এই দিনে দেখি জনকের মুখ by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
বিশ্বভুবনে এ তো প্রকৃতিরই অনিবার্যতা,
সময়ের পালা গড়িয়ে আসে দিনের পর দিন। আর আমাদের কাছেও তা অতি স্বাভাবিক,
স্বতঃস্ফূর্ত। তবু এর পরেও কিন্তু কথা থেকে থাকে।
এবং সেই
খানেতে ইতিহাস কথা কয়। তবে কী সেই কথা? মনে করি, সচেতন জন মাত্রেরই অবশ্য
করে জানা সে-সব জবাব। আবার বহমান ঐ মতো, এক চিহ্নিত দিনে কখন যে তা বিশেষ
'দিবসের গুরুত্বে', মাহাত্ম্যে উজ্জ্ব্বল হয়ে ওঠে।
মনে করি যে, তেমন করে আর বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, বছর ঘুরে আবারও এসেছে আজ বিশেষ সেই 'দিবস',_ আজ সতেরোই মার্চ; জাতির জনকের আজ জন্মদিন। 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি; সৌভাগ্য বলে মানি, সমকালীন আমাদেরই অতীব কাছের মানুষ_বঙ্গবন্ধু তিনি; পারিবারিক বংশনাম পরিচিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান।
আজকের এই দিনে দেশের হেথায় হোথায় এবং দেশের বাইরেতেও মেলাই সব অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্বাভাবিক যে, আবেগ থাকবে, একটা ভালোবাসা থাকবে এবং সেই তাঁকে নিয়ে আরো আরো জানবার আগ্রহ_ কৌতূহল থাকবে। তবে বিবেচনা করি যে, দিবসটি উদযানপন উপলক্ষে অবকাশ এসেছে_ নষ্ট-বিকৃত করে দেয়া, অসৎ কতিপয়ের বিরামহীন যত সব কুকীর্তি; এবং অপর দিকে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া প্রাসঙ্গিক অনেক নানান সম্পদ ঐশ্বর্য উদ্ধারের প্রয়াসে আমরা যেন আন্তরিক উদ্যোগী হয়ে উঠি। প্রশ্ন জাগে_এটি শুধুই কেবল শেখ মুজিবুর রহমান এই নামের মানুষটির জন্মদিন উদযাপন? মোটা দাগে সরাসরি আক্ষরিক শব্দার্থ হয়তো বা তাই। তবে দেশ বাংলার সড়কযাত্রায় অভিযাত্রী যাঁরা, তাঁরা অবগত কথাটার ব্যঞ্জনা কত গভীরে, বহন করে কী সেই মহৎ ইতিহাস। সেইখানে শেখ মুজিবে/বঙ্গবন্ধুতে আর লাড় নেয়া বাংলাদেশে যেমন একাত্মায় মেশামেশি। এবং কালের পালা-বদলে তিনিই তো হয়ে ওঠেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কোটি বাঙালির 'বঙ্গবন্ধু'। একদা ব্যক্তিনামের শেখ মুজিব হয়ে দাঁড়ায় আমাদের গোটা বাংলাদেশেরই আরেক নাম। আর, শুরুতেই, ঐ যে উল্লেখ করা গেছে_ 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি'। জনক তিনি আমাদের এই বাংলার। নজির টানি যেমন কিনা তুরস্ক দেশের কামাল পাশা কামাল 'আতাতুর্ক' ভিয়েতনামের হোচিমিন আংকন হো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ ব্রাদার/ব্যাংকার্নো এবং পাশের দেশের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী মহাত্মাজী, বাপুজী। তা আমাদের বেলাতেও তো অমনটাই। ঘোরতর মফস্বল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান কখন যে আপনার নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে হয়ে গেছেন, ঐ যে বলা গেছে জাতির 'জনক'। নবীন এক নেশন স্টেটের 'স্থপতি' তিনি। আজ গল্প তাঁকে নিয়ে, কথা তাঁকে নিয়ে। আদপে অবশ্য যেন জেনে রাখি, দেশ বাংলার ইতিহাস কথা কয়েছে 'শেখ মুজিব' প্রতীকীতে।
স্বভাবতই খোঁজ আসবে_রাতারাতি হঠাৎ করেই নয় তো এমনটা। অবশ্য রয়েছে বাস্তবতার পটভূমি, রয়েছে শুরুর জানা, রয়েছে সমকালীন সময়ের আধারে নানান সব বাঁকের সড়ক-যাত্রা। কতো যে সব বাধা বিপত্তি-বিপর্যয়, দুশমন অপশক্তির হামলার আছর; তার পরেতে এগিয়ে যাওয়া। আজ পেছনে তাকিয়ে দেখছি, _শেখ মুজিব, সেই তিনি হটেননি কখনো আপোস করেননি আপন বিশ্বাস-বিবেকের বিনিময়ে। প্রসঙ্গত এখানে উদ্ধৃত করি, কী দৃঢ়-গভীর ঈমানের জোরেই তাঁর জানান দেয়া :_ 'ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।' এই সাথে অতঃপর যোগ করে নেব তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা_ 'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' লক্ষ্য করবার যে, শেষাবধি যেমন পৌঁছে যাচ্ছেন, 'জয় বাংলা'র সীমান্তে।
এখন তবে ফিরে আসি, ইতিপূর্বেই যে উল্লেখ করা গেছে, অবশ্য রয়েছে বাস্তবতার পটভূমি, রয়েছে শুরুর পালা, রয়েছে নানান সব বাঁকের সড়কযাত্রা। বর্তমান অবকাশে খানিক আভাসিত করবার প্রয়াস পাওয়া যাবে।
তদর্থে কিন্তু রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নয় তাঁর। বংশে মধ্যবিত্ত শেখ পরিবার। শৈশব থেকে কৈশোর, প্রথম যৌবনের শুরু অবধি লালন তাঁর ঘোরতর মফঃস্বল অঞ্চলে, গ্রামীণ পরিবেশে। চারদিকে নদীঘেরা সেই দেশাঞ্চল, দিগন্ত প্রসারী চরভূমি; আর তৃণমূল শত সহস্র সাধারণ জনমানুষের জীবনপ্রবাহ। প্রধানতই গায়ে গতরে খাটা মাঝি-জেলে-চাষী এরা। মিলিয়ে নেব, রবীন্দ্র বর্ণনাতে যেমনটা : 'ওরা চিরকাল/টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল;/ওরা মাঠে মাঠে/ বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।/ওরা কাজ করে/ নগরে প্রান্তরে।'
শেখ বাড়ির খোকা নামের ছেলেটি বেড়ে উঠছে নদীমাতৃক এই বাংলার কোলে, ঐ সব প্রাকৃত সাধারণ মানুষের মাঝে। এবং সমান্তরালে প্রাসঙ্গিক অপর এই তথ্যটি_ গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে পড়বার কালে ছাত্রদের দাবি নিয়ে উচ্চতম কর্তৃপক্ষ বরাবর তাঁর সরাসরি ভূমিকা। অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঐ স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। খেয়ালে রাখতে হবে, আগামী দিনের বঙ্গবন্ধুর ভিত্ তৈরি হচ্ছিল ঐ ঠিকানাতে।
অত:পর পরের পালা।
ইতোমধ্যে তিনি মহানগরী কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। এবং ক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নানান সব আন্দোলনে। দেখছি তাঁকে সিরাজ দিবস পালনের অনুষ্ঠানে, আজাদ হিন্দ ফৌজের জঙ্গী মিছিলে, ট্রাক শ্রমিক হরতালে, খিদিরপুরে ডক মজুরদের বিক্ষোভের সাথে। কলকাতা তখন উত্তপ্ত কত সব প্রতিবাদী প্রতিরোধী আন্দোলনে।
অতঃপর এবার উনিশ শো সাতচল্লিশের পার্টিশন উত্তর আমাদের সেই সব দিনের পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান। পরের বছর আটচল্লিশ থেকেই এতদ্ অঞ্চলের সারাটা দেশজুড়ে সর্বত্র যেমন দানা বেঁধে উঠছে আগ্রাসী পাকিস্তানিত্বের আছর হটাবার প্রতিরোধ। আটচল্লিশ-বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন দিয়ে সেই অভিযানের উদ্বোধন। ছাত্র-কিশোর-যুবক আমরা কাতার বাঁধছি, শামিল হচ্ছি। আজ দিনের এই অবকাশে স্মরণে আনছি সেই সময় সেই দিনগুলি; এবং চিহ্নিত করছি। কাতারের অন্যতম অগ্রপথিক ঐ মানুষটি, আমাদেরই অতি ঘনিষ্ঠ কাছের জন 'মুজিব ভাই'। পূর্বতন বর্ণনার জের টেনে অতঃপর এখন এমন করে আবারো জানাই যে, আমাদের সেই 'মুজিব ভাই' কখন তিনি 'আমার বাংলা'র কোটি আদম সন্তানের মুকুটহীন নেতা মহোত্তম 'বঙ্গবন্ধু'।
প্রাসঙ্গিকতার দাবিতে আবারো তবে সেই সময়। বলবার যে, দুনিয়ার মানচিত্রে তেমন নিদর্শন আর কী রয়েছে_ মাতৃভাষার ইজ্জত প্রতিষ্ঠার নিশানায় প্রতিবাদী প্রতিরোধী আন্দোলনের যাত্রা শুরু, এবং শেষ সীমান্তে অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম নেশন স্টেট। এতদঞ্চলের কোটি মানুষের শ্রমে স্বেদে-রক্তে এবং শপথ-আদর্শের জোরে ব্যতিক্রমী সেই সত্যটিকেই তো বাস্তবতায় সম্ভব করা গেছে।
এইখানে আমাদের বাংলাদেশ-অভিযানের দুই যুগের ইতিহাস নির্মাণে শেখ মুজিব, তাঁর ভূমিকা অবলোকন করছি। সে তো সন ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের উদ্বোধন থেকেই। পার্টিশনের দরুন কলকাতা বাসের পাট চুকিয়ে ঢাকায় আসা শেখ মুজিব তখন ছাত্রনেতা। আর '৫৪ নাগাদ যখন প্রদেশ পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবিতে আন্দোলনের নির্বাচন ততদিনে তিনি তৃণমূল অবধি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। নির্বাচনী যুক্তফ্রন্টের তিনি সাংগঠনিক নেতা। প্রসঙ্গত লক্ষ| করব যে, সর্বগ্রাসী প্রশাসনিক শক্তি মুসলিম লীগবিরোধী ফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের 'একুশ' দফার প্রথম দফাই হচ্ছে_ 'বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম স্বাধিকারের দাবি দু'টো যেমন এক স্রোতোধারায় মিশে গেছে। বিবেচনাতে আনব, '৫২ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ভাষা আন্দোলনের বছর চারেক পূর্বে সূত্রপাতটি করেছিলেন খোদ কেন্দ্রীয় গণপরিষদের অধিবেশনে সংসদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত:_ I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state. তার পর সাত বছরের কাল ব্যবধান। ঐ পরিষদেই ১৯৫৫তে উত্তরসূরি শেখ মুজিবুর রহমান এমনতর সুস্পষ্ট এবং জোরালো করে; give us full autonomy ... write down that Bengali shall be one the state Language. সেই কালে ফিরে ফিরেই এসেছে একে অপরের সম্পূরক হয়ে_ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবি আর মাতৃভাষার দাবি।
তার পরের থেকে নদী বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। এবং সব শেষের সত্য : 'একটি জাতির জন্ম।'
আজকের এই বিশেষ দিবসটি অবলম্বনে আমরা দেখবার প্রয়াস পাচ্ছি বাঙালির বাঁচার দাবি 'ছয় দফা'র রূপকার দ্রুত কেমন সারাটা দেশময় সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এবং সেইখানে দেখি আমরা বাংলার মুখ। এখন তবে স্মরণে আনব সব ১৯৬৯ সেইদিন ৫ ডিসেম্বর, তার ঐতিহাসিক ঘোষণা,_'আজ থেকে এই দেশের নাম বাংলাদেশ।' ইতিহাসের রথচক্র ইতোমধ্যে ধ্রুব নিশানার সন্ধান পেয়ে গেছে। '৭১ মার্চ ২৬-এর সবে নিশির প্রথম প্রহর-উন্মেষ। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো Oracle (২) শেষ সেই বার্তাটি 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।'
মহাকালের সাক্ষ্য, এমনটাই অতঃপর ইতিহাসের লিখন, ইতিহাসের সৃজন।
তবু, তার পরেতেও কিন্তু কোন অন্ধকার গুহা থেকে নিয়তি-দুর্গ্রহের হামলা। বাংলাদেশ বাঙালির জীবনে অভিশপ্ত সেই পঁচাত্তর পনেরোই আগস্ট। কার না বিষম অভিজ্ঞতা কেমন যে ভীষণ দুঃসময়ের সংকটে আক্রান্ত আমাদের তখনকার দিনগুলি। পর পর একাত্তরের সামরিক শাসন, ছন্দবেশী গণতন্ত্রের লেবাসে সুযোগ-তল্লাশি অপশাসন, আর সেই সাথে হাত মিলিয়ে আবারো রাজাকার _ধর্মবেনিয়া মৌলবাদী জোটের ছড়িয়ে পড়া। কালের তাগিদেই তাই আজ আমাদের সেই নেতার সন্ধান, যিনি সড়কের নিশানা বাত্লে দেবেন, আশার মশাল তুলে ধরবেন। আবারও করে গণমানুষের মুক্তি'র ডাক দেবেন।
আজকের বিশেষ এই দিবসে তেমনটাই তো সুস্পষ্ট দেখতে পাই তাঁকে_
ঐ যে সামনেই উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি, ঋজু শক্ত মেরুদণ্ডের; দীর্ঘদেহী, উন্নতশির, প্রশস্ত ললাট। মহাকাশ শূন্যপানে উত্থিত তাঁর দক্ষিণ বাহু_ ছবিটা এবং ইমেজটা এ দু'য়ে মেশামেশিতে কেমন একাত্ম-একাকার হয়ে আসে। তাঁর কণ্ঠে যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে নজরুল কণ্ঠের সাথে মিলিয়ে কালজয়ী সেই ডাক : 'বাঙালির জয় হোক' 'জয় বাংলা'।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমার বাংলার বঙ্গবন্ধু_ তাঁর শুভ জন্মজয়ন্তীর বিশেষ এই দিবসে প্রার্থনা_বিশ্বাস আমাদের, এবং নিবেদন এই মতো: যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান '
মনে করি যে, তেমন করে আর বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, বছর ঘুরে আবারও এসেছে আজ বিশেষ সেই 'দিবস',_ আজ সতেরোই মার্চ; জাতির জনকের আজ জন্মদিন। 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি; সৌভাগ্য বলে মানি, সমকালীন আমাদেরই অতীব কাছের মানুষ_বঙ্গবন্ধু তিনি; পারিবারিক বংশনাম পরিচিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান।
আজকের এই দিনে দেশের হেথায় হোথায় এবং দেশের বাইরেতেও মেলাই সব অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্বাভাবিক যে, আবেগ থাকবে, একটা ভালোবাসা থাকবে এবং সেই তাঁকে নিয়ে আরো আরো জানবার আগ্রহ_ কৌতূহল থাকবে। তবে বিবেচনা করি যে, দিবসটি উদযানপন উপলক্ষে অবকাশ এসেছে_ নষ্ট-বিকৃত করে দেয়া, অসৎ কতিপয়ের বিরামহীন যত সব কুকীর্তি; এবং অপর দিকে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া প্রাসঙ্গিক অনেক নানান সম্পদ ঐশ্বর্য উদ্ধারের প্রয়াসে আমরা যেন আন্তরিক উদ্যোগী হয়ে উঠি। প্রশ্ন জাগে_এটি শুধুই কেবল শেখ মুজিবুর রহমান এই নামের মানুষটির জন্মদিন উদযাপন? মোটা দাগে সরাসরি আক্ষরিক শব্দার্থ হয়তো বা তাই। তবে দেশ বাংলার সড়কযাত্রায় অভিযাত্রী যাঁরা, তাঁরা অবগত কথাটার ব্যঞ্জনা কত গভীরে, বহন করে কী সেই মহৎ ইতিহাস। সেইখানে শেখ মুজিবে/বঙ্গবন্ধুতে আর লাড় নেয়া বাংলাদেশে যেমন একাত্মায় মেশামেশি। এবং কালের পালা-বদলে তিনিই তো হয়ে ওঠেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কোটি বাঙালির 'বঙ্গবন্ধু'। একদা ব্যক্তিনামের শেখ মুজিব হয়ে দাঁড়ায় আমাদের গোটা বাংলাদেশেরই আরেক নাম। আর, শুরুতেই, ঐ যে উল্লেখ করা গেছে_ 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি'। জনক তিনি আমাদের এই বাংলার। নজির টানি যেমন কিনা তুরস্ক দেশের কামাল পাশা কামাল 'আতাতুর্ক' ভিয়েতনামের হোচিমিন আংকন হো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ ব্রাদার/ব্যাংকার্নো এবং পাশের দেশের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী মহাত্মাজী, বাপুজী। তা আমাদের বেলাতেও তো অমনটাই। ঘোরতর মফস্বল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান কখন যে আপনার নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে হয়ে গেছেন, ঐ যে বলা গেছে জাতির 'জনক'। নবীন এক নেশন স্টেটের 'স্থপতি' তিনি। আজ গল্প তাঁকে নিয়ে, কথা তাঁকে নিয়ে। আদপে অবশ্য যেন জেনে রাখি, দেশ বাংলার ইতিহাস কথা কয়েছে 'শেখ মুজিব' প্রতীকীতে।
স্বভাবতই খোঁজ আসবে_রাতারাতি হঠাৎ করেই নয় তো এমনটা। অবশ্য রয়েছে বাস্তবতার পটভূমি, রয়েছে শুরুর জানা, রয়েছে সমকালীন সময়ের আধারে নানান সব বাঁকের সড়ক-যাত্রা। কতো যে সব বাধা বিপত্তি-বিপর্যয়, দুশমন অপশক্তির হামলার আছর; তার পরেতে এগিয়ে যাওয়া। আজ পেছনে তাকিয়ে দেখছি, _শেখ মুজিব, সেই তিনি হটেননি কখনো আপোস করেননি আপন বিশ্বাস-বিবেকের বিনিময়ে। প্রসঙ্গত এখানে উদ্ধৃত করি, কী দৃঢ়-গভীর ঈমানের জোরেই তাঁর জানান দেয়া :_ 'ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।' এই সাথে অতঃপর যোগ করে নেব তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা_ 'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' লক্ষ্য করবার যে, শেষাবধি যেমন পৌঁছে যাচ্ছেন, 'জয় বাংলা'র সীমান্তে।
এখন তবে ফিরে আসি, ইতিপূর্বেই যে উল্লেখ করা গেছে, অবশ্য রয়েছে বাস্তবতার পটভূমি, রয়েছে শুরুর পালা, রয়েছে নানান সব বাঁকের সড়কযাত্রা। বর্তমান অবকাশে খানিক আভাসিত করবার প্রয়াস পাওয়া যাবে।
তদর্থে কিন্তু রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নয় তাঁর। বংশে মধ্যবিত্ত শেখ পরিবার। শৈশব থেকে কৈশোর, প্রথম যৌবনের শুরু অবধি লালন তাঁর ঘোরতর মফঃস্বল অঞ্চলে, গ্রামীণ পরিবেশে। চারদিকে নদীঘেরা সেই দেশাঞ্চল, দিগন্ত প্রসারী চরভূমি; আর তৃণমূল শত সহস্র সাধারণ জনমানুষের জীবনপ্রবাহ। প্রধানতই গায়ে গতরে খাটা মাঝি-জেলে-চাষী এরা। মিলিয়ে নেব, রবীন্দ্র বর্ণনাতে যেমনটা : 'ওরা চিরকাল/টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল;/ওরা মাঠে মাঠে/ বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।/ওরা কাজ করে/ নগরে প্রান্তরে।'
শেখ বাড়ির খোকা নামের ছেলেটি বেড়ে উঠছে নদীমাতৃক এই বাংলার কোলে, ঐ সব প্রাকৃত সাধারণ মানুষের মাঝে। এবং সমান্তরালে প্রাসঙ্গিক অপর এই তথ্যটি_ গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে পড়বার কালে ছাত্রদের দাবি নিয়ে উচ্চতম কর্তৃপক্ষ বরাবর তাঁর সরাসরি ভূমিকা। অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঐ স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। খেয়ালে রাখতে হবে, আগামী দিনের বঙ্গবন্ধুর ভিত্ তৈরি হচ্ছিল ঐ ঠিকানাতে।
অত:পর পরের পালা।
ইতোমধ্যে তিনি মহানগরী কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। এবং ক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নানান সব আন্দোলনে। দেখছি তাঁকে সিরাজ দিবস পালনের অনুষ্ঠানে, আজাদ হিন্দ ফৌজের জঙ্গী মিছিলে, ট্রাক শ্রমিক হরতালে, খিদিরপুরে ডক মজুরদের বিক্ষোভের সাথে। কলকাতা তখন উত্তপ্ত কত সব প্রতিবাদী প্রতিরোধী আন্দোলনে।
অতঃপর এবার উনিশ শো সাতচল্লিশের পার্টিশন উত্তর আমাদের সেই সব দিনের পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান। পরের বছর আটচল্লিশ থেকেই এতদ্ অঞ্চলের সারাটা দেশজুড়ে সর্বত্র যেমন দানা বেঁধে উঠছে আগ্রাসী পাকিস্তানিত্বের আছর হটাবার প্রতিরোধ। আটচল্লিশ-বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন দিয়ে সেই অভিযানের উদ্বোধন। ছাত্র-কিশোর-যুবক আমরা কাতার বাঁধছি, শামিল হচ্ছি। আজ দিনের এই অবকাশে স্মরণে আনছি সেই সময় সেই দিনগুলি; এবং চিহ্নিত করছি। কাতারের অন্যতম অগ্রপথিক ঐ মানুষটি, আমাদেরই অতি ঘনিষ্ঠ কাছের জন 'মুজিব ভাই'। পূর্বতন বর্ণনার জের টেনে অতঃপর এখন এমন করে আবারো জানাই যে, আমাদের সেই 'মুজিব ভাই' কখন তিনি 'আমার বাংলা'র কোটি আদম সন্তানের মুকুটহীন নেতা মহোত্তম 'বঙ্গবন্ধু'।
প্রাসঙ্গিকতার দাবিতে আবারো তবে সেই সময়। বলবার যে, দুনিয়ার মানচিত্রে তেমন নিদর্শন আর কী রয়েছে_ মাতৃভাষার ইজ্জত প্রতিষ্ঠার নিশানায় প্রতিবাদী প্রতিরোধী আন্দোলনের যাত্রা শুরু, এবং শেষ সীমান্তে অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম নেশন স্টেট। এতদঞ্চলের কোটি মানুষের শ্রমে স্বেদে-রক্তে এবং শপথ-আদর্শের জোরে ব্যতিক্রমী সেই সত্যটিকেই তো বাস্তবতায় সম্ভব করা গেছে।
এইখানে আমাদের বাংলাদেশ-অভিযানের দুই যুগের ইতিহাস নির্মাণে শেখ মুজিব, তাঁর ভূমিকা অবলোকন করছি। সে তো সন ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের উদ্বোধন থেকেই। পার্টিশনের দরুন কলকাতা বাসের পাট চুকিয়ে ঢাকায় আসা শেখ মুজিব তখন ছাত্রনেতা। আর '৫৪ নাগাদ যখন প্রদেশ পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবিতে আন্দোলনের নির্বাচন ততদিনে তিনি তৃণমূল অবধি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। নির্বাচনী যুক্তফ্রন্টের তিনি সাংগঠনিক নেতা। প্রসঙ্গত লক্ষ| করব যে, সর্বগ্রাসী প্রশাসনিক শক্তি মুসলিম লীগবিরোধী ফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের 'একুশ' দফার প্রথম দফাই হচ্ছে_ 'বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম স্বাধিকারের দাবি দু'টো যেমন এক স্রোতোধারায় মিশে গেছে। বিবেচনাতে আনব, '৫২ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ভাষা আন্দোলনের বছর চারেক পূর্বে সূত্রপাতটি করেছিলেন খোদ কেন্দ্রীয় গণপরিষদের অধিবেশনে সংসদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত:_ I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state. তার পর সাত বছরের কাল ব্যবধান। ঐ পরিষদেই ১৯৫৫তে উত্তরসূরি শেখ মুজিবুর রহমান এমনতর সুস্পষ্ট এবং জোরালো করে; give us full autonomy ... write down that Bengali shall be one the state Language. সেই কালে ফিরে ফিরেই এসেছে একে অপরের সম্পূরক হয়ে_ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবি আর মাতৃভাষার দাবি।
তার পরের থেকে নদী বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। এবং সব শেষের সত্য : 'একটি জাতির জন্ম।'
আজকের এই বিশেষ দিবসটি অবলম্বনে আমরা দেখবার প্রয়াস পাচ্ছি বাঙালির বাঁচার দাবি 'ছয় দফা'র রূপকার দ্রুত কেমন সারাটা দেশময় সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এবং সেইখানে দেখি আমরা বাংলার মুখ। এখন তবে স্মরণে আনব সব ১৯৬৯ সেইদিন ৫ ডিসেম্বর, তার ঐতিহাসিক ঘোষণা,_'আজ থেকে এই দেশের নাম বাংলাদেশ।' ইতিহাসের রথচক্র ইতোমধ্যে ধ্রুব নিশানার সন্ধান পেয়ে গেছে। '৭১ মার্চ ২৬-এর সবে নিশির প্রথম প্রহর-উন্মেষ। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো Oracle (২) শেষ সেই বার্তাটি 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।'
মহাকালের সাক্ষ্য, এমনটাই অতঃপর ইতিহাসের লিখন, ইতিহাসের সৃজন।
তবু, তার পরেতেও কিন্তু কোন অন্ধকার গুহা থেকে নিয়তি-দুর্গ্রহের হামলা। বাংলাদেশ বাঙালির জীবনে অভিশপ্ত সেই পঁচাত্তর পনেরোই আগস্ট। কার না বিষম অভিজ্ঞতা কেমন যে ভীষণ দুঃসময়ের সংকটে আক্রান্ত আমাদের তখনকার দিনগুলি। পর পর একাত্তরের সামরিক শাসন, ছন্দবেশী গণতন্ত্রের লেবাসে সুযোগ-তল্লাশি অপশাসন, আর সেই সাথে হাত মিলিয়ে আবারো রাজাকার _ধর্মবেনিয়া মৌলবাদী জোটের ছড়িয়ে পড়া। কালের তাগিদেই তাই আজ আমাদের সেই নেতার সন্ধান, যিনি সড়কের নিশানা বাত্লে দেবেন, আশার মশাল তুলে ধরবেন। আবারও করে গণমানুষের মুক্তি'র ডাক দেবেন।
আজকের বিশেষ এই দিবসে তেমনটাই তো সুস্পষ্ট দেখতে পাই তাঁকে_
ঐ যে সামনেই উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি, ঋজু শক্ত মেরুদণ্ডের; দীর্ঘদেহী, উন্নতশির, প্রশস্ত ললাট। মহাকাশ শূন্যপানে উত্থিত তাঁর দক্ষিণ বাহু_ ছবিটা এবং ইমেজটা এ দু'য়ে মেশামেশিতে কেমন একাত্ম-একাকার হয়ে আসে। তাঁর কণ্ঠে যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে নজরুল কণ্ঠের সাথে মিলিয়ে কালজয়ী সেই ডাক : 'বাঙালির জয় হোক' 'জয় বাংলা'।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমার বাংলার বঙ্গবন্ধু_ তাঁর শুভ জন্মজয়ন্তীর বিশেষ এই দিবসে প্রার্থনা_বিশ্বাস আমাদের, এবং নিবেদন এই মতো: যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান '
No comments