সুন্দরবন লড়ছে by ইফতেখার মাহমুদ
(লোনা
পানির কারণে সুন্দরবনের মাটিতে অক্সিজেন কম থাকে। এই বনের বেশির ভাগ
গাছপালা নিঃশ্বাস নেয় শ্বাসমূল দিয়ে। ৯ ডিসেম্বর তেলবাহী জাহাজডুবিতে এসব
শ্বাসমূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরই মধ্যে তেল লেপ্টে থাকা মাটি ফুঁড়ে নতুন
শ্বাসমূল জেগে উঠছে। গজাচ্ছে নতুন চারা। ২৪ ডিসেম্বর সকালে জয়মিণঘোল এলাকা
থেকে তোলা ছবি l জিয়া ইসলাম) আন্ধারমানিক
খালের দুই পাড়জুড়ে কালো কার্পেটের মতো ফার্নেস তেলের প্রলেপ। গাছ আর
লতাগুলোর অর্ধেক শরীরে কেউ যেন ব্রাশ দিয়ে তেল মাখিয়ে দিয়েছে। শত শত
শ্বাসমূলে তেল যেন আলকাতরার মতো লেপ্টে আছে। সুন্দরবনকে এমন অসুন্দর সাজে
সাজানোর জন্য দায়ী কে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে বনের ধারের খালপাড়ে একরাশি
শ্বাসমূলে গিয়ে চোখ আটকে গেল। পাড়ের দিকে কিছুটা এগোতেই শ্বাসমূলগুলোর
মাথা দিয়ে হালকা সবুজাভ কী যেন দেখা যাচ্ছিল। ট্রলারটি নিয়ে আরও সামনে
যেতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন গ্যারি সিগিনাকা। এ তো দেখি, তেলদূষণে
মৃতপ্রায় শ্বাসমূল ভেদ করে নতুন শ্বাসমূল গজাচ্ছে! জাতিসংঘ দলের সঙ্গে আসা
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সামুদ্রিক ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা নোয়ার বিশেষজ্ঞ
গ্যারির কণ্ঠ থেকে আনমনেই বেরিয়ে এল ‘অ্যামেজিং (অভাবনীয়), স্টিল দিজ
ফরেস্ট ট্রাইং টু সারভাইভ (বনটি এখনো বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে)।’
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ মাসুদুর রহমান জানালেন, নতুন করে শ্বাসমূল গজানো গাছটির নাম ‘সাইলা’। শ্বাসমূলে তেলের আবরণের কারণে অন্য গাছগুলোর পক্ষে এখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। তবে সাইলা গাছের মতো যাদের বিকল্প শ্বাসমূল গজানোর ক্ষমতা থাকবে, তারাই ভালোমতো টিকবে।
দুই বিশেষেজ্ঞর সঙ্গে একমত হয়েছেন দলের অন্যরাও। তাঁরা বললেন, সিডর ও আইলার আঘাতে সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও মানুষকে বাঁচিয়েছে। অথচ মানুষের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হলো সুন্দরবন। তবে সুন্দরবন আবারও ক্ষতি কাটিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের আটটি দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘের ২৫ সদস্যের দলটি টানা পাঁচ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে। ২৩ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্যালা নদী ও পশুর নদের বিভিন্ন স্থানে তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব নিয়ে জরিপ চালায়। যে পৌনে দুই লাখ লিটার তেল এখনো সুন্দরবনের নদীর পানিতে মিশে আছে এবং পাড়ে ও গাছে লেগে থাকা তেল কীভাবে অপসারণ করা যায়, সেই পরামর্শ দিতেই সরকারের আমন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ দলটির বাংলাদেশে আসা।
এই পাঁচ দিনে বিশেষজ্ঞ দলটি যেমন তেল ছড়িয়ে পড়ার দুই সপ্তাহ পরেও বনের বিভিন্ন স্থানে তেল লেগে থাকতে দেখেছে, তেমনি শতাধিক প্রজাতির বন্য প্রাণীকে বনে ঘুরে বেড়াতেও দেখেছে। শ্যালা ও পশুর নদ তো বটেই, বনের যেসব খালে তেল ছড়িয়েছে, সেখানেও সরেজমিনে গিয়েছে দলটি। মাটিতে হাজারো শ্বাসমূলের বাধা, কর্দমাক্ত মাটি আর হরেক রকম বন্য প্রাণীর ভয়কে সঙ্গী করেই সুন্দরবনের ক্ষতি পর্যবেক্ষণে নামে দলটি।
তবে বিশেষজ্ঞ দলটি সরেজমিনে যখন দেখতে পায় যে পশুর ও শ্যালা নদীতে তেল ছড়ালেও তা উপচে বনের ভেতরে ঢোকেনি, তখন তারা রীতিমতো খুশিই হয়েছে। বনের উঁচু পাড় টপকে তেল পৌঁছাল কি না, তা পরীক্ষা করতে গবেষক দল বনের ভেতরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে ঘুরে দেখে।
জাতিসংঘের দুর্যোগ জরিপ ও সমন্বয়বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিসিএর প্রতিনিধি পার এনডার্স বার্থলিন তো বলেই ফেললেন, সুন্দরবনের আরও বড় ক্ষতি হতে পারত। সাউদার্ন সেভেন নামের তেলের ট্যাঙ্কারটি গত ৯ ডিসেম্বর না ডুবে ২১ ডিসেম্বর ডুবলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসত। কারণ, ৯ ডিসেম্বর ছিল মরা কাটাল বা দুর্বল জোয়ারের সময়। আর ২১ ডিসেম্বর থেকে ভরা কাটাল শুরু হয়েছে। মরা কাটালের চেয়ে ভরা কাটালের জোয়ারের উচ্চতা ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে তেল মেশানো পানি বনের অনেক গভীরে প্রবেশ করত। আর সুন্দরবনের ভেতরে ওই তেল প্রবেশ করলে তা কাদার স্তরে প্রবেশ করে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারত।
২২ ডিসেম্বর সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা দিয়ে ওই দিনই বিকেল থেকে জাতিসংঘের দলটি কাজ শুরু করে। ছোট্ট একটি লঞ্চেই ছিল দলটির রাত্রিযাপন আর জরিপের ফলাফল মূল্যায়নের জন্য স্থাপন করা অস্থায়ী কার্যালয়। প্রতিদিনই ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা, কখনো বা রাত একটা-দুটো পর্যন্ত চলে দলটির কাজ। বনের সম্ভাব্য তেল ছড়ানো এলাকার প্রায় পুরোটাই ছয়টি দলে ভাগ হয়ে বিশেষজ্ঞরা পর্যবেক্ষণ করেছেন। বাংলাদেশের ১২ জন বিশেষজ্ঞও জাতিসংঘের এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরবনে পৌঁছে বিশেষজ্ঞ দলটির প্রথম দিন কাটে মংলা বন্দরের কাছে পশুর নদে। পরদিন সকালে চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় পৌঁছায় তারা। হরিণটানা, তাম্বুলবুনিয়া, নন্দবালা, মৃগমারী, আন্ধারমানিক এলাকার বন আর খালের মধ্যে দলটি একটানা চষে বেড়ায়। নদী ও খালের পাড়ে লেগে থাকা কালো প্রলেপ তেল না কাদামাটি, তা নিশ্চিত হতে বিশেষজ্ঞরা বেলচা নিয়ে নদীর ধারে নেমে পড়েন।
চোখের দেখাতে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে ওই তেলের নমুনা বন থেকে বাক্সে ভরে পেট্রোবাংলায় পাঠান বিশেষজ্ঞরা। পানিতে দ্রবীভূত তেল, অক্সিজেনসহ অন্যান্য জৈব উপাদান কী পরিমাণে আছে, তা জানতে পানির নমুনা পাঠানো হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে। মাছের শরীরে তেল প্রবেশ করেছে কি না, তার পরীক্ষা অবশ্য নৌকায় বসেই করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন অ্যান্ড ফিশারিজের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে মাছের ময়নাতদন্ত (শরীর বৃত্তিয় পর্যবেক্ষণ) করা হয় লঞ্চে বসেই।
সরু খালের দুর্গম জায়গায় কতটুকু তেল ছড়িয়েছে আর বনের ভেতরে তেল আদৌ পৌঁছাল কি না, তা দেখতে জরিপ দলটি ব্যবহার করে মনুষ্যবিহীন ক্যামেরাওয়ালা উড়োযান বা ড্রোন ক্যামেরা। তেল ছড়ানোর পরপর বন্য প্রাণিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) ১২ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের তেল ছড়ানো এলাকায় ওই ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে জরিপ চালায়। আর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলটি ড্রোন ক্যামেরায় জরিপ চালায় ২৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ডব্লিউসিএস ও জাতিসংঘের ড্রোন ক্যামেরার জরিপের মাধ্যমে তোলা ভিডিও দেখে তেল ছড়ানো এলাকার পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করা হয়। এই তেল বনের কোথায় কোথায় এখনো লেগে আছে এবং কীভাবে তা অপসারণ করা যায়, তা-ও ওই জরিপ থেকে নির্ধারণ করা হবে বলে বিশেষজ্ঞ দলটি সিদ্ধান্ত নেয়।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলের নেতা ফিনল্যান্ড থেকে আসা এমিলিয়া ওয়ালস্টর্ন পুরো জরিপটি তদারক করেন। আর সমন্বয় করেন সুইডেন থেকে আসা পার এনডার্স বার্থলিন। তেল অপসারণের কাজে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান শেয়ারওয়াটার এনভায়রমেন্টাল ইমারজেন্সি সলিউশনের প্রধান নির্বাহী ও জাতিসংঘের পরামর্শক রায়ান হুইলারও ছিলেন এই দলে। জরিপ চলা অবস্থাতেই কানাডার এই নাগরিকের পরামর্শ নিয়ে বন বিভাগ তেল অপসারণের বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়। ২৭ ডিসেম্বর বিশেষজ্ঞ দলটি সুন্দরবন থেকে লঞ্চে করে ফিরে আসে খুলনায়। সেখানে একটি হোটেলে পাঁচ দিনের মাঠকর্মের ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনায় বসেন সবাই। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রতিনিধিরা ওই সভায় অংশ নেন। সুন্দরবন থেকে তেল অপসারণের হালনাগাদ অবস্থা জানাতে গিয়ে বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, এ পর্যন্ত তাঁরা স্থানীয় মানুষের মাধ্যমে সুন্দরবনের নদী থেকে সংগ্রহ করা ৬৮ হাজার ২০০ লিটার তেল কিনেছেন। ২২৪ জন বনজীবী এই তেল তাঁদের কাছে বিক্রি করেছেন।
বিশেষজ্ঞ দলের নেতা বনজীবীদের তেল তোলার কর্মযজ্ঞ দেখে ও শুনে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বললেন, শুধু প্রকৃতিই নয়, এখানকার মানুষও এই বনের বন্ধু। তাঁরাই ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনকে রক্ষা করেছেন।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ মাসুদুর রহমান জানালেন, নতুন করে শ্বাসমূল গজানো গাছটির নাম ‘সাইলা’। শ্বাসমূলে তেলের আবরণের কারণে অন্য গাছগুলোর পক্ষে এখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। তবে সাইলা গাছের মতো যাদের বিকল্প শ্বাসমূল গজানোর ক্ষমতা থাকবে, তারাই ভালোমতো টিকবে।
দুই বিশেষেজ্ঞর সঙ্গে একমত হয়েছেন দলের অন্যরাও। তাঁরা বললেন, সিডর ও আইলার আঘাতে সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও মানুষকে বাঁচিয়েছে। অথচ মানুষের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হলো সুন্দরবন। তবে সুন্দরবন আবারও ক্ষতি কাটিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের আটটি দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘের ২৫ সদস্যের দলটি টানা পাঁচ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে। ২৩ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্যালা নদী ও পশুর নদের বিভিন্ন স্থানে তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব নিয়ে জরিপ চালায়। যে পৌনে দুই লাখ লিটার তেল এখনো সুন্দরবনের নদীর পানিতে মিশে আছে এবং পাড়ে ও গাছে লেগে থাকা তেল কীভাবে অপসারণ করা যায়, সেই পরামর্শ দিতেই সরকারের আমন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ দলটির বাংলাদেশে আসা।
এই পাঁচ দিনে বিশেষজ্ঞ দলটি যেমন তেল ছড়িয়ে পড়ার দুই সপ্তাহ পরেও বনের বিভিন্ন স্থানে তেল লেগে থাকতে দেখেছে, তেমনি শতাধিক প্রজাতির বন্য প্রাণীকে বনে ঘুরে বেড়াতেও দেখেছে। শ্যালা ও পশুর নদ তো বটেই, বনের যেসব খালে তেল ছড়িয়েছে, সেখানেও সরেজমিনে গিয়েছে দলটি। মাটিতে হাজারো শ্বাসমূলের বাধা, কর্দমাক্ত মাটি আর হরেক রকম বন্য প্রাণীর ভয়কে সঙ্গী করেই সুন্দরবনের ক্ষতি পর্যবেক্ষণে নামে দলটি।
তবে বিশেষজ্ঞ দলটি সরেজমিনে যখন দেখতে পায় যে পশুর ও শ্যালা নদীতে তেল ছড়ালেও তা উপচে বনের ভেতরে ঢোকেনি, তখন তারা রীতিমতো খুশিই হয়েছে। বনের উঁচু পাড় টপকে তেল পৌঁছাল কি না, তা পরীক্ষা করতে গবেষক দল বনের ভেতরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে ঘুরে দেখে।
জাতিসংঘের দুর্যোগ জরিপ ও সমন্বয়বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিসিএর প্রতিনিধি পার এনডার্স বার্থলিন তো বলেই ফেললেন, সুন্দরবনের আরও বড় ক্ষতি হতে পারত। সাউদার্ন সেভেন নামের তেলের ট্যাঙ্কারটি গত ৯ ডিসেম্বর না ডুবে ২১ ডিসেম্বর ডুবলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসত। কারণ, ৯ ডিসেম্বর ছিল মরা কাটাল বা দুর্বল জোয়ারের সময়। আর ২১ ডিসেম্বর থেকে ভরা কাটাল শুরু হয়েছে। মরা কাটালের চেয়ে ভরা কাটালের জোয়ারের উচ্চতা ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে তেল মেশানো পানি বনের অনেক গভীরে প্রবেশ করত। আর সুন্দরবনের ভেতরে ওই তেল প্রবেশ করলে তা কাদার স্তরে প্রবেশ করে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারত।
২২ ডিসেম্বর সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা দিয়ে ওই দিনই বিকেল থেকে জাতিসংঘের দলটি কাজ শুরু করে। ছোট্ট একটি লঞ্চেই ছিল দলটির রাত্রিযাপন আর জরিপের ফলাফল মূল্যায়নের জন্য স্থাপন করা অস্থায়ী কার্যালয়। প্রতিদিনই ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা, কখনো বা রাত একটা-দুটো পর্যন্ত চলে দলটির কাজ। বনের সম্ভাব্য তেল ছড়ানো এলাকার প্রায় পুরোটাই ছয়টি দলে ভাগ হয়ে বিশেষজ্ঞরা পর্যবেক্ষণ করেছেন। বাংলাদেশের ১২ জন বিশেষজ্ঞও জাতিসংঘের এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরবনে পৌঁছে বিশেষজ্ঞ দলটির প্রথম দিন কাটে মংলা বন্দরের কাছে পশুর নদে। পরদিন সকালে চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় পৌঁছায় তারা। হরিণটানা, তাম্বুলবুনিয়া, নন্দবালা, মৃগমারী, আন্ধারমানিক এলাকার বন আর খালের মধ্যে দলটি একটানা চষে বেড়ায়। নদী ও খালের পাড়ে লেগে থাকা কালো প্রলেপ তেল না কাদামাটি, তা নিশ্চিত হতে বিশেষজ্ঞরা বেলচা নিয়ে নদীর ধারে নেমে পড়েন।
চোখের দেখাতে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে ওই তেলের নমুনা বন থেকে বাক্সে ভরে পেট্রোবাংলায় পাঠান বিশেষজ্ঞরা। পানিতে দ্রবীভূত তেল, অক্সিজেনসহ অন্যান্য জৈব উপাদান কী পরিমাণে আছে, তা জানতে পানির নমুনা পাঠানো হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে। মাছের শরীরে তেল প্রবেশ করেছে কি না, তার পরীক্ষা অবশ্য নৌকায় বসেই করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন অ্যান্ড ফিশারিজের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে মাছের ময়নাতদন্ত (শরীর বৃত্তিয় পর্যবেক্ষণ) করা হয় লঞ্চে বসেই।
সরু খালের দুর্গম জায়গায় কতটুকু তেল ছড়িয়েছে আর বনের ভেতরে তেল আদৌ পৌঁছাল কি না, তা দেখতে জরিপ দলটি ব্যবহার করে মনুষ্যবিহীন ক্যামেরাওয়ালা উড়োযান বা ড্রোন ক্যামেরা। তেল ছড়ানোর পরপর বন্য প্রাণিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) ১২ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের তেল ছড়ানো এলাকায় ওই ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে জরিপ চালায়। আর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলটি ড্রোন ক্যামেরায় জরিপ চালায় ২৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ডব্লিউসিএস ও জাতিসংঘের ড্রোন ক্যামেরার জরিপের মাধ্যমে তোলা ভিডিও দেখে তেল ছড়ানো এলাকার পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করা হয়। এই তেল বনের কোথায় কোথায় এখনো লেগে আছে এবং কীভাবে তা অপসারণ করা যায়, তা-ও ওই জরিপ থেকে নির্ধারণ করা হবে বলে বিশেষজ্ঞ দলটি সিদ্ধান্ত নেয়।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলের নেতা ফিনল্যান্ড থেকে আসা এমিলিয়া ওয়ালস্টর্ন পুরো জরিপটি তদারক করেন। আর সমন্বয় করেন সুইডেন থেকে আসা পার এনডার্স বার্থলিন। তেল অপসারণের কাজে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান শেয়ারওয়াটার এনভায়রমেন্টাল ইমারজেন্সি সলিউশনের প্রধান নির্বাহী ও জাতিসংঘের পরামর্শক রায়ান হুইলারও ছিলেন এই দলে। জরিপ চলা অবস্থাতেই কানাডার এই নাগরিকের পরামর্শ নিয়ে বন বিভাগ তেল অপসারণের বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়। ২৭ ডিসেম্বর বিশেষজ্ঞ দলটি সুন্দরবন থেকে লঞ্চে করে ফিরে আসে খুলনায়। সেখানে একটি হোটেলে পাঁচ দিনের মাঠকর্মের ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনায় বসেন সবাই। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রতিনিধিরা ওই সভায় অংশ নেন। সুন্দরবন থেকে তেল অপসারণের হালনাগাদ অবস্থা জানাতে গিয়ে বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, এ পর্যন্ত তাঁরা স্থানীয় মানুষের মাধ্যমে সুন্দরবনের নদী থেকে সংগ্রহ করা ৬৮ হাজার ২০০ লিটার তেল কিনেছেন। ২২৪ জন বনজীবী এই তেল তাঁদের কাছে বিক্রি করেছেন।
বিশেষজ্ঞ দলের নেতা বনজীবীদের তেল তোলার কর্মযজ্ঞ দেখে ও শুনে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বললেন, শুধু প্রকৃতিই নয়, এখানকার মানুষও এই বনের বন্ধু। তাঁরাই ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনকে রক্ষা করেছেন।
No comments