জাতির জনকের পুণ্যজন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি by তোফায়েল আহমেদ
আজ জাতির জনকের জন্মদিন। স্বাধীন
বাংলাদেশের বুকে বঙ্গবন্ধুর এবারের এই জন্মদিন সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দীর্ঘ
চৌত্রিশ বছর ধরে যে কলঙ্ক আমরা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তা থেকে মুক্ত হয়ে
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালীর ইতিহাস আজ কলঙ্কমুক্ত
হয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ ধরে জগদ্দল পাথরের মতো এই
অভিশাপ জাতির ওপর চেপে বসেছিল। আজ আমরা অনেকটাই ভারমুক্ত হয়েছি। দীর্ঘ
প্রায় তিন যুগ ধরে এই কলঙ্ক, এই গ্লানি আমরা বহন করেছি। বঙ্গবন্ধুর খুনী
এবং খুনীদের দোসর যারা তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল আমাদের প্রাণপ্রিয় দল,
বাংলাদেশের আপামর গণমানুষের দল, জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া দল জাতীয়
মুক্তি-সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কখনও
এককভাবে, কখনওবা মৈত্রীজোট গঠন করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমমনাদের
ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে-সংসদে কঠিন লড়াই-সংগ্রাম শেষে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরে
বাংলার মানুষের গণরায়ের ভিত্তিতে আমরা অভিশাপ মুক্ত হয়েছি। সমগ্র জাতি আজ
কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির জনকের শুভ পুণ্যজন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, আর তা হচ্ছে বাংলা ও বাঙালীর মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। তাঁর এই সাধনার শুরু ১৯৪৮ থেকে। ১৯৪৭-এ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালীরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হব। তাই '৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে গঠন করেছিলেন ছাত্রলীগ এবং '৪৯-এর জুনের ২৩ তারিখে আওয়ামী লীগ। এবং সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা আজ বিস্মৃত হয়েছি ভাষাআন্দোলনের প্রথম পর্ব '৪৮-এর মার্চের ১১ তারিখটি। '৫২-এর পূর্বে '৪৮-এর মার্চ মাসের ১১ তারিখটি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতো। আর এই পর্বের ভাষাআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়া থেকেই শাসক শ্রেণীর কোন অন্যায়কে তিনি আন-চ্যালেঞ্জ যেতে দেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ করাকে তিনি ন্যায়সঙ্গতজ্ঞান করতেন। বঙ্গবন্ধুর কৈশোর জীবনেই এর প্রমাণ মেলে। ১৯৩৯-এ তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সে সময় শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের স্কুল পরিদর্শনে আসা ও তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ দলের বচসা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংবর্ধনার পক্ষে এবং পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি একটি সফল সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। কিন্তু এক চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে পুলিশ কর্তৃক সাত দিনের জন্য কারারুদ্ধ হন। জীবনের প্রথম কারাবন্দী হওয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি দমে যাননি বরং আরও দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন। একই স্কুলে ছাত্র থাকাকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক উক্ত স্কুল পরিদর্শনে আসেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়ান এবং বলেন, "স্যার, আমাদের স্কুলের বোর্ডিংয়ের ছাদ ভাঙ্গা। বৃষ্টি হলেই ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ওটা আমরা ঠিক করে নিতে চাই।" কিশোর বঙ্গবন্ধুর বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে সোহরাওয়ার্দী সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, "আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার দাবি পূরণ করা হবে।" দাবি পূরণ হয়েছিল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই কিশোরকে তার ডাকবাংলোয় দেখা করতে বলেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে দেখা করলেন এবং দীক্ষা নিলেন এক নতুন জীবনের। যে জীবনের নাম রাজনীতি ও সংগ্রাম। বাল্যকাল ও কৈশোর জীবন থেকেই যে সংগ্রামের শুরু তা থেমে থাকেনি বরং কালক্রমে তা বিস্তৃত ও প্রসারিত হয়ে সমগ্র বাঙালী জাতির জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের এক মহৎ প্রচ্ছদপট এঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহামানব।
মনে পড়ে ১৯৭৩-এর সতেরোই মার্চের কথা। সেদিন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিবসে জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা শ্রদ্ধাভাজন জননেতা কমরেড মণি সিংহ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন।" চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনার কথা তিনি অবহিত হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, "যদিও আমাদের মতপার্থক্য ছিল তথাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে আমরা সমর্থন করবো কিনা।" এবং সেই সভায় তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তখন ধারণাটির বিরোধিতা করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে, স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জনগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় এবং এ ধরনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সেদিন মহান মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম নেতা কমরেড মণি সিংহ আরও বলেছিলেন, "আমি বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবন কামনা করি। কোন জনতা তাদের নেতা নির্বাচনে ভুল করে না। বাংলাদেশের জনগণও তাঁর পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং তাঁকে মুক্তিদাতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।" প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সকলেই একবাক্যে এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। কেননা বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালীর সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি তো সব সময় বলতেন, এমনকি দু'দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, "ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।" যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন জীবনের জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালীর জন্য তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালীর জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ যে ভালবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভিড় করে আসে। এমন মহামানবের সান্নিধ্য কেঁদেও আর পাব না কোনদিন, এমনটা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। এহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানম ির বাসভবনে বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, "আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী? উত্তরে বঞ্চিত বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, "জনগণের সার্বিক মুক্তি।" এরপর সাংবাদিকদের প থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, "আমি জন্মদিন পালন করি না-আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।" কত বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই তিনি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারী বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌরে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যৃ থেকেছেন। ধানমন্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় তখন ভাল একটি প্লট নেয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, "আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।"
নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করত। একবার এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, "একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে-আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।" নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। তা প্রতিফলিত হয়েছে, অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। ১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপে সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "বিশ্ব আজ দু'ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে"
মনে পড়ে ১৯৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় আমাকে তুলে ধরেছিলেন এবং তিনি নেতাকর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন তখন সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে সম্মানিত করে, মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে টেনে তুলে উন্নীত করেছিলেন জাতীয় নেতায়। ফলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে।
১৯৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখের কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে '৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, "৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেহ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।" জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচী। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরও বলেছিলেন, "আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আয়ুব খানও পারেনি-কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারি।" বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর এই ভালবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, "আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করিবারে।"
বঙ্গবন্ধুর কথা এবং বক্তৃতায় প্রায় সময়ই উদ্ধৃত হতো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের কবিতার চরণ। এত সাবলীল আর প্রাসঙ্গিকতায় তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতে হতো। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মধ্য মার্চের কথা। যখন এহিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে তখন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নজরুলের কবিতা থেকে বলতেন, "আমি নরকে বসিয়া হাসি মৃতু্যর হাসি।" কবিগুরুর কবিতা থেকে বলতেন, "চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।" সেসময় অগ্নিঝরা মার্চে একদিকে চলছে আলোচনার নামে এহিয়ার প্রহসন, অন্যদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি, সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কাজ পুর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিল নেতার অভয় মন্ত্র। এই মার্চেই টঙ্গীতে পাক সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল ভয়াল গর্জনে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। উত্তেজিত শ্রমিক শ্রেণীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান শেষে বিদ্রোহী কবিকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, "বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না...।" আশ্চর্যরকম অবলীলায় পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করে মৃ্ত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে তিনি এইসব কাব্যাংশ উচ্চারণ করে যেতেন।
১৯৭৫-এর জানুয়ারির ১১ তারিখের কথা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও জ্বলজ্বল করে। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। এদিন বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "... আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন, প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন। কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দু'বার হন না। জাতির পিতা হিসাবেই যে আমি তোমাদের ভালবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সৎ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালবাসবে। মনে রেখো তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানী মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী।" দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির জনক যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিনি "জনগণের বাহিনী" বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনা সদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সৎ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন, "মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হতে হবে মানুষ যখন।"
অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতাকর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী এক মতা ছিল তাঁর। ১৯৭২-এর ১৪ এপ্রিল, আমি তখন গ্যাস্ট্রিক-আলসারে আক্রান্ত হয়ে হলিফ্যামিলিতে চিকিৎসাধীন। আমার পাকস্থলীতে নালী-ঘায়ের অপারেশন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে এসেছেন। সস্নেহে আমার হাত ধরে, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। আমার একমাত্র কন্যা মুন্নী যখন ২য় শ্রেণীতে পড়ে তখন টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে শুভাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ছবি তুলতে ভালবাসতেন। ফটোগ্রাফার অনেকেই প্রশ্ন করতেন, "লিডার আপনি এতো ছবি তোলেন কেন?" বলতেন, "ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।" বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দু'টি গাড়ি থাকত। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ত। তখন এরকম স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ানো হঠাৎ একটি শিশু কত বয়স হবে সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলছে, "আস্সালামু আলাইকুম, মুজিব সাহেব!" তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি একজন রাষ্ট্রনায়কের, জাতির জনকের শিশুদের প্রতি কী অপার ভালবাসা, কী অপূর্ব মমত্ববোধ। এখন মনে হয়, "এখন এসব কল্পকথা, দূরের শোনা গল্প; তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প।"
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় আমরা সকলেই গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিলাম; অচেতন থেকে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলাম যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের। দীর্ঘ নয় মাস চৌদ্দ দিন কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে '৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সে সর্বকালের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক গণমহাসমুদ্রে তিনি বলেছিলেন, "সাত কোটি বাঙালিরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।" অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্চকিত হয়েছিলেন এই বলে যে, "কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছ, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে...।"
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা। আকাশের মতো উদার ছিল তাঁর হৃদয়। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে সমসাময়িক নেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের তাঁর তেজোময় ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য মতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন ভাস্বর। তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তাঁর একটা তহবিল থাকত আমার কাছে। এই তহবিল থেকে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের প্রতিপীয় লোকজনও ছিলেন। কিন্তু শর্ত ছিল যাদের অর্থ সাহায্য দেয়া হচ্ছে তাঁদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে, প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত, কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ, সময়ের এক চুল হেরফের হতো না, ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানাদিতে যেতেন। দলের নেতাকর্মী সকলের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাদের কাজের মর্যাদা দিতেন, ভালবেসে বুকে টেনে নিতেন। প্রচ রেগে গেলেও পরমুহূর্তেই শিশুর মতো শান্ত হয়ে যেতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দতা ছিল অপরিসীম, এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেয়ার অবিশ্বাস্য মতা ছিল তাঁর। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। মনে পড়ে ১৯৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন শ্রদ্ধাভাজন জননেতা শহীদ কামারুজ্জামান সাহেব। ঠিক ১৯৫৭তে করেছিলেন বিপরীত কাজটি অর্থাৎ মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না। বজ্রকণ্ঠের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয় বাগ্মী। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বক্তৃতায় বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি চয়ন যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। যেজন্য তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল "রাজনীতির কবি" হিসেবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, আর তা হচ্ছে বাংলা ও বাঙালীর মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। তাঁর এই সাধনার শুরু ১৯৪৮ থেকে। ১৯৪৭-এ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালীরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হব। তাই '৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে গঠন করেছিলেন ছাত্রলীগ এবং '৪৯-এর জুনের ২৩ তারিখে আওয়ামী লীগ। এবং সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা আজ বিস্মৃত হয়েছি ভাষাআন্দোলনের প্রথম পর্ব '৪৮-এর মার্চের ১১ তারিখটি। '৫২-এর পূর্বে '৪৮-এর মার্চ মাসের ১১ তারিখটি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতো। আর এই পর্বের ভাষাআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়া থেকেই শাসক শ্রেণীর কোন অন্যায়কে তিনি আন-চ্যালেঞ্জ যেতে দেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ করাকে তিনি ন্যায়সঙ্গতজ্ঞান করতেন। বঙ্গবন্ধুর কৈশোর জীবনেই এর প্রমাণ মেলে। ১৯৩৯-এ তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সে সময় শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের স্কুল পরিদর্শনে আসা ও তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ দলের বচসা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংবর্ধনার পক্ষে এবং পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি একটি সফল সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। কিন্তু এক চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে পুলিশ কর্তৃক সাত দিনের জন্য কারারুদ্ধ হন। জীবনের প্রথম কারাবন্দী হওয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি দমে যাননি বরং আরও দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন। একই স্কুলে ছাত্র থাকাকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক উক্ত স্কুল পরিদর্শনে আসেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়ান এবং বলেন, "স্যার, আমাদের স্কুলের বোর্ডিংয়ের ছাদ ভাঙ্গা। বৃষ্টি হলেই ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ওটা আমরা ঠিক করে নিতে চাই।" কিশোর বঙ্গবন্ধুর বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে সোহরাওয়ার্দী সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, "আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার দাবি পূরণ করা হবে।" দাবি পূরণ হয়েছিল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই কিশোরকে তার ডাকবাংলোয় দেখা করতে বলেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে দেখা করলেন এবং দীক্ষা নিলেন এক নতুন জীবনের। যে জীবনের নাম রাজনীতি ও সংগ্রাম। বাল্যকাল ও কৈশোর জীবন থেকেই যে সংগ্রামের শুরু তা থেমে থাকেনি বরং কালক্রমে তা বিস্তৃত ও প্রসারিত হয়ে সমগ্র বাঙালী জাতির জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের এক মহৎ প্রচ্ছদপট এঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহামানব।
মনে পড়ে ১৯৭৩-এর সতেরোই মার্চের কথা। সেদিন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিবসে জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা শ্রদ্ধাভাজন জননেতা কমরেড মণি সিংহ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন।" চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনার কথা তিনি অবহিত হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, "যদিও আমাদের মতপার্থক্য ছিল তথাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে আমরা সমর্থন করবো কিনা।" এবং সেই সভায় তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তখন ধারণাটির বিরোধিতা করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে, স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জনগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় এবং এ ধরনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সেদিন মহান মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম নেতা কমরেড মণি সিংহ আরও বলেছিলেন, "আমি বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবন কামনা করি। কোন জনতা তাদের নেতা নির্বাচনে ভুল করে না। বাংলাদেশের জনগণও তাঁর পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং তাঁকে মুক্তিদাতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।" প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সকলেই একবাক্যে এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। কেননা বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালীর সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি তো সব সময় বলতেন, এমনকি দু'দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, "ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।" যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন জীবনের জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালীর জন্য তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালীর জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ যে ভালবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভিড় করে আসে। এমন মহামানবের সান্নিধ্য কেঁদেও আর পাব না কোনদিন, এমনটা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। এহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানম ির বাসভবনে বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, "আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী? উত্তরে বঞ্চিত বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, "জনগণের সার্বিক মুক্তি।" এরপর সাংবাদিকদের প থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, "আমি জন্মদিন পালন করি না-আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।" কত বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই তিনি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারী বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌরে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যৃ থেকেছেন। ধানমন্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় তখন ভাল একটি প্লট নেয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, "আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।"
নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করত। একবার এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, "একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে-আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।" নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। তা প্রতিফলিত হয়েছে, অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। ১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপে সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "বিশ্ব আজ দু'ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে"
মনে পড়ে ১৯৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় আমাকে তুলে ধরেছিলেন এবং তিনি নেতাকর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন তখন সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে সম্মানিত করে, মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে টেনে তুলে উন্নীত করেছিলেন জাতীয় নেতায়। ফলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে।
১৯৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখের কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে '৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, "৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেহ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।" জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচী। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরও বলেছিলেন, "আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আয়ুব খানও পারেনি-কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারি।" বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর এই ভালবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, "আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করিবারে।"
বঙ্গবন্ধুর কথা এবং বক্তৃতায় প্রায় সময়ই উদ্ধৃত হতো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের কবিতার চরণ। এত সাবলীল আর প্রাসঙ্গিকতায় তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতে হতো। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মধ্য মার্চের কথা। যখন এহিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে তখন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নজরুলের কবিতা থেকে বলতেন, "আমি নরকে বসিয়া হাসি মৃতু্যর হাসি।" কবিগুরুর কবিতা থেকে বলতেন, "চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।" সেসময় অগ্নিঝরা মার্চে একদিকে চলছে আলোচনার নামে এহিয়ার প্রহসন, অন্যদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি, সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কাজ পুর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিল নেতার অভয় মন্ত্র। এই মার্চেই টঙ্গীতে পাক সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল ভয়াল গর্জনে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। উত্তেজিত শ্রমিক শ্রেণীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান শেষে বিদ্রোহী কবিকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, "বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না...।" আশ্চর্যরকম অবলীলায় পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করে মৃ্ত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে তিনি এইসব কাব্যাংশ উচ্চারণ করে যেতেন।
১৯৭৫-এর জানুয়ারির ১১ তারিখের কথা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও জ্বলজ্বল করে। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। এদিন বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "... আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন, প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন। কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দু'বার হন না। জাতির পিতা হিসাবেই যে আমি তোমাদের ভালবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সৎ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালবাসবে। মনে রেখো তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানী মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী।" দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির জনক যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিনি "জনগণের বাহিনী" বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনা সদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সৎ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন, "মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হতে হবে মানুষ যখন।"
অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতাকর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী এক মতা ছিল তাঁর। ১৯৭২-এর ১৪ এপ্রিল, আমি তখন গ্যাস্ট্রিক-আলসারে আক্রান্ত হয়ে হলিফ্যামিলিতে চিকিৎসাধীন। আমার পাকস্থলীতে নালী-ঘায়ের অপারেশন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে এসেছেন। সস্নেহে আমার হাত ধরে, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। আমার একমাত্র কন্যা মুন্নী যখন ২য় শ্রেণীতে পড়ে তখন টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে শুভাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ছবি তুলতে ভালবাসতেন। ফটোগ্রাফার অনেকেই প্রশ্ন করতেন, "লিডার আপনি এতো ছবি তোলেন কেন?" বলতেন, "ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।" বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দু'টি গাড়ি থাকত। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ত। তখন এরকম স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ানো হঠাৎ একটি শিশু কত বয়স হবে সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলছে, "আস্সালামু আলাইকুম, মুজিব সাহেব!" তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি একজন রাষ্ট্রনায়কের, জাতির জনকের শিশুদের প্রতি কী অপার ভালবাসা, কী অপূর্ব মমত্ববোধ। এখন মনে হয়, "এখন এসব কল্পকথা, দূরের শোনা গল্প; তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প।"
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় আমরা সকলেই গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিলাম; অচেতন থেকে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলাম যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের। দীর্ঘ নয় মাস চৌদ্দ দিন কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে '৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সে সর্বকালের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক গণমহাসমুদ্রে তিনি বলেছিলেন, "সাত কোটি বাঙালিরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।" অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্চকিত হয়েছিলেন এই বলে যে, "কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছ, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে...।"
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা। আকাশের মতো উদার ছিল তাঁর হৃদয়। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে সমসাময়িক নেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের তাঁর তেজোময় ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য মতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন ভাস্বর। তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তাঁর একটা তহবিল থাকত আমার কাছে। এই তহবিল থেকে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের প্রতিপীয় লোকজনও ছিলেন। কিন্তু শর্ত ছিল যাদের অর্থ সাহায্য দেয়া হচ্ছে তাঁদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে, প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত, কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ, সময়ের এক চুল হেরফের হতো না, ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানাদিতে যেতেন। দলের নেতাকর্মী সকলের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাদের কাজের মর্যাদা দিতেন, ভালবেসে বুকে টেনে নিতেন। প্রচ রেগে গেলেও পরমুহূর্তেই শিশুর মতো শান্ত হয়ে যেতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দতা ছিল অপরিসীম, এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেয়ার অবিশ্বাস্য মতা ছিল তাঁর। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। মনে পড়ে ১৯৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন শ্রদ্ধাভাজন জননেতা শহীদ কামারুজ্জামান সাহেব। ঠিক ১৯৫৭তে করেছিলেন বিপরীত কাজটি অর্থাৎ মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না। বজ্রকণ্ঠের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয় বাগ্মী। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বক্তৃতায় বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি চয়ন যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। যেজন্য তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল "রাজনীতির কবি" হিসেবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো।
No comments