দুর্নীতি যেখানে নীতি by পলাশ কুমার রায়
দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশন
(দুদক) নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। কঠোর শাস্তির বিধান এবং
যুগোপযোগী আইন করার পরও দেশ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। বরং
দুর্নীতি ভয়াবহ ব্যাধির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে
নিুস্তর পর্যন্ত কতটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে তা ভুক্তভোগী ব্যক্তিরাই কেবল
জানেন। সরকারি অফিসগুলোয় দুর্নীতি এখন আর কোনো অপরাধ কিংবা নিন্দনীয় বিষয়
নয় বরং এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সরকারি
অফিসগুলোয় দুর্নীতি কতটা বহুমাত্রিক ও চরম আকার ধারণ করেছে তা দুদক থেকে
প্রায় অর্ধকিলোমিটার এলাকার মধ্যে অবস্থিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের
সরেজমিন অবস্থা থেকে পাঠকদের অবহিত করার চেষ্টা করব।
দুদক থেকে প্রায় অর্ধকিলোমিটার আর বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে ৫০০ গজ পশ্চিম-উত্তর দিকে তেজগাঁও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়। এ কার্যালয়ে প্রতি কর্মদিবসে প্রায় শতাধিক ভূমি মালিক ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে যাতায়াত করেন। আগন্তুক এসব সহজ-সরল মনের ভূমি মালিক এবং তাদের প্রতিনিধিদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। জমির মালিকানা তথা ভূমি নিয়ে উদ্ভূত বিরোধকে কেন্দ্র করে ভূমি মালিকরা যতটা না কষ্ট সহ্য করেন, তার চেয়েও ঢের বেশি হয়রানি হতে হয় এখানে কর্মরত ব্যক্তিদের দ্বারা। ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত পরামর্শ এবং সহযোগিতার নামে দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঘাটে ঘাটে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে প্রণামি আদায় করে থাকেন।
এ ভূমি অফিসে ভুক্তভোগী এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তিনি কীভাবে এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা চরমভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, তার সদ্য কেনা একটি ফ্ল্যাটের নামজারি (অনেকে মিউটেশন বা খারিজ বলেন) করার জন্য এ ভূমি অফিসের এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেন। সেই ব্যক্তি সঠিকভাবে নামজারি করেছেন কিনা তা যাচাই করার জন্য এ অফিসের রেকর্ড রুমে মূল নথি দেখার চেষ্টা করেন। ওই ব্যক্তি তার নামজারি খতিয়ানের নথিটি দেখার জন্য সহকারী কমিশনার ভূমি, তেজগাঁও কার্যালয়ের রেকর্ড কিপারের শরণাপন্ন হলে তিনি নথিটি দেখিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ১ হাজার টাকা দাবি করেন। ফ্ল্যাট মালিক ১ হাজার টাকা দিয়ে মূল নথিটি দেখতে চাইলে রেকর্ড কিপার তাকে পরের দিন সকালে আসতে বলেন। সেই ব্যক্তি পরের দিন সকালে এলে রেকর্ড কিপার তাকে বিকালে আসতে বলেন। সেই ব্যক্তি বিকালে এলে রেকর্ড কিপার তাকে দুদিন পরে আসতে বলেন। এভাবে এক সপ্তাহ ঘুরানোর পর রেকর্ড কিপার ওই ব্যক্তিকে বলেন নথিটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এত ভিড়ের মধ্য থেকে নথিটি খুঁজতে আরও কয়েকদিন সময় এবং পারিশ্রমিক হিসেবে ২ হাজার টাকা লাগবে। সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাত ২ হাজার টাকা দিয়ে তাকে নথিটি দ্রুত খুঁজতে বলেন। বাড়তি এ টাকা পেয়ে রেকর্ড কিপার মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে নথিটি খুঁজে পান। শুধু রেকর্ড কিপার নয়, এ অফিসের প্রতিটি টেবিলে আপনার ন্যায্য ও যৌক্তিক কাজ করে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আপনার কাজটি প্রত্যাশিত সময়ে শেষ হবে না, অথবা হয়রানির শিকার হওয়ার পাশাপাশি আপনার নথিটি হয়তো আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনি না চাইলেও এখানে আপনাকে ঘুষ দিতে হবে। অবশ্য এ ঘুষকে সেলামি, প্রণামি, পারিশ্রমিক, বকশিশ, স্পিডমানি কিংবা অন্য নামেও ডাকা যায়।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের অন্যতম দায়িত্ব হল জমির মালিকের পক্ষে সব ধরনের কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্তে জমি বা ফ্ল্যাট মালিকের নামে প্রস্তাবিত জমি নামজারি ও জমা ভাগের আদেশ দেয়া। তেজগাঁওয়ের এ ভূমি অফিসে প্রতিদিন অসংখ্য নামজারি সংক্রান্ত ফাইল দেখভাল করতে হয়। প্রত্যেকটি ফাইল নামজারি এবং জমা ভাগে কাজ করার জন্য সরকারি ফিস ২৫০ টাকা হলেও জমি মালিকদের কাছ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১৫ থেকে ৫০ হাজার, কখনও বা এর চেয়ে বেশি পরিমাণে টাকা নেয়া হয়। এ টাকা দিতে জমি/ফ্ল্যাট মালিকদের বাধ্য করা হয়। জমি মালিকদের কাছ থেকে আদায়কৃত এসব টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের গল্প। ভূমি অফিস সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে জমি মালিকের মালিকানার স্বপক্ষে দাখিলকৃত কাগজপত্র যত স্বচ্ছ ও নির্ভুলই হোক না কেন, নামজারি করিয়ে নেয়া অসাধ্য বলা যেতে পারে। এ নিয়ে ভূমি অফিসগুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে প্রায়শই ভূমি মালিকদের বচসা হয়। আপনি জমির মালিক হিসেবে ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী, দাপটশালী হোন না কেন, ভূমি অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের নগদ নারায়ণ না দিয়ে শুধু সরকারি ফিস ২৫০ টাকা দিয়ে নামজারি করিয়ে নেয়া অসাধ্য বটে। তাছাড়া এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির সংখ্যাও খুবই নগণ্য, যারা মাত্র কয়েক হাজার টাকা খরচাপাতি করেই নামজারি করিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য আপনার সঙ্গে যদি ভূমি অফিসের বড়কর্তার সঙ্গে সখ্য থাকে অথবা আপনি যদি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি হোন তাহলে ভিন্ন কথা। আর একটা কথা মনে রাখবেন, অল্প টাকায় নামজারি করাতে চাইলে ভূমি অফিসে যাতায়াত করতে করতে আপনাকে কয়েক জোড়া জুতার তলানি ছিঁড়তে হবে।
উপজেলা ভূমি অফিস তথা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় হিসেবে বহুল পরিচিত এসব অফিসে অনুমোদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি একশ্রেণীর অসাধু দালাল ও উমেদার জমি মালিকদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকে। কখনও কখনও উমেদাররা জমি মালিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যাতে মনে হয় জমি/ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া একটা অপরাধের ব্যাপার। ভূমি অফিসের এসব দালাল চক্র এবং উমেদাররা জমি মালিকদের শুধু হয়রানি করেন তাই নয়, কখনও তারা নামজারি ও জমা ভাগের নথিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্রের পাতা ছিঁড়ে কিংবা তথ্য বিকৃতি করে জমি মালিকদের কাছ থেকে বাড়তি প্রণামি আদায় করার ফন্দিফিকিরও করেন। তাছাড়া উপজেলা ভূমি অফিসের প্রধান একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় প্রশাসনিক নানা ধরনের কাজকর্মে তাকে প্রায়শই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে জমি মালিকদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে বেশ বেগ পেতে হয় ভুক্তভোগীদের। জমিজমা সংক্রান্ত শত শত মামলা-মোকদ্দমার বিচারিক কাজ দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকার ফলে বিচারপ্রার্থী জমি মালিকদের খরচ যেমনিভাবে বাড়ে, তেমনি বাড়তি উৎকণ্ঠাও সহ্য করতে হয় তাদের। প্রশাসন ক্যাডারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পক্ষে জমি বিরোধ সংক্রান্ত এসব মামলা-মোকদ্দমা স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি করা আদৌ সম্ভব কি-না, তাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা দরকার।
বাংলাদেশ সচিবালয় এবং দুদকের এত কাছে অবস্থিত এ ভূমি অফিসের অনিয়ম আর দুর্নীতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে ভাবতে শেখায়, বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের ভূমি অফিসগুলোর অবস্থা আরও কতটা শোচনীয়। ভূমি অফিসগুলোর কর্তাব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম আর দুর্নীতিই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে সরকার কার্যত এখনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন যেমন জরুরি, তেমনি ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যপনা প্রতিরোধ করাও সময়ের দাবি। জমি সংক্রান্ত ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তিসহ জমি মালিকরা ফি বছর ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার জন্য নামজারি ও জমা ভাগ করতেই ভূমি অফিসে যাতায়াত করেন বেশি। নামজারি এবং জমা ভাগের খতিয়ান পেতে এবং ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতেও যদি জমি মালিকদের দফায় দফায় ঘুষ দিতে হয়, তাহলে বলতে হয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বসে বসে ঘুষের টাকা ভাগবাটোয়ারা করা ছাড়া আর কি কোনো কাজ নেই?
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী; আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
দুদক থেকে প্রায় অর্ধকিলোমিটার আর বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে ৫০০ গজ পশ্চিম-উত্তর দিকে তেজগাঁও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়। এ কার্যালয়ে প্রতি কর্মদিবসে প্রায় শতাধিক ভূমি মালিক ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে যাতায়াত করেন। আগন্তুক এসব সহজ-সরল মনের ভূমি মালিক এবং তাদের প্রতিনিধিদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। জমির মালিকানা তথা ভূমি নিয়ে উদ্ভূত বিরোধকে কেন্দ্র করে ভূমি মালিকরা যতটা না কষ্ট সহ্য করেন, তার চেয়েও ঢের বেশি হয়রানি হতে হয় এখানে কর্মরত ব্যক্তিদের দ্বারা। ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত পরামর্শ এবং সহযোগিতার নামে দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঘাটে ঘাটে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে প্রণামি আদায় করে থাকেন।
এ ভূমি অফিসে ভুক্তভোগী এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তিনি কীভাবে এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা চরমভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, তার সদ্য কেনা একটি ফ্ল্যাটের নামজারি (অনেকে মিউটেশন বা খারিজ বলেন) করার জন্য এ ভূমি অফিসের এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেন। সেই ব্যক্তি সঠিকভাবে নামজারি করেছেন কিনা তা যাচাই করার জন্য এ অফিসের রেকর্ড রুমে মূল নথি দেখার চেষ্টা করেন। ওই ব্যক্তি তার নামজারি খতিয়ানের নথিটি দেখার জন্য সহকারী কমিশনার ভূমি, তেজগাঁও কার্যালয়ের রেকর্ড কিপারের শরণাপন্ন হলে তিনি নথিটি দেখিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ১ হাজার টাকা দাবি করেন। ফ্ল্যাট মালিক ১ হাজার টাকা দিয়ে মূল নথিটি দেখতে চাইলে রেকর্ড কিপার তাকে পরের দিন সকালে আসতে বলেন। সেই ব্যক্তি পরের দিন সকালে এলে রেকর্ড কিপার তাকে বিকালে আসতে বলেন। সেই ব্যক্তি বিকালে এলে রেকর্ড কিপার তাকে দুদিন পরে আসতে বলেন। এভাবে এক সপ্তাহ ঘুরানোর পর রেকর্ড কিপার ওই ব্যক্তিকে বলেন নথিটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এত ভিড়ের মধ্য থেকে নথিটি খুঁজতে আরও কয়েকদিন সময় এবং পারিশ্রমিক হিসেবে ২ হাজার টাকা লাগবে। সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাত ২ হাজার টাকা দিয়ে তাকে নথিটি দ্রুত খুঁজতে বলেন। বাড়তি এ টাকা পেয়ে রেকর্ড কিপার মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে নথিটি খুঁজে পান। শুধু রেকর্ড কিপার নয়, এ অফিসের প্রতিটি টেবিলে আপনার ন্যায্য ও যৌক্তিক কাজ করে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আপনার কাজটি প্রত্যাশিত সময়ে শেষ হবে না, অথবা হয়রানির শিকার হওয়ার পাশাপাশি আপনার নথিটি হয়তো আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনি না চাইলেও এখানে আপনাকে ঘুষ দিতে হবে। অবশ্য এ ঘুষকে সেলামি, প্রণামি, পারিশ্রমিক, বকশিশ, স্পিডমানি কিংবা অন্য নামেও ডাকা যায়।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের অন্যতম দায়িত্ব হল জমির মালিকের পক্ষে সব ধরনের কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্তে জমি বা ফ্ল্যাট মালিকের নামে প্রস্তাবিত জমি নামজারি ও জমা ভাগের আদেশ দেয়া। তেজগাঁওয়ের এ ভূমি অফিসে প্রতিদিন অসংখ্য নামজারি সংক্রান্ত ফাইল দেখভাল করতে হয়। প্রত্যেকটি ফাইল নামজারি এবং জমা ভাগে কাজ করার জন্য সরকারি ফিস ২৫০ টাকা হলেও জমি মালিকদের কাছ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১৫ থেকে ৫০ হাজার, কখনও বা এর চেয়ে বেশি পরিমাণে টাকা নেয়া হয়। এ টাকা দিতে জমি/ফ্ল্যাট মালিকদের বাধ্য করা হয়। জমি মালিকদের কাছ থেকে আদায়কৃত এসব টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের গল্প। ভূমি অফিস সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে জমি মালিকের মালিকানার স্বপক্ষে দাখিলকৃত কাগজপত্র যত স্বচ্ছ ও নির্ভুলই হোক না কেন, নামজারি করিয়ে নেয়া অসাধ্য বলা যেতে পারে। এ নিয়ে ভূমি অফিসগুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে প্রায়শই ভূমি মালিকদের বচসা হয়। আপনি জমির মালিক হিসেবে ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী, দাপটশালী হোন না কেন, ভূমি অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের নগদ নারায়ণ না দিয়ে শুধু সরকারি ফিস ২৫০ টাকা দিয়ে নামজারি করিয়ে নেয়া অসাধ্য বটে। তাছাড়া এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির সংখ্যাও খুবই নগণ্য, যারা মাত্র কয়েক হাজার টাকা খরচাপাতি করেই নামজারি করিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য আপনার সঙ্গে যদি ভূমি অফিসের বড়কর্তার সঙ্গে সখ্য থাকে অথবা আপনি যদি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি হোন তাহলে ভিন্ন কথা। আর একটা কথা মনে রাখবেন, অল্প টাকায় নামজারি করাতে চাইলে ভূমি অফিসে যাতায়াত করতে করতে আপনাকে কয়েক জোড়া জুতার তলানি ছিঁড়তে হবে।
উপজেলা ভূমি অফিস তথা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় হিসেবে বহুল পরিচিত এসব অফিসে অনুমোদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি একশ্রেণীর অসাধু দালাল ও উমেদার জমি মালিকদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকে। কখনও কখনও উমেদাররা জমি মালিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যাতে মনে হয় জমি/ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া একটা অপরাধের ব্যাপার। ভূমি অফিসের এসব দালাল চক্র এবং উমেদাররা জমি মালিকদের শুধু হয়রানি করেন তাই নয়, কখনও তারা নামজারি ও জমা ভাগের নথিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্রের পাতা ছিঁড়ে কিংবা তথ্য বিকৃতি করে জমি মালিকদের কাছ থেকে বাড়তি প্রণামি আদায় করার ফন্দিফিকিরও করেন। তাছাড়া উপজেলা ভূমি অফিসের প্রধান একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় প্রশাসনিক নানা ধরনের কাজকর্মে তাকে প্রায়শই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে জমি মালিকদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে বেশ বেগ পেতে হয় ভুক্তভোগীদের। জমিজমা সংক্রান্ত শত শত মামলা-মোকদ্দমার বিচারিক কাজ দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকার ফলে বিচারপ্রার্থী জমি মালিকদের খরচ যেমনিভাবে বাড়ে, তেমনি বাড়তি উৎকণ্ঠাও সহ্য করতে হয় তাদের। প্রশাসন ক্যাডারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পক্ষে জমি বিরোধ সংক্রান্ত এসব মামলা-মোকদ্দমা স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি করা আদৌ সম্ভব কি-না, তাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা দরকার।
বাংলাদেশ সচিবালয় এবং দুদকের এত কাছে অবস্থিত এ ভূমি অফিসের অনিয়ম আর দুর্নীতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে ভাবতে শেখায়, বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের ভূমি অফিসগুলোর অবস্থা আরও কতটা শোচনীয়। ভূমি অফিসগুলোর কর্তাব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম আর দুর্নীতিই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে সরকার কার্যত এখনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন যেমন জরুরি, তেমনি ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যপনা প্রতিরোধ করাও সময়ের দাবি। জমি সংক্রান্ত ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তিসহ জমি মালিকরা ফি বছর ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার জন্য নামজারি ও জমা ভাগ করতেই ভূমি অফিসে যাতায়াত করেন বেশি। নামজারি এবং জমা ভাগের খতিয়ান পেতে এবং ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতেও যদি জমি মালিকদের দফায় দফায় ঘুষ দিতে হয়, তাহলে বলতে হয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বসে বসে ঘুষের টাকা ভাগবাটোয়ারা করা ছাড়া আর কি কোনো কাজ নেই?
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী; আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
No comments