অসহিষ্ণুতা আর নৃশংসতার বিরুদ্ধে মানুষ by আনু মুহাম্মদ

সমাজে ধর্মান্ধ, মতান্ধ, দলান্ধ, ক্ষমতান্ধ আর অর্থান্ধদের দাপট বাড়ছেই। এর ফলে বাংলাদেশ এখন অসহিষ্ণুতা আর নৃশংসতার উর্বর ভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অন্ধত্বের সহযোগী সীমাহীন লোভ আর সংবেদনহীনতা। এর শিকার হয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন নামে, অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছে মানুষ, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সমাজ আর অসংখ্য পরিবার। বলপ্রয়োগের বিস্তারে চিন্তা, মত, রাজনৈতিক তৎপরতার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। রাজনীতিকে বানানো হয়েছে অসহিষ্ণু সহিংস তৎপরতায়। একের পর এক আঘাতে ক্লান্ত সমাজ, ক্ষোভ, ঘৃণা, প্রতিবাদ জানানোর পথ ও ভাষা খুঁজে পাওয়াও যেন কঠিন কিংবা অর্থহীন। যে কেউ যেকোনো স্থানে দগ্ধ হতে পারেন, খুন হতে পারেন, যেকোনো স্থান থেকে গুম হতে পারেন। অদৃশ্য কিংবা মুখোশধারী ঘাতকদের বিচরণে ‘আইনের শাসন’ ‘গণতন্ত্র’ পরিহাসের বিষয়।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক, গবেষক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড এই নিষ্ঠুর ও নৃশংস সময়ের বহিঃপ্রকাশ। আগের অনেক ঘটনায় আমরা দেখেছি, এ রকম খুনের পর সমাজে প্রতিক্রিয়া হলে কয়েক দিন চোটপাট হয়, উল্টোপাল্টা গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসল খুনিদের পাওয়া যায় না। অভিজিতের ক্ষেত্রে সেটাও হয়নি। মুখস্থ কথাবার্তাও কম। এর এক মাসের মাথায় ওয়াশিকুর খুন হলো, ‘হিজড়া’ নামে পরিচিত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মানুষেরা এই খুনিদের না ধরলে আদৌ কেউ ধরা পড়ত কি না সন্দেহ। এসব খুনের পেছনে ধর্মের নাম ব্যবহার হয়, কিন্তু কোনো ধার্মিক মানুষ বিচার ও শাস্তি নির্ধারণের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন? তদন্তের রহস্যজনক গতিবিধির কারণে খুনি আর এর মূল পৃষ্ঠপোষকদের জাল আড়ালেই থেকে যায়। সমাজে স্বচ্ছভাবে এসব বিষয়ে আলোচনাও অগ্রসর করা যায় না।
অভিজিৎ হত্যার সময় পুলিশের ‘দায়িত্বে কোনো অবহেলা ছিল না’ বলে এক মাসের ‘তদন্ত’ শেষে পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে! আসলে পুলিশ ও র্যা বের কথা এখন কে বিশ্বাস করে? বছরের পর বছর বিনা বিচারে খুন, সম্প্রতি একের পর এক গুম নিয়ে মিথ্যা ভাষণ থেকে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাদের কথা বিশ্বাস করা যায় না। সালাহ উদ্দিন গুম হয়েছেন পুলিশ-র্যা বের হাতে, এই বিষয়টি তাঁর পরিবার নিশ্চিত করে বলছে। পুলিশ-র্যা ব অস্বীকার করে যাচ্ছে যথারীতি, কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার কোনো তৎপরতাও তাদের নেই। বিএনপি নেতা বলে সালাহ উদ্দিন নিয়ে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, কিন্তু না জানা গুমও যে অনেক, তা পত্রিকার খবর খেয়াল করলে বোঝা যায়। অনেকগুলোই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
এ ছাড়া সন্ত্রাস, পেট্রলবোমা, ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে তৎপরতা দেখা যায় তাতেও মনে হয়, আসল অপরাধীদের শনাক্ত করতে এবং তাদের ধরতে কোনো সমস্যা আছে। পুলিশ ও র্যা বের দক্ষতা নিয়ে আমার প্রশ্ন খুবই কম, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন হাজার। কোথাও দুর্নীতি, কোথাও ‘ওপরের নির্দেশ’–এ আটকা পড়ে আছে জনগণের টাকায় প্রতিপালিত নানা বাহিনী। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, অভিজিৎ, ত্বকীও সাগর-রুনির মডেলে প্রবেশ করছে। প্রথমে সিদ্ধান্ত ‘খুনি ধরা যাবে না’, তারপর তদন্তের খেলা, এটাই হচ্ছে এই মডেল।
ত্বকী হত্যার দুই বছর হয়ে গেল। তদন্ত হয়েছে, অপরাধী শনাক্তও হয়েছে, কিন্তু তার পরও আটকে আছে বিচারকাজ। কারণ, অভিযুক্ত পরিবারের হাত অনেক লম্বা। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পার হয়ে গেছে, তার হত্যাকারীদের বিচার তো দূরের কথা, তদন্তের ঘোরপ্যাঁচই কাটছে না। ঢাকার মিরপুরের কালশীতে বাইরে থেকে ঘরের তালা আটকে গানপাউডার ঢেলে শিশু-নারীসহ নয়জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কোনো তদন্তের খবরই পাওয়া যায় না, বিচার তো দূরের কথা। অথচ এখানেও অভিযুক্ত চেনাজানা। এর বাইরে চলছে পেট্রলবোমা আর ক্রসফায়ারের হত্যাকাণ্ড। সে জন্য এ ক্ষেত্রে কথাটি এখন অতিশয়োক্তি নয় যে বাংলাদেশ এখন সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, অসহিষ্ণুতা আর বিচারহীনতার দেশ। অনেকে এর জন্য পুলিশি অদক্ষতাকে দায়ী করেন। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ‘ওপরের নির্দেশ’, ক্ষমতাবানদের প্রভাব বা সিদ্ধান্তের কোনো বাধা না থাকলে অপরাধী শনাক্ত করা, খুঁজে বের করা যে তাদের পক্ষে খুবই সম্ভব, তার বহু প্রমাণ আছে। সমস্যা দক্ষতার নয়, সমস্যা সিদ্ধান্তের।
পুলিশ-র্যা বের সক্রিয়তা বরং এখন অনেক বেশি বিচারবহির্ভূত খুন আর বিনা বিচারে আটক রাখায়। গ্রেপ্তার এখন যেমন একদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত, তেমনি এটি বাণিজ্যেরও উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। অর্থ উপার্জনের উন্মাদনা সর্বত্র, ‘উন্নয়ন’ আর ভোগের জোয়ার। এই উন্মাদনায় সরকারের প্রায় প্রতিটি বিভাগ তার সুবিধা বা এখতিয়ার অনুযায়ী বাণিজ্য করছে। নিয়োগ-বাণিজ্য হয়ে কেউ যখন নিয়োগ পায়, তখন তাকে অন্য বাণিজ্য করে পোষাতে হয়। সেটা পুলিশ, আনসার বা শিক্ষক—যে-ই হোক না কেন! গ্রেপ্তার-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র-বাণিজ্য, কোচিং-টিউশনি-বাণিজ্য, চিকিৎসা-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য—সবকিছুই তাই এখন ‘স্বাভাবিক’ অর্থ উপার্জনের মাধ্যম।
সম্প্রতি হাইকোর্ট হরতাল-অবরোধের নামে নাশকতা–সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীদের কাছ থেকে হতাহত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করার বিষয়েও রুল দিয়েছেন। আমরা এর পাশাপাশি এটাও আশা করতে পারি যে মাননীয় আদালত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনা বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, গুম ও পাইকারি গ্রেপ্তারের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে হয়রানি এবং গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন।
এ দেশে কিছু লোকের লোভের বলি হয়ে মানুষের অকালমৃত্যু আসলে খুবই সহজ! কিছুদিন আগে মংলায় ভবন ধসে মারা গেলেন শ্রমিকেরা। সারা দেশেই নির্মাণ খাতের জোর দাপট এখন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় অংশ যে ওখান থেকেই আসছে, তার হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসে) আছে। কিন্তু খরচ কমানোর জন্য দায়িত্বহীন, নিরাপত্তাহীন নির্মাণকাজে কত শ্রমিকের জীবন গেছে, আর কতজন পঙ্গু—সে হিসাব বিবিএস রাখে না। তার আগে লঞ্চ ডুবে মারা গেলেন অনেকে, ৭০ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ দুই দিনের মধ্যেই শনাক্ত হয়েছে। ‘আল্লাহই এভাবে মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন’ স্বজনেরা বরাবর হয়তো এই বিশ্বাসের মধ্যেই সান্ত্বনা খোঁজেন। কিন্তু তাতে কি স্বজনদের কষ্ট লাঘব হয়? তাতে কি অপরাধীদের দায়মোচন হয়? ত্রুটিপূর্ণ আনফিট সব লঞ্চ নদীতে, বাস সড়কে। বছর বছর এসব মরণ বাহনের সার্টিফিকেট আর অনুমতির বিনিময়ে কর্তাব্যক্তিদের গাড়ি-বাড়ি নিশ্চিত হয়, ব্যাংক-ব্যালান্স মোটা
হয়। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের, তাদের মেদ বাড়ে বহুজনের জীবন হরণের ব্যবস্থা করে। একটু খোঁজ করলে ঢাকার বহু দামি গাড়ি আর অট্টালিকায়, বিভিন্ন সময়ের মন্ত্রী-কর্তাব্যক্তির শরীরে তাই ভবনধস, লঞ্চডুবি আর বাস ‘দুর্ঘটনায়’ মৃত মানুষের গন্ধ পাওয়া যাবে। নিহত, নির্যাতিত, নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে।
বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলছে ১৪ বছর ধরে। এটা বস্তুত সন্ত্রাস দমনের যুদ্ধ নয়, এটি হলো সন্ত্রাস দমনের নামে লুণ্ঠন, দখল, আধিপত্য তৈরির একটি বৈশ্বিক কূটকৌশল। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বহু দেশই এই কূটকৌশলের জালে আটকা পড়েছে। ২০০১ থেকে এই স্লোগানের অধীনে অনেক জনপদ ধ্বংস হয়েছে, প্রায় ১৫ লাখ মানুষ খুন হয়েছে, তার কয়েক গুণ বেশি মানুষ বিপর্যস্ত। এর ফলে আরও সন্ত্রাস বেড়েছে। আল-কায়েদা ধ্বংস করার কথা বলে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াকে এখন চিরস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ফলাফল: আল-কায়েদা থাকল, যোগ হলো আইএস, বোকো হারামসহ অনেক গ্রুপ। একদিকে মুসলিমবিদ্বেষ, অন্যদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে সন্ত্রাসী হামলা, দখল, লুণ্ঠন, গণহত্যা ও ধ্বংসের কারণে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অসহিষ্ণু দিকহারা গোষ্ঠীর। এই মুখোশ নীতি পুরো বিশ্বকে অস্থির, নিরাপত্তাহীন, সহিংস করে তুলছে।
জাতিগত, লিঙ্গীয় বা ধর্মীয় পরিচয়, বর্ণ, মত, ভাষা বা অঞ্চল ইত্যাদি কখনো কোনো মানুষের অপরাধ হতে পারে না। অথচ এসব বিষয় নিয়ে অসহিষ্ণুতা, ‘ব্যাটাগিরি’ সমাজে, এমনকি নতুন প্রযুক্তির মঞ্চ ফেসবুকেও আলোচনা ও বিতর্কের পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত করে তুলছে। কুৎসা, হিংসা, দ্বেষ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, মিথ্যাচার ঢেকে দিচ্ছে মতের সঙ্গে মতের বিতর্কের পরিসর। প্রত্যেক মানুষের ধর্মে বিশ্বাস, ধর্মের নির্দিষ্ট তরিকা অনুসরণ কিংবা অবিশ্বাস, নির্দিষ্ট বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার অধিকার আছে। প্রত্যেক মানুষের এই বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানাতে হবে। এই সম্মান রেখেই যেকোনো ধর্মমত পর্যালোচনার অধিকার সমাজে রক্ষা করতে হবে। কুৎসার সঙ্গে পর্যালোচনার তফাত বোঝার সক্ষমতাও সমাজে তৈরি হবে এই পরিসর তৈরি হলে। কথা বলা ও লেখার কারণে যদি আক্রমণ আসে, তখন নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন আরও বেশি কথা বলা ও লেখা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলে যদি নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, তাহলে নিরাপত্তার জন্য দরকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরও বেশি মানুষ জড়ো করা।
সমাজের ভেতর চিন্তা ও প্রতিরোধের শক্তি ছাড়া ভরসা করার আর কী আছে আমাদের?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu

No comments

Powered by Blogger.