বরফ আদৌ গলবে কি? by তারেক শামসুর রেহমান
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কর্তৃক কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা
প্রত্যাহারের ঘোষণা এবং দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ
বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
করেছে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর এই বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা
বলবৎ রেখেছে। এর ফলে কিউবা প্রায় ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন
হয়েছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং স্নায়ুযুদ্ধের
অবসান ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা
প্রত্যাহার করে নেয়নি। এখন ওবামার এ ঘোষণা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
প্রথমত, ওবামার এই সিদ্ধান্ত কি আদৌ কার্যকর হবে? দ্বিতীয়ত, এতে করে
যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্কের আদৌ উন্নতি হবে কি? তৃতীয়ত, সম্পর্কোন্নয়নের
উদ্যোগ কি কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় আদৌ কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র আবারও হাভানায় সরকারের উৎখাতের উদ্যোগ নেবে- এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়া ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে এসেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি একরকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কারণ কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস এবং নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কি-না? একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনের’ মুখ থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি-না, এ প্রশ্নও ছিল। আরও একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল- তা হচ্ছে, কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কারণ চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এ দুটি দেশ এখন আর ধ্র“পদি মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ছিল, কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কি-না?
কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং বিপ্লবের পর (১৯৫৯) কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছেছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি তার ‘প্রভাবাধীন এলাকায়’ অন্য কোনো শক্তি প্রভাব খাটাক। মনরো ডকট্রিনের আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসাব-নিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিউবার বিপ্লবের মাত্র দু’বছরের মাঝে ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা
চালায়। সিআইএ’র অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অফ পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলাই বাহুল্য, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। এর পরের বছরই ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবার মিসাইল সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ
করেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা লড়াই করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কোন্নয়নের ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বললেও এর বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে না। কারণ ওবামাকে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কংগ্রেসে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে রিপাবলিকানরা। তারা ওবামার ঘোষণায় খুশি নন। আমি একাধিক কংগ্রেস সদস্য তথা সিনেটরের বক্তব্য দেখেছি, যেখানে তারা ওবামার এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। সিনেটর জন ম্যাককেইন ও সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সংকুচিত করবে। অন্যদিকে সিনেটর রয় ব্লান্ট মনে করেন, এই ঘোষণার বাস্তবায়ন ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে। ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর রবার্ট মেনডেজ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিউবার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ও স্বৈরশাসনকে স্বীকার করে নেয়া। সিনেটর মেনডেজ নিজে কিউবান আমেরিকান। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো আইনকে কংগ্রেস অনুমোদন দেবে না। ফলে ওবামার ঘোষণা শেষ পর্যন্ত ‘একটি ঘোষণা’ হিসেবেই থেকে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়ন, আরও বেশি অর্থনৈতিক উদারিকরণ চান। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও উন্নতি চান। একই সঙ্গে চান রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সবকিছু ‘উন্মুক্ত’ করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গরবাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে; কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচি ‘পেরেস্ত্রয়কা’র বাস্তবায়ন হয়েছে; কিন্তু ‘গ্লাসনস্ত’ কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবায় কোনোটাই আসেনি। চীন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম যায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা, তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে রাজনীতি অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দু’দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনও কিউবার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা ‘একা’ চলতে পারবে না। দেশটিকে ‘দুয়ার’ উন্মুক্ত করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮০ ভাগ এখনও সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পর্যটন খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরও উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেইন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে ‘ডলার বাণিজ্য’ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান আমেরিকানদের পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবায় আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল অত্যন্ত কম দামে ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছে। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো তা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে। কারণ ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ! অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক একদিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মেনডেজ ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গত এপ্রিল থেকেই সেখানে অসন্তোষ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশ কয়েকজন ভেনিজুয়েলান ভিআইপির ওপর। সম্পদ আটক থেকে শুরু করে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ভেনিজুয়েলার মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এটা সত্য, হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়; কিন্তু তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোতে। মেক্সিকোর ৪৩ জন স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। এখন খুব সঙ্গত কারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিন ‘চাপ’ যদি বাড়ে, তাহলে কিউবাকে দেয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে।
কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। এক্ষেত্রে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগৎ বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। এখন পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গেছেন। কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত উপকৃত হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি ‘বড় উদ্যোগ’। কিন্তু এই উদ্যোগের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ কনজারভেটিভদের একটা বড় অংশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। এটা সত্য, দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈরিতার অবসান হওয়া প্রয়োজন। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এখন আর নেই। ছোট রাষ্ট্র কিউবাকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিউবাকে সঙ্গে নিয়েই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, কিউবা এ বিশ্বকে অনেক কিছু দিতে পারে। তাই বিকাশমান নয়া বিশ্বব্যবস্থার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্কোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র আবারও হাভানায় সরকারের উৎখাতের উদ্যোগ নেবে- এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়া ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে এসেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি একরকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কারণ কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস এবং নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কি-না? একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনের’ মুখ থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি-না, এ প্রশ্নও ছিল। আরও একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল- তা হচ্ছে, কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কারণ চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এ দুটি দেশ এখন আর ধ্র“পদি মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ছিল, কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কি-না?
কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং বিপ্লবের পর (১৯৫৯) কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছেছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি তার ‘প্রভাবাধীন এলাকায়’ অন্য কোনো শক্তি প্রভাব খাটাক। মনরো ডকট্রিনের আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসাব-নিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিউবার বিপ্লবের মাত্র দু’বছরের মাঝে ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা
চালায়। সিআইএ’র অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অফ পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলাই বাহুল্য, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। এর পরের বছরই ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবার মিসাইল সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ
করেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা লড়াই করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কোন্নয়নের ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বললেও এর বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে না। কারণ ওবামাকে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কংগ্রেসে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে রিপাবলিকানরা। তারা ওবামার ঘোষণায় খুশি নন। আমি একাধিক কংগ্রেস সদস্য তথা সিনেটরের বক্তব্য দেখেছি, যেখানে তারা ওবামার এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। সিনেটর জন ম্যাককেইন ও সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সংকুচিত করবে। অন্যদিকে সিনেটর রয় ব্লান্ট মনে করেন, এই ঘোষণার বাস্তবায়ন ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে। ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর রবার্ট মেনডেজ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিউবার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ও স্বৈরশাসনকে স্বীকার করে নেয়া। সিনেটর মেনডেজ নিজে কিউবান আমেরিকান। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো আইনকে কংগ্রেস অনুমোদন দেবে না। ফলে ওবামার ঘোষণা শেষ পর্যন্ত ‘একটি ঘোষণা’ হিসেবেই থেকে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়ন, আরও বেশি অর্থনৈতিক উদারিকরণ চান। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও উন্নতি চান। একই সঙ্গে চান রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সবকিছু ‘উন্মুক্ত’ করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গরবাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে; কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচি ‘পেরেস্ত্রয়কা’র বাস্তবায়ন হয়েছে; কিন্তু ‘গ্লাসনস্ত’ কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবায় কোনোটাই আসেনি। চীন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম যায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা, তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে রাজনীতি অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দু’দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনও কিউবার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা ‘একা’ চলতে পারবে না। দেশটিকে ‘দুয়ার’ উন্মুক্ত করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮০ ভাগ এখনও সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পর্যটন খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরও উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেইন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে ‘ডলার বাণিজ্য’ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান আমেরিকানদের পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবায় আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল অত্যন্ত কম দামে ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছে। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো তা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে। কারণ ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ! অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক একদিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মেনডেজ ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গত এপ্রিল থেকেই সেখানে অসন্তোষ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশ কয়েকজন ভেনিজুয়েলান ভিআইপির ওপর। সম্পদ আটক থেকে শুরু করে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ভেনিজুয়েলার মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এটা সত্য, হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়; কিন্তু তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোতে। মেক্সিকোর ৪৩ জন স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। এখন খুব সঙ্গত কারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিন ‘চাপ’ যদি বাড়ে, তাহলে কিউবাকে দেয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে।
কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। এক্ষেত্রে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগৎ বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। এখন পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গেছেন। কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত উপকৃত হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি ‘বড় উদ্যোগ’। কিন্তু এই উদ্যোগের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ কনজারভেটিভদের একটা বড় অংশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। এটা সত্য, দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈরিতার অবসান হওয়া প্রয়োজন। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এখন আর নেই। ছোট রাষ্ট্র কিউবাকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিউবাকে সঙ্গে নিয়েই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, কিউবা এ বিশ্বকে অনেক কিছু দিতে পারে। তাই বিকাশমান নয়া বিশ্বব্যবস্থার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্কোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments