যেভাবে বদলে গেল গ্রামটি by সাঈদা ইসলাম
পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের গ্রামটি একসময় কুখ্যাত ছিল চোরাচালানের রুট হিসেবে (ছবি-১পটিয়ার
কোলাগাঁওয়ে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিনের কারখানায় কাজ
করছেন এক শ্রমিক। এই এলাকায় জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বদলে
গেছে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের ভাগ্যl সৌরভ দাশ ছবি-২জাহাজ নির্মাণ কারখানায় কাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন শ্রমিকেরাl প্রথম আলো) অভাবের
কারণে সপ্তম শ্রেণিতেই পড়ার পাট চুকাতে হয়েছিল পটিয়া উপজেলার লাখেরা
গ্রামের আবদুর রশীদকে। তিন বেলা খাবার জোগাতে বাবার পাশাপাশি কাজে নামতে
হয় তাঁকেও। তবে ভাগ্য ভালো রশীদের। বাবা আবদুল কাদেরের মতো গ্রাম ছেড়ে
কাজের সন্ধানে দূরে যেতে হয়নি তাঁকে। নিজ গ্রামেই এখন জাহাজ তৈরির কাজ
করছেন তিনি। সঙ্গে কাজ করছেন ছোট ভাইও। এক যুগ আগের স্মৃতি হাতড়ে আবদুর
রশীদ বলেন, ‘একসময় গ্রামে তেমন কাজ ছিল না। নদী পার হয়ে শহরে কাজ খুঁজতে
যেতেন বাবা। সে সময় খেয়ে না–খেয়ে কষ্টে দিন কেটেছে। এখন নিজের গ্রামেই কাজ
করছি আমরা। বাবাও জাহাজ মেরামতের কাজ করছেন। আগের চেয়ে ভালো আছি। পরিবারের
ছোট দুই ভাইবোনকে পড়াচ্ছি।’ কর্ণফুলী নদীর তীরে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায়
ভাগ্য বদলাচ্ছে সংলগ্ন গ্রামগুলোর। এর একটি উদাহরণ লাখেরা গ্রাম। পটিয়া
উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের গ্রামটি একসময় কুখ্যাত ছিল চোরাচালানের রুট
হিসেবে। আর এখন জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের
জন্য একনামেই পরিচিত গ্রামটি। এসব গ্রামে তৈরি জাহাজ এখন ভেসে বেড়াচ্ছে
দেশ-বিদেশের নদী-সাগরে। কোলাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শামসুল
ইসলাম বলেন, লাখেরা গ্রামের নদীতীর একসময় ডাকাতদের অভয়ারণ্য ছিল। পণ্যবাহী
বিভিন্ন নৌকায় ডাকাতি করে মালামাল এখানে নিয়ে আসত ডাকাতেরা। এ ছাড়া এ পথ
দিয়ে চোরাচালানের পণ্যও আনা–নেওয়া হতো একসময়। তবে এখন আর সেদিন নেই।
শুধু লাখেরাই নয়, কর্ণফুলীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা ধীরে ধীরে ভাগ্য
বদলে দিচ্ছে আরও অনেক গ্রামের। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে শুরু থেকেই কাজ
করছেন মো. ইব্রাহিম। বর্তমানে তিনি তদারক কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম নগরের
কর্নেলহাট থেকে আসা–যাওয়া করেন প্রতিদিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অভাবী এ
গ্রাম সম্পর্কে কুখ্যাতি ছিল। কাজ শুরুর প্রথম দিকেও নির্ভয়ে চলাফেরা করতে
পারতাম না। সে সময় চুরি ছিনতাইও হতো। তবে আস্তে আস্তে এ চিত্র বদলে
গেছে।’
অভাব জয়: লাখেরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২ বছর আগেও গ্রামের অধিবাসীদের বেশির ভাগেরই নির্দিষ্ট কোনো আয়ের রাস্তা ছিল না। অধিকাংশই ছিল একফসলি জমি। জোয়ারের কারণে ফসলও ভালো হতো না। তাই বছরের অর্ধেক সময়ই কাজের খোঁজে গ্রামের বাইরে থাকতে হতো পুরুষদের। অনেকে চিংড়ি পোনা ধরে কিংবা নৌকা চালিয়ে পেট চালাতেন। কাজের অভাবে উঠতি বয়সের তরুণেরা অলস সময় কাটাত। ধীরে ধীরে ওই গ্রামের নদীর তীরে জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ আশপাশের ইউনিয়নগুলোতে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় গ্রামবাসীর কর্মহীনতা ঘুচেছে। উপার্জন বেড়েছে, বাড়ছে শিক্ষার হার, ও জীবনযাত্রার মান। গ্রামের তরুণ-যুবকদের প্রায় সবাই এ কাজে জড়িত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূলত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে ঘিরে বদলে গেছে পাঁচ হাজার অধিবাসীর লাখেরা গ্রামের ভাগ্য। দেশ–বিদেশের জন্য জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করে নিজেদের অভাব দূর করছেন গ্রামের বাসিন্দারা। ওয়েস্টার্ন মেরিন ছাড়াও নূর এ মদিনা ও মক্কা মেরিন শিপইয়ার্ড নামে জাহাজ মেরামতকারী দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখানে। সংখ্যায় কম হলেও গ্রামের অনেকেই সেখানে কাজ করছেন। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এই শিপইয়ার্ডে শ্রমিকের সংখ্যা সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজার। এর অর্ধেকই লাখেরা গ্রামের মানুষ। এ ছাড়া শিকলবাহা, কোলাগাঁওসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের বাসিন্দারাও কাজ করছেন এখানে। ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির পরিসর দিনে দিনে বেড়েছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কর্মসংস্থানও। যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অস্থায়ী শ্রমিক পদে কাজ করছেন বাসিন্দারা। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও লাখেরা গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন জানান, তাঁর নিজের ও তিন চাচার পরিবারের প্রায় সবাই এ পেশায় জড়িত। গত ১০ বছরে একটু একটু করে অভাব দূর হচ্ছে তাঁদের। একসময় মাটির ঘরে বাস করতেন। এখন সেমিপাকা ঘর তুলেছেন। গত রমজানে কিনেছেন রেফ্রিজারেটর (ফ্রিজ)। পাশেই তাঁর চাচা পাকা বাড়ি তুলছেন। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকায় গ্রামের অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবকও কাজ করছেন এখানে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা মো. নাজিমউদ্দিন তাঁদের একজন। ওয়েস্টার্ন মেরিনে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করার পাশাপাশি নিজের গ্রামে মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। বাইরে থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু বসতঘর তুলে ভাড়াও দিয়েছেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামের আরও কয়েকজন এ পন্থায় আয়ের রাস্তা করেছেন। গ্রামবাসীর ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বাড়ায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের দোকানও।
বিদ্যালয়মুখী শিশুরা: লাখেরা গ্রামে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে আটটি। উচ্চবিদ্যালয় একটি। এগুলোতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, কমছে ঝরে পড়ার হার। সকাল হলেই লাখেরা গ্রামে দল বেঁধে বিদ্যালয়ের পথ ধরে শিশুরা। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ানোর স্বপ্ন তাদের চোখ–মুখে। আর আগামী প্রজন্মের সোনালি ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় রয়েছে পরিবারগুলোও। কর্মসংস্থান তাঁদের এ স্বপ্ন জুগিয়েছে বলে মনে করেন লাখেরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানিক কিশোর মালাকার। ২২ বছর ধরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছিল অতিদরিদ্র। পেটের দায়ে অনেককেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে। একসময় চিংড়ি আহরণের মৌসুমে স্কুলে শিক্ষার্থীদের খঁুজে পাওয়া যেত না। এখন দিন বদলেছে। শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার পর অভাব কমেছে। এখন সাড়ে পাঁচ শ শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে পড়ছে।’ এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হারও ৯৫ শতাংশ বলে তিনি জানান। এ ছাড়া গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী পাশের পিডিবি উচ্চবিদ্যালয়েও পড়ছে।
অভাব জয়: লাখেরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২ বছর আগেও গ্রামের অধিবাসীদের বেশির ভাগেরই নির্দিষ্ট কোনো আয়ের রাস্তা ছিল না। অধিকাংশই ছিল একফসলি জমি। জোয়ারের কারণে ফসলও ভালো হতো না। তাই বছরের অর্ধেক সময়ই কাজের খোঁজে গ্রামের বাইরে থাকতে হতো পুরুষদের। অনেকে চিংড়ি পোনা ধরে কিংবা নৌকা চালিয়ে পেট চালাতেন। কাজের অভাবে উঠতি বয়সের তরুণেরা অলস সময় কাটাত। ধীরে ধীরে ওই গ্রামের নদীর তীরে জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ আশপাশের ইউনিয়নগুলোতে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় গ্রামবাসীর কর্মহীনতা ঘুচেছে। উপার্জন বেড়েছে, বাড়ছে শিক্ষার হার, ও জীবনযাত্রার মান। গ্রামের তরুণ-যুবকদের প্রায় সবাই এ কাজে জড়িত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূলত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে ঘিরে বদলে গেছে পাঁচ হাজার অধিবাসীর লাখেরা গ্রামের ভাগ্য। দেশ–বিদেশের জন্য জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করে নিজেদের অভাব দূর করছেন গ্রামের বাসিন্দারা। ওয়েস্টার্ন মেরিন ছাড়াও নূর এ মদিনা ও মক্কা মেরিন শিপইয়ার্ড নামে জাহাজ মেরামতকারী দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখানে। সংখ্যায় কম হলেও গ্রামের অনেকেই সেখানে কাজ করছেন। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এই শিপইয়ার্ডে শ্রমিকের সংখ্যা সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজার। এর অর্ধেকই লাখেরা গ্রামের মানুষ। এ ছাড়া শিকলবাহা, কোলাগাঁওসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের বাসিন্দারাও কাজ করছেন এখানে। ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির পরিসর দিনে দিনে বেড়েছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কর্মসংস্থানও। যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অস্থায়ী শ্রমিক পদে কাজ করছেন বাসিন্দারা। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও লাখেরা গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন জানান, তাঁর নিজের ও তিন চাচার পরিবারের প্রায় সবাই এ পেশায় জড়িত। গত ১০ বছরে একটু একটু করে অভাব দূর হচ্ছে তাঁদের। একসময় মাটির ঘরে বাস করতেন। এখন সেমিপাকা ঘর তুলেছেন। গত রমজানে কিনেছেন রেফ্রিজারেটর (ফ্রিজ)। পাশেই তাঁর চাচা পাকা বাড়ি তুলছেন। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকায় গ্রামের অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবকও কাজ করছেন এখানে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা মো. নাজিমউদ্দিন তাঁদের একজন। ওয়েস্টার্ন মেরিনে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করার পাশাপাশি নিজের গ্রামে মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। বাইরে থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু বসতঘর তুলে ভাড়াও দিয়েছেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামের আরও কয়েকজন এ পন্থায় আয়ের রাস্তা করেছেন। গ্রামবাসীর ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বাড়ায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের দোকানও।
বিদ্যালয়মুখী শিশুরা: লাখেরা গ্রামে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে আটটি। উচ্চবিদ্যালয় একটি। এগুলোতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, কমছে ঝরে পড়ার হার। সকাল হলেই লাখেরা গ্রামে দল বেঁধে বিদ্যালয়ের পথ ধরে শিশুরা। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ানোর স্বপ্ন তাদের চোখ–মুখে। আর আগামী প্রজন্মের সোনালি ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় রয়েছে পরিবারগুলোও। কর্মসংস্থান তাঁদের এ স্বপ্ন জুগিয়েছে বলে মনে করেন লাখেরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানিক কিশোর মালাকার। ২২ বছর ধরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছিল অতিদরিদ্র। পেটের দায়ে অনেককেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে। একসময় চিংড়ি আহরণের মৌসুমে স্কুলে শিক্ষার্থীদের খঁুজে পাওয়া যেত না। এখন দিন বদলেছে। শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার পর অভাব কমেছে। এখন সাড়ে পাঁচ শ শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে পড়ছে।’ এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হারও ৯৫ শতাংশ বলে তিনি জানান। এ ছাড়া গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী পাশের পিডিবি উচ্চবিদ্যালয়েও পড়ছে।
No comments