অর্থনীতিতে স্থবিরতা দূর হোক
আজ ২০১৫ ইংরেজি নববর্ষের শুরু। শুরুটা
হচ্ছে বৃহস্পতিবার; অতএব নতুন বছর মঙ্গলময় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী
দিনের কথা পরে হবে, যে বছরটি ফেলে এলাম সেটি কেমন গেল? রাজনৈতিকভাবে নয়,
অর্থনৈতিকভাবে। এ প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দেবেন। আমি ব্যবসায়িক
দৃষ্টিকোণ দিয়ে শুরু করি। গেল বছরের শেষের দিকের খবর হচ্ছে- ব্যাংকগুলো
তাদের খাতা ক্লোজ করছে বেশি বেশি খেলাপি ঋণ দিয়ে (ক্লাসিফাইড লোন)। এর অর্থ
কী? ২০১৪ সাল শুরু হয়েছিল প্রায় ৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ দিয়ে। শেষ হবে ১১
শতাংশের ওপর পরিমাণ খেলাপি ঋণ দিয়ে। এই হচ্ছে আশংকা। ব্যবসায়ীরা কখন ঋণ
খেলাপি হন? কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলেই তারা ব্যাংকের
টাকা চুক্তি মোতাবেক পরিশোধ করতে পারেন না। এটা বাস্তবতা। সাধারণভাবে
ব্যবসায় মন্দা আগে, খেলাপি ঋণ পরে। যদি তাই হয় তাহলে বলা যায় ব্যবসায়িক দিক
থেকে ২০১৪ সালটি ছিল মন্দার বছর। গত ২৫ ডিসেম্বরের খবর- ফ্ল্যাট বিক্রি
প্রায় বন্ধ। এ মুহূর্তে ১২,১৮৫টি ফ্ল্যাট যার মূল্য প্রায় ৯ হাজার কোটি
টাকা তা অবিক্রীত আছে বলে রিহ্যাব নেতারা পূর্তমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। আবাসন
শিল্পটির সঙ্গে প্রায় ২০০টি শিল্প জড়িত, জড়িত লাখ লাখ শ্রমিকের ভাগ্য। এ
খাতের মন্দা গলা টিপে ধরছে অনেক শিল্পকে। বলা হচ্ছে আয়কর ও দুদকের ভয়ে
ক্রেতারা ফ্ল্যাট ক্রয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না।
দেখা যাচ্ছে ভোক্তাপণ্যের বাজারও মন্দা। কিছু দিন আগে মল ও মীনাবাজার সমিতির নেতারা বলেছেন, তাদের বেচাকেনা কম। এর অর্থ হচ্ছে মধ্যবিত্ত মীনাবাজারে আগের মতো যাচ্ছেন না। মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতা ২০১৪ সালে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই সালে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার আশংকাজনকহারে কমেছে। যেখানে ১৩-১৪ শতাংশ ছিল সুদের হার, তা এখন মাত্র ৮-৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তের ওপর ২০১৪ সালের বাজেট ঘোষণাকালে এক প্রস্থ কর বেড়েছে। এসব কারণে বাজারে, মলে, শপিং সেন্টারে বেচাকেনা কম। ২০১৪ সালে কয়েকটি শিল্পের অবস্থা খারাপ বলে কাগজে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। চীনা প্রোডাক্টের অত্যাচারে গ্লাস শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত। শিপ-ব্রেকিং শিল্পের অবস্থা খারাপ। অনেক শিপ-ব্রেকিং শিল্প বন্ধ হয়েছে। শিপবিল্ডিং শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। এ শিল্পের পুরোধারা এখন ব্যাংকে ব্যাংকে দৌড়াচ্ছেন খেলাপি না হওয়ার জন্য। সুগার রিফাইনিং শিল্প মার খেয়েছে আগেই। তারা নিজেরাও মরেছে, স্থানীয় চিনি শিল্পকেও মার দিয়েছে। মূল্য পতনের কারণে বাংলাদেশ চিনি শিল্প সংস্থা লোকসানের মুখে। স্টিল মিলসের মধ্যে যারা বড় তারা চলছে, ছোট ও মাঝারিরা ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ধীরে ধীরে বাজার থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে। সুতা ও কাপড়ের বাজারে চলছে অনিশ্চয়তা। স্থানীয় বস্ত্র শিল্প হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। এদিকে শিল্পের জন্য গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই- ২০১৪ সালজুড়ে ছিল এ অবস্থা। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ২০১৪ সালজুড়ে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বেশি এ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান চোখে পড়েনি।
ব্যবসায়িক নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি আরও কিছু নেতিবাচক খবর আছে। যেমন রফতানি প্রবৃদ্ধির হার গেল নভেম্বরে আগের মাসের তুলনায় বাড়লেও ২০১৪ সালের শেষ পাঁচ মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধির হার নগণ্য। ২০১৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০১৪ সালের শেষ পাঁচ মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র দশমিক ৯২ শতাংশ। বলা হচ্ছে, পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ, অতএব সার্বিকভাবেও তাই। পোশাকের সঙ্গে যোগ হয়েছে হিমায়িত মাছ, চামড়া, কাঁচা পাট এবং আসবাবপত্র। তাহলে আর থাকে কী? বস্তুত রফতানির বাজার আমাদের এক পণ্যের। পোশাক ও বস্ত্র। এদিকে রফতানির বিপরীতে আমদানির প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। ২০১৪ সালের শেষের চার মাসে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ভাগ্য ভালো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের জিনিসের দামই বাড়তির দিকে। এরপরও আমদানির প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ। রফতানি কম আমদানি বেশি- এর ফল যা হওয়ার তাই। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালের শেষ চার মাসে এ ঘাটতি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায় পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। ২০১৪ সালের শেষ পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কর আদায় কম হয়েছে ১৪৮৪ কোটি টাকা। খবরে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে কম আদায় হয়েছে ভ্যাট। আয়কর আদায় মোটামুটি ভালো। ভোগ হ্রাস এবং বিনিয়োগ ঘাটতির ফলে রাজস্ব আদায়েও শ্লথগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের চিত্রও সুখকর নয়। ২০১৪ সালের জুলাই-অক্টোবর সময়ে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের মাত্র ১৩ শতাংশ। গেল বছরে এ হার ছিল ১৫ শতাংশ।
যেসব মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পায় তার মধ্যে ৬টি মন্ত্রণালয়
তাদের গড় ব্যয়ের তুলনায়ও কম খরচ করেছে। এ কারণে উন্নয়নের গতিতে একটা ছেদ পড়ছে। বিশেষত যেখানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ খুব বেশি লক্ষণীয় নয়।
এতসব নেতিবাচক খবরের মধ্যেও ২০১৪ সালের ভালো খবর আমার কাছে দুটি : মূল্যস্ফীতি ও চালের দাম। এ সালে মূল্যস্ফীতি গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিু স্তরে নেমে আসে। এখন তা ছয় শতাংশের মতো। এটা বিশাল অর্জন। এ অর্জন দুটি কারণে সম্ভব হয়েছে। প্রথমত বিশ্ববাজারে তেলের দামসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম ২০১৪ সালে হ্রাস পেয়েছে। এর সুবিধা আমরা পেয়েছি। দ্বিতীয়ত বছরজুড়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখে। গত দু-তিন বছর আগে ঋণ সম্প্রসারণ বেশি হওয়ার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি গ্রহণ করে, বিশেষ করে ১১-১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে। মূল্যস্ফীতি নিচু স্তরে থাকার ফলে সাধারণ মানুষ বেশ কিছুটা স্বস্তি পায়। বাজারে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এটা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই। চালের সরবরাহ ২০১৪ সালজুড়েই সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল। সরকারের গুদামে চালের স্টক যথেষ্ট ছিল। ২০১৪ সালে সরকার বহুদিন পর শ্রীলংকায় কয়েক হাজার টন চাল রফতানি করে। এতে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়নি। শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম-দুধ ও ফলমূলের দামেও চলতি বছরে (২০১৪) কোনো অস্বাভাবিক উত্থান-পতন পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, রোজার দিনেও ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে কোনো হুজ্জতি হয়নি। অথচ এটা প্রতিবছর হয়।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুটি খবর নিঃসন্দেহে ভালো খবর। ভালো খবর আরও একটি আছে। যেমন শিল্পায়ন। এ কথা সত্যি বিদ্যুতের অভাব আছে, গ্যাসের সমস্যা আছে, ঋণের ওপর সুদের হারের বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে শিল্পঋণে একটা ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়। ২০১৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে শিল্পঋণের সরবরাহ প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে যে, এটা সম্ভব হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ার ফলে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত ও প্রকৌশল খাতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। লক্ষণীয়, খবরে দেখলাম, শিল্পের প্রচলন পুঁজির (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) সরবরাহও এ সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বৃদ্ধির হার ৬৩ শতাংশ। এসব খবর ও তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শিল্প খাতে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে। এটা ধারণা করা হয়, যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তাহলে শিল্প বিনিয়োগ গতি পাবে। যদি দেশীয় বেসরকারি খাত এগিয়ে চলে তাহলে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে। শত হোক দেশীয় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে না গেলে বিদেশীরা আসবে কোন কারণে? বিদেশীরা দেশীয়দের মাধ্যমেই আসে। ইদানীং তারা পোর্টফলিও বিনিয়োগে আসছে-যাচ্ছে। আমরা চাই তারা ম্যানুফেকচারিংয়ে আসুক। এর পরিবেশ এখন কিছুটা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে রেমিটেন্সে বড় রকমের কোনো উত্থান পরিলক্ষিত হয়নি। তবে এ খাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে, যদিও এ হার আশানুরূপ নয়। রেমিটেন্সের বাজার বিদেশে মন্দাক্রান্ত। এরপরও রেমিটেন্স ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এদিকে আবার ডলারের মূল্য রয়েছে। ২০১৪ সালে ডলারের বিনিময় মূল্য বেশ স্থিতিশীল ছিল। ডলার নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হয়নি। বরং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য নিচের দিকেই স্থিতিশীল ছিল। এতদসত্ত্বেও রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। লক্ষণীয় আমাদের টাকা, ভারতীয় রুপি, পাকিস্তানি রুপির চোয়েও স্থিতিশীল। এটা একটা বড় অর্জনই বটে। আমদানি, রফতানি ও রেমিটেন্সের সঙ্গে জড়িত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ। এটা খুবই সন্তুষ্টির বিষয় যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ প্রতি মাসেই রেকর্ড ভঙ্গ করছে। বর্তমান বাজারমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ আমাদের ৬-৭ মাসের আমদানির প্রয়োজনীয় টাকার সমান, যেখানে সাধারণভাবে তিন মাসের সমপরিমাণ থাকলেই চলে। সাধারণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে। লক্ষণীয় আমাদের রিজার্ভ প্রতি মাসে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির হার কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধন্যবাদ তাদের ব্যবস্থাপনার জন্য। গভর্নর আতিউর রহমান এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। সার্বিক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে তার ভিত্তি শক্ত করছে। এবারও আশাবাদ, ৬ শতাংশের অনেক ওপরেই থাকবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। ২০১৪ পেছনে পড়েছে। সামনে ২০১৫ সাল। ইংরেজি নববর্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা, যুগান্তরের পাঠকদের শুভেচ্ছা।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
দেখা যাচ্ছে ভোক্তাপণ্যের বাজারও মন্দা। কিছু দিন আগে মল ও মীনাবাজার সমিতির নেতারা বলেছেন, তাদের বেচাকেনা কম। এর অর্থ হচ্ছে মধ্যবিত্ত মীনাবাজারে আগের মতো যাচ্ছেন না। মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতা ২০১৪ সালে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই সালে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার আশংকাজনকহারে কমেছে। যেখানে ১৩-১৪ শতাংশ ছিল সুদের হার, তা এখন মাত্র ৮-৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তের ওপর ২০১৪ সালের বাজেট ঘোষণাকালে এক প্রস্থ কর বেড়েছে। এসব কারণে বাজারে, মলে, শপিং সেন্টারে বেচাকেনা কম। ২০১৪ সালে কয়েকটি শিল্পের অবস্থা খারাপ বলে কাগজে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। চীনা প্রোডাক্টের অত্যাচারে গ্লাস শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত। শিপ-ব্রেকিং শিল্পের অবস্থা খারাপ। অনেক শিপ-ব্রেকিং শিল্প বন্ধ হয়েছে। শিপবিল্ডিং শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। এ শিল্পের পুরোধারা এখন ব্যাংকে ব্যাংকে দৌড়াচ্ছেন খেলাপি না হওয়ার জন্য। সুগার রিফাইনিং শিল্প মার খেয়েছে আগেই। তারা নিজেরাও মরেছে, স্থানীয় চিনি শিল্পকেও মার দিয়েছে। মূল্য পতনের কারণে বাংলাদেশ চিনি শিল্প সংস্থা লোকসানের মুখে। স্টিল মিলসের মধ্যে যারা বড় তারা চলছে, ছোট ও মাঝারিরা ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ধীরে ধীরে বাজার থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে। সুতা ও কাপড়ের বাজারে চলছে অনিশ্চয়তা। স্থানীয় বস্ত্র শিল্প হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। এদিকে শিল্পের জন্য গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই- ২০১৪ সালজুড়ে ছিল এ অবস্থা। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ২০১৪ সালজুড়ে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বেশি এ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান চোখে পড়েনি।
ব্যবসায়িক নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি আরও কিছু নেতিবাচক খবর আছে। যেমন রফতানি প্রবৃদ্ধির হার গেল নভেম্বরে আগের মাসের তুলনায় বাড়লেও ২০১৪ সালের শেষ পাঁচ মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধির হার নগণ্য। ২০১৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০১৪ সালের শেষ পাঁচ মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র দশমিক ৯২ শতাংশ। বলা হচ্ছে, পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ, অতএব সার্বিকভাবেও তাই। পোশাকের সঙ্গে যোগ হয়েছে হিমায়িত মাছ, চামড়া, কাঁচা পাট এবং আসবাবপত্র। তাহলে আর থাকে কী? বস্তুত রফতানির বাজার আমাদের এক পণ্যের। পোশাক ও বস্ত্র। এদিকে রফতানির বিপরীতে আমদানির প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। ২০১৪ সালের শেষের চার মাসে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ভাগ্য ভালো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের জিনিসের দামই বাড়তির দিকে। এরপরও আমদানির প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ। রফতানি কম আমদানি বেশি- এর ফল যা হওয়ার তাই। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালের শেষ চার মাসে এ ঘাটতি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায় পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। ২০১৪ সালের শেষ পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কর আদায় কম হয়েছে ১৪৮৪ কোটি টাকা। খবরে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে কম আদায় হয়েছে ভ্যাট। আয়কর আদায় মোটামুটি ভালো। ভোগ হ্রাস এবং বিনিয়োগ ঘাটতির ফলে রাজস্ব আদায়েও শ্লথগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের চিত্রও সুখকর নয়। ২০১৪ সালের জুলাই-অক্টোবর সময়ে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের মাত্র ১৩ শতাংশ। গেল বছরে এ হার ছিল ১৫ শতাংশ।
যেসব মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পায় তার মধ্যে ৬টি মন্ত্রণালয়
তাদের গড় ব্যয়ের তুলনায়ও কম খরচ করেছে। এ কারণে উন্নয়নের গতিতে একটা ছেদ পড়ছে। বিশেষত যেখানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ খুব বেশি লক্ষণীয় নয়।
এতসব নেতিবাচক খবরের মধ্যেও ২০১৪ সালের ভালো খবর আমার কাছে দুটি : মূল্যস্ফীতি ও চালের দাম। এ সালে মূল্যস্ফীতি গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিু স্তরে নেমে আসে। এখন তা ছয় শতাংশের মতো। এটা বিশাল অর্জন। এ অর্জন দুটি কারণে সম্ভব হয়েছে। প্রথমত বিশ্ববাজারে তেলের দামসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম ২০১৪ সালে হ্রাস পেয়েছে। এর সুবিধা আমরা পেয়েছি। দ্বিতীয়ত বছরজুড়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখে। গত দু-তিন বছর আগে ঋণ সম্প্রসারণ বেশি হওয়ার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি গ্রহণ করে, বিশেষ করে ১১-১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে। মূল্যস্ফীতি নিচু স্তরে থাকার ফলে সাধারণ মানুষ বেশ কিছুটা স্বস্তি পায়। বাজারে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এটা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই। চালের সরবরাহ ২০১৪ সালজুড়েই সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল। সরকারের গুদামে চালের স্টক যথেষ্ট ছিল। ২০১৪ সালে সরকার বহুদিন পর শ্রীলংকায় কয়েক হাজার টন চাল রফতানি করে। এতে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়নি। শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম-দুধ ও ফলমূলের দামেও চলতি বছরে (২০১৪) কোনো অস্বাভাবিক উত্থান-পতন পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, রোজার দিনেও ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে কোনো হুজ্জতি হয়নি। অথচ এটা প্রতিবছর হয়।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুটি খবর নিঃসন্দেহে ভালো খবর। ভালো খবর আরও একটি আছে। যেমন শিল্পায়ন। এ কথা সত্যি বিদ্যুতের অভাব আছে, গ্যাসের সমস্যা আছে, ঋণের ওপর সুদের হারের বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে শিল্পঋণে একটা ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়। ২০১৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে শিল্পঋণের সরবরাহ প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে যে, এটা সম্ভব হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ার ফলে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত ও প্রকৌশল খাতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। লক্ষণীয়, খবরে দেখলাম, শিল্পের প্রচলন পুঁজির (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) সরবরাহও এ সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বৃদ্ধির হার ৬৩ শতাংশ। এসব খবর ও তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শিল্প খাতে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে। এটা ধারণা করা হয়, যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তাহলে শিল্প বিনিয়োগ গতি পাবে। যদি দেশীয় বেসরকারি খাত এগিয়ে চলে তাহলে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে। শত হোক দেশীয় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে না গেলে বিদেশীরা আসবে কোন কারণে? বিদেশীরা দেশীয়দের মাধ্যমেই আসে। ইদানীং তারা পোর্টফলিও বিনিয়োগে আসছে-যাচ্ছে। আমরা চাই তারা ম্যানুফেকচারিংয়ে আসুক। এর পরিবেশ এখন কিছুটা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে রেমিটেন্সে বড় রকমের কোনো উত্থান পরিলক্ষিত হয়নি। তবে এ খাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে, যদিও এ হার আশানুরূপ নয়। রেমিটেন্সের বাজার বিদেশে মন্দাক্রান্ত। এরপরও রেমিটেন্স ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এদিকে আবার ডলারের মূল্য রয়েছে। ২০১৪ সালে ডলারের বিনিময় মূল্য বেশ স্থিতিশীল ছিল। ডলার নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হয়নি। বরং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য নিচের দিকেই স্থিতিশীল ছিল। এতদসত্ত্বেও রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। লক্ষণীয় আমাদের টাকা, ভারতীয় রুপি, পাকিস্তানি রুপির চোয়েও স্থিতিশীল। এটা একটা বড় অর্জনই বটে। আমদানি, রফতানি ও রেমিটেন্সের সঙ্গে জড়িত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ। এটা খুবই সন্তুষ্টির বিষয় যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ প্রতি মাসেই রেকর্ড ভঙ্গ করছে। বর্তমান বাজারমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ আমাদের ৬-৭ মাসের আমদানির প্রয়োজনীয় টাকার সমান, যেখানে সাধারণভাবে তিন মাসের সমপরিমাণ থাকলেই চলে। সাধারণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে। লক্ষণীয় আমাদের রিজার্ভ প্রতি মাসে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির হার কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধন্যবাদ তাদের ব্যবস্থাপনার জন্য। গভর্নর আতিউর রহমান এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। সার্বিক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে তার ভিত্তি শক্ত করছে। এবারও আশাবাদ, ৬ শতাংশের অনেক ওপরেই থাকবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। ২০১৪ পেছনে পড়েছে। সামনে ২০১৫ সাল। ইংরেজি নববর্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা, যুগান্তরের পাঠকদের শুভেচ্ছা।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
No comments