'দু'হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী' by আবদুল লতিফ সিদ্দিকী

বাঙালিত্বকে ভূগোল-বিভাজিত একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অহঙ্কার হিসেবে উদ্যাপিত, প্রতিপালিত এবং প্রদর্শিত হতে দেখা গেলে যে শীর্ষপুরম্নষ তার সর্বোচ্চ সাংগঠনিক প্রবক্তার অভিধা পেতে পারেন তিনি নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বক্তব্যের সমর্থনে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মনত্মব্য "বঙ্গবন্ধু বিগত দু'হাজার বছরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী" খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে উদ্ধৃত হতে পারে। বাঙালীত্বের মর্যাদাকে পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিষ্ঠার দায়ভার আর যারা গ্রহণ করেন নিজ নিজ েেত্র তাঁরা স্বপ্রতিভায় প্রৌজ্জ্বল হলেও জাতিগোষ্ঠীর অবকাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক নিয়নত্মার ভূমিকায় তারা বঙ্গবন্ধুকে অতিক্রম করতে পারেননি। ভাষা সাহিত্য দর্শন শিা সংস্কৃতি প্রভৃতি যেসব অবস্থানে বাঙালী যুগপুরম্নষেরা তাঁদের কীর্তিফলক সংস্থাপিত করেছেন সে সবের পূর্ণ দীপ্তি স্বীকার করেও বঙ্গবন্ধুকে যে একটি পৃথক অহঙ্কারে বরণ করা যায় তার মূলে আছে এ সত্য যে, মূর্ত বিমূর্ত উভয় শক্তির সম্মিলনে তিনিই একটি টেকসই সংস্কৃতি কাঠামো সূত্রবদ্ধ করতে পেরেছেন।
ব্যক্তি-প্রতিভার বিচ্ছুরণে সমাজের সত্মরোন্নয়ন যে সম্ভব তা সর্বজন স্বীকৃত; কিন্তু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিক বিকাশ কখনও স্থায়ী কোন প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্ম দিতে পারে না বলে সাহিত্যিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বৃদ্ধির বিকিরণ জাতি-সংহতি ও সমাজ-সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারে না। যে কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর, রবীন্দ্র-নজরম্নলসহ অন্য কালপুরম্নষেরা ইতিহাসের যাত্রাকে বর্ণাঢ্য করে তুললেও তাত্তি্বক ও ব্যবহারিক কৃতিত্বের নিরিখে বঙ্গবন্ধুই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেতে পারেন; বর্তমানকালের জনজরিপের প্রোপটে সেটা ইতোমধ্যে অবশ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।
কোন বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন-গৌরবের প্রতিষ্ঠাকে সম্ভবপর করে তুলেছিলেন সে দিকে দৃষ্টি ফেরালে তাঁর ব্যক্তিসত্তার বিশেষত্ব টের পাওয়া যায়।
জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ইতিহাস তিনি নির্মাণ করেন তা তাঁকে ব্যক্তিসত্তার গৌরবসীমা ভেঙে জাতিগত গোষ্ঠীসত্তার অহঙ্কারে প্রতিষ্ঠিত করে। ব্যক্তি-একক হিসেবে তাঁর যে কীর্তিমূল্য তা স্ফীত হয়ে জাতীয় অর্জনের বাটখারায় প্রতীকী মূল্যমানে মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে। যে মর্যাদার আসনে তিনি অভিষিক্ত তাঁর জন্য তা সম্ভবপর হয়ে ওঠে এজন্য যে, সর্বজনীন মূল্যায়নে তিনি জাতিসত্তার সপ্রাণ পতাকা; প্রতীকার্থই যেখানে প্রধান। এ অর্থে তিনি একের ভেতর বহু, সংখ্যার মধ্যে অসংখ্য।
ঔপনিবেশিক মসত্মিষ্কের জঞ্জাল হিসেবে দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুরিতে ভারতভূমি দ্বিভাজিত হলে মুসলিম জাতিসত্তার যে অনত্মঃসারশূন্য উদ্বোধন ঘটে তা দিয়ে জনমানুষের স্বাধীনতার আসল স্পৃহাকে প্রশমিত করা সম্ভব ছিল না। সাতচলিস্নশ-উত্তরকাল থেকে ১৯৭১ পর্যনত্ম আড়াই দশকে বঙ্গবন্ধুর এ অনুভব ক্রমাগত পোক্ত হয়েছিল যে, একপেশে ধর্মতত্ত্ব স্বাধীনতার অনত্মরায়; এর জন্য চাই জাতীয় চেতনাজ্জবাঙালিত্বের চেতনা।
ইতিহাসের কালপুরম্নষ যারা হতে পারেন তাঁদের সঙ্গে উত্তর-প্রজন্মের সম্পর্ক স্বভাবত আবেগ-বিচ্ছিন্ন নিরপেতায় স্থিরীকৃত। যদি জেনারেশন গ্যাপ তিন পুরম্নষের অধিককালে সমপ্রসারিত হয়, তাহলে একথা একটু বেশিই খাটে। বঙ্গবন্ধুর েেত্র বিচ্ছিন্নতার অনুরূপ পরিস্থিতি বাসত্মবে বলবৎ না থাকায় তাঁর কীর্তি বিবেচনায় আবেগের সম্পৃক্তি ইতি ও নেতি উভয়ের বাটখারায় বাড়তি ভার যে চাপিয়ে দিতে পারে বুদ্ধিশীল মসত্মিষ্কের রায়ে সেটুকু অনত্মত স্বীকার্য বলে মেনে নিতে হয়। এ কারণে জাতিসত্তার বর্ণাঢ্য রূপকার হিসেবে এত বড় দুর্লভ কর্মকীর্তির যিনি সাধক তাঁর গোষ্ঠীগত গ্রাহ্যতা সহজে নির্মিত হলেও জাতিগত গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বিতর্ক জট পাকায়। এটা দুঃখজনক হতে পারে, কিন্তু হতাশাব্যঞ্জক নয় এজন্য যে, কালের প্রহার সয়েই ইতিহাসের আলোকসত্মম্ভকে তার শিখা জ্বেলে রাখতে হয়। বড়র বিতর্ক বারোয়ারির চেয়ে যে প্রাবল্য পাবে সে তো সাধারণ কথা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাতে আবেগের হসত্মপে আছে এ কথা সত্য; কিন্তু মসত্মিষ্কের সিদ্ধানত্মের কাছে অবনত থেকে এ কথা উচ্চারণ করতে পারি, তাঁর জীবনের সার্বিক সংগঠন যেভাবে রূপ পেয়েছে তাতে বড় জীবনের বিভা ও বৈভব সর্বাংশে দীপ্যমান।
বিভাজনোত্তর চবি্বশ বছরের রাজনৈতিক চক্রাবর্তে বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছিন্ন পরম্পরায় পালন করে গেছেন তাঁর আদর্শনিবিষ্ট ভূমিকা। এেেত্র ধার্মিকতার যে ভঙ্গুর প্রতিশ্রম্নতি পাকিসত্মান আদর্শের নেতৃবর্গ সংশিস্নষ্ট জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাতে কৃত্রিমতা যেমন অবলম্বিত হয়েছে তেমনি শোষণের বাহন হিসেবে ধর্মানুভূতিকে সর্বাগ্রে কাজে লাগানোর প্রয়াস লণীয়। ভূগোল-নিরপে ইসলামিকতার ধুয়া তুলে দুই পাকিসত্মান অথবা পূর্ব-পশ্চিম দুই বাংলার ধর্মদর্শনের অভিন্নতাকে জোর খাটিয়ে বড় করে দেখানোর সে অপপ্রয়াস বাঙালী মনের সংবেদনায় যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারেনি। বাঙালীর এ বিমুখ মানসিকতার বিােভ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলে জনস্রোতের গতিমুখ পর্যবেণ করে তিনি সর্বসামপ্রদায়িক গণনেতৃত্বের হালটিকে শক্ত হাতে ধরতে পেরেছেন। মানব প্রকৃতির শুদ্ধ পাঠ রপ্ত থাকায় ইহজাগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দায়বোধ তাঁর মধ্যে দানা বাঁধতে পেরেছে; মুক্ত মানব সংস্কৃতির পচারিতা তাঁকে বাঙালীর মনোভঙ্গি উপলব্ধির দুয়ার খুলে দিয়েছে। মানবের অখ-তাকে যারা মর্যাদার চোখে দেখতে পারেনি, তাঁরা সমপ্রদায়গত ভিন্নতাবোধের গলি-ঘুপচিতে মানবতাবাদের আদর্শের খেই হারিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর চলার রাসত্মাটি নিজের মতো করে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। তর্কাতিত প্রত্যয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক তরিকায় অবিচল থেকে সিদ্ধির মোহনায় মিলিত হতে পেরেছেন বৃহৎ মানবের অবিভাজিত মহাসমুদ্রে। এটা ব্যক্তি আদর্শের এক বিশিষ্ট দিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। পশ্চিম পাকিসত্মানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তি ভূগোলসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না; হিন্দুত্ব আর মুসলমানিত্ব যখন পরস্পরকে সাংঘর্ষিকভাবে মোকাবিলা করে চলেছে তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ঔপনিবেশিক আস্কারা ভারতভূমিতে বেপরোয়া ছুরি-চাকু চালিয়ে পূর্ববাংলাকে পশ্চিমবাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। হাজার মাইলের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতাকে তারা ধর্মীয় সংহতি দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছে; কিন্তু জীবনপ্রণালী, সংস্কৃতিনিষ্ঠ, চিনত্মাপ্রকৃতি ও ভাষাভাষিতার দৃষ্টিকোণে দুই পাকিসত্মানের মধ্যে ধর্মীয় বহিরাবরণ ছাড়া আর কোন ল্যযোগ্য অভিন্নতার অসত্মিত্ব ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সত্যটি উপলব্ধি করতে সম ছিলেন বলে রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বাচনে তাঁর ভুল হয়নি।
একাত্তর পরবর্তী প্রশাসন সংশিস্নষ্ট ভূমিকা পালনে তাঁর বিরম্নদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হতে দেখা যায় তাতে বঙ্গবন্ধুর প্রাণগত বিশেষত্বের প্রতি অবিচারই শুধু করা হয়েছে। চির-ঔদার্যের যে ব্যক্তিমহিমা তিনি ধারণ করেন তাকে বুঝতে না পেরে রাজনীতি বলয়ের একাংশ উদারতাকে স্বেচ্ছাচারিতা ও শক্তিমত্তার অপব্যবহারগত গড্ডলিকায় গা ভাসাতে থাকে। প্রশাসনভুক্ত ব্যক্তিবর্গ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হৃদয়গত বিশালত্বকে শোষণ করে নেতৃত্বের স্বাভাবিক প্রবাহ ও মসৃণতাকে ুণ্ন করে। 'দ্বিতীয় বিপস্নব' বলে যে কর্মসূচি তিনি বিধিবদ্ধ করেন বৃহৎকালের পরিসরে তা প্রতিপালিত হতে পারলে তার সুফল অনিবার্যভাবে জাতির জন্য ভোগ্য হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু সে সময়কার জটিলতর বৈরী পারিপাশ্বর্িকতায় সবকিছু সামলে উঠতে যে সময় ও সমর্থন জরম্নরি ছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা থেকে তিনি হয়েছেন সম্পূর্ণই বঞ্চিত। পরাজিত প্রতিশক্তির জঙ্গিবাদী আক্রোশ, সাম্রাজ্যবাদী মতাকেন্দ্রের আনত্মর্জাতিক চক্রানত্ম, উগ্র বামপন্থা-আশ্রিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সংঘর্ষ, সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্প, যুদ্ধবিধ্বসত্মতার আভিপেসহ অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও প্রশাসন কাঠামোকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। সবশেষে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীদের চূড়ানত্ম অপাঘাতে শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নাদর্শিত দেশচিত্রের বাসত্মবায়নের আগেই পৃথিবীর আলোবাতাস, বর্ণগন্ধের আস্বাদ অসম্পূর্ণ রেখে অনত্মর্হিত হন। কিন্তু ১৯৪৭-১৯৭৫ পর্যনত্ম বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর যে সাড়ম্বর উপস্থিতি তা-ই তাঁকে রাজনৈতিক ইতিহাসের কালপুরম্নষে পরিণত করে।
জীবনকালের পরিসীমায় পৃথিবীর অনেক স্বর্ণপুরম্নষই তাঁর কর্মকীর্তির প্রকৃত স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন; ব্যক্তিদুর্বলতাও হয়ত সবার েেত্র অল্পবিসত্মর থাকতে পারে, কিন্তু কর্মকীর্তির নিরাবেগ মূল্যায়ন একদিন ইতিহাসের ধারাক্রমে সম্ভবপর হয়ে ওঠে। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের প্রতীা শেষে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশ অনুধাবন করছে বঙ্গবন্ধুর কর্মকীর্তি আসলে কোন মহান উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিসঞ্চারী আইনী নিরপেতার ফলেই ইতোমধ্যে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে মৌলধারায় পরিচালিত হতে দেখেছি তাতে ব্যক্তিগতভাবে এটুকু প্রত্যয় আমি ধারণ করি যে, ইতিহাসের নিরপে কাঠগড়ায় জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিন জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন কিংবা অপরাপর বিশ্বনেতৃত্বের প্রতীক-চিহ্নিত মর্যাদায় অভিষিক্ত হবেন।

লেখক : মাননীয় মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

No comments

Powered by Blogger.