দিচ্ছে, সে হিসাবও কেউ নিচ্ছে না। না সরকার নিজে, না বিশ্বব্যাংক, না সিপিডি। আমার মতো সামান্য এক অ-অর্থনীতিবিদ (অনর্থনীতিবিদ না হলেও) এ প্রশ্ন তোলাতে এসব মহলে একটা যে হাস্যরোল উঠতে পারে, তা আন্দাজ করেও বলছি, মান্যবর অর্থনীতিবিদগণ, আমার এ দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশটি, সরকারি সংসদে বিরোধী দলের দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশের মতো, ছুড়ে ফেলে না দিয়ে একটা সন্তোষজনক জবাব দিন। আমাদের অর্থমন্ত্রী আমাদের বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের যা দাম, তা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। অর্থাৎ যেদিন বিশ্ব ও বাংলাতেলের দাম সমান হবে, সেদিন আদর্শ অবস্থার সৃষ্টি হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মহোদয় যদি এ কথাও বলতেন, বিশ্ব-বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমার বাৎসরিক বেতনটা যে ভয়ানক লজ্জাজনকভাবে পিছিয়ে, তা বাংলাতেলের সঙ্গে, একই যাত্রায় বিশ্বমানে পৌঁছে যাবে, তাহলে তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কেন, ৫০ টাকা বাড়ালেও আমার আপত্তি থাকত না; কারণ, সেদিন বাংলা-প্রাইমারি স্কুল, শিক্ষক, বাংলা-পুলিশ কনস্টেবল, বাংলা-কারখানার শ্রমিক ও বাংলা কৃষকের আয় হতো তাদের বিশ্বের সহকর্মীদের সমান।
সুতরাং, ঈদে আমার দ্বিতীয় অভিজ্ঞাটি হলো এই: পাগলকে পুল না নাড়ানোর সুপারিশ দেওয়াটা যেমন আত্মঘাতী, সরকারকেও কোনো জিনিসের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করাটাও সমান আত্মঘাতী। এই অভিজ্ঞার বর্ধিত অংশ হলো এই: গরিব প্রতিবেশীকে উপদেশ দেওয়াটা যতটা আয়েশের, তাঁকে প্রকৃত সাহায্য করাটা সে রকমই পরিশ্রমসাধ্য। এবং, ভবিষ্যতে এ রকম উপদেশ যত বাড়বে (অবশ্যই বাড়বে), সাহায্যও তত কমবে (অবশ্যই কমবে)।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.