যুক্তি তর্ক গল্প-এই বারতা গুরুত্ব পাবে তো? by আবুল মোমেন
দিনবদলের স্লোগান দিয়েই ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করা হবে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করে—এমন রূপকল্প ও স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। এই স্বপ্ন তরুণ ভোটারদের মহাজোটের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। তা ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি-দুঃশাসনের স্মৃতি তখনো সাধারণ ভোটাররা ভুলতে পারেনি।
তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাদের প্রতি। ফলে দিনবদলের স্লোগানে ও মধ্য আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়ে এবং বিএনপি-জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করে প্রদত্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকার ভোট পেয়ে মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে।
শেখ হাসিনা পুরোনোদের বাদ দিয়ে নতুন মুখের চমক দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে পরিবর্তনের বারতাটি জোরালো করেছিলেন। তিন বছর পর দেখা যাচ্ছে, সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অদক্ষতার পুরোনো বৃত্তে ফিরে যাচ্ছে। আমি এখনই বলব না এ সরকার, অর্থাৎ আমাদের আরও একটি সরকার, ব্যর্থ হতে চলেছে। এর কারণ আমি এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর লিখেছি।
আমার বিবেচনায় বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানোর দুটি বড় সুযোগ পেয়েছিল ১৯৭১-এর বিজয়ের পর এবং ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের পর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কাজে লাগাতে পারেনি। দুবারই সুযোগ তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টির ফলে। এবার একাত্তর বা নব্বইয়ের মতো গণঐক্য তৈরি না হলেও মানুষের মধ্যে প্রত্যাশার ঐক্য ছিল। প্রতিবারই ব্যর্থতার মূল কারণ আমাদের নেতৃত্ব সময়ের চাহিদা অনুযায়ী রাজনীতিকে ঢেলে সাজাতে পারেনি। এটা ঠিক, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলন তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে যে ঐক্যের সূচনা করেছিল, তারই ফল সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা মানুষকে বাস্তবেই ঐক্যবদ্ধ করে ফেলেছিল। সেই স্বপ্ন আর সেই ঐক্যেরই ফসল হলো একাত্তরের বিজয়। কোন্দলপ্রবণ, ঘরকুনো এক জাতির ত্যাগে ও বীরত্বে জেগে ওঠার এবং বদলে যাওয়ার অবিস্মরণীয় ঘটনা একাত্তর।
বিজয়ের পর সাধারণ মানুষ স্বাধীন দেশটি গড়ার কাজে প্রাণ-মন ঢেলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। অর্থাৎ সবাই মিলে আরও সংগ্রাম, আরও ত্যাগের পথে এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তারা টগবগ করছিল সেদিন। কিন্তু সশস্ত্র যুদ্ধ দেশে যে বিপ্লবী বাস্তবতা তৈরি করেছিল, আর তার ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী যে রাজনীতির চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী বুঝতে পারেননি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বুঝতে পারেননি স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। একদিকে তিনি সত্তরের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান প্রণয়ন ও দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দুর্লভ কিন্তু ঐতিহাসিক ঐক্যের পথ ছেড়ে রাজনৈতিক বিভাজনের পথ প্রশস্ত করলেন, অন্যদিকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতার রূপকারের দাবি নিয়ে যেন দেশের ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠায় লেগে গেলেন। খুব দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধকালীন উন্নত আদর্শিক চেতনার—যার মূল শক্তি ছিল ঐক্য ও ত্যাগের চেতনা—অবসান হয়ে সমাজে হীন, ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির মনোভাব মাথাচাড়া দিয়েছিল। এভাবে সমাজে ঐক্যের ও মহৎ লক্ষ্যাদর্শের বাতাবরণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর প্রমাণ, আওয়ামী লীগ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিল, দেশ ও দলের ভেতরে-বাইরে নানা রকম ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু নানাভাবে হতাশা ব্যক্ত করছিলেন। আর এই ভ্রান্তির একেবারে পাথুরে প্রমাণ হলো, প্রথাগত গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ গড়া ও এগিয়ে যাওয়ার সব পথ ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সরকার গঠনের পথে আসতে হয়েছিল বাকশাল গঠন করে। কিন্তু তত দিনে ঐক্য ও ত্যাগের চেতনা অবশিষ্ট ছিল না। অবিশ্বাস ও বিভাজনে সমাজ তখন দূষিত, অকার্যকর। ভ্রান্তির দ্বিতীয় জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো—স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে খোন্দকার মোশতাককে কাছে টেনেছিলেন। বিনষ্ট সময়ে বড় মানুষেরাও এমন ভুল করেন।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের সময়ও আরেকবার জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য ও দেশগড়ার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল। এবার মানুষ স্বৈরাচার, ছদ্মবেশী স্বৈরাচার, সীমিত গণতন্ত্র পেরিয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিল। এরশাদের পতনের পর নতুন প্রজন্মসহ আন্দোলনকারী মানুষের মধ্যে একাত্তরের বিজয়-পরবর্তী আনন্দের উল্লাস দেখা গিয়েছিল। রাজপথে উল্লসিত মানুষের ঢল নেমেছিল। সচেতন মানুষ তিন জোটের রূপরেখার মধ্যে আশার আলো দেখেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপি, দেখা গেল, সময়ের চাহিদা ভুলে গিয়ে জিয়া ও এরশাদের প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক পথই অনুসরণ করতে লাগল। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য তাদের যত প্রয়াস, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে মত-পথের মুক্ত পরিবেশ তৈরি, জনগণের ক্ষমতায়নের পথ সুগম করা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকার জোরদার করা ইত্যাদি জরুরি কোনো পদক্ষেপই তারা নিল না। জিয়া-এরশাদের ছদ্মবেশী স্বৈরশাসনই ফিরে এসেছিল যেন।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগও ক্ষমতার সবটা নিজেদের ভোগে লাগিয়ে ক্ষমতার জোরে শাসন চালাতে গিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশে প্রায় কোনো কাজই করতে পারল না। এভাবে নব্বই-পরবর্তী দেড় যুগে নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদল হলেও দুই বড় দলের মধ্যেকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বটাই ছিল তাতে মুখ্য। দেশ ও মানুষের অগ্রগতি নয়, এই দ্বন্দ্ব কতটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক তা বোঝা যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের অবস্থান বদলের মধ্যে। একদিন যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে জানবাজি আন্দোলন করেছিল আজ তারা সেটি তুলে দেওয়ার পক্ষে অনড় অবস্থানে, আর একদিন যারা বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাগলের প্রলাপ, তারা এখন এ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে অনড়। ক্ষমতার রাজনীতির চোটে মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতেও দুই দলের মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায়। বিএনপির আপ্রাণ চেষ্টা ছিল জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে দাঁড় করানোর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বৃত্তে আটকে গিয়ে সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে তারা মনে করছে বঙ্গবন্ধুকে একচ্ছত্রভাব প্রতিষ্ঠা করা আর জিয়াউর রহমানের নাম সব জায়গা থেকে মুছে দেওয়া। অথচ ইতিহাসচর্চা সঠিকভাবে হলে দেখা যেত বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাসের মহানায়ক সেখানে জিয়া বস্তুত একজন পার্শ্বচরিত্র এবং পরে এক খলনায়ক।
দুই দলের এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই। তা সত্ত্বেও ২০০৮ সালে মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে তিনটি কারণে। এক, দেশে এমনই রাজনৈতিক শূন্যতা-স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে যে বড় দুই দল ভিন্ন তার সামনে পছন্দ করার মতো কোনো বিকল্প নেই; দুই, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এমন দুঃশাসন ও দুর্নীতি চালিয়েছে যে তাদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়ন হয়ে পড়ে আশু কাজ এবং বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর তো কেউ নেই; তিন, প্রথমে যে স্লোগান ও লক্ষ্যের কথা তুলেছি তাতে নতুন প্রজন্মসহ মানুষের মনে সত্যিই আশা ও আস্থা জেগেছিল।
এই সময়ে মানুষ আবারও সময়োপযোগী রাজনীতির চাহিদা জানান দিয়েছিল। তারা রাজনীতি ও সরকারে পুরোনো ধারার দুর্নীতি, মাস্তানির এবং তামাদি চিন্তার মুখ দেখতে চায়নি। তারা চেয়েছে সৎ, দক্ষ, পরিশ্রমী তরুণ-প্রবীণের সমন্বয়, তার জন্য দলীয় রাজনীতির মার্কামারা মুখ না হয়ে তরুণ মুখ কিংবা সমাজের আস্থাভাজন মুখ হলে তারা খুশি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষ আস্থা রেখেছিল। মন্ত্রিসভা গঠন করে তিনি আশাও জাগিয়েছিলেন মানুষের মনে। কিন্তু দিনে দিনে সরকারের সব ক্ষমতা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ন্যূনতম টিমওয়ার্কের সুযোগও নষ্ট হয়েছে। অদক্ষতা, স্থবিরতা একদিকে আর অন্যদিকে অস্থিরতার মুখে পড়ে মানুষ সত্যিই হতাশ হয়ে পড়ছে।
এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। আমার মতো দেশের অনেক মানুষ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পার্থক্য আছে বলে মনে করে, তাদের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মনে করে না। কারণ আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আর বিএনপি পাকিস্তানি ধারার মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে। তাতে দুই দলের শাসনামলে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বিরাট পার্থক্য ঘটে যায়। আমাদের ক্ষোভ ও দুঃখ এখানেই যে শুধু জনগণের চাহিদা বুঝে সময়োপযোগী রাজনীতি করতে পারলে যে দল দেশের সত্যিকারের উপকার করতে পারে তারা কেন প্রতিপক্ষের মতোই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার রাজনীতি করে দুর্নীতি ও ব্যর্থতার পথ ধরবে।
শেষ কথা বলি, শেখ হাসিনার জন্য নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন হলো ওয়েক-আপ কল বা জেগে ওঠার ডাক। না, মানুষ আর শামীম ওসমানদের রাজনীতিতে নিতে চাইছে না, তারা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির পক্ষে। আমি জানি, পঁচাত্তর-পরবর্তী দুই দশকের দুঃসময়ে এ ধরনের রাজনীতিবিদদের উত্থান হয়েছে, সেই অস্তিত্ব রক্ষার দিনে দলের জন্য তাদের অবদানও কম নয়। কিন্তু কেউ যদি সময়ের বারতা বুঝে নিজেকে বদলাতে না পারে তাহলে নেতৃত্বকে তাদের পথের মধ্যে ছেড়ে আসতে হবে, ব্যক্তিগত দায় বা আবেগের দাবি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পূরণ করা যায় না। তা ছাড়া নেতার কাছে ব্যক্তিগত, দলীয় আবেগের দায়ের চেয়ে ইতিহাস ও জাতির চাহিদা পূরণ অবশ্যই অগ্রাধিকার পেতে হবে।
আশা করব, নারায়ণগঞ্জবাসী আজকের রাজনীতির অঙ্গনে যে বারতা পাঠিয়েছেন, তা শেখ হাসিনা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। তাঁর এ সরকার ব্যর্থ হলে পরিণতি কারও জন্যই ভালো হবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
শেখ হাসিনা পুরোনোদের বাদ দিয়ে নতুন মুখের চমক দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে পরিবর্তনের বারতাটি জোরালো করেছিলেন। তিন বছর পর দেখা যাচ্ছে, সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অদক্ষতার পুরোনো বৃত্তে ফিরে যাচ্ছে। আমি এখনই বলব না এ সরকার, অর্থাৎ আমাদের আরও একটি সরকার, ব্যর্থ হতে চলেছে। এর কারণ আমি এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর লিখেছি।
আমার বিবেচনায় বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানোর দুটি বড় সুযোগ পেয়েছিল ১৯৭১-এর বিজয়ের পর এবং ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের পর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কাজে লাগাতে পারেনি। দুবারই সুযোগ তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টির ফলে। এবার একাত্তর বা নব্বইয়ের মতো গণঐক্য তৈরি না হলেও মানুষের মধ্যে প্রত্যাশার ঐক্য ছিল। প্রতিবারই ব্যর্থতার মূল কারণ আমাদের নেতৃত্ব সময়ের চাহিদা অনুযায়ী রাজনীতিকে ঢেলে সাজাতে পারেনি। এটা ঠিক, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলন তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে যে ঐক্যের সূচনা করেছিল, তারই ফল সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা মানুষকে বাস্তবেই ঐক্যবদ্ধ করে ফেলেছিল। সেই স্বপ্ন আর সেই ঐক্যেরই ফসল হলো একাত্তরের বিজয়। কোন্দলপ্রবণ, ঘরকুনো এক জাতির ত্যাগে ও বীরত্বে জেগে ওঠার এবং বদলে যাওয়ার অবিস্মরণীয় ঘটনা একাত্তর।
বিজয়ের পর সাধারণ মানুষ স্বাধীন দেশটি গড়ার কাজে প্রাণ-মন ঢেলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। অর্থাৎ সবাই মিলে আরও সংগ্রাম, আরও ত্যাগের পথে এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তারা টগবগ করছিল সেদিন। কিন্তু সশস্ত্র যুদ্ধ দেশে যে বিপ্লবী বাস্তবতা তৈরি করেছিল, আর তার ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী যে রাজনীতির চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী বুঝতে পারেননি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বুঝতে পারেননি স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। একদিকে তিনি সত্তরের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান প্রণয়ন ও দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দুর্লভ কিন্তু ঐতিহাসিক ঐক্যের পথ ছেড়ে রাজনৈতিক বিভাজনের পথ প্রশস্ত করলেন, অন্যদিকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতার রূপকারের দাবি নিয়ে যেন দেশের ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠায় লেগে গেলেন। খুব দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধকালীন উন্নত আদর্শিক চেতনার—যার মূল শক্তি ছিল ঐক্য ও ত্যাগের চেতনা—অবসান হয়ে সমাজে হীন, ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির মনোভাব মাথাচাড়া দিয়েছিল। এভাবে সমাজে ঐক্যের ও মহৎ লক্ষ্যাদর্শের বাতাবরণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর প্রমাণ, আওয়ামী লীগ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিল, দেশ ও দলের ভেতরে-বাইরে নানা রকম ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু নানাভাবে হতাশা ব্যক্ত করছিলেন। আর এই ভ্রান্তির একেবারে পাথুরে প্রমাণ হলো, প্রথাগত গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ গড়া ও এগিয়ে যাওয়ার সব পথ ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সরকার গঠনের পথে আসতে হয়েছিল বাকশাল গঠন করে। কিন্তু তত দিনে ঐক্য ও ত্যাগের চেতনা অবশিষ্ট ছিল না। অবিশ্বাস ও বিভাজনে সমাজ তখন দূষিত, অকার্যকর। ভ্রান্তির দ্বিতীয় জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো—স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে খোন্দকার মোশতাককে কাছে টেনেছিলেন। বিনষ্ট সময়ে বড় মানুষেরাও এমন ভুল করেন।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের সময়ও আরেকবার জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য ও দেশগড়ার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল। এবার মানুষ স্বৈরাচার, ছদ্মবেশী স্বৈরাচার, সীমিত গণতন্ত্র পেরিয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিল। এরশাদের পতনের পর নতুন প্রজন্মসহ আন্দোলনকারী মানুষের মধ্যে একাত্তরের বিজয়-পরবর্তী আনন্দের উল্লাস দেখা গিয়েছিল। রাজপথে উল্লসিত মানুষের ঢল নেমেছিল। সচেতন মানুষ তিন জোটের রূপরেখার মধ্যে আশার আলো দেখেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপি, দেখা গেল, সময়ের চাহিদা ভুলে গিয়ে জিয়া ও এরশাদের প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক পথই অনুসরণ করতে লাগল। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য তাদের যত প্রয়াস, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে মত-পথের মুক্ত পরিবেশ তৈরি, জনগণের ক্ষমতায়নের পথ সুগম করা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকার জোরদার করা ইত্যাদি জরুরি কোনো পদক্ষেপই তারা নিল না। জিয়া-এরশাদের ছদ্মবেশী স্বৈরশাসনই ফিরে এসেছিল যেন।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগও ক্ষমতার সবটা নিজেদের ভোগে লাগিয়ে ক্ষমতার জোরে শাসন চালাতে গিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশে প্রায় কোনো কাজই করতে পারল না। এভাবে নব্বই-পরবর্তী দেড় যুগে নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদল হলেও দুই বড় দলের মধ্যেকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বটাই ছিল তাতে মুখ্য। দেশ ও মানুষের অগ্রগতি নয়, এই দ্বন্দ্ব কতটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক তা বোঝা যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের অবস্থান বদলের মধ্যে। একদিন যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে জানবাজি আন্দোলন করেছিল আজ তারা সেটি তুলে দেওয়ার পক্ষে অনড় অবস্থানে, আর একদিন যারা বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাগলের প্রলাপ, তারা এখন এ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে অনড়। ক্ষমতার রাজনীতির চোটে মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতেও দুই দলের মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায়। বিএনপির আপ্রাণ চেষ্টা ছিল জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে দাঁড় করানোর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বৃত্তে আটকে গিয়ে সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে তারা মনে করছে বঙ্গবন্ধুকে একচ্ছত্রভাব প্রতিষ্ঠা করা আর জিয়াউর রহমানের নাম সব জায়গা থেকে মুছে দেওয়া। অথচ ইতিহাসচর্চা সঠিকভাবে হলে দেখা যেত বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাসের মহানায়ক সেখানে জিয়া বস্তুত একজন পার্শ্বচরিত্র এবং পরে এক খলনায়ক।
দুই দলের এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই। তা সত্ত্বেও ২০০৮ সালে মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে তিনটি কারণে। এক, দেশে এমনই রাজনৈতিক শূন্যতা-স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে যে বড় দুই দল ভিন্ন তার সামনে পছন্দ করার মতো কোনো বিকল্প নেই; দুই, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এমন দুঃশাসন ও দুর্নীতি চালিয়েছে যে তাদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়ন হয়ে পড়ে আশু কাজ এবং বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর তো কেউ নেই; তিন, প্রথমে যে স্লোগান ও লক্ষ্যের কথা তুলেছি তাতে নতুন প্রজন্মসহ মানুষের মনে সত্যিই আশা ও আস্থা জেগেছিল।
এই সময়ে মানুষ আবারও সময়োপযোগী রাজনীতির চাহিদা জানান দিয়েছিল। তারা রাজনীতি ও সরকারে পুরোনো ধারার দুর্নীতি, মাস্তানির এবং তামাদি চিন্তার মুখ দেখতে চায়নি। তারা চেয়েছে সৎ, দক্ষ, পরিশ্রমী তরুণ-প্রবীণের সমন্বয়, তার জন্য দলীয় রাজনীতির মার্কামারা মুখ না হয়ে তরুণ মুখ কিংবা সমাজের আস্থাভাজন মুখ হলে তারা খুশি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষ আস্থা রেখেছিল। মন্ত্রিসভা গঠন করে তিনি আশাও জাগিয়েছিলেন মানুষের মনে। কিন্তু দিনে দিনে সরকারের সব ক্ষমতা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ন্যূনতম টিমওয়ার্কের সুযোগও নষ্ট হয়েছে। অদক্ষতা, স্থবিরতা একদিকে আর অন্যদিকে অস্থিরতার মুখে পড়ে মানুষ সত্যিই হতাশ হয়ে পড়ছে।
এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। আমার মতো দেশের অনেক মানুষ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পার্থক্য আছে বলে মনে করে, তাদের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মনে করে না। কারণ আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আর বিএনপি পাকিস্তানি ধারার মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে। তাতে দুই দলের শাসনামলে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বিরাট পার্থক্য ঘটে যায়। আমাদের ক্ষোভ ও দুঃখ এখানেই যে শুধু জনগণের চাহিদা বুঝে সময়োপযোগী রাজনীতি করতে পারলে যে দল দেশের সত্যিকারের উপকার করতে পারে তারা কেন প্রতিপক্ষের মতোই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার রাজনীতি করে দুর্নীতি ও ব্যর্থতার পথ ধরবে।
শেষ কথা বলি, শেখ হাসিনার জন্য নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন হলো ওয়েক-আপ কল বা জেগে ওঠার ডাক। না, মানুষ আর শামীম ওসমানদের রাজনীতিতে নিতে চাইছে না, তারা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির পক্ষে। আমি জানি, পঁচাত্তর-পরবর্তী দুই দশকের দুঃসময়ে এ ধরনের রাজনীতিবিদদের উত্থান হয়েছে, সেই অস্তিত্ব রক্ষার দিনে দলের জন্য তাদের অবদানও কম নয়। কিন্তু কেউ যদি সময়ের বারতা বুঝে নিজেকে বদলাতে না পারে তাহলে নেতৃত্বকে তাদের পথের মধ্যে ছেড়ে আসতে হবে, ব্যক্তিগত দায় বা আবেগের দাবি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পূরণ করা যায় না। তা ছাড়া নেতার কাছে ব্যক্তিগত, দলীয় আবেগের দায়ের চেয়ে ইতিহাস ও জাতির চাহিদা পূরণ অবশ্যই অগ্রাধিকার পেতে হবে।
আশা করব, নারায়ণগঞ্জবাসী আজকের রাজনীতির অঙ্গনে যে বারতা পাঠিয়েছেন, তা শেখ হাসিনা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। তাঁর এ সরকার ব্যর্থ হলে পরিণতি কারও জন্যই ভালো হবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments