খেরোখাতায় আমাদের শিক্ষাঙ্গন
একটি বছরের হিসাবে শিক্ষার সার্বিক চিত্র
স্পষ্ট করা কঠিন। শিক্ষা কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক বছরের
ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায় পরের বছর। তবুও ২০১৫-এর প্রথম দিনে দাঁড়িয়ে আমরা
যদি সদ্য ছেড়ে আসা খেরোখাতার দিকে চোখ বুলাই তবে দেশের সার্বিক
শিক্ষাঙ্গনের একটা ছবি হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তবে ২০১৪-এর অভিজ্ঞতা যে
খুব স্বস্তির ছিল তা বলা যাবে না। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাঙ্গন,
শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিয়ে বরাবরের মতো আমাদের ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতারা
তেমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি। গত বছরের শুরু থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলন
কর্মসূচির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বারবার। শিক্ষাবিদহীন
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থাকলে যে যে ধরনের গোলমেলে অবস্থা তৈরি হতে পারে, সব
ক্ষেত্রে তার প্রকাশ স্পষ্ট হয়েছিল।
ইতিবাচক দিক হিসেবে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। নারীশিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া বছরের প্রথম দিন স্কুল পর্যায়ে টেক্সট বুক বোর্ডের বই পৌঁছানোর কৃতিত্ব রয়েছে সরকারের। এর বাইরে সরকারি কৃতিত্ব বড় মুখ করে বলার মতো ছিল না। তবে সরকার পক্ষ বড় মুখ করে বলেছে অনেক কিছুই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরদারি, টেক্সট বুক বোর্ডের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট লেখকদের ঐকান্তিকতা এবং শ্রমে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে বইয়ের মানগত দিক এবং প্রকাশনার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল বিগত বছরগুলোর মতোই। বই লেখার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্র“টি, লেখক-সম্পাদক নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে গ্রন্থ রচনাকে মানসম্মত রাখতে দেয়নি। আর দুর্নীতি ও বাজেট সংকট বইয়ের উৎপাদন-মানকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বছরের শুরুর পূর্বেই আন্দোলনরত স্কুলের নিুবেতনভুক শিক্ষকরা পুলিশের টিয়ার শেল ও লাঠিপেটার শিকার হন। প্রাথমিক ও জুনিয়র পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পিইসি আর জেএসসি নামের পাবলিক পরীক্ষার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার চাপে গত বছরও গলদঘর্ম ছিল। এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজে এসব পদ্ধতি অভিভাবকের পকেট কেটেছে আর রমরমা করেছে গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীদের পকেট। এর সঙ্গে নতুন ও ভয়ানক উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের মধ্য দিয়ে কোমলমতি শিশুদের হাতেকলমে অনৈতিকতার প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় অথবা পৃষ্ঠপোষকতায়। ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ শব্দে সংশ্লিষ্টজনদের মধ্যে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু এমন ‘আপত্তিকর’ শব্দ ব্যবহার করতে হচ্ছে কার্যকারণ সূত্রেই। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি যখন দেশবাসী ও ভুক্তভোগীদের কাছে স্পষ্ট, তখনও বিষয়টি ক্রমাগত অস্বীকার করে চলেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অস্বীকারের অর্থই হচ্ছে ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার পথ তৈরি করে দেয়া। একই সঙ্গে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শত ভাগ পাস আর উজ্জ্বল ফলাফলের বিস্ফোরণ দেখিয়ে সরকারের কৃতিত্ব জাহির করার প্রবণতা কলুষিত করেছে মেধাচর্চার জায়গাটিকে। সরকার পক্ষ অস্বীকার করলেও দেশের সহস্র সহস্র স্কুল-কলেজের শিক্ষক জানেন কোনো এক অলৌকিক নির্দেশনায় তাদের হাত খুলে নম্বর দিয়ে জিপিএ-৫-এর জোয়ার বইয়ে দিতে হয়েছে। এসব কার্যক্রমই শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। নিুবেতন কাঠামোয় আটকে রেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষক আকৃষ্ট করার ব্যাপারে গেল বছর কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। বেসরকারি স্কুল আর কলেজের পরিচালনা পর্ষদ, এমপিসহ নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক অভিলাষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি বণিক আর দুর্বল মেধার শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
লাখ লাখ কিশোর-তরুণ কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। অথচ এসব মাদ্রাসার কারিকুলামে তেমন কোনো সংস্কার আনতে পারেনি মাদ্রাসা বোর্ড আর সরকারের
মন্ত্রণালয়। আধুনিকায়নের কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও মূলধারার কারিকুলামে তেমন কোনো সমন্বয় সাধিত হয়নি গেল বছরে। একইভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতে সমন্বয়ের চেষ্টা করেনি ইউজিসি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। ফলে শিক্ষা ও সার্টিফিকেটের মান নিয়ে বরাবরের মতো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ।
রাজনীতিকরণের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নাজুক অবস্থা অতিক্রম করেছে বিগত বছরটিতে। ছাত্র সংঘাত আর খুনোখুনিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনেক বেশি রক্তাক্ত হয়েছে। সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রলীগ অনেক বেশি উন্মত্ততা প্রকাশ করেছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রলয় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিপথগামী অপরাধী ছাত্ররা সরকারি নেতা-নেত্রীদের প্রশ্রয় বঞ্চিত হয়নি। ফলে তারা দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল বছরজুড়ে।
দলীয় শিক্ষক রাজনীতির নতজানু ও সুবিধাবাদী দশা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পাণ্ডিত্য ও মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, নিয়োগ বাণিজ্যের প্রশ্নটিও গত বছর সামনে চলে এসেছিল। কয়েক বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দু-একটি ক্ষেত্রে অর্থ বাণিজ্যের কথা শোনা যেত। এখন কমবেশি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও অর্থ বিনিয়োগের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, নিরপেক্ষ তদন্তে সেসব যাচাই-বাছাই করা হলে এ সত্য খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হবে না।
এভাবে রাজনীতিকরণের বিষময় প্রভাব পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রমে। কুরাজনীতিকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, শিক্ষক সমিতি বা সিন্ডিকেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভিসিপন্থী দল হিসাব করতে থাকে আর কটি ভোট যুক্ত হলে বিজয় নিশ্চিত হবে। সেইমতো শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন বিভাগে বিজ্ঞাপিত পদে এবং বিজ্ঞাপনের বাইরেও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। এসব ভোটার শিক্ষকের প্রধান যোগ্যতা থাকতে হয় দলীয় আনুগত্য। ছাত্র জীবনে কোন আদর্শের রাজনীতি করেছে সে বিবেচনাটি সামনে চলে আসে। এসব নিয়োগের পরও যদি ভোটের ব্যাপারে সন্দিহান থাকে, তখন রাতারাতি নতুন বিভাগ খুলে ফেলা হয়। আর সেই বিভাগের বিপরীতে নিয়োগ দিয়ে ফেলা হয় কয়েকজন শিক্ষক। এসব কাণ্ডে ইউজিসিও কেমন করে যেন ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব নতুন বিভাগের শিক্ষার্থী ও তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। যত দ্রুত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করা যায়, তত শিগগির বিভাগের অবকাঠামো তৈরি হয় না। শিক্ষার্থীরা অনেকটা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের দু-তিন বর্ষ পার হলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শিক্ষকের দেখা পায় না। লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি তৈরি হয় না। সর্বোপরি বিশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমে তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। উপাচার্য মহোদয়দের ক্যাম্পাসে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেয়ার বদলে দলীয় রাজনীতি নিয়ে বেশি ভাবতে হয়। এসবের বিষময় প্রভাব এখন প্রতিফলিত হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
আমার এক সহকর্মী সেদিন যথার্থ বলেছিলেন, এখন ক্যাম্পাসে শিক্ষক রাজনীতি চলছে নয়-ছয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছি এর মধ্যে যেমন প্রতীকী বিষয় রয়েছে তেমনি রয়েছে পরাবাস্তবতা। জাতীয় রাজনীতির চেয়ে এদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে কিছুটা ফারাক আছে। দলীয় রাজনীতির সাইনবোর্ড থাকলেও কখনও গোষ্ঠী রাজনীতির স্বার্থে নয়-ছয়ের খেলায় মেতে ওঠেন অনেকে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদাহরণ নেয়া যায়। জাতীয় রাজনীতিতে এখন বিএনপি-আওয়ামী লীগ পারস্পরিক শত্র“ সম্পর্ক নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন অংশ ও বিএনপির শিক্ষক গ্র“প গভীর বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। যেহেতু দু’দলের ভোট ব্যাংক একসঙ্গে হলে সরল হিসাবেই একচ্ছত্র শক্তি ধারণ করা যায়, সে কারণেই মিলন সমীকরণে চলছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় শিক্ষকরা। এ কারণেই ন্যায়-নীতি ও যুক্তির বাইরে উভয়ের সন্তুষ্টিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিগত বছরে অব্যাহতভাবে চলেছে।
নয়-ছয়ের বিষয়টি বেশি প্রচার পেয়েছে একটি বাস্তব অবস্থা থেকে। গেল ডিসেম্বরে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। মোট পনেরোটি পদের মধ্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা ৯টি এবং বিএনপিপন্থীরা ৬টিতে সম্মিলিত প্যানেল ঘোষণা করে। যেহেতু দলবৃত্তে বন্দি শিক্ষকরা এখন বিবেক আর যুক্তি দিয়ে ভোট দেন না, তাই অন্য পক্ষের শিক্ষকরা মিছিমিছি প্যানেল উপস্থাপন করেননি। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয়-ছয়ের প্যানেল নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতীকী স্থান মাত্র। মোটামুটি একই তাল-লয়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই রাজনীতির শিক্ষকরা দলবৃত্তে বন্দি করে ফেলছেন শিক্ষা-পরিবেশকে। তাই শিক্ষা কার্যক্রমের সূচক কেবল নিুমুখী হচ্ছে।
নতুন বছরে আমরা সবসময়ই জরামুক্ত হতে চাই। তেজোদীপ্ত হয়ে সুন্দরের পথে হাঁটতে চাই। এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই তবে শিক্ষাকে রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিমুক্ত না করতে পারলে অভীষ্টে পৌঁছা সম্ভব নয়। ২০১৫ সালের প্রথম দিন থেকে আমাদের সব ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানরা যদি এই উপলব্ধিতে আসতে পারেন যে, নিজেদের সন্তান দেশে লেখাপড়া না করলেও এ দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তানের মতোই। একটি প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার পরিবেশ সুস্থ রাখার স্বার্থে সব অশুভ তৎপরতা থেকে সরে আসব। স্বাভাবিক নিয়মে জ্ঞানচর্চার সব পথ কণ্টকমুক্ত করব। তবেই আমাদের শিক্ষাঙ্গন বন্দিত্বমুক্ত হতে পারবে। আমরা চাই একটি সুস্থ ধারার বিকাশ ঘটুক নতুন বছরে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিবাচক দিক হিসেবে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। নারীশিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া বছরের প্রথম দিন স্কুল পর্যায়ে টেক্সট বুক বোর্ডের বই পৌঁছানোর কৃতিত্ব রয়েছে সরকারের। এর বাইরে সরকারি কৃতিত্ব বড় মুখ করে বলার মতো ছিল না। তবে সরকার পক্ষ বড় মুখ করে বলেছে অনেক কিছুই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরদারি, টেক্সট বুক বোর্ডের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট লেখকদের ঐকান্তিকতা এবং শ্রমে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে বইয়ের মানগত দিক এবং প্রকাশনার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল বিগত বছরগুলোর মতোই। বই লেখার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্র“টি, লেখক-সম্পাদক নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে গ্রন্থ রচনাকে মানসম্মত রাখতে দেয়নি। আর দুর্নীতি ও বাজেট সংকট বইয়ের উৎপাদন-মানকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বছরের শুরুর পূর্বেই আন্দোলনরত স্কুলের নিুবেতনভুক শিক্ষকরা পুলিশের টিয়ার শেল ও লাঠিপেটার শিকার হন। প্রাথমিক ও জুনিয়র পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পিইসি আর জেএসসি নামের পাবলিক পরীক্ষার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার চাপে গত বছরও গলদঘর্ম ছিল। এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজে এসব পদ্ধতি অভিভাবকের পকেট কেটেছে আর রমরমা করেছে গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীদের পকেট। এর সঙ্গে নতুন ও ভয়ানক উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের মধ্য দিয়ে কোমলমতি শিশুদের হাতেকলমে অনৈতিকতার প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় অথবা পৃষ্ঠপোষকতায়। ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ শব্দে সংশ্লিষ্টজনদের মধ্যে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু এমন ‘আপত্তিকর’ শব্দ ব্যবহার করতে হচ্ছে কার্যকারণ সূত্রেই। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি যখন দেশবাসী ও ভুক্তভোগীদের কাছে স্পষ্ট, তখনও বিষয়টি ক্রমাগত অস্বীকার করে চলেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অস্বীকারের অর্থই হচ্ছে ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার পথ তৈরি করে দেয়া। একই সঙ্গে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শত ভাগ পাস আর উজ্জ্বল ফলাফলের বিস্ফোরণ দেখিয়ে সরকারের কৃতিত্ব জাহির করার প্রবণতা কলুষিত করেছে মেধাচর্চার জায়গাটিকে। সরকার পক্ষ অস্বীকার করলেও দেশের সহস্র সহস্র স্কুল-কলেজের শিক্ষক জানেন কোনো এক অলৌকিক নির্দেশনায় তাদের হাত খুলে নম্বর দিয়ে জিপিএ-৫-এর জোয়ার বইয়ে দিতে হয়েছে। এসব কার্যক্রমই শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। নিুবেতন কাঠামোয় আটকে রেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষক আকৃষ্ট করার ব্যাপারে গেল বছর কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। বেসরকারি স্কুল আর কলেজের পরিচালনা পর্ষদ, এমপিসহ নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক অভিলাষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি বণিক আর দুর্বল মেধার শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
লাখ লাখ কিশোর-তরুণ কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। অথচ এসব মাদ্রাসার কারিকুলামে তেমন কোনো সংস্কার আনতে পারেনি মাদ্রাসা বোর্ড আর সরকারের
মন্ত্রণালয়। আধুনিকায়নের কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও মূলধারার কারিকুলামে তেমন কোনো সমন্বয় সাধিত হয়নি গেল বছরে। একইভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতে সমন্বয়ের চেষ্টা করেনি ইউজিসি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। ফলে শিক্ষা ও সার্টিফিকেটের মান নিয়ে বরাবরের মতো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ।
রাজনীতিকরণের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নাজুক অবস্থা অতিক্রম করেছে বিগত বছরটিতে। ছাত্র সংঘাত আর খুনোখুনিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনেক বেশি রক্তাক্ত হয়েছে। সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রলীগ অনেক বেশি উন্মত্ততা প্রকাশ করেছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রলয় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিপথগামী অপরাধী ছাত্ররা সরকারি নেতা-নেত্রীদের প্রশ্রয় বঞ্চিত হয়নি। ফলে তারা দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল বছরজুড়ে।
দলীয় শিক্ষক রাজনীতির নতজানু ও সুবিধাবাদী দশা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পাণ্ডিত্য ও মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, নিয়োগ বাণিজ্যের প্রশ্নটিও গত বছর সামনে চলে এসেছিল। কয়েক বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দু-একটি ক্ষেত্রে অর্থ বাণিজ্যের কথা শোনা যেত। এখন কমবেশি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও অর্থ বিনিয়োগের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, নিরপেক্ষ তদন্তে সেসব যাচাই-বাছাই করা হলে এ সত্য খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হবে না।
এভাবে রাজনীতিকরণের বিষময় প্রভাব পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রমে। কুরাজনীতিকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, শিক্ষক সমিতি বা সিন্ডিকেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভিসিপন্থী দল হিসাব করতে থাকে আর কটি ভোট যুক্ত হলে বিজয় নিশ্চিত হবে। সেইমতো শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন বিভাগে বিজ্ঞাপিত পদে এবং বিজ্ঞাপনের বাইরেও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। এসব ভোটার শিক্ষকের প্রধান যোগ্যতা থাকতে হয় দলীয় আনুগত্য। ছাত্র জীবনে কোন আদর্শের রাজনীতি করেছে সে বিবেচনাটি সামনে চলে আসে। এসব নিয়োগের পরও যদি ভোটের ব্যাপারে সন্দিহান থাকে, তখন রাতারাতি নতুন বিভাগ খুলে ফেলা হয়। আর সেই বিভাগের বিপরীতে নিয়োগ দিয়ে ফেলা হয় কয়েকজন শিক্ষক। এসব কাণ্ডে ইউজিসিও কেমন করে যেন ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব নতুন বিভাগের শিক্ষার্থী ও তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। যত দ্রুত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করা যায়, তত শিগগির বিভাগের অবকাঠামো তৈরি হয় না। শিক্ষার্থীরা অনেকটা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের দু-তিন বর্ষ পার হলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শিক্ষকের দেখা পায় না। লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি তৈরি হয় না। সর্বোপরি বিশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমে তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। উপাচার্য মহোদয়দের ক্যাম্পাসে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেয়ার বদলে দলীয় রাজনীতি নিয়ে বেশি ভাবতে হয়। এসবের বিষময় প্রভাব এখন প্রতিফলিত হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
আমার এক সহকর্মী সেদিন যথার্থ বলেছিলেন, এখন ক্যাম্পাসে শিক্ষক রাজনীতি চলছে নয়-ছয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছি এর মধ্যে যেমন প্রতীকী বিষয় রয়েছে তেমনি রয়েছে পরাবাস্তবতা। জাতীয় রাজনীতির চেয়ে এদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে কিছুটা ফারাক আছে। দলীয় রাজনীতির সাইনবোর্ড থাকলেও কখনও গোষ্ঠী রাজনীতির স্বার্থে নয়-ছয়ের খেলায় মেতে ওঠেন অনেকে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদাহরণ নেয়া যায়। জাতীয় রাজনীতিতে এখন বিএনপি-আওয়ামী লীগ পারস্পরিক শত্র“ সম্পর্ক নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন অংশ ও বিএনপির শিক্ষক গ্র“প গভীর বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। যেহেতু দু’দলের ভোট ব্যাংক একসঙ্গে হলে সরল হিসাবেই একচ্ছত্র শক্তি ধারণ করা যায়, সে কারণেই মিলন সমীকরণে চলছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় শিক্ষকরা। এ কারণেই ন্যায়-নীতি ও যুক্তির বাইরে উভয়ের সন্তুষ্টিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিগত বছরে অব্যাহতভাবে চলেছে।
নয়-ছয়ের বিষয়টি বেশি প্রচার পেয়েছে একটি বাস্তব অবস্থা থেকে। গেল ডিসেম্বরে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। মোট পনেরোটি পদের মধ্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা ৯টি এবং বিএনপিপন্থীরা ৬টিতে সম্মিলিত প্যানেল ঘোষণা করে। যেহেতু দলবৃত্তে বন্দি শিক্ষকরা এখন বিবেক আর যুক্তি দিয়ে ভোট দেন না, তাই অন্য পক্ষের শিক্ষকরা মিছিমিছি প্যানেল উপস্থাপন করেননি। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয়-ছয়ের প্যানেল নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতীকী স্থান মাত্র। মোটামুটি একই তাল-লয়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই রাজনীতির শিক্ষকরা দলবৃত্তে বন্দি করে ফেলছেন শিক্ষা-পরিবেশকে। তাই শিক্ষা কার্যক্রমের সূচক কেবল নিুমুখী হচ্ছে।
নতুন বছরে আমরা সবসময়ই জরামুক্ত হতে চাই। তেজোদীপ্ত হয়ে সুন্দরের পথে হাঁটতে চাই। এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই তবে শিক্ষাকে রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিমুক্ত না করতে পারলে অভীষ্টে পৌঁছা সম্ভব নয়। ২০১৫ সালের প্রথম দিন থেকে আমাদের সব ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানরা যদি এই উপলব্ধিতে আসতে পারেন যে, নিজেদের সন্তান দেশে লেখাপড়া না করলেও এ দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তানের মতোই। একটি প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার পরিবেশ সুস্থ রাখার স্বার্থে সব অশুভ তৎপরতা থেকে সরে আসব। স্বাভাবিক নিয়মে জ্ঞানচর্চার সব পথ কণ্টকমুক্ত করব। তবেই আমাদের শিক্ষাঙ্গন বন্দিত্বমুক্ত হতে পারবে। আমরা চাই একটি সুস্থ ধারার বিকাশ ঘটুক নতুন বছরে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments