‘যেকোনো প্রকারে’ জিতলে হেরে যায় জনগণ by আলী ইমাম মজুমদার

ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। এর প্রচার-প্রক্রিয়া আইনানুগভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়ে গেছে। এমনকি তফসিল ঘোষণার আগেই বিলবোর্ডে ছেয়ে গিয়েছিল মহানগর দুটি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সময় নির্ধারণ করে এগুলো নামিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিলেও অনেক ক্ষেত্রে তা পালিত হয়নি। এ নির্দেশ পালনে অবজ্ঞার জন্যও শাস্তি পেতে হয়নি কাউকে। এমনকি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও দায়িত্বশীল পদে আসীন কেউ কেউ নিয়ম ভেঙে প্রচারণা চালাচ্ছেন। একজন তো এমনও বলেছেন বলে সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয় যে ‘তিনটি সিটি করপোরেশনে অবশ্যই যেকোনো প্রকারে আমাদের জিততে হবে।’
এ সংবাদটি যথার্থ নয় বলে প্রতিবাদ হয়েছে, তবে অত্যন্ত দুর্বল ভাষায়। কিন্তু প্রতিবেদক তাঁর বক্তব্য যথার্থ বলে দাবি করেছেন। আর খবরটি একাধিক সংবাদপত্রেই এসেছে। এ ধরনের বক্তব্য একজন নয়, আরও কেউ কেউ দিয়েছেন। আর আচরণবিধি? সেটা অনেকটাই কাজির গরুর মতো। কেতাবেই তা আছে। আইনত নির্দলীয় নির্বাচন হলেও দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। অনেক প্রার্থীর বিলবোর্ড, পোস্টার, ব্যানারে শোভা পাচ্ছে প্রার্থী ব্যতীত সেই দলের নেতাদের ছবি। এমনকি জাতির জনকের ছবিও। নির্বাচন কমিশন দেখেও না দেখার অবস্থানে আছে। রিটার্নিং কর্মকর্তারাও আছেন এ বিষয়ে অনেকটা গা-ছাড়া অবস্থায়। কমিশন বা তাদের প্রতিনিধিদের এরূপ নির্লিপ্ততার সুযোগ নেবে সবল পক্ষ। সবলতা হতে পারে সরকারি ক্ষমতা, অর্থ কিংবা ক্যাডারদের তাণ্ডব। আর এসব নির্বাচনের ফলাফলকে করবে প্রভাবিত। এমনকি নির্বাচনব্যবস্থাটির প্রতি জনগণের সাম্প্রতিক কালের ক্রমহ্রাসমান আস্থার মনোভাবকে আরও জোরদার করতে পারে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রায় ১৩ বছর পর ঢাকায় সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলমান আন্দোলন ও নৈরাজ্যের মুখে এ ঘোষণাটি সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্তে অনেকটা আলোকরশ্মির মতো বলে দাবি করা চলে। কেননা, সরকারি দলের পাশাপাশি আন্দোলনকারী প্রধান দলটি এই নির্বাচনগুলোতে অংশ নিতে সক্রিয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে তাদের সত্যিকার অর্থে নির্বাচনমুখী করতে পারলে সব পক্ষেরই লাভ। বিশেষ করে দেশবাসীর। এই তিনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, রাষ্ট্রক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। তাই যেকোনো মূল্যে এগুলোতে বিজয়ী হতে সরকারদলীয় কারও কারও প্রত্যয় আত্মঘাতী হতে পারে। বরং দৃশ্যমান নিরপেক্ষতা ও বিরোধী দলের প্রচার-প্রচারণা চালাতে উপযুক্ত সুযোগ দিলে সরকারের মর্যাদা বাড়বে। গণতন্ত্রের ভিত হবে শক্তিশালী। অবশ্য আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আচরণবিধি ভঙ্গ না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁর এ বক্তব্য প্রশংসনীয়। আমরা আশা করব, সবাই এটা মেনে চলবেন।
কিন্তু বারবার পোড় খাওয়া এ দেশের জনগণ ভালো কিছু হবে, এমনটি বিশ্বাস করতে শঙ্কিত। বিরোধী দলের গত তিন মাসে লাগাতার হরতাল-অবরোধ, এরই আড়ালে নাশকতা আর নাশকতা দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, বিরোধী দলকে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনে বাধা, সরকারি দলের রণহুংকার আর এই সুযোগে উগ্র মৌলবাদীদের উত্থানের প্রচেষ্টা—এ সবকিছুই জনগণকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। তবু তারা বারবার আশায় বুক বাঁধে। তেমনি ক্ষীণ আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছে এই নির্বাচন তিনটির সফল পরিণতি দেখার।
যেকোনো প্রকারে নির্বাচনে জয়লাভের যে বাসনা, তা নতুন বা অভিনব নয়। আমরা তা দেখেছি বারবার। স্থানীয় ও জাতীয় উভয় নির্বাচনে। সম্ভবত এটা অনেকটা পাকিস্তান আমলের উত্তরাধিকার। ১৯৫৮ সালে তখনকার পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর ‘গণভোট’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। প্রেসিডেন্ট পদ দখলকারী ব্যক্তির প্রতি আস্থার বিপরীতে একটি কালো বাক্স ছিল। সেই কালো বাক্স গণভোটে জিততে পারে না। তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কখনো কোথাও জেতেনি। ১৯৬৫ সালে সেই প্রেসিডেন্ট একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে আরেক মেয়াদের জন্য তাঁর শাসনক্ষমতা ‘নিশ্চিত’ করেন। এ ধরনের গণভোট আর নির্বাচনই ছিল যেকোনো প্রকারে জয়লাভের প্রচেষ্টা। এর সঙ্গে জনগণের তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, বরং বৈরী ছিল তারা। তবে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। সে ধরনের শাসনব্যবস্থায় নানাবিধ বৈষম্যে ক্ষুব্ধ বাঙালি তাদের জাতীয়তার সংজ্ঞা নতুনভাবে খুঁজে নিল। যাত্রা করল নতুন পথ ধরে। সেই পথেই প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ। ভেঙে যায় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি। আজও অবশিষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধান সংকট শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা।
আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলাম। স্বাধীনতার প্রধান চেতনা ছিল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ শাসিত হবে। বলাবাহুল্য, সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসবেন জনগণের সমর্থনকে ভিত্তি করে; যেকোনো মূল্যে নয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, আবার আমরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার দুই-দুটি গণভোট দেখলাম। ১৯৮৮-র ভোটারবিহীন নির্বাচনও দেখলাম। তবে গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নির্বাচিত দুটি সরকারের অধীনে ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি আর ২০১৪-এর জানুয়ারির নির্বাচনও দেখেছি। শেষোক্তটিতে তো অধিকাংশ প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আবার এ ধরনের নির্বাচনে আরেকটি ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল ২০০৭-এর জানুয়ারিতে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকার মাসাধিককালের মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০১৪-এর নির্বাচন নিয়ে সংকট এখনো কাটেনি।
আলোচনা করা যেতে পারে, যেকোনো মূল্য বলতে প্রকৃত অর্থে কী বোঝায়। নির্বাচন একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রক্রিয়া। দলগত বা ব্যক্তিগত যেভাবেই হোক, নির্বাচনে জিততে জনসমর্থন লাভ করতে হবে। তা করতে নির্বাচনী বিধিমালার আওতায় ব্যাপক জনসংযোগ একটি নির্দোষ ও অপরিহার্য প্রক্রিয়া। তবে এটা করতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে কালোটাকার লেনদেন হয়। আর তা করে ক্ষমতায় থাক বা না থাক যেকোনো পক্ষ। প্রার্থী ও দলের অতীত কার্যক্রম এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় সহযোগিতা বা অগ্রহণযোগ্য নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আয়ত্তে নিয়ে বা অগ্রাহ্য করে ভোটকেন্দ্র দখল। ভোটার না গেলেও সিল মেরে ভোটের ফলাফল প্রভাবান্বিত করা। মূল প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচন থেকে সরে গেলে সাধারণত ভোটাররা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। ভোটকেন্দ্রে যান না। এ ক্ষেত্রে সংঘাত ছাড়াই ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর তা না হলে সংঘাতে গিয়ে। তবে এ ধরনের জয়ের মূল্য কিন্তু খুব চড়া। ভোটারবিহীন আর কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের সঙ্গে জনগণের তেমন সম্পর্ক থাকে না।
সূচনাতেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের উদ্যোগ উৎসাহজনক। স্থানীয় সরকার নির্বাচন বলে এবং কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের প্রচেষ্টায় তৃণমূল পর্যায়ে ভোটাররা ভোট দিতে উৎসাহী হবেন। এই নির্বাচনগুলো সফল হলে জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আর এগুলো সফল করতে সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসমূহ ও প্রার্থীরা সবার সমভাবে সচেতন থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। আম্পায়ারের ভূমিকায় থাকা নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত দৃঢ়তার কোনো ছাপ রেখে অগ্রসর হতে পারেনি। আইন ও বিধি প্রয়োগে তাদের সক্রিয় উদ্যোগ অত্যাবশ্যক। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে একটি নেতিবাচক চিত্র এসেছে। কমিশনের নামে এর প্রধানই সব দায়িত্ব নিচ্ছেন। এটা অসংগত এবং সংবিধানের বিচ্যুতি। নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে কমিশনের এ অবস্থান নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
যা-ই হোক, সরকারপ্রধানের সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্যের প্রতিফলন সরকারের কাজেও থাকবে আশা করা যায়। বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা ছোটখাটো বিচ্যুতি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা সফল নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যক। সব পক্ষেরই যেকোনো প্রকারে জয়লাভের মানসিকতা বর্জন করতে হবে। কেননা, এরূপ জয়ে হেরে যাবে জনগণ।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.