স্বমহিমায় ভাস্বর শহীদ ময়েজউদ্দিন by মো. মুজিবুর রহমান
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার শহীদ ময়েজউদ্দিনের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এ রকম এক অবস্থায় ১৯৮৪ সালের এই দিনে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল।
কালীগঞ্জে হরতাল সফল করার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক ময়েজউদ্দিন আন্দোলনরত অবস্থায় ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক সাহসী ব্যক্তিত্ব শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন ১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. ছুরত আলী। মা মহরবানু। মা-বাবার চার ছেলের মধ্যে মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নোয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
শহীদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা। সব পরিচয়ে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো ভাস্বর। তিনি তাঁর গ্রামবাসীসহ আশপাশ এলাকার অধিবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষার লক্ষ্যে দাতব্য চিকিৎসালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাতৃসদনকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করেন। তিনি রোগীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ড শুধু তাঁর নিজ এলাকায় বিস্তৃত ছিল না। আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির অবৈতনিক মহাসচিব ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান। এ দুটি সংস্থায় নিজেকে জড়িত করে দেশব্যাপী সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তিনি নিজের অবদান উজ্জ্বলতর করেন। নব নব চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে এ দুটি সংস্থার আওতা ও পরিধি বিস্তৃত করেছেন এবং দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একজন দীপ্তিমান আইনজীবী হিসেবে প্রচুর টাকা আয় করেছেন। আবার আর্তের সেবায় তিনি দান করেছেন অকৃপণ হস্তে। তাঁর কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফিরে যায়নি। তাঁর নিজ এলাকার নোয়াপাড়া ময়েজউদ্দিন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের আমৃত্যু প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আইন পেশা ও রাজনীতি_দুটিতেই সমান পারদর্শী, কৃতিত্ব ও একনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল পথিকৃতের। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কিছু করা কোনো দিন তাঁর অন্তরে স্থান পায়নি। তারপর তাঁর মানবিক গুণ ছিল অপরিসীম। জীবনের সব সঞ্চয় ও আহরণ তিনি অকাতরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বিলি করেছেন।
১৯৬৮ সাল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের মাধ্যমে চক্রান্ত শুরু করে। সে সময় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা ও সংগঠক কারাগারে। তখন আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন দেশব্যাপী সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রচারে নেতৃত্বের ছাপ রাখেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জননেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। 'মুজিব তহবিলে'র জন্য দেশব্যাপী কুপন বিক্রি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী ময়েজউদ্দিন বেগম মুজিবের সঙ্গে মামলা ও আন্দোলনের বিষয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। পাশাপাশি আইয়ুববিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের যথেষ্ট সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেন। তখন তিনি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের অত্যন্ত সক্রিয় একজন নেতা ছিলেন। অন্যদিকে শিক্ষাজীবন শেষে শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন আইন পেশায় যোগদান ও ঢাকার কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তিনি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে সংগ্রাম-আন্দোলনসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি তাঁর নিজ এলাকা কালীগঞ্জ থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। জননেতা ময়েজউদ্দিন বন্ধুপ্রীতি ও অনুগত জনের প্রতি গভীর ভালোবাসা, দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম আর সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি আদর্শের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন।
বাঙালির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ সহযোগী ও কর্মী ছিলেন শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি আওয়ামী লীগের অনেক লিফলেট, সাংগঠনিক পেপার, অনেক বক্তব্যের খসড়া তৈরি করে দিতেন। লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন ও আইনজীবী থাকার কারণে দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের ড্রাফট তৈরি করেছেন। শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে আসেন।
একাত্তরের সেই উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তাজউদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধানে আস্থাবান রাজনৈতিক সহকর্মী মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, তা নিজ চোখে ঢাকায় অবলোকন করেন। এ অবস্থায় তিনি ও তাঁর পরিবার ঢাকা ত্যাগ করে নিজ গ্রাম বড়হরায় চলে আসেন। মার্চ মাসের একেবারের শেষদিকে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার অভিপ্রায়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার উদ্দেশে রওনা হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে তিনি সার্থক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অন্যদের মতো মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন শরণার্থী শিবির ও হাপানিয়া ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ভারতের বিভিন্ন স্তরে রাজনীতিক ও সমাজসেবীদের সঙ্গে বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি ও খাদ্য, বস্ত্র, অস্ত্র, ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সংগ্রহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিপরীতে নানা চক্রান্ত চলে। সেসব চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য বিদেশের মাটিতে শহীদ ময়েজউদ্দিন সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের আরো কয়েকজন সংগঠকসহ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন ঢাকায় আসেন ১৮ ডিসেম্বর এবং ওই একই দিন বিকেলে ঢাকার জোনাকি সিনেমা হলে নাগরিক সভা আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ওই সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের ঢাকায় পেঁৗছতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে বিধায় আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার একটি সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর লক্ষ্যে নাগরিক সভার আয়োজন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর আহ্বানে সোনার বাংলা গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি ছিলেন। কালীগঞ্জের সব স্তরের মানুষের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাই তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তির ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে তেমন কষ্ট হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর একান্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিত্ব ময়েজউদ্দিন আরো কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। তিনি অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে লিফলেট সাইক্লোস্টাইল করে শত শত কপি করার ব্যবস্থা নেন।
দূরদর্শী রাজনীতিক, প্রথিতযশা আইনজীবী, সমাজদরদি নেতা এবং গরিবের বন্ধু শহীদ ময়েজউদ্দিনের স্মৃতি মানুষের অন্তর্লোকে চিরকাল ভাস্বর হয়ে বিরাজ করবে। প্রতিটি সমাজকর্মী ও রাজনৈতিককর্মী যেন তাঁর আদর্শ ধারণ করেন_সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ, গাজীপুর।
শহীদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা। সব পরিচয়ে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো ভাস্বর। তিনি তাঁর গ্রামবাসীসহ আশপাশ এলাকার অধিবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষার লক্ষ্যে দাতব্য চিকিৎসালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাতৃসদনকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করেন। তিনি রোগীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ড শুধু তাঁর নিজ এলাকায় বিস্তৃত ছিল না। আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির অবৈতনিক মহাসচিব ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান। এ দুটি সংস্থায় নিজেকে জড়িত করে দেশব্যাপী সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তিনি নিজের অবদান উজ্জ্বলতর করেন। নব নব চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে এ দুটি সংস্থার আওতা ও পরিধি বিস্তৃত করেছেন এবং দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একজন দীপ্তিমান আইনজীবী হিসেবে প্রচুর টাকা আয় করেছেন। আবার আর্তের সেবায় তিনি দান করেছেন অকৃপণ হস্তে। তাঁর কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফিরে যায়নি। তাঁর নিজ এলাকার নোয়াপাড়া ময়েজউদ্দিন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের আমৃত্যু প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আইন পেশা ও রাজনীতি_দুটিতেই সমান পারদর্শী, কৃতিত্ব ও একনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল পথিকৃতের। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কিছু করা কোনো দিন তাঁর অন্তরে স্থান পায়নি। তারপর তাঁর মানবিক গুণ ছিল অপরিসীম। জীবনের সব সঞ্চয় ও আহরণ তিনি অকাতরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বিলি করেছেন।
১৯৬৮ সাল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের মাধ্যমে চক্রান্ত শুরু করে। সে সময় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা ও সংগঠক কারাগারে। তখন আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন দেশব্যাপী সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রচারে নেতৃত্বের ছাপ রাখেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জননেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। 'মুজিব তহবিলে'র জন্য দেশব্যাপী কুপন বিক্রি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী ময়েজউদ্দিন বেগম মুজিবের সঙ্গে মামলা ও আন্দোলনের বিষয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। পাশাপাশি আইয়ুববিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের যথেষ্ট সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেন। তখন তিনি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের অত্যন্ত সক্রিয় একজন নেতা ছিলেন। অন্যদিকে শিক্ষাজীবন শেষে শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন আইন পেশায় যোগদান ও ঢাকার কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তিনি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে সংগ্রাম-আন্দোলনসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি তাঁর নিজ এলাকা কালীগঞ্জ থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। জননেতা ময়েজউদ্দিন বন্ধুপ্রীতি ও অনুগত জনের প্রতি গভীর ভালোবাসা, দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম আর সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি আদর্শের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন।
বাঙালির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ সহযোগী ও কর্মী ছিলেন শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি আওয়ামী লীগের অনেক লিফলেট, সাংগঠনিক পেপার, অনেক বক্তব্যের খসড়া তৈরি করে দিতেন। লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন ও আইনজীবী থাকার কারণে দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের ড্রাফট তৈরি করেছেন। শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে আসেন।
একাত্তরের সেই উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তাজউদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধানে আস্থাবান রাজনৈতিক সহকর্মী মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, তা নিজ চোখে ঢাকায় অবলোকন করেন। এ অবস্থায় তিনি ও তাঁর পরিবার ঢাকা ত্যাগ করে নিজ গ্রাম বড়হরায় চলে আসেন। মার্চ মাসের একেবারের শেষদিকে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার অভিপ্রায়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার উদ্দেশে রওনা হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে তিনি সার্থক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অন্যদের মতো মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন শরণার্থী শিবির ও হাপানিয়া ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ভারতের বিভিন্ন স্তরে রাজনীতিক ও সমাজসেবীদের সঙ্গে বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি ও খাদ্য, বস্ত্র, অস্ত্র, ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সংগ্রহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিপরীতে নানা চক্রান্ত চলে। সেসব চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য বিদেশের মাটিতে শহীদ ময়েজউদ্দিন সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের আরো কয়েকজন সংগঠকসহ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন ঢাকায় আসেন ১৮ ডিসেম্বর এবং ওই একই দিন বিকেলে ঢাকার জোনাকি সিনেমা হলে নাগরিক সভা আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ওই সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের ঢাকায় পেঁৗছতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে বিধায় আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার একটি সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর লক্ষ্যে নাগরিক সভার আয়োজন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর আহ্বানে সোনার বাংলা গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি ছিলেন। কালীগঞ্জের সব স্তরের মানুষের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাই তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তির ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে তেমন কষ্ট হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর একান্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিত্ব ময়েজউদ্দিন আরো কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। তিনি অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে লিফলেট সাইক্লোস্টাইল করে শত শত কপি করার ব্যবস্থা নেন।
দূরদর্শী রাজনীতিক, প্রথিতযশা আইনজীবী, সমাজদরদি নেতা এবং গরিবের বন্ধু শহীদ ময়েজউদ্দিনের স্মৃতি মানুষের অন্তর্লোকে চিরকাল ভাস্বর হয়ে বিরাজ করবে। প্রতিটি সমাজকর্মী ও রাজনৈতিককর্মী যেন তাঁর আদর্শ ধারণ করেন_সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ, গাজীপুর।
No comments