মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক
২০১৪
সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল বলে মন্তব্য করেছে
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল বেলা ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে
বাংলাদেশের ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী
পরিচালক সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৪ সালেও অপহরণ,
গুম, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-
অব্যাহত ছিল। বছরটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। যা
পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭২। এদিকে
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) একই দিনে অপর এক সংবাদ
সম্মেলনের মাধ্যমে ২০১৪ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে
জানিয়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে উল্লেখযোগ্য ৪৪ ঘটনার তুলনামূলক পর্যালোচনার
আলোকে সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে
প্রচারিত এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে সংবাদ
সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা ছিল
র্যাবের কতিপয় সদস্যের যোগসাজশে নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা
হয়েছে, ২০১৪ সালে বিনা বিচারে আটক, পুলিশের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর
ঘটনা কমেনি বিরোধী দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী গ্রেপ্তার, আটকসহ অতিমাত্রায় বল প্রয়োগ করেছে। এ বছরেও অনেকগুলো
নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী
বিএসএফের গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক। এছাড়া, ৫ই জানুয়ারি
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগে ও পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
পর্যালোচনায় ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের
অনুপস্থিতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। জাতীয় সম্প্রচার
নীতিমালা প্রণয়ন ও নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী
২০০৯ ও ২০১৩) গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ ও মতপ্রকাশের বাধা
হিসেবে দেখা হয়েছে। বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে প্রদান করে
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে
বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-কে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৪ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ার,
বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং
থানা-পুলিশসহ বিভিন্ন হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সব
ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১২৮ জনের। যশোর, সাতক্ষীরা, ঢাকাসহ দেশের
বিভিন্নস্থানে অভিযুক্তদের পায়ে গুলি করার একটি প্রবণতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। গুম-গুপ্তহত্যা ছিল উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
সদস্য পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি অনেকেরই। কোন
কোন ক্ষেত্রে গুম হওয়ার পর লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে বিভিন্ন
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৮৮ জন।
এর মধ্যে ১২ জন মুক্তি পেয়েছেন, ২৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং কারাগারে
পাঠানো হয়েছে ২ জনকে। বাকিদের এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত বছর জাতীয় সংসদে
‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩’ পাস করা হলেও আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। নির্যাতন এবং অন্যান্য
নিষ্ঠুর অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির আন্তর্জাতিক সনদে
বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও তা মানা হয়নি। আটক ও গ্রেপ্তারের পর বিভিন্ন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১৩ জন,
গ্রেপ্তারের আগে নিহত হন ২ জন, আত্মহত্যা করেছেন ১ জন। এছাড়া, কারা হেফাজতে
মারা যান ৬০ জন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগে ও পরে প্রায়
৬৬৪টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘাতে ১৪৭ জন নিহত এবং ৮৩৭৩ জন
আহত হয়েছেন। শুধু ১লা জানুয়ারি থেকে ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতায় মারা
গেছেন ২৪ জন। বছরটিতে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ সমাবেশে অনেকগুলো
হামলার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের
৭৬১টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, ১৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও
ভাঙচুর এবং মন্দির, উপাসনালয় ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে ২৪৭টি।
নির্বাচনের আগে ও পরে ১৩টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো
হয়েছে। বছরটিতে সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনসহ মোট ২৩৭টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে
বিএসএফের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন ১৬ জন, শারীরিক নির্যাতনে নিহত
হয়েছেন ১৬ জন এবং সীমান্ত থেকে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১১০ জন। বিভিন্ন
পত্রপত্রিকা ও আসক-এর তথ্যানুসন্ধানে এ পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ
সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তা নিরসনে কোন
উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ২০১৪ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা
ঘটেছে। ২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এছাড়া, পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ১
জনের এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও ১ সাংবাদিক। পোশাক কারখানায় বড় ধরনের বিপর্যয়
না ঘটলেও বেতন-বোনাস নিয়ে অসন্তোষ আর অস্থিরতা লেগে ছিল বছরজুড়ে।
বেতন-বোনাস না দিয়ে মালিকপক্ষ অনেক কারখানা বন্ধ করে দেয়। বছরটিতে অভিবাসী
শ্রমিকের ওপর নির্যাতন, আটক ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে। অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ার
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানব পাচার ও সমুদ্রপথে মৃত্যু। অক্টোবর মাসে দু’দফায়
থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গল থেকে বন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ১২২ জন
বাংলাদেশীকে। অন্যদিকে ১৭ই নভেম্বর মালয়েশিয়ায় পাচারকালীন সময়ে সেন্ট
মার্টিন উপকূল থেকে নারী-শিশুসহ ৫৯৫ জনকে আটক করে নৌবাহিনী। আদিবাসীদের
সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। উপরন্তু তাদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলার ঘটনা
ঘটেছে। ২০১৪ সালে চিকিৎসায় অবহেলা ও ত্রুটির কারণে বেশ কয়েকজন রোগীর
মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে ২০১৪ সালে। ১৪ই অক্টোবর চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ভবনের ৯ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন
নুরুন্নবী নামে এক রোগী। এছাড়া ঢাকা ও এর আশেপাশে এ সংক্রান্ত নানা ঘটনা
ঘটেছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ঝরে গেছে বহু প্রাণ। ৪ঠা আগস্ট পিনাক-৬
নামে একটি লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর ১১ শিশুসহ ৪৭ লাশ উদ্ধারের পর হঠাৎ করে ৬১
যাত্রী নিখোঁজ থাকা অবস্থায় উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেয়া হয়। ৯ই ডিসেম্বর
শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে
সুন্দরবন। এদিকে গতকাল বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস)
দুপুরে সংস্থাটির কার্যালয়ে এ অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সংবাদ
সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো. জালাল উদ্দিন
জানান, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ৫১ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের
ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে। তার মধ্যে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে উল্লেখযোগ্য ৪৪ ঘটনার
আলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তুলনামূলক চিত্র পাওয়া গেছে। এখানে দেখা যায়, গত
২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে ২৮টি এবং
কমেছে ১৬টি। গত বছরের তুলনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে
নারী ও শিশুধর্র্ষণ, গণধর্ষন, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন ও হত্যা, অপহরণ, শিশু ও
নারী পাচার, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও মৃত্যু বেশ উদ্বেগজনক। দেশের গণতন্ত্র
রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতার কারণে সামাজিক অস্থিতিশীলতায়
পারিবারিক কলহের জেরে আহত ও নিহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে, যা
জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। এছাড়াও ২০১৪ সালে সোনা চোরাচালান ও মাদকের
অবাধ প্রবেশাধিকার জাতিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
No comments