সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা হলেও লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়নি : ড. আকবর আলি খান by মোকাম্মেল হোসেন
যুগান্তর : ৫ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ৫
জানুয়ারি ২০১৫। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এ দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়েছিল। সেই নির্বাচন যাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে, তারা তাদের ক্ষমতার
মেয়াদ এক বছর পূর্ণ করতে চলেছে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে আপনার
মূল্যায়ন কী?
ড. আকবর আলি খান : ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য করা হয়েছে। যদি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হতো, কিংবা সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যেত, তাহলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দিত। সেদিক থেকে এ নির্বাচন জরুরি ছিল। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা দেশ শাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংবিধানের আরও অন্যান্য লক্ষ্য রয়েছে। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ শাসন করা হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সেটা স্বাভাবিক হতো। তা করা হলে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা ছাড়াও অন্য যেসব লক্ষ্য আছে, সেগুলো অর্জন করা যেত। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তারা বলছে, এ ধরনের কোনো আলোচনায় তারা আগ্রহী নয়। আমরা মনে করি, সরকার বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা ও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে যদি দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, তাহলে সংবিধানের লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হবে। অন্যথায় সংবিধানের আইন প্রতিপালিত হলেও সংবিধানের লক্ষ্যসমূহ প্রতিপালিত হবে না।
যুগান্তর : আপনি নতুন আরেকটি নির্বাচনের কথা বললেন। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয় এ রকম একটি নির্বাচন পরিচালনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন কি সক্ষম?
আ. আ. খান : না। সেজন্যই আমার বক্তব্য হল, সবার সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা করে করা উচিত। সবাই অনড় অবস্থানে থাকলে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমাধান খুঁজে বের করতে হলে সব দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতে হবে। সরকার এটা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে করতে পারে। দুঃখজনক হল, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
যুগান্তর : সংবিধানের লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হোক বা না হোক, শাসক দল এক বছর ধরে দেশ চালাচ্ছে- এটাই বাস্তবতা। এক বছরের শাসনকাল সামনে রেখে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য দাবি করছে বা করবে। যুগান্তরের পাঠক যদি আপনার চোখে সরকারের সাফল্যগুলো দেখতে চায়?
আ. আ. খান : বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। অনেক ব্যর্থতাও রয়েছে। সরকারে থাকলে সব সময় সাফল্য দাবি করা হবে- এটাই স্বাভাবিক। ব্যর্থতার যে প্রশ্ন, সেটা তারা মানবে না। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। এটা পৃথিবীর অনেক অনুন্নয়নশীল দেশের তুলনায় খুব ভালো। অন্যদিক থেকে দেখলে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সে লক্ষ্যমাত্রা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে খুব একটা সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যতটুকু ছিল- ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। এর প্রমাণ হল- দেশে হরতাল, ধর্মঘট যাই হোক, প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনীতির ভয়ংকর রকম ক্ষতি করলে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো না। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, একদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এর কারণ বাংলাদেশে যে উন্নয়ন চলছে, তাতে সরকারের ভূমিকা আছে ঠিকই, তবে তার চেয়েও অনেক বেশি ভূমিকা হল সাধারণ মানুষের। বাংলাদেশে কারা প্রবৃদ্ধি করছে? বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির বড় নায়ক হল প্রবাসে যে বাংলাদেশীরা রয়েছেন, তারা। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বছরে প্রায় ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠাচ্ছেন।
যুগান্তর : রেমিটেন্সের এ অংক তো আনুষ্ঠানিক। অনানুষ্ঠানিক খাত যোগ করলে নিশ্চয়ই আরও বেশি হবে?
আ. আ. খান : হ্যাঁ। বিদেশ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আসা অর্থ যোগ করলে এ অংক আরও বেশি হবে। বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে তুলনা করলে এর ব্যাপকতা বোঝা যাবে। আমরা বৈদেশিক সাহায্য পাই বড়জোর দুই বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ আগের ঋণ শোধ করতেই চলে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাকুল্যে প্রতিবছর আমরা যে ৭শ’ থেকে ৮শ’ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য পাই- সে তুলনায় প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ অন্তত ২০ গুণ বেশি। আমাদের পোশাক খাত বিশ্বে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। পোশাক খাতে মূলত অবদান হল দেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নারীদের। এর সঙ্গে গার্মেন্ট উদ্যোক্তারাও কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হচ্ছে এবং এটা শুধু এ সরকারের আমলেই অর্জিত হয়েছে, তা নয়। ধারাবাহিকভাবে তিন বছরের বেশি সময় ধরে অর্জিত হচ্ছে। এ সাফল্যের নায়কও বাংলাদেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কৃষক। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে নারী সমাজের উদ্যোগ ও অবদান বেশি। তার মানে এ দেশের মানুষ অতি সৃজনশীল। বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এজন্যই মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। এটা যে চিরদিনই বজায় থাকবে তা কিন্তু নয়। আমরা যখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটা পর্যায়ে উপনীত হব, তখন সুশাসনের অভাবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে।
যুগান্তর : বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা পরিমাপ করতে বললে আপনি কোন কোন ক্ষেত্র চিহ্নিত করবেন?
আ. আ. খান : সরকারের অর্থনৈতিক যে ব্যর্থতা, সেগুলোর ওপর আমি খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করি না। কারণ কোনো সরকারই অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করতে পারে না। সরকার মোটা দাগে বিদ্যুৎ খাতে কিছুটা সফল হলেও জ্বালানি খাতে ব্যর্থ হয়েছে। জ্বালানি খাতে নিদারুণ অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যুৎ খাতেও তার প্রভাব পড়ছে। অন্যান্য অবকাঠামো খাতেও যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়নি। অবকাঠামোর দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। তবে সরকার কাজ করছে। সরকারকে আমি একেবারেই কৃতিত্ব দেব না- সেটা না, কিন্তু যা করছে তা যথেষ্ট নয়।
যুগান্তর : আপনি অনুন্নত অবকাঠামোর কথা বললেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক-বন্দর-বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো অবকাঠামোগুলোর উন্নয়ন করতে না পারলে বিনিয়োগে কাক্সিক্ষত সাফল্য পাওয়া যাবে কি? বিশেষ করে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে?
আ. আ. খান : বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি যেসব অবকাঠামোর কথা বললেন, সেগুলো অত্যাবশ্যক। এখন পর্যন্ত দেশী বিনিয়োগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কিন্তু একটু আগে যেটা বললাম- আমরা যখন অর্থনৈতিক উন্নতির একটা পর্যায়ে উপনীত হব, তখন এ অভাবগুলো আরও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। ফলে আমাদের যে অগ্রগতি, সেটা ১০ বছর পর থেমে যাবে। কাজেই অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমাদের হাতে আছে ১০ বছর সময়। আমাদের সামনে একটি সুযোগের জানালা খোলা আছে। এ সুযোগের জানালা হল- আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমাদের অবকাঠামোগত ঘাটতিগুলো পূরণ করা। সরকার যদি এ ঘাটতি পূরণ করতে পারে, তবে অবশ্যই দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আকৃষ্ট হবে।
যুগান্তর : অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন এবং আর্থিক খাতে শৃংখলা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। এসব শর্ত পূরণ করতে হলে করণীয় কী?
আ. আ. খান : আর্থিক খাতে শৃংখলা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাও সুশাসনের অঙ্গ। সামগ্রিকভাবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন না থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। যখন কোনো দেশ খুব নিু পর্যায়ে থাকে, তখন সুশাসনের অনুপস্থিতিতেও সেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব। যেমনটা বাংলাদেশের বেলায় ঘটছে। এর কারণ আমাদের এত সম্ভাবনা রয়েছে যে, তার কিছুটা বাস্তবায়িত হলেও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়। যখন আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা পর্যায়ে চলে যাব, তখন সুশাসন আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে, আমাদের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে এবং অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা ঠিক, এটা কতদিন পরে ঘটবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। আমার মনে হয়, আগামী ১০-১৫ বছর সুশাসনের অনুপস্থিতিতেও আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের কাজটি চালিয়ে যেতে পারব। এরপর দেখা যাবে, সুশাসনের অভাবে আর এগোনো যাচ্ছে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সামনে ১০-১৫ বছরের সুযোগের একটা জানালা খোলা আছে। যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ সময়ের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। অন্যথায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়বে।
যুগান্তর : তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কি যৌক্তিক হারে ঘটছে?
আ. আ. খান : অতীতে সরকার এ সম্পর্কিত রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি সরকারি যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেটার সঙ্গে আমি একমত নই। বিশ্ববাজারে তেলের দাম এত কমে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশে দাম বেশি রেখে যদি পেট্রোবাংলা লাভ করে, আবার সরকারও কর আদায় করে- তাহলে এর প্রভাব রফতানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। বিদেশে জ্বালানির দামের তুলনায় আমাদের এখানে দাম অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য দাম কমানো উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : আমাদের এডিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দাতাগোষ্ঠীর অসন্তোষ রয়েছে। বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গতি আনতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
আ. আ. খান : গতি আনতে হলে সরকারের ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। ধরুন, আমরা যখন টেন্ডার আহ্বান করি, টেন্ডারে লেখা থাকে- ৬ সপ্তাহের মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া হবে। দু’তিন বছর আগে বিশ্বব্যাংক একটা সমীক্ষা করেছিল- সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ টেন্ডারের কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হয়। বাকি ৮৮ শতাংশ টেন্ডার ফাইনাল করা যায় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সব তৃতীয় শ্রেণীর ঠিকাদার ভিড় করে। তারা অধিক লাভের জন্য বিভিন্ন ধরনের অজুহাত তোলে। অহেতুক বিলম্ব করতে থাকে। কাজেই সরকারকে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই টেন্ডারের কার্যাদেশ চূড়ান্ত করতে হবে। ৬ মাস বা ৬ বছর লাগালে হবে না।
যুগান্তর : প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি কি একটি বড় বাধা নয়?
আ. আ. খান : শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি একটি বড় বাধা। আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি এত ব্যাপক মাত্রায় প্রসার লাভ করেছে যে, এ সমস্যার আশু সমাধানের উদ্যোগ নেয়া না হলে দেশের অগ্রগতি অবশ্যই ব্যাহত হবে। আশু সমাধানের একমাত্র উপায়- দুর্নীতিবাজদের ধরতে হবে। বিচার করতে হবে।
যুগান্তর : কে ধরবে? কে বিচার করবে? দেখা যাচ্ছে- দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছে!
আ. আ. খান : দেখুন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সরকারি দলের অনেকের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত শুরু করেছিল। এর ফলে তার ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত শুরুর পর দেখা যাচ্ছে, সবাইকে দায়মুক্তির প্রত্যয়নপত্র দেয়া হচ্ছে। যদি দায়মুক্তিই তদন্তের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে দুদকের ভাবমূর্তি যতখানি উজ্জ্বল হয়েছিল, এটা তো ম্লান হবেই, সাংঘাতিকভাবে অনেক নিচে নেমে যাবে।
যুগান্তর : তাহলে দুদকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? দুদক কীভাবে কাজ করবে?
আ. আ. খান : দুদকের ভূমিকা হবে দুর্নীতিবাজদের ধরা। তাদের বিচারের সম্মুখীন করা। এটাই দুদকের কাজ।
যুগান্তর : পক্ষপাতবিহীনভাবে?
আ. আ. খান : দুদকের পক্ষে তো পক্ষপাত করার প্রশ্নই ওঠে না। যদি পক্ষপাতের ঘটনা ঘটে, তাহলে তার ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ হবে।
যুগান্তর : এখন যা চলছে, তাতে কি পক্ষপাত মনে হচ্ছে না?
আ. আ. খান : গত বছর বিভিন্ন মামলায় যাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তারা সরকারি দলের লোকজন। এদের ধরাটাই ছিল অবাক কাণ্ড। ধরার পর দেখা গেল, সবাইকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে দুদক আন্তরিকভাবে এসব করেছে, নাকি লোক দেখানোর জন্য করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
যুগান্তর : দুদকের প্রত্যয়নপত্র কি দুর্নীতিবাজদের সমাজে বিশিষ্ট সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পুনর্বাসিত করছে না?
আ. আ. খান : হ্যাঁ। এতে জনমনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আরও হবে।
যুগান্তর : এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় সম্পর্কে আপনাকে পরামর্শ দিতে বলা হলে আপনার প্রথম তিনটি পরামর্শ কী হবে?
আ. আ. খান : প্রথম পরামর্শ- দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত- অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত- দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
যুগান্তর : সরকারের অতিরিক্ত ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি দেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেবে কি?
আ. আ. খান : এ প্রশ্নটা কিন্তু মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আপনি ভারতঘেঁষা ইত্যাদি বলছেন। এটা সঠিক মূল্যায়ন নাও হতে পারে। ভারত একটি বৃহৎ দেশ। সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ছোট। সাধারণত বড় দেশ সম্পর্কে ছোট দেশের অনেক সন্দেহ, অবিশ্বাস থাকে। যদি অতি দ্রুত এ ধারণার অবসান ঘটানো না যায়, যদি এর স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি না হয়, আপনি যে ধরনের মন্তব্য করলেন- সে ধরনের মন্তব্য পাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কাজেই দেশের মানুষ যেন বুঝতে পারে দু’দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার ফলে আমাদের কী লাভ হচ্ছে। কেবল এভাবেই দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক টেকসই হবে। নচেৎ নয়।
যুগান্তর : আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে গণভোটের দাবি তোলা হচ্ছে। এ দাবির যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলুন।
আ. আ. খান : গণভোট যে কোনো বিষয়ের ওপর করা যায়। মাত্র ক’দিন আগে স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডের সঙ্গে থাকবে, নাকি স্বাধীন হয়ে যাবে, তার ওপর গণভোট হয়েছে। এজন্য সংবিধানের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। বিলেতে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা গণভোট করেছে। আমাদের এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে প্রশ্ন- এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো কোনোদিনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনীয়, নাকি প্রয়োজনীয় নয়- এটা যদি জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং জনগণ যদি বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না, তাহলে সেটা বিএনপির মানতে হবে। আর জনগণ যদি বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, তাহলে সেটা সরকারকে মানতে হবে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়তো হবে না। সুপ্রিমকোর্টের রায়ের সঙ্গে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সঙ্গতিপূর্ণ সেটা বের করতে হবে। সুপ্রিমকোর্ট বলেছে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক হতে পারবে না। নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও করা সম্ভব। এটা বিভিন্নভাবে করা সম্ভব। এটা নিয়ে যদি গণভোট করতে হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোকে বসে কী প্রশ্নে গণভোট হবে সেটা নির্ধারণ করতে হবে।
যুগান্তর : শাসক দলের অসহনশীল চরিত্র কি দিন দিন উগ্র হচ্ছে? সম্প্রতি গাজীপুরে বিরোধী দলকে জনসভা করতে না দেয়া কি তারই প্রমাণ?
আ. আ. খান : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে। এজন্য দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। সম্প্রতি গাজীপুরে যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। যদি সরকার বিরোধী দলকে সভা করতে না দেয়, আর বিরোধী দল সরকারকে সভা করতে না দেয়, তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন হবে। যদি ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন ও ফ্রিডম অব স্পিচ সংরক্ষণ করা না যায়, তাহলে আমাদের গণতন্ত্র থেকে আমরা কোনো সুফল পাব না।
যুগান্তর : মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জীবনযাত্রার মান সমন্বয় করতে স্থায়ী বেতন ও চাকরি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে অষ্টম জাতীয় বেতন কমিশন। এ সম্পর্কে বলুন।
আ. আ. খান : আসল সমস্যার সমাধান না করে শুধু বেতন কমিশন গঠন করলে সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের আসল সমস্যা কী? প্রথম কথা হল- সরকারি কর্মচারীদের এমন বেতন দিতে হবে যা জাতীয় আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আপনি যদি নির্ধারণ করতে পারেন কতজন লোকের মাথাপিছু আয়ের সমান সর্বনিু বেতন হবে, তাহলে তার ভিত্তিতে কমিশন ছাড়াই প্রত্যেক বছর বা দুই বছর অন্তর সেটা বাড়ানো সম্ভব। এখানে সমস্যা হচ্ছে তিনটি। প্রথম সমস্যা- সম্পূর্ণ প্রয়োজন মেটে এমন বেতন দেয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। কাজেই সরকারের আর্থিক যে সমস্যা, সেটার সমাধান করতে হবে। আবার শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভালো আর্থিক সুবিধা দিলেই হবে না। উন্নয়ন প্রকল্প করতে হবে। অবকাঠামো করতে হবে। সরকারের অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুতরাং ওখানে কতটুকু পর্যন্ত বেতন বাড়ানো যাবে, এ সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয় সমস্যা হল- সরকারি কর্মচারীদের শুধু মাসের বেতন দিলেই হবে না; তাদের থাকার জায়গারও বন্দোবস্ত করতে হবে এবং অবসর গ্রহণের পর যাতে বাসস্থান সুবিধা বহাল থাকে, সে রকম ব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্তমানে আমাদের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, ঢাকা শহরের আশপাশে এটা করা সম্ভব নয়। সেজন্য আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড পরিকল্পিত উপায়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। যদি এটা করা না যায়, তাহলে বাড়িভাড়া নিয়ে যে সমস্যা হবে, বেতন বৃদ্ধি করেও সেটার সমাধান করা যাবে না। তৃতীয় হল- পেনশনের যে ব্যয়, সেটাও কিন্তু অনেক বেড়ে যাবে। সুতরাং পেনশন নিয়ে কী করা হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসবের কোনো চটজলদি সমাধান নেই। এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে, গবেষণা করতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যুগান্তর : রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না হলে পে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি?
আ. আ. খান : এটা নির্ভর করে সরকার অন্য জায়গায় খরচ কমাবে, নাকি রাজস্ব বাড়াবে- এর ওপর। অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, বেতন কাঠামো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থাৎ এক বছরে করা হবে না। কতদিনে করা হবে- এর ওপর নির্ভর করবে এটার প্রভাব কতটুকু পড়বে।
যুগান্তর : ২০১৪ সাল রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই স্থিতিশীল থাকার পরও বিনিয়োগের বন্ধ দরজা খোলা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সাল রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়ে ওঠার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে?
আ. আ. খান : গত বছর যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল, এ বছরও মোটামুটিভাবে সেসব চ্যালেঞ্জই আছে। তবে অর্থনীতির ওপর একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। সরকার অনেক বড় বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। সরকার বলছে সাবমেরিন কিনবে, যুদ্ধজাহাজ কিনবে, উড়োজাহাজ কিনছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, পদ্মা সেতু করছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে ইত্যাদি। এত বড় বড় প্রকল্প করতে গেলে, সেখানে অর্থায়ন করতে গেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির ওপর চাপ পড়বে। সরকারের ব্যয়ের ওপরও চাপ পড়বে। এখন সেই চাপ কীভাবে সমন্বয় করা হয়- বর্তমান বছরে সেটা আমরা আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। পরিকল্পনা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যুগান্তর : সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করছেন পরিবেশবাদীরা। এ প্রকল্পের বাস্তবতা কি এটা সমর্থন করে?
আ. আ. খান : এটা অবশ্যই যৌক্তিক। সুন্দরবনের সংরক্ষণ আমরা সবাই চাই। এ বিষয়ে সরকার যত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে আলাপ-আলোচনা ও গবেষণা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সমীচীন।
যুগান্তর : মানবাধিকার কমিশনের কাজকর্ম দেখে একে একটা ফ্রেমবন্দি প্রতিষ্ঠান মনে হয়। এটাকে কার্যকর করতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
আ. আ. খান : আইনে যা আছে, সেটা বাস্তবায়ন করলেই কার্যকর হবে।
যুগান্তর : কে বাস্তবায়ন করবে? যারা দায়িত্বে আছে, তারা তো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না!
আ. আ. খান : তারা না পারলে তাদের সরিয়ে দেয়া হোক। যারা পারবে, তাদের বসানো হোক।
যুগান্তর : নতুনরা কি পারবে, যদি সেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন থাকে?
আ. আ. খান : নিয়ন্ত্রণ থাকলে সম্ভব নয়। ভারতের মানবাধিকার কমিশন যেভাবে কাজ করছে, আমাদের এখানে সেভাবে করতে পারছে না।
যুগান্তর : কেন পারছে না? সমস্যাটা কোথায়?
আ. আ. খান : বললাম তো, উপযুক্ত লোক দেয়া হচ্ছে না, উপযুক্ত লোক দিলে তিনি কাজ করতে পারবেন।
যুগান্তর : উপযুক্ত লোক বাছাই করবে কে?
আ. আ. খান : সরকারই করবে। সরকারই করে।
যুগান্তর : বাছাইটা যদি সরকার করে, তাহলে তো আগের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকবে। লাভ হবে কিছু?
আ. আ. খান : এর উত্তর আমার কাছে নেই। দেশের কারও কাছেই এর উত্তর নেই।
যুগান্তর : একজন সাবেক আমলা হিসেবে কতিপয় আমলার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আ. আ. খান : সাধারণ নাগরিক সবার সঙ্গে আমি একমত- এটা অত্যন্ত জঘন্য কাজ হয়েছে। সরকারি কর্মচারী তো বটেই, কারোরই এ ধরনের কাজ করার অধিকার নেই। যারা করেছে, তাদের আইনানুগ শাস্তি হওয়া উচিত।
যুগান্তর : দেশের আমলাতন্ত্রে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
আ. আ. খান : এ সম্বন্ধে আমার একটা বই ফেব্র“য়ারি মাসে প্রকাশিত হবে। সাড়ে তিনশ’ পৃষ্ঠার বই। যে বিষয়ের ওপর আমাকে সাড়ে তিনশ’ পৃষ্ঠা লিখতে হয়েছে, সে সম্পর্কে ১০ মিনিট, আধঘণ্টায় আমি কী বলব!
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
আ. আ. খান : ধন্যবাদ।
ড. আকবর আলি খান : ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য করা হয়েছে। যদি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হতো, কিংবা সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যেত, তাহলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দিত। সেদিক থেকে এ নির্বাচন জরুরি ছিল। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা দেশ শাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংবিধানের আরও অন্যান্য লক্ষ্য রয়েছে। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ শাসন করা হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সেটা স্বাভাবিক হতো। তা করা হলে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা ছাড়াও অন্য যেসব লক্ষ্য আছে, সেগুলো অর্জন করা যেত। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তারা বলছে, এ ধরনের কোনো আলোচনায় তারা আগ্রহী নয়। আমরা মনে করি, সরকার বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা ও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে যদি দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, তাহলে সংবিধানের লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হবে। অন্যথায় সংবিধানের আইন প্রতিপালিত হলেও সংবিধানের লক্ষ্যসমূহ প্রতিপালিত হবে না।
যুগান্তর : আপনি নতুন আরেকটি নির্বাচনের কথা বললেন। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয় এ রকম একটি নির্বাচন পরিচালনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন কি সক্ষম?
আ. আ. খান : না। সেজন্যই আমার বক্তব্য হল, সবার সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা করে করা উচিত। সবাই অনড় অবস্থানে থাকলে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমাধান খুঁজে বের করতে হলে সব দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতে হবে। সরকার এটা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে করতে পারে। দুঃখজনক হল, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
যুগান্তর : সংবিধানের লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হোক বা না হোক, শাসক দল এক বছর ধরে দেশ চালাচ্ছে- এটাই বাস্তবতা। এক বছরের শাসনকাল সামনে রেখে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য দাবি করছে বা করবে। যুগান্তরের পাঠক যদি আপনার চোখে সরকারের সাফল্যগুলো দেখতে চায়?
আ. আ. খান : বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। অনেক ব্যর্থতাও রয়েছে। সরকারে থাকলে সব সময় সাফল্য দাবি করা হবে- এটাই স্বাভাবিক। ব্যর্থতার যে প্রশ্ন, সেটা তারা মানবে না। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। এটা পৃথিবীর অনেক অনুন্নয়নশীল দেশের তুলনায় খুব ভালো। অন্যদিক থেকে দেখলে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সে লক্ষ্যমাত্রা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে খুব একটা সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যতটুকু ছিল- ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। এর প্রমাণ হল- দেশে হরতাল, ধর্মঘট যাই হোক, প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনীতির ভয়ংকর রকম ক্ষতি করলে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো না। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, একদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এর কারণ বাংলাদেশে যে উন্নয়ন চলছে, তাতে সরকারের ভূমিকা আছে ঠিকই, তবে তার চেয়েও অনেক বেশি ভূমিকা হল সাধারণ মানুষের। বাংলাদেশে কারা প্রবৃদ্ধি করছে? বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির বড় নায়ক হল প্রবাসে যে বাংলাদেশীরা রয়েছেন, তারা। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বছরে প্রায় ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠাচ্ছেন।
যুগান্তর : রেমিটেন্সের এ অংক তো আনুষ্ঠানিক। অনানুষ্ঠানিক খাত যোগ করলে নিশ্চয়ই আরও বেশি হবে?
আ. আ. খান : হ্যাঁ। বিদেশ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আসা অর্থ যোগ করলে এ অংক আরও বেশি হবে। বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে তুলনা করলে এর ব্যাপকতা বোঝা যাবে। আমরা বৈদেশিক সাহায্য পাই বড়জোর দুই বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ আগের ঋণ শোধ করতেই চলে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাকুল্যে প্রতিবছর আমরা যে ৭শ’ থেকে ৮শ’ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য পাই- সে তুলনায় প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ অন্তত ২০ গুণ বেশি। আমাদের পোশাক খাত বিশ্বে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। পোশাক খাতে মূলত অবদান হল দেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নারীদের। এর সঙ্গে গার্মেন্ট উদ্যোক্তারাও কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হচ্ছে এবং এটা শুধু এ সরকারের আমলেই অর্জিত হয়েছে, তা নয়। ধারাবাহিকভাবে তিন বছরের বেশি সময় ধরে অর্জিত হচ্ছে। এ সাফল্যের নায়কও বাংলাদেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কৃষক। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে নারী সমাজের উদ্যোগ ও অবদান বেশি। তার মানে এ দেশের মানুষ অতি সৃজনশীল। বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এজন্যই মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। এটা যে চিরদিনই বজায় থাকবে তা কিন্তু নয়। আমরা যখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটা পর্যায়ে উপনীত হব, তখন সুশাসনের অভাবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে।
যুগান্তর : বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা পরিমাপ করতে বললে আপনি কোন কোন ক্ষেত্র চিহ্নিত করবেন?
আ. আ. খান : সরকারের অর্থনৈতিক যে ব্যর্থতা, সেগুলোর ওপর আমি খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করি না। কারণ কোনো সরকারই অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করতে পারে না। সরকার মোটা দাগে বিদ্যুৎ খাতে কিছুটা সফল হলেও জ্বালানি খাতে ব্যর্থ হয়েছে। জ্বালানি খাতে নিদারুণ অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যুৎ খাতেও তার প্রভাব পড়ছে। অন্যান্য অবকাঠামো খাতেও যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়নি। অবকাঠামোর দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। তবে সরকার কাজ করছে। সরকারকে আমি একেবারেই কৃতিত্ব দেব না- সেটা না, কিন্তু যা করছে তা যথেষ্ট নয়।
যুগান্তর : আপনি অনুন্নত অবকাঠামোর কথা বললেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক-বন্দর-বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো অবকাঠামোগুলোর উন্নয়ন করতে না পারলে বিনিয়োগে কাক্সিক্ষত সাফল্য পাওয়া যাবে কি? বিশেষ করে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে?
আ. আ. খান : বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি যেসব অবকাঠামোর কথা বললেন, সেগুলো অত্যাবশ্যক। এখন পর্যন্ত দেশী বিনিয়োগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কিন্তু একটু আগে যেটা বললাম- আমরা যখন অর্থনৈতিক উন্নতির একটা পর্যায়ে উপনীত হব, তখন এ অভাবগুলো আরও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। ফলে আমাদের যে অগ্রগতি, সেটা ১০ বছর পর থেমে যাবে। কাজেই অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমাদের হাতে আছে ১০ বছর সময়। আমাদের সামনে একটি সুযোগের জানালা খোলা আছে। এ সুযোগের জানালা হল- আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমাদের অবকাঠামোগত ঘাটতিগুলো পূরণ করা। সরকার যদি এ ঘাটতি পূরণ করতে পারে, তবে অবশ্যই দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আকৃষ্ট হবে।
যুগান্তর : অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন এবং আর্থিক খাতে শৃংখলা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। এসব শর্ত পূরণ করতে হলে করণীয় কী?
আ. আ. খান : আর্থিক খাতে শৃংখলা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাও সুশাসনের অঙ্গ। সামগ্রিকভাবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন না থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। যখন কোনো দেশ খুব নিু পর্যায়ে থাকে, তখন সুশাসনের অনুপস্থিতিতেও সেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব। যেমনটা বাংলাদেশের বেলায় ঘটছে। এর কারণ আমাদের এত সম্ভাবনা রয়েছে যে, তার কিছুটা বাস্তবায়িত হলেও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়। যখন আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা পর্যায়ে চলে যাব, তখন সুশাসন আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে, আমাদের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে এবং অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা ঠিক, এটা কতদিন পরে ঘটবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। আমার মনে হয়, আগামী ১০-১৫ বছর সুশাসনের অনুপস্থিতিতেও আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের কাজটি চালিয়ে যেতে পারব। এরপর দেখা যাবে, সুশাসনের অভাবে আর এগোনো যাচ্ছে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সামনে ১০-১৫ বছরের সুযোগের একটা জানালা খোলা আছে। যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ সময়ের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। অন্যথায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়বে।
যুগান্তর : তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কি যৌক্তিক হারে ঘটছে?
আ. আ. খান : অতীতে সরকার এ সম্পর্কিত রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি সরকারি যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেটার সঙ্গে আমি একমত নই। বিশ্ববাজারে তেলের দাম এত কমে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশে দাম বেশি রেখে যদি পেট্রোবাংলা লাভ করে, আবার সরকারও কর আদায় করে- তাহলে এর প্রভাব রফতানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। বিদেশে জ্বালানির দামের তুলনায় আমাদের এখানে দাম অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য দাম কমানো উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : আমাদের এডিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দাতাগোষ্ঠীর অসন্তোষ রয়েছে। বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গতি আনতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
আ. আ. খান : গতি আনতে হলে সরকারের ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। ধরুন, আমরা যখন টেন্ডার আহ্বান করি, টেন্ডারে লেখা থাকে- ৬ সপ্তাহের মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া হবে। দু’তিন বছর আগে বিশ্বব্যাংক একটা সমীক্ষা করেছিল- সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ টেন্ডারের কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হয়। বাকি ৮৮ শতাংশ টেন্ডার ফাইনাল করা যায় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সব তৃতীয় শ্রেণীর ঠিকাদার ভিড় করে। তারা অধিক লাভের জন্য বিভিন্ন ধরনের অজুহাত তোলে। অহেতুক বিলম্ব করতে থাকে। কাজেই সরকারকে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই টেন্ডারের কার্যাদেশ চূড়ান্ত করতে হবে। ৬ মাস বা ৬ বছর লাগালে হবে না।
যুগান্তর : প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি কি একটি বড় বাধা নয়?
আ. আ. খান : শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি একটি বড় বাধা। আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি এত ব্যাপক মাত্রায় প্রসার লাভ করেছে যে, এ সমস্যার আশু সমাধানের উদ্যোগ নেয়া না হলে দেশের অগ্রগতি অবশ্যই ব্যাহত হবে। আশু সমাধানের একমাত্র উপায়- দুর্নীতিবাজদের ধরতে হবে। বিচার করতে হবে।
যুগান্তর : কে ধরবে? কে বিচার করবে? দেখা যাচ্ছে- দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছে!
আ. আ. খান : দেখুন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সরকারি দলের অনেকের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত শুরু করেছিল। এর ফলে তার ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত শুরুর পর দেখা যাচ্ছে, সবাইকে দায়মুক্তির প্রত্যয়নপত্র দেয়া হচ্ছে। যদি দায়মুক্তিই তদন্তের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে দুদকের ভাবমূর্তি যতখানি উজ্জ্বল হয়েছিল, এটা তো ম্লান হবেই, সাংঘাতিকভাবে অনেক নিচে নেমে যাবে।
যুগান্তর : তাহলে দুদকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? দুদক কীভাবে কাজ করবে?
আ. আ. খান : দুদকের ভূমিকা হবে দুর্নীতিবাজদের ধরা। তাদের বিচারের সম্মুখীন করা। এটাই দুদকের কাজ।
যুগান্তর : পক্ষপাতবিহীনভাবে?
আ. আ. খান : দুদকের পক্ষে তো পক্ষপাত করার প্রশ্নই ওঠে না। যদি পক্ষপাতের ঘটনা ঘটে, তাহলে তার ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ হবে।
যুগান্তর : এখন যা চলছে, তাতে কি পক্ষপাত মনে হচ্ছে না?
আ. আ. খান : গত বছর বিভিন্ন মামলায় যাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তারা সরকারি দলের লোকজন। এদের ধরাটাই ছিল অবাক কাণ্ড। ধরার পর দেখা গেল, সবাইকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে দুদক আন্তরিকভাবে এসব করেছে, নাকি লোক দেখানোর জন্য করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
যুগান্তর : দুদকের প্রত্যয়নপত্র কি দুর্নীতিবাজদের সমাজে বিশিষ্ট সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পুনর্বাসিত করছে না?
আ. আ. খান : হ্যাঁ। এতে জনমনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আরও হবে।
যুগান্তর : এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় সম্পর্কে আপনাকে পরামর্শ দিতে বলা হলে আপনার প্রথম তিনটি পরামর্শ কী হবে?
আ. আ. খান : প্রথম পরামর্শ- দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত- অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত- দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
যুগান্তর : সরকারের অতিরিক্ত ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি দেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেবে কি?
আ. আ. খান : এ প্রশ্নটা কিন্তু মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আপনি ভারতঘেঁষা ইত্যাদি বলছেন। এটা সঠিক মূল্যায়ন নাও হতে পারে। ভারত একটি বৃহৎ দেশ। সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ছোট। সাধারণত বড় দেশ সম্পর্কে ছোট দেশের অনেক সন্দেহ, অবিশ্বাস থাকে। যদি অতি দ্রুত এ ধারণার অবসান ঘটানো না যায়, যদি এর স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি না হয়, আপনি যে ধরনের মন্তব্য করলেন- সে ধরনের মন্তব্য পাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কাজেই দেশের মানুষ যেন বুঝতে পারে দু’দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার ফলে আমাদের কী লাভ হচ্ছে। কেবল এভাবেই দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক টেকসই হবে। নচেৎ নয়।
যুগান্তর : আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে গণভোটের দাবি তোলা হচ্ছে। এ দাবির যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলুন।
আ. আ. খান : গণভোট যে কোনো বিষয়ের ওপর করা যায়। মাত্র ক’দিন আগে স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডের সঙ্গে থাকবে, নাকি স্বাধীন হয়ে যাবে, তার ওপর গণভোট হয়েছে। এজন্য সংবিধানের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। বিলেতে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা গণভোট করেছে। আমাদের এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে প্রশ্ন- এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো কোনোদিনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনীয়, নাকি প্রয়োজনীয় নয়- এটা যদি জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং জনগণ যদি বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না, তাহলে সেটা বিএনপির মানতে হবে। আর জনগণ যদি বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, তাহলে সেটা সরকারকে মানতে হবে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়তো হবে না। সুপ্রিমকোর্টের রায়ের সঙ্গে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সঙ্গতিপূর্ণ সেটা বের করতে হবে। সুপ্রিমকোর্ট বলেছে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক হতে পারবে না। নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও করা সম্ভব। এটা বিভিন্নভাবে করা সম্ভব। এটা নিয়ে যদি গণভোট করতে হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোকে বসে কী প্রশ্নে গণভোট হবে সেটা নির্ধারণ করতে হবে।
যুগান্তর : শাসক দলের অসহনশীল চরিত্র কি দিন দিন উগ্র হচ্ছে? সম্প্রতি গাজীপুরে বিরোধী দলকে জনসভা করতে না দেয়া কি তারই প্রমাণ?
আ. আ. খান : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে। এজন্য দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। সম্প্রতি গাজীপুরে যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। যদি সরকার বিরোধী দলকে সভা করতে না দেয়, আর বিরোধী দল সরকারকে সভা করতে না দেয়, তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন হবে। যদি ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন ও ফ্রিডম অব স্পিচ সংরক্ষণ করা না যায়, তাহলে আমাদের গণতন্ত্র থেকে আমরা কোনো সুফল পাব না।
যুগান্তর : মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জীবনযাত্রার মান সমন্বয় করতে স্থায়ী বেতন ও চাকরি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে অষ্টম জাতীয় বেতন কমিশন। এ সম্পর্কে বলুন।
আ. আ. খান : আসল সমস্যার সমাধান না করে শুধু বেতন কমিশন গঠন করলে সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের আসল সমস্যা কী? প্রথম কথা হল- সরকারি কর্মচারীদের এমন বেতন দিতে হবে যা জাতীয় আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আপনি যদি নির্ধারণ করতে পারেন কতজন লোকের মাথাপিছু আয়ের সমান সর্বনিু বেতন হবে, তাহলে তার ভিত্তিতে কমিশন ছাড়াই প্রত্যেক বছর বা দুই বছর অন্তর সেটা বাড়ানো সম্ভব। এখানে সমস্যা হচ্ছে তিনটি। প্রথম সমস্যা- সম্পূর্ণ প্রয়োজন মেটে এমন বেতন দেয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। কাজেই সরকারের আর্থিক যে সমস্যা, সেটার সমাধান করতে হবে। আবার শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভালো আর্থিক সুবিধা দিলেই হবে না। উন্নয়ন প্রকল্প করতে হবে। অবকাঠামো করতে হবে। সরকারের অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুতরাং ওখানে কতটুকু পর্যন্ত বেতন বাড়ানো যাবে, এ সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয় সমস্যা হল- সরকারি কর্মচারীদের শুধু মাসের বেতন দিলেই হবে না; তাদের থাকার জায়গারও বন্দোবস্ত করতে হবে এবং অবসর গ্রহণের পর যাতে বাসস্থান সুবিধা বহাল থাকে, সে রকম ব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্তমানে আমাদের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, ঢাকা শহরের আশপাশে এটা করা সম্ভব নয়। সেজন্য আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড পরিকল্পিত উপায়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। যদি এটা করা না যায়, তাহলে বাড়িভাড়া নিয়ে যে সমস্যা হবে, বেতন বৃদ্ধি করেও সেটার সমাধান করা যাবে না। তৃতীয় হল- পেনশনের যে ব্যয়, সেটাও কিন্তু অনেক বেড়ে যাবে। সুতরাং পেনশন নিয়ে কী করা হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসবের কোনো চটজলদি সমাধান নেই। এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে, গবেষণা করতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যুগান্তর : রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না হলে পে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি?
আ. আ. খান : এটা নির্ভর করে সরকার অন্য জায়গায় খরচ কমাবে, নাকি রাজস্ব বাড়াবে- এর ওপর। অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, বেতন কাঠামো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থাৎ এক বছরে করা হবে না। কতদিনে করা হবে- এর ওপর নির্ভর করবে এটার প্রভাব কতটুকু পড়বে।
যুগান্তর : ২০১৪ সাল রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই স্থিতিশীল থাকার পরও বিনিয়োগের বন্ধ দরজা খোলা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সাল রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়ে ওঠার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে?
আ. আ. খান : গত বছর যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল, এ বছরও মোটামুটিভাবে সেসব চ্যালেঞ্জই আছে। তবে অর্থনীতির ওপর একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। সরকার অনেক বড় বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। সরকার বলছে সাবমেরিন কিনবে, যুদ্ধজাহাজ কিনবে, উড়োজাহাজ কিনছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, পদ্মা সেতু করছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে ইত্যাদি। এত বড় বড় প্রকল্প করতে গেলে, সেখানে অর্থায়ন করতে গেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির ওপর চাপ পড়বে। সরকারের ব্যয়ের ওপরও চাপ পড়বে। এখন সেই চাপ কীভাবে সমন্বয় করা হয়- বর্তমান বছরে সেটা আমরা আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। পরিকল্পনা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যুগান্তর : সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করছেন পরিবেশবাদীরা। এ প্রকল্পের বাস্তবতা কি এটা সমর্থন করে?
আ. আ. খান : এটা অবশ্যই যৌক্তিক। সুন্দরবনের সংরক্ষণ আমরা সবাই চাই। এ বিষয়ে সরকার যত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে আলাপ-আলোচনা ও গবেষণা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সমীচীন।
যুগান্তর : মানবাধিকার কমিশনের কাজকর্ম দেখে একে একটা ফ্রেমবন্দি প্রতিষ্ঠান মনে হয়। এটাকে কার্যকর করতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
আ. আ. খান : আইনে যা আছে, সেটা বাস্তবায়ন করলেই কার্যকর হবে।
যুগান্তর : কে বাস্তবায়ন করবে? যারা দায়িত্বে আছে, তারা তো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না!
আ. আ. খান : তারা না পারলে তাদের সরিয়ে দেয়া হোক। যারা পারবে, তাদের বসানো হোক।
যুগান্তর : নতুনরা কি পারবে, যদি সেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন থাকে?
আ. আ. খান : নিয়ন্ত্রণ থাকলে সম্ভব নয়। ভারতের মানবাধিকার কমিশন যেভাবে কাজ করছে, আমাদের এখানে সেভাবে করতে পারছে না।
যুগান্তর : কেন পারছে না? সমস্যাটা কোথায়?
আ. আ. খান : বললাম তো, উপযুক্ত লোক দেয়া হচ্ছে না, উপযুক্ত লোক দিলে তিনি কাজ করতে পারবেন।
যুগান্তর : উপযুক্ত লোক বাছাই করবে কে?
আ. আ. খান : সরকারই করবে। সরকারই করে।
যুগান্তর : বাছাইটা যদি সরকার করে, তাহলে তো আগের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকবে। লাভ হবে কিছু?
আ. আ. খান : এর উত্তর আমার কাছে নেই। দেশের কারও কাছেই এর উত্তর নেই।
যুগান্তর : একজন সাবেক আমলা হিসেবে কতিপয় আমলার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আ. আ. খান : সাধারণ নাগরিক সবার সঙ্গে আমি একমত- এটা অত্যন্ত জঘন্য কাজ হয়েছে। সরকারি কর্মচারী তো বটেই, কারোরই এ ধরনের কাজ করার অধিকার নেই। যারা করেছে, তাদের আইনানুগ শাস্তি হওয়া উচিত।
যুগান্তর : দেশের আমলাতন্ত্রে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
আ. আ. খান : এ সম্বন্ধে আমার একটা বই ফেব্র“য়ারি মাসে প্রকাশিত হবে। সাড়ে তিনশ’ পৃষ্ঠার বই। যে বিষয়ের ওপর আমাকে সাড়ে তিনশ’ পৃষ্ঠা লিখতে হয়েছে, সে সম্পর্কে ১০ মিনিট, আধঘণ্টায় আমি কী বলব!
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
আ. আ. খান : ধন্যবাদ।
No comments