সিটি নির্বাচনে বোঝা যাবে পানি কোথায় গড়ায় -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : রফিক-উল হক by মিজানুর রহমান খান
বিশিষ্ট
আইনজীবী রফিক-উল হক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও এলএলবি
ডিগ্রি নেন। ১৯৬০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন।
পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠ
আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন
করেছেন ১৯৯০ সালে।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচন কি সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে?
রফিক-উল হক : সন্ত্রাসী তৎপরতা গত কয়েক দিনে কিছুটা হলেও ঠান্ডা হয়েছে। আসলে নির্বাচন দিলেই মানুষ কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়। আমাদের দেশের মানুষ ইলেকশন-পাগল। বার কাউন্সিল বা বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচন, ইউপি বা মেয়র—যেমনই হোক, নির্বাচন পেলেই মানুষ খুশি।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন?
রফিক-উল হক : মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকার কারণে এখন নির্বাচনে কারচুপি করা খুব দুরূহ। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে আশা করি।
প্রথম আলো : আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হওয়াকে কীভাবে দেখেন?
রফিক-উল হক : তিনি বেকুবের মতো কাজ করেছেন। তিন বছর হলো প্রস্তুতি নিয়ে সমর্থক নিয়েছেন আরেক এলাকা থেকে।
প্রথম আলো : এ ছাড়া তাঁর অন্য কি সমস্যা ছিল?
রফিক-উল হক : মিন্টুর যমুনা রিসোর্টের ইজারা বাতিল করে গত বুধবার সরকার আদেশ দিয়েছে। আদেশে রোববার (আজ) ১০টার মধ্যে সেনাবাহিনীকে ওই জমির দখল নিতে বলেছিল। ওই জমির পাশেই ছিল আর্মি ক্যাম্প। চুক্তিতে থাকা সালিসির বিধান ছিল। সেটা না মেনে ওই আদেশ দেয়। আমি এর ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ পেলাম।
প্রথম আলো : ওই আদেশটা কি কাকতালীয়?
রফিক-উল হক : আমার মনে হলো, মিন্টু যখন নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা বললেন, তখনই এই আদেশটা পাস হলো। এখন ভেবে দেখুন সরকারের সততার কী অবস্থা! আমি জানি না, এর অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। আদেশটা এল শুক্র ও শনি মাঝে রেখে, রোববারে তারা দখল নেবে। আমি জানামাত্র সারা রাত খেটে পরদিনই জেলা আদালত থেকে স্থগিতাদেশটা পেলাম। প্রায় ১৬০ বিঘা জমি ৩০ বছরের ইজারা। মিন্টু ১৮ কোটি টাকা দিয়েছেনও। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার আমলে মিন্টুকে ইজারাদানের সিদ্ধান্ত হলো আর ২০০২ সালে বেগম জিয়ার আমলে তা কার্যকর হলো। যমুনা সেতুর পাশের ওই রিসোর্টে শেখ হাসিনা তিনবার ও বেগম খালেদা জিয়া একবার গিয়ে থেকেছেন।
মিন্টুর ছেলের প্রার্থিতার বিষয়ে আমি জানি না। তবে আমার ধারণা, ঢাকা উত্তরে আমার জামাতা আনিসুল হক জয়ী হবেন। দক্ষিণে হানিফের ছেলে (সাঈদ খোকন)। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। চট্টগ্রামে মনজুর জিতবেন। আবার এও বলি, আমাদের মানুষের সাধারণ মজ্জাগত প্রবণতা হলো ক্ষমতাসীন দলকে হারানো। ঢাকা বার, বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম কোর্ট বারে তা-ই দেখা গেল।
প্রথম আলো : অনেকের মতে সিটি নির্বাচন দুধারি তরবারি। বিএনপি হারলে বলবে, কারচুপির আশঙ্কাই সত্যি। আর জিতলে বলবে, সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। এই নির্বাচন কি সংকটকে শিথিল, নাকি আরও গভীরতর করতে পারে?
রফিক-উল হক : আপনার এই কথা এখানে বলে লাভ নেই। ব্রিটেনের আসন্ন নির্বাচনে রক্ষণশীলেরা ভাবছে, তারা এবার এককভাবে জয়ী হবে আর লেবার ভাবছে তারা আসবে। আমরা এসব ভাবতে পারি না।
প্রথম আলো : বিএনপি ইসিকে সেনা মোতায়েন, অফিসের তালা খুলতে এবং হাজার হাজার আসামি ছেড়ে দিতে বলেছে।
রফিক-উল হক : এটা কি বলা সম্ভব যে নির্বাচনে অংশ নিতে জেল থেকে সবাইকে বের করে দেওয়া হোক। জামিন তো ব্যক্তিগতভাবে নিতে হবে। রাজনীতিক হিসেবে বলা যায়, একজন বিবেচনাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনি বলবেন?
প্রথম আলো : সংকট উত্তরণে একটা অ্যামনেস্টি হতে পারে। সুনির্দিষ্ট মামলা না থাকা, সন্দেহভাজন হিসেবে পাইকারি আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দিয়ে সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারে।
রফিক-উল হক : হ্যাঁ, এটা সম্ভব। খুব ভালো যুক্তি। কিন্তু ৫৪ ধারায় আর কতজন বন্দী আছেন? পিন্টু তো শাস্তি পেয়েছেন, তিনি কী করে দাঁড়াবেন?
প্রথম আলো : আচ্ছা, এত বড় একটা সংকটের মধ্যে বিএনপির মিন্টুর বোকাটে ত্রুটি, পিন্টুর মতো দণ্ডিতকে দাঁড় করানোটা বিএনপির শক্তি, না দুর্বলতার নির্দেশক? জনগণের সঙ্গে মশকরা কি না?
রফিক-উল হক : আপনি নীতিকথা বলছেন, এর উচ্চ রাজনৈতিক মূল্য আছে। যে দল বলছে দেশে গণতন্ত্র চাই, তার দলে কি গণতন্ত্র আছে? আসল তন্ত্র হলো ক্ষমতা কী করে পাব। আমরা আসলে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না।
প্রথম আলো : আওয়ামী লীগ মনে হচ্ছে এই কার্ডটাই খেলছে। তারা বলে, বিএনপি এলে জঙ্গি-জামায়াতের আরও উল্লম্ফন ঘটবে। তার চেয়ে গণতন্ত্রহীনভাবে ও ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে তাদের শাসনটাই দীর্ঘ হোক।
রফিক-উল হক : আপনি দেখবেন, যে যতই বলুক, হেসে-খেলে আওয়ামী লীগই পরবর্তী পাঁচ বছর টিকে যাবে।
প্রথম আলো : তার মানে, ২০১৯ সালের আগে আপনি কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখেন না?
রফিক-উল হক : নির্বাচন (স্থানীয় সরকার) বা দু-একটা উপনির্বাচন ইত্যাদি হবে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচন নয়।
প্রথম আলো : তাহলে আপনার কথা হলো, সিটি নির্বাচনের ফলাফল যেমনই হোক না কেন, তা কোনো মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন ত্বরান্বিত করছে না?
রফিক-উল হক : আগাম নির্বাচনের কথা আওয়ামী লীগ একবার বলে ফেলেছিল। এখন মেয়র নির্বাচনে তারা যদি জিতে যায়, তাহলে তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ধার দিয়েও যাবে না। কারণ, তারা জানে, বাংলাদেশের ইতিহাস হলো যে দল ক্ষমতায় থাকে, নির্বাচন দিলে তারা হেরে যায়।
প্রথম আলো : যে সহিংসতা ও দম বন্ধ করার মধ্য দিয়ে জাতি যাচ্ছে, সেটাও কি ২০১৯ পর্যন্ত তাদের নিত্যসঙ্গী হতে পারে?
রফিক-উল হক : আচ্ছা, বলুন তো বিএনপির প্রধানের সঙ্গে কে আছেন, যিনি বা যাঁরা বিএনপির হয়ে লড়াই করছেন? মওদুদরা কোথায়? মাহবুবউদ্দিন খোকনের অর্ধেক কথা বোঝা যায় না। খন্দকার মাহবুব একজন আছেন।
প্রথম আলো : যে রাষ্ট্রে সালাহ উদ্দিনকে গুম করা যায়, সেই রাষ্ট্রে কী করে আশা করা চলে, কেউ প্রতিবাদে সরব হবেন?
রফিক-উল হক : তার মানে আপনি রাজনীতি করবেন, জেলে যেতে ভয় পাবেন। অতীতের নেতারা জেল-জুলুম...
প্রথম আলো : অনেকের মতে, এখানে বিরাট গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর প্রথাগত জেল-জুলুমে থেমে নেই, গুম-খুনে চলে গেছে। কী বলবেন? সেলফ সেন্সরশিপ বাড়ছে কি না?
রফিক-উল হক : ইলিয়াস আলী ও সালাহ উদ্দিনের ধারা চলতে থাকবে? সালাহ উদ্দিনের ব্যাপারে সরকার একটা তথ্য বিবরণী পর্যন্ত দিল না। দেশে প্রেস ফ্রিডম যেটা আছে, তা কোনো দিন ছিল না, সেলফ সেন্সরশিপ আপনাদের ব্যাপার। আমার মনে হয়, পরিস্থিতি যদি এভাবে চলে আর বিএনপি একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সরকার একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের শর্তমতে, ১৫৪ আসনে ‘প্রত্যক্ষ ভোট’ হয়নি। সংবিধান লঙ্ঘনের কারণেও একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন হওয়া উচিত। অবশ্য সবে ১৪ মাস কাটল। এখনই পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। সিটি নির্বাচনে দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। আর সংকট নিরসনে পদে পদে আমেরিকা ও ভারত মানে বিদেশিদের টেনে আনাকে আমি ঘৃণা করি।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন দরকার?
রফিক-উল হক : এটা বিএনপি বলেছে। সেনারা আসুক বা না আসুক, তাতে কোনো পার্থক্য হবে না। সেনারা না এলে আওয়ামী লীগ কারচুপি করবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না।
প্রথম আলো : বিএনপি আর কত দিন চলমান অকার্যকর ও জনভোগান্তির অবরোধ-হরতাল করে যাবে? একে নিয়ন্ত্রণে আইনের কথা মুখে বলা হয় কিন্তু প্রাণহানি ও লাখ-কোটি টাকা ক্ষতির দায় কারও ওপর বর্তানো হয় না।
রফিক-উল হক : আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে আশা করব, রাজনীতিকেরা যা-ই করুন, এ ধরনের কোনো কর্মসূচি ভবিষ্যতে আর না দেন। এর বিরুদ্ধে একটা আইন হতে পারে।
প্রথম আলো : দুর্নীতি দমন কেমন চলছে? গত ছয় বছরেও আপিল বিভাগে কারও দণ্ডের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি?
রফিক-উল হক : আমি প্রথমেই বলব, দুদকই সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ। প্রিন্স মুসা এত বড় কাণ্ড ঘটালেন। দেহরক্ষী নিয়ে তিনি দুদকে গেলেন, এরপর কোনো সাড়াশব্দ শুনেছেন? কারণ, তাঁর প্রভাবশালী আত্মীয় আছে। এত দিন পর্যন্ত দুদক চলছে, কারও এখনো শাস্তি হয়নি। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের হয়েছিল, আমি মামলা করে স্থগিতাদেশ নিয়েছিলাম, সেটা এখনো বিচারাধীন। আপনি বলুন, শাস্তি হয়েছে কারও?
প্রথম আলো : হবে কীভাবে বলুন, দুদক তো কেবল মামলা করতে পারে। আপনার মতো তারকা আইনজীবীরা যখন প্রক্রিয়াগত ত্রুটির
কথা বলে স্থগিতাদেশ নেন, তখন তো মামলা চলতে পারে না। এক-এগারোতে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি দুর্নীতি মামলা স্টে হয়েছিল, এখন তা পাঁচ ভাগে নেমেছে।
রফিক-উল হক : সেটা তো সব দেশেই ঘটে। দুদকের মামলায় অনেক ঘাপলা থাকে। দুর্নীতি উচ্ছেদে একটা বিপ্লব দরকার।
প্রথম আলো : আপনি ৫৫ বছর আইন পেশায়, স্মরণ করতে পারেন কি, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত কতগুলো দুর্নীতির মামলার চূড়ান্ত ফয়সালা দেখেছেন?
রফিক-উল হক : তা পারি না। তবে হাইকোর্টে ১০০ বিচারক হলে আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা ২০ হওয়া উচিত।
প্রথম আলো : এক-এগারোতে আপনি কত মামলায় স্টে পেয়েছিলেন? অন্তত ১০০ মামলায় দাঁড়িয়েছিলেন?
রফিক-উল হক : আমার মনে নেই। (হেসে) ও বুঝেছি, আপনি ইনকাম ট্যাক্সের লোক!
প্রথম আলো : বেগম রওশন এরশাদ কি একটি মামলায় হাজির না হতে কমিশন চেয়েছেন? খুলে বলবেন?
রফিক-উল হক : হ্যাঁ, সম্প্রতি এই সরকারের দেওয়া ব্যাংকের মধ্যে রওশন পেয়েছেন একটি। নতুন ব্যাংক পেতে সৎ পথে অর্জিত ৪০০ কোটি টাকা লাগে। রওশনের লাইসেন্স হস্তান্তর নিয়ে কোম্পানি কোর্টে মামলা হয়েছে। এখন রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হয়ে বলছেন, তিনি পর্দানশিন নারী। তাই আদালতে হাজির হতে অপারগ। তাই তিনি কমিশন চেয়েছেন। এ নিয়ে কথা বলতে লজ্জিত বোধ করি।
প্রথম আলো : তাঁর ব্যাংক প্রাপ্তি দুর্নীতি নয়?
রফিক-উল হক : দুর্নীতির বাপ। আরেক তরুণ আইনজীবী ৪০০ কোটি টাকা কোথায় পেলেন? দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বেরোতে সময় লাগবে।
প্রথম আলো : শুরুটা কীভাবে? উঁচু স্তরে তো আগে থামাতে হবে।
রফিক-উল হক : তরুণ প্রজন্ম করবে। বি. চৌধুরীর ছেলে। শেখ হাসিনার ছেলে। নাজিউর রহমানের ছেলে। এমনকি তারেক; তিনি অনেক বেশি পরিপক্ব। তাঁরা পারবেন।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
রফিক-উল হক : ধন্যবাদ।
রফিক-উল হক : সন্ত্রাসী তৎপরতা গত কয়েক দিনে কিছুটা হলেও ঠান্ডা হয়েছে। আসলে নির্বাচন দিলেই মানুষ কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়। আমাদের দেশের মানুষ ইলেকশন-পাগল। বার কাউন্সিল বা বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচন, ইউপি বা মেয়র—যেমনই হোক, নির্বাচন পেলেই মানুষ খুশি।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন?
রফিক-উল হক : মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকার কারণে এখন নির্বাচনে কারচুপি করা খুব দুরূহ। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে আশা করি।
প্রথম আলো : আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হওয়াকে কীভাবে দেখেন?
রফিক-উল হক : তিনি বেকুবের মতো কাজ করেছেন। তিন বছর হলো প্রস্তুতি নিয়ে সমর্থক নিয়েছেন আরেক এলাকা থেকে।
প্রথম আলো : এ ছাড়া তাঁর অন্য কি সমস্যা ছিল?
রফিক-উল হক : মিন্টুর যমুনা রিসোর্টের ইজারা বাতিল করে গত বুধবার সরকার আদেশ দিয়েছে। আদেশে রোববার (আজ) ১০টার মধ্যে সেনাবাহিনীকে ওই জমির দখল নিতে বলেছিল। ওই জমির পাশেই ছিল আর্মি ক্যাম্প। চুক্তিতে থাকা সালিসির বিধান ছিল। সেটা না মেনে ওই আদেশ দেয়। আমি এর ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ পেলাম।
প্রথম আলো : ওই আদেশটা কি কাকতালীয়?
রফিক-উল হক : আমার মনে হলো, মিন্টু যখন নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা বললেন, তখনই এই আদেশটা পাস হলো। এখন ভেবে দেখুন সরকারের সততার কী অবস্থা! আমি জানি না, এর অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। আদেশটা এল শুক্র ও শনি মাঝে রেখে, রোববারে তারা দখল নেবে। আমি জানামাত্র সারা রাত খেটে পরদিনই জেলা আদালত থেকে স্থগিতাদেশটা পেলাম। প্রায় ১৬০ বিঘা জমি ৩০ বছরের ইজারা। মিন্টু ১৮ কোটি টাকা দিয়েছেনও। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার আমলে মিন্টুকে ইজারাদানের সিদ্ধান্ত হলো আর ২০০২ সালে বেগম জিয়ার আমলে তা কার্যকর হলো। যমুনা সেতুর পাশের ওই রিসোর্টে শেখ হাসিনা তিনবার ও বেগম খালেদা জিয়া একবার গিয়ে থেকেছেন।
মিন্টুর ছেলের প্রার্থিতার বিষয়ে আমি জানি না। তবে আমার ধারণা, ঢাকা উত্তরে আমার জামাতা আনিসুল হক জয়ী হবেন। দক্ষিণে হানিফের ছেলে (সাঈদ খোকন)। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। চট্টগ্রামে মনজুর জিতবেন। আবার এও বলি, আমাদের মানুষের সাধারণ মজ্জাগত প্রবণতা হলো ক্ষমতাসীন দলকে হারানো। ঢাকা বার, বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম কোর্ট বারে তা-ই দেখা গেল।
প্রথম আলো : অনেকের মতে সিটি নির্বাচন দুধারি তরবারি। বিএনপি হারলে বলবে, কারচুপির আশঙ্কাই সত্যি। আর জিতলে বলবে, সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। এই নির্বাচন কি সংকটকে শিথিল, নাকি আরও গভীরতর করতে পারে?
রফিক-উল হক : আপনার এই কথা এখানে বলে লাভ নেই। ব্রিটেনের আসন্ন নির্বাচনে রক্ষণশীলেরা ভাবছে, তারা এবার এককভাবে জয়ী হবে আর লেবার ভাবছে তারা আসবে। আমরা এসব ভাবতে পারি না।
প্রথম আলো : বিএনপি ইসিকে সেনা মোতায়েন, অফিসের তালা খুলতে এবং হাজার হাজার আসামি ছেড়ে দিতে বলেছে।
রফিক-উল হক : এটা কি বলা সম্ভব যে নির্বাচনে অংশ নিতে জেল থেকে সবাইকে বের করে দেওয়া হোক। জামিন তো ব্যক্তিগতভাবে নিতে হবে। রাজনীতিক হিসেবে বলা যায়, একজন বিবেচনাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আপনি বলবেন?
প্রথম আলো : সংকট উত্তরণে একটা অ্যামনেস্টি হতে পারে। সুনির্দিষ্ট মামলা না থাকা, সন্দেহভাজন হিসেবে পাইকারি আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দিয়ে সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারে।
রফিক-উল হক : হ্যাঁ, এটা সম্ভব। খুব ভালো যুক্তি। কিন্তু ৫৪ ধারায় আর কতজন বন্দী আছেন? পিন্টু তো শাস্তি পেয়েছেন, তিনি কী করে দাঁড়াবেন?
প্রথম আলো : আচ্ছা, এত বড় একটা সংকটের মধ্যে বিএনপির মিন্টুর বোকাটে ত্রুটি, পিন্টুর মতো দণ্ডিতকে দাঁড় করানোটা বিএনপির শক্তি, না দুর্বলতার নির্দেশক? জনগণের সঙ্গে মশকরা কি না?
রফিক-উল হক : আপনি নীতিকথা বলছেন, এর উচ্চ রাজনৈতিক মূল্য আছে। যে দল বলছে দেশে গণতন্ত্র চাই, তার দলে কি গণতন্ত্র আছে? আসল তন্ত্র হলো ক্ষমতা কী করে পাব। আমরা আসলে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না।
প্রথম আলো : আওয়ামী লীগ মনে হচ্ছে এই কার্ডটাই খেলছে। তারা বলে, বিএনপি এলে জঙ্গি-জামায়াতের আরও উল্লম্ফন ঘটবে। তার চেয়ে গণতন্ত্রহীনভাবে ও ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে তাদের শাসনটাই দীর্ঘ হোক।
রফিক-উল হক : আপনি দেখবেন, যে যতই বলুক, হেসে-খেলে আওয়ামী লীগই পরবর্তী পাঁচ বছর টিকে যাবে।
প্রথম আলো : তার মানে, ২০১৯ সালের আগে আপনি কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখেন না?
রফিক-উল হক : নির্বাচন (স্থানীয় সরকার) বা দু-একটা উপনির্বাচন ইত্যাদি হবে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচন নয়।
প্রথম আলো : তাহলে আপনার কথা হলো, সিটি নির্বাচনের ফলাফল যেমনই হোক না কেন, তা কোনো মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন ত্বরান্বিত করছে না?
রফিক-উল হক : আগাম নির্বাচনের কথা আওয়ামী লীগ একবার বলে ফেলেছিল। এখন মেয়র নির্বাচনে তারা যদি জিতে যায়, তাহলে তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ধার দিয়েও যাবে না। কারণ, তারা জানে, বাংলাদেশের ইতিহাস হলো যে দল ক্ষমতায় থাকে, নির্বাচন দিলে তারা হেরে যায়।
প্রথম আলো : যে সহিংসতা ও দম বন্ধ করার মধ্য দিয়ে জাতি যাচ্ছে, সেটাও কি ২০১৯ পর্যন্ত তাদের নিত্যসঙ্গী হতে পারে?
রফিক-উল হক : আচ্ছা, বলুন তো বিএনপির প্রধানের সঙ্গে কে আছেন, যিনি বা যাঁরা বিএনপির হয়ে লড়াই করছেন? মওদুদরা কোথায়? মাহবুবউদ্দিন খোকনের অর্ধেক কথা বোঝা যায় না। খন্দকার মাহবুব একজন আছেন।
প্রথম আলো : যে রাষ্ট্রে সালাহ উদ্দিনকে গুম করা যায়, সেই রাষ্ট্রে কী করে আশা করা চলে, কেউ প্রতিবাদে সরব হবেন?
রফিক-উল হক : তার মানে আপনি রাজনীতি করবেন, জেলে যেতে ভয় পাবেন। অতীতের নেতারা জেল-জুলুম...
প্রথম আলো : অনেকের মতে, এখানে বিরাট গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর প্রথাগত জেল-জুলুমে থেমে নেই, গুম-খুনে চলে গেছে। কী বলবেন? সেলফ সেন্সরশিপ বাড়ছে কি না?
রফিক-উল হক : ইলিয়াস আলী ও সালাহ উদ্দিনের ধারা চলতে থাকবে? সালাহ উদ্দিনের ব্যাপারে সরকার একটা তথ্য বিবরণী পর্যন্ত দিল না। দেশে প্রেস ফ্রিডম যেটা আছে, তা কোনো দিন ছিল না, সেলফ সেন্সরশিপ আপনাদের ব্যাপার। আমার মনে হয়, পরিস্থিতি যদি এভাবে চলে আর বিএনপি একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সরকার একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের শর্তমতে, ১৫৪ আসনে ‘প্রত্যক্ষ ভোট’ হয়নি। সংবিধান লঙ্ঘনের কারণেও একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন হওয়া উচিত। অবশ্য সবে ১৪ মাস কাটল। এখনই পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। সিটি নির্বাচনে দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। আর সংকট নিরসনে পদে পদে আমেরিকা ও ভারত মানে বিদেশিদের টেনে আনাকে আমি ঘৃণা করি।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন দরকার?
রফিক-উল হক : এটা বিএনপি বলেছে। সেনারা আসুক বা না আসুক, তাতে কোনো পার্থক্য হবে না। সেনারা না এলে আওয়ামী লীগ কারচুপি করবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না।
প্রথম আলো : বিএনপি আর কত দিন চলমান অকার্যকর ও জনভোগান্তির অবরোধ-হরতাল করে যাবে? একে নিয়ন্ত্রণে আইনের কথা মুখে বলা হয় কিন্তু প্রাণহানি ও লাখ-কোটি টাকা ক্ষতির দায় কারও ওপর বর্তানো হয় না।
রফিক-উল হক : আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে আশা করব, রাজনীতিকেরা যা-ই করুন, এ ধরনের কোনো কর্মসূচি ভবিষ্যতে আর না দেন। এর বিরুদ্ধে একটা আইন হতে পারে।
প্রথম আলো : দুর্নীতি দমন কেমন চলছে? গত ছয় বছরেও আপিল বিভাগে কারও দণ্ডের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি?
রফিক-উল হক : আমি প্রথমেই বলব, দুদকই সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ। প্রিন্স মুসা এত বড় কাণ্ড ঘটালেন। দেহরক্ষী নিয়ে তিনি দুদকে গেলেন, এরপর কোনো সাড়াশব্দ শুনেছেন? কারণ, তাঁর প্রভাবশালী আত্মীয় আছে। এত দিন পর্যন্ত দুদক চলছে, কারও এখনো শাস্তি হয়নি। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের হয়েছিল, আমি মামলা করে স্থগিতাদেশ নিয়েছিলাম, সেটা এখনো বিচারাধীন। আপনি বলুন, শাস্তি হয়েছে কারও?
প্রথম আলো : হবে কীভাবে বলুন, দুদক তো কেবল মামলা করতে পারে। আপনার মতো তারকা আইনজীবীরা যখন প্রক্রিয়াগত ত্রুটির
কথা বলে স্থগিতাদেশ নেন, তখন তো মামলা চলতে পারে না। এক-এগারোতে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি দুর্নীতি মামলা স্টে হয়েছিল, এখন তা পাঁচ ভাগে নেমেছে।
রফিক-উল হক : সেটা তো সব দেশেই ঘটে। দুদকের মামলায় অনেক ঘাপলা থাকে। দুর্নীতি উচ্ছেদে একটা বিপ্লব দরকার।
প্রথম আলো : আপনি ৫৫ বছর আইন পেশায়, স্মরণ করতে পারেন কি, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত কতগুলো দুর্নীতির মামলার চূড়ান্ত ফয়সালা দেখেছেন?
রফিক-উল হক : তা পারি না। তবে হাইকোর্টে ১০০ বিচারক হলে আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা ২০ হওয়া উচিত।
প্রথম আলো : এক-এগারোতে আপনি কত মামলায় স্টে পেয়েছিলেন? অন্তত ১০০ মামলায় দাঁড়িয়েছিলেন?
রফিক-উল হক : আমার মনে নেই। (হেসে) ও বুঝেছি, আপনি ইনকাম ট্যাক্সের লোক!
প্রথম আলো : বেগম রওশন এরশাদ কি একটি মামলায় হাজির না হতে কমিশন চেয়েছেন? খুলে বলবেন?
রফিক-উল হক : হ্যাঁ, সম্প্রতি এই সরকারের দেওয়া ব্যাংকের মধ্যে রওশন পেয়েছেন একটি। নতুন ব্যাংক পেতে সৎ পথে অর্জিত ৪০০ কোটি টাকা লাগে। রওশনের লাইসেন্স হস্তান্তর নিয়ে কোম্পানি কোর্টে মামলা হয়েছে। এখন রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হয়ে বলছেন, তিনি পর্দানশিন নারী। তাই আদালতে হাজির হতে অপারগ। তাই তিনি কমিশন চেয়েছেন। এ নিয়ে কথা বলতে লজ্জিত বোধ করি।
প্রথম আলো : তাঁর ব্যাংক প্রাপ্তি দুর্নীতি নয়?
রফিক-উল হক : দুর্নীতির বাপ। আরেক তরুণ আইনজীবী ৪০০ কোটি টাকা কোথায় পেলেন? দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বেরোতে সময় লাগবে।
প্রথম আলো : শুরুটা কীভাবে? উঁচু স্তরে তো আগে থামাতে হবে।
রফিক-উল হক : তরুণ প্রজন্ম করবে। বি. চৌধুরীর ছেলে। শেখ হাসিনার ছেলে। নাজিউর রহমানের ছেলে। এমনকি তারেক; তিনি অনেক বেশি পরিপক্ব। তাঁরা পারবেন।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
রফিক-উল হক : ধন্যবাদ।
No comments