রাষ্ট্র গঠন ও কৃষকদের এজেন্ডা by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠন রাষ্ট্রের দুটি ভূমিকা নির্দিষ্ট করেছে। প্রথমটি হচ্ছে : রাষ্ট্র সমাজের ক্ষেত্রে ম্যানেজারিয়ান কর্তৃত্ব উৎপন্ন করবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাষ্ট্র সমাজ রূপান্তরণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ কলোনাইজড বাসিন্দাদের মধ্যে ঐক্য নির্মাণের মতাদর্শ এবং একই সঙ্গে নিম্নপর্যায়ের সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধির উপায়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনে, ঔপনিবেশিক আমল থেকেই, কৃষকদের এজেন্ডা একটা বড় উপাদান হিসাবে কাজ করেছে। এই এজেন্ডা উচ্চারিত হয়েছে জাতীয়তাবাদের মধ্যে, যেখানে কৃষকদের শ্রেণী স্বার্থ মধ্য শ্রেণীর হেজিমনির মধ্যে মিলে মিশে গেছে। বাঙালী মধ্যবিত্ত, ঔপনিবেশিক পরিসরে, রাজনৈতিক সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে শ্রেণী হিসাবে নয়, বরং সমগ্র সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে। অন্যদিক থেকে ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিকোত্তর আমলে কৃষকদের এজেন্ডা বিশ্লেষণ করা জরুরি। কৃষকদের সঙ্গে জমির মালিকানার সম্পর্ক আছে, কৃষকদের সঙ্গে জমির ফলনের সম্পর্ক আছে, কৃষকদের সঙ্গে জমিতে প্রদত্ত শ্রমের সম্পর্ক আছে, কৃষকদের সঙ্গে জমি ব্যবহারের সম্পর্ক আছে, কৃষকদের সঙ্গে জমির উৎপাদন বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে, কৃষকদের সঙ্গে জমির ক্ষেত্রে পুঁজি লগ্নি এবং ব্যবহারের সম্পর্ক আছে।
ঔপনিবেশিক বাংলা থেকে ঔপনিবেশিকোত্তর বালাদেশের প্রথম সিভিল সরকারের রাজত্ব পর্যন্ত কৃষকদের এজেন্ডার পক্ষ থেকে ভূমি সংস্কারের যুক্তির পেছনে কাজ করেছে : ১. স্বল্পসংখ্যক ভূস্বামী/জমিদার/জোতদারদের মালিকানার বদলে যদি জমি ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হয়, তাহলে সমাজের চূড়ান্ত মেরুকরণ, যা-কিনা অসন্তোষ ও প্রতিবাদের উৎস, তা হ্রস্ব করে আনা সম্ভব। কৃষি সংস্কার কৃষকদের প্রতিবাদ শান্ত করে, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সপক্ষে জনপ্রিয় সমর্থন গড়ে তোলে, তৈরি করে রাষ্ট্র মধ্যে স্থিতিশীলতা ও অংশগ্রহণের ভিত্তি, এ সবই গণতন্ত্র ও স্পন্দিত অর্থনীতির জন্য দরকার। ২. যখন কৃষকের মালিকানা নিশ্চিত হয়, তখন জমির তদারকিতে দক্ষতা বাড়ে ও কৃষক-ও জমিতে লগ্নি করতে উৎসাহী হয়। ৩. ভূমি সংস্কারের দক্ষতা কৃষকের হাতে জমি এলে কৃষক জমির উৎপাদন বাড়াতে সচেষ্ট হয়। ৪. গ্রামীণ দারিদ্র্য কমাতে হলে বর্তমান ও ভবষ্যিত উৎপাদনের ভার কৃষকদের অর্পণ করতেই হবে। ৫. যখন কৃষকদের জমির ওপর মালিকানা তৈরি হয়, তারা জামিতে নিজেদের পরিবারের শ্রম বেশি ব্যবহার করে, এর ফলে গ্রামাঞ্চলের অব-জীবিকা সংস্থান সমস্যার সমাধানে একটা সহায়ক শক্তি তৈরি হয়। ৬. ভূমি সংস্কার ক্ষমতার বোধ শক্তিশালী করে।
ভূমি সংস্কারের এসব যুক্তি কাজ করেছে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলে ও ঔপনিবেশিকোত্তর বাংলাদেশের প্রথম পর্যায়ে। ঔপনিবেশিক বাংলায় বিশাল ব্যাপক কৃষক আন্দোলন হয়েছে, তেভাগা, হাজং, নানকার, জিরাতিয়া এবং জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে। এসব আন্দোলন ঔপনিবেশিক পঞ্চাশ দশকের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পটভূমি হিসাবে কাজ করেছে, অবশ্য বিশাল সংখ্যক হিন্দু জমিদার/ভূমির মালিকদের ভারত বিভাগের দক্ষতা ভারতে গমন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ সহজ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী কোলাবরেটরদের জমি দখল ও মুক্তাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ভূমি বিতরণ এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্বে ও অব্যবহিত পরে নকশালপন্থী বিভিন্ন সশস্ত্র কমিউনিস্ট দলগুলোর জমি দখল, জমি দখলের লড়াই ও শ্রেণী শত্রু নিধনের আন্দোলন বাংলাদেশের প্রথম সিভিল সরকারের ওপর ভূমি সংস্কারের চাপ তীব্র করে তুলেছে। এ কারণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম সিভিল সরকার প্রথম ভূমি সংস্কার আরও সংস্কার করে দ্বিতীয় ভূমি সংস্কার নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেছে। আবার দ্বিতীয় ভূমি সংস্কারের ফাঁকগুলোতে ভরাট করেছে এরশাদের সামরিক সরকার প্রণীত তৃতীয় ভূমিসংস্কার।
কিন্তু ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিকোত্তর আমলের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভূমি সংস্কার অকার্যকর হয়েছে এবং কৃষক এজেন্ডা অমীমাংসিত থেকেছে। তার কারণ হচ্ছে: ১. দ্রুত জমি অধিগ্রহণ ও বণ্টনের নির্দিষ্ট ধারা ও মানকাঠি না থাকার দারুণ ভূমি সংস্কার বিলম্বিত হয়েছে, মামলা মোকাদ্দমা তৈরি হয়েছে, নিষ্ক্রিয়তা প্রবল হয়েছে ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ২. যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বাজার দরে তার দাম বিলম্বিত হওয়ার কারণে বহুক্ষেত্রে ভূমি সংস্কার স্থগিত থেকেছে। ৩. খাস জমির বিতরণ ও খাস জমিতে ভূমিহীন/স্বল্পভূমির মালিকদের পুনর্বাসনের ওপর জোর দেয়ার দরুণ ব্যক্তিক মালিকানাধীন বৃহৎ জমির মালিকরা প্রধানত সংস্কারের বাইরে থেকেছে। ৪. ভূমি সংস্কারের অত্যধিক জটিল, আইনানুগ এবং তার দক্ষতা ধীরগতি নিয়মকানুন ভূমি সংস্কার ব্যাহত করেছে। ৫. ভূমি সিলিং-এর মাত্রা বেশি এবং একই পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন নামে জমি রেকর্ড করার দারুণ অধিকাংশ জমি ভূমি সংস্কারের আওতার বাইরে থেকেছে। অন্যপক্ষে ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিকোত্তর পর্যায়ে ভূমি সংস্কারকে স্থানীয় সরকার কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। সে জন্য তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক জনসাধারণ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি, আবার সম্পৃক্ত হতে না পারার দরুণ সংস্কার কর্মসূচী একান্তভাবে কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্বে পর্যবসিত হয়েছে। সংস্কার কর্মসূচীর দায়িত্ব বর্তিয়েছে আমলাতন্ত্রের ওপর। এই আমলাতন্ত্রের কোন রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকার দারুণ আমলাতন্দ্র নিষ্ক্রিয় করেছে কর্মসূচীকে; অন্যপক্ষে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে আঁতাত তৈরি করার মধ্য দিয়ে ভূস্বামী/ধনী কৃষক অংশ তাদের স্বার্থ অক্ষুন্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। সেজন্য ভূমিসংস্কারে কৃষক জনসাধারণের অংশগ্রহণ ন্যুনতম হয়েছে এবং সমানত্মরালভাবে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের প্রভাব বলয়ের মধ্যে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী আবদ্ধ থেকেছে। তৃতীয় ভূমি সংস্কার হয় জেনারেল এরশাদের সামরিক আমলে। এই সময়কার সামরিক সরকার ভূমির সিলিং নির্ধারণ, খাস জমি উদ্ধার, ক্ষেতমজুরদের ন্যুনতম মজুরি, ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বণ্টনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই ঘোষণার কোন কার্যকারিতা মাঠ পর্যায়ে না থাকার দরুণ এই আইনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। এই তিন পর্যায়ের ভূমি সংস্কারের মধ্যে কৃষকদের মধ্যকার এবং কৃষক ও রাষ্ট্র মধ্যকার সংগ্রামের বিভিন্ন সম্পর্ক ধরা পড়েনি। বিশেষ করে, কোন কোন ক্ষেত্রে এসব সংগ্রামের জয় ও পরাজয়ের প্যাটার্ন, এসব জয় ও পরাজয়ের রাষ্ট্র ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া, পরিবর্তমান রাজত্ব থেকে রাজত্বের ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তি ও শ্রেণীর মৈত্রী ও সংগ্রামের পাট্যার্নের বিশ্লেষণ এই তিন পর্যায়ের ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়। অন্যপক্ষে ভূমি সংস্কার সমাজ কাঠামোর বিশদ বিশ্লেষণ, এই কাঠামোর অন্তর্গত বিভিন্ন শ্রেণী ও ব্যক্তি, শ্রেণী বৈরিতা ও শ্রেণী মৈত্রীর এই নাটকে রাষ্ট্রের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমি সংস্কারের তিন দলিলে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যকার কংক্রিট ব্যক্তিবর্গের বর্ণনাভিত্তিক সম্পর্ক ও তাদের যুক্ততা এবং এসবের মধ্যে রাষ্ট্রের অবস্থানের নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় না।

No comments

Powered by Blogger.